দেবীগর্জন: শিল্পীর মুখে মাস্ক, তবু গড়ে উঠছে দুর্গাপ্রতিমা। বাঁ দিকে চায়না পাল এবং ডান দিকে কাঞ্চী পাল দত্তর স্টুডিয়োয়
অবশেষে মেরিন ব্লু আকাশ আর ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। পুজো পুজো গন্ধ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই গন্ধ আর কাটাকুটি খেলতে থাকা আকাশকে সঙ্গে নিয়ে গন্তব্য কুমোরটুলি। পুরনো কলকাতায় বেড়ে ওঠা মানুষদের পিছুটান গলিঘুঁজি, ভাঙা ইটের দেওয়াল, মরচে ধরার গন্ধ। মনে আছে, ছোটবেলায় গলির ভেতর গলি খুঁজে বেড়ানো ছিল নেশার মতো। কত অজানা কিস্সা। অনামা অখ্যাত গলির জালে জড়িয়ে পড়া আমার শহর।
লকডাউন আর কোভিডের মনখারাপের গল্পগুলোকে নিয়েই ঢুকে পড়া গেল।
কেমন আছেন এ গলির মানুষরা? কেমন আছেন দুগ্গাঠাকুর? কোভিডের সঙ্গে সঙ্গে কি এ বার তাঁরও রমরমা কমে যাচ্ছে?
শরৎকালের মাঝসকালে ঝিমিয়ে পড়া এ গলির কোথাও খড়ের গাদা জড়ো হয়ে আছে, কোথাও কাঠামোটুকুই তৈরি হয়েছে বা কোথাও হয়তো একটু একটু তুলির আঁচড়। কারও মন নেই কিছু জানতে চাইলে জবাব দেওয়ার। যে যার মতো ধীরে সুস্থে না-কাজের ব্যস্ততায় ব্যস্ত। আপনি যদি ভুলেও এর মধ্যে কোনও পুরুষ মৃৎশিল্পীর কাছে জানতে চান যে মহিলারা কোথায় ঠাকুর গড়েন, ভুরু কুঁচকে বেশ বিরক্তির সঙ্গে আপনাকে জানানো হবে যে এ দিকে নয়। এখানে কোনও “মহিলা-ফহিলা ঠাকুর করেন না। সামনে এগিয়ে যান, ওখানে পেলেও পেতে পারেন।” প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই একটা খটকা। কাজেরও আবার ছেলেমেয়ে হয় না কি? নিশ্চয়ই হয়, না হলে এমন উত্তর আসবে কেন!
কথাবার্তার মারপ্যাঁচ এড়িয়ে পৌঁছলাম গলির শেষে। সেখান থেকে ডান দিকে এগোতেই চায়না পালের স্টুডিয়ো। বেশ কিছু লোকজন কাজ করছেন। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। ঢুকেই মাটির সোঁদা গন্ধ। চায়নাদি-র সঙ্গে কথা বলব শুনে এক জন তাঁকে ডেকে নিয়ে এলেন। আটপৌরে শাড়ি পরা চায়না পাল গত পঁচিশ বছর ধরে কুমোরটুলির বুকে দাপিয়ে ব্যবসা করছেন। বাবা হেমন্তকুমার পাল। আদি বাড়ি কৃষ্ণনগর। সেখান থেকে এসে এখানে ঠাকুর গড়তেন। তার পর ১৯৯৪ সালে পুজোর ঠিক আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা কোনও দিন চাননি চায়না এই পেশায় আসুন, যেহেতু পেশায় পুরুষের আধিপত্যই বেশি। তাঁর মেয়ে কী করে টিকে থাকবেন এই কাজে! কিন্তু বাবা যখন অসুস্থ হলেন, সেই সময়ে প্রচুর ঠাকুরের বায়না এসেছিল, অগত্যা চায়নাই হাল ধরলেন এই ব্যবসার। বাবা সেই বছরই মারা যান, তাই স্থায়ী ভাবে তিনি জড়িয়ে পড়লেন এই পেশায়। স্টুডিয়োর পাশেই থাকেন মাকে নিয়ে। ব্যবসার ব্যস্ততা সামলে আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। বাবার কাছে যতটুকু কাজ শিখেছিলেন, তার পর পুরোটাই নিজের শিক্ষা। তাঁর মত, তিনি প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখছেন।
ঠাকুর গড়ার সাবেকি পদ্ধতিতেই চায়না বিশ্বাস করেন, ফলে মূলত একচালার ঠাকুর তৈরি করেন। বললেন, “যদি থিম ঠাকুরকে পুজো করা যেত, তা হলে আমার আপত্তি থাকত না। কিন্তু থিমের সামনে যে হেতু একটা সাবেকি ঠাকুর বসিয়েই পুজো করতে হয়, তা হলে আর থিমের কী প্রয়োজন!”
এ-কথা সে-কথা পেরিয়ে জানতে চাইলাম বর্তমানে এই কোভিড পরিস্থিতিতে কী অবস্থা। যা জানা গেল, মন খারাপ হয়ে গেল শুনে। পরিস্থিতি তো ভাল নয়ই। তিন ভাগের এক ভাগ বায়না হয়েছে। অনেক কর্মচারীকে বসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ, শুধু ঠাকুরের দাম কমেছে। চৈত্র মাসের অন্নপূর্ণা পুজো থেকে শুরু হয়েছে। জীবন, সংসার সব কিছু এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে এই ভাইরাস। শুধু ভাইরাস নয়, ওই আমপানও সত্যি সত্যি ঝড় তুলে দিয়েছে জীবনে। মাটি যা আনা হয়েছিল সব ধুয়ে গেছে। স্টুডিয়োর ওপরে প্লাস্টিক ছিঁড়ে ফর্দাফাই। “ঝড় যখন উঠল, তখন তো সবাই বাড়ির ভেতরে। বুঝিনি বাইরে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। পরের দিন সকালে উঠে দেখলাম চারপাশ স্টুডিয়ো সব বিধ্বস্ত। লকডাউনে তো সব কাজ বন্ধই ছিল, আর ঝড় যেন গোদের ওপর বিষফোড়া। সেই সব নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছি। যারা প্রতি বার আমার কাছ থেকেই ঠাকুর করান, তাঁদের কেউ কেউ বায়না করে গেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই আসেননি,” বলছিলেন চায়না।
জানা গেল, নতুন কেউ কেউ আসছেন। সবাই ছোট ঠাকুর চাইছেন। আসলে পরিস্থতি এতটাই অনিশ্চিত যে, ভরসা করে কেউ ঠাকুর অর্ডার দিচ্ছেন না। চায়না জানান, “প্রথমে তো আমরা শুনেছিলাম পুজোই হবে না, তখন মাথায় হাত! এতগুলো কর্মচারী সবাইকে নিয়ে পথে বসতে হবে।” চায়না আরও বলছিলেন, “বিশ্বকর্মা পুজোর আগে অন্য বার এই সময় কুমোরটুলি পাড়ার ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো থাকে। সারাদিন হইচই। কত মানুষের আনাগোনা, কত খাবারের দোকান খুলে যায়। সারা রাত কাজ চলে, চায়ের দোকান সরগরম। এ বার কিছুই নেই। তার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে নিরাশ না করতে। দু’তরফ থেকেই খানিকটা রফা করে যাঁরা ঠাকুর কিনতে আসছেন, তাঁদের হতাশ করছি না।”
এই পাড়ায় প্রায় আড়াইশো মৃৎশিল্পী কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে আট-দশ জন মহিলা, কিন্তু ব্যবসা চালাচ্ছেন পুরুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপেক্ষা করেই।
চায়নার স্টুডিয়ো ছাড়ালেই পাশের গলির পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আর-একটা সরু গলিতে ঢুকে দেখা হল মায়া পাল আর অণিমা পালের সঙ্গে। সম্পর্কে ওঁরা দু’জন জা। দু’জনেই এক সঙ্গে ঠাকুর গড়েন। দুপুরের খাবার তৈরির ব্যস্ততার ফাঁকেই কথা হচ্ছিল। আফসোস করছিলেন, এই ভাইরাসের হাত থেকে যে কবে নিস্তার পাবেন! তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মচারীদের জন্যও নিজেরাই রান্না করছেন।
দুই জা-ই ব্যবসায় এসেছেন স্বামীদের মৃত্যুর পর। পারিবারিক ব্যবসা। আদি নিবাস শান্তিপুর। প্রথমে শ্বশুর, তার পর স্বামীরা আর এখন এঁরা। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এই পেশায় আসেননি। ওঁরা কাজ শিখেছেন শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি আর স্বামীর কাছ থেকে। গত প্রজন্মে এই সব কারিগর-বাড়ির মেয়েরা হয়তো স্টুডিয়ো খুলে বসতেন না, কিন্তু পারিবারিক সূত্রেই ঠাকুর গড়ার কাজ জানতেন।
মায়া ও অণিমা পালের অবস্থা শুনলাম, চায়না পালদের চেয়েও খারাপ। মোটে দুটো ঠাকুরের বায়না পেয়েছেন এখনও অবধি। পুরনো খদ্দেররা আসবেন কি না অনিশ্চিত। জানাচ্ছিলেন, “ঠাকুর বানাতে যা যা লাগে, যেমন পেরেক, খড়, দড়ি, মাটি সব কিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এমনকি মাটি যে ছানে তার মজুরিও বাড়ছে, কিন্তু ঠাকুরের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ খদ্দের নেই।”
অনিশ্চয়তার পারদ বেড়েই চলেছে। মায়ারা আরও বললেন, “শুধু তো ঠাকুর বিক্রি নয়, ঠাকুরের সাজের যে দোকান, সেখানেও চাহিদা কমছে।”
মনখারাপ বাড়ছে ক্রমশ। গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে আর-একটু বাঁ হাতে এগোলাম। দেখলাম বসে আছেন কাঞ্চী পাল দত্ত। আলো-অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়লাম তাঁর স্টুডিয়োতে। অনেক বড় বড় কাঠামো তৈরি হয়েছে। জানতে চাইলাম, কাজ কী রকম চলছে। খুবই প্রত্যাশিত উত্তর, এক কথায় ভাল নয়। তাও দামের সঙ্গে আপস করে কাজ করে চলেছেন। উনি যে শুধু একচালার ঠাকুর গড়েন, তা নয়। থিমের ঠাকুরও তৈরি করেন। জানালেন, সময়ের সঙ্গে চিন্তাধারার পরিবর্তন না করলে ব্যবসা বাড়াতে পারতেন না।
কাঞ্চীরা দুই বোন মিলে ব্যবসা চালান। কাঞ্চীর স্বামী কুয়েতে চাকরি করতেন। লকডাউনে তিনিও বাড়িতেই বসে। জানতে চাইছিলাম লকডাউন পর্ব তাঁদের চলল কেমন করে। শুনলাম, ওখানকার ক্লাব এবং স্থানীয় বিধায়ক পুরো পাড়ার জন্যই চাল, ডাল, তেল, নুন, সয়াবিন ইত্যাদি বেশ কয়েকবার দিয়েছিলেন। তা ছাড়া নিজেদের জমা পুঁজিও ব্যবহার করছেন।
এখন পুরনো খদ্দেররা ফিরে আসছেন। তবে সবাই ছোট ঠাকুর চাইছেন। তাই বড় ঠাকুর বানানোর ঝুঁকি শিল্পীরা নিচ্ছেন না একেবারেই। জানতে চাইলাম, ভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না! ওঁরা জানালেন, প্রত্যেক দিন স্টুডিয়ো পরিষ্কার করছেন। কর্পোরেশন থেকে এসে রোজই প্রায় মেশিন দিয়ে স্যানিটাইজ় করে দেয়। নিজেরাও স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক সব ব্যবহার করেছেন। কত দিন আর ভাইরাসকে ভয় পাবেন! এই তো সিজ়ন শুরু হল, চলবে সরস্বতী পুজো অবধি।
কাঞ্চীদেরও পারিবারিক ব্যবসা। বাবা কিন্তু মেয়েদের এই ব্যবসায় আসার সিদ্ধান্তে আপত্তি করেননি।
ঠাকুর গড়ার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। পরবর্তী কালে বাবার কাছেও শিখেছেন।
জানতে চেয়েছিলাম, মহিলা বলে কখনও কি কোনও অসুবিধে হয়েছে ব্যবসা চালাতে? স্পষ্ট উত্তর, “এত দিন ছিল না। কিন্তু কিছু বছর ধরে লক্ষ করছি যে, কেউ কেউ রটাচ্ছে মহিলারা আবার ঠাকুর বানাতে পারে না কি! এটা কি তাদের কাজ! যত জন মহিলা এখানে আছি, কাজ দিয়েই প্রমাণ করে দিচ্ছি যে আমরা পিছিয়ে নেই। খদ্দেররা আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের কাছেই ফিরে আসেন। এ বারেও এসেছেন। অনেকেই এই দুর্দিনের বাজারে মহিলা শিল্পীদের নামে বদনাম রটিয়ে কাজ হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি, হবেও না। আমরা মা দুর্গার মূর্তি গড়ি। তাঁর থেকেই ক্ষমতা পাই লড়াই করার।”
এ তর্ক তো বহু দিনের! কাজের ছেলে-মেয়ে বিচার করার সামাজিক মোড়লগিরি। তাই এত বাধা উপেক্ষা করেও চায়না, অণিমা, মায়া, কাঞ্চীরা নিজেদের ব্যবসা চালাচ্ছেন, মূর্তি গড়ছেন, পুরুষ কর্মচারীদের রান্না করে খাওয়াচ্ছেন... ওদের সংসার চলেছে এই মহিলাদের ব্যবসার টাকাতেই।
ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, শরতের ঝকঝকে আকাশের মতোই যেন এঁদের সবার মুখে দ্রুত হাসি ফুটে ওঠে। মাতৃমূর্তির রঙিন রূপে যেন আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই শিল্পীদের জীবন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy