মায়া ডেরেন। নিজেরই পরিচালিত ছবিতে
ছবি দেখতে দেখতে বড় হওয়ার অবকাশেই এক দিন দেখে ফেললাম মায়া ডেরেন পরিচালিত চোদ্দো মিনিটের চলচ্চিত্র, ‘মেশেস অব দি আফটারনুন’। ‘দ্বিপ্রহরের গোলকধাঁধাঁ’। দুপুরের পাহাড়ি রাস্তায় এক নারী— মায়া নিজেই, এক রহস্যময় ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করতে করতে পথের পাশে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসেন নিজের বাড়ি। দোতলায়, জানালার পাশে আরামকেদারায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার পর স্বপ্ন আর বাস্তব এক হয়ে যায়, দেওয়াল-জোড়া কাচের জানালায় চোখ রেখে মায়া বারবার সেই রহস্যমূর্তিকে, অনুসরণরত নিজেকেই দেখতেই থাকেন। ছায়ামূর্তিটি মায়া নিজেই নাকি অন্য কেউ, ভাবতে ভাবতেই একটি পুরুষকে দেখি মায়ার বাড়িতে উঠে আসতে। অনুমানে বুঝি, পুরুষটিকেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন মায়া। কিন্তু শেষ দৃশ্যে দেখি, পুরুষটি বাড়িতে ঢুকে দেখছে, চেয়ারে এলিয়ে রক্তাক্ত, মৃত মায়া। সিনেমা শেষ হয়, কিন্তু মাথার ভিতরে দুপুরের ঘটমান গোলকধাঁধাঁ থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। ভাবনা, চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনা, সব মিলিয়ে এমন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার উৎস যে ১৯৪৩ সালের একটি চলচ্চিত্র, বিশ্বাস করা শক্ত হয়।
আমেরিকার ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রের মুখ মায়া ডেরেন। ১৯১৭-র ২৯ এপ্রিল ইউক্রেনের কিয়েভ শহরে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম তাঁর। প্রিয় ইতালীয় অভিনেত্রীর নামে তাঁর মা নাম রেখেছিলেন ইলিয়েনোরা, পারিবারিক উপাধি যোগে মেয়ের নাম হল ইলিয়েনোরা ডেরেনকোওস্কা। ১৯৩৩-এ জেনিভাতে স্কুলের পাট চুকিয়ে আমেরিকার সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নিতে শুরু করেন মায়া। কলেজেই আলাপ সমাজকর্মী গ্রেগরি বারদেক-এর সঙ্গে, আঠারো বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে বিয়ে। ১৯৩৬-এ নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, ১৯৩৯-এ ম্যাসাচুসেটস-এর স্মিথ কলেজ থেকে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পড়াশোনা শেষ করে সংবাদপত্র, রেডিয়োর জন্যে লেখালিখি শুরু করলেন, গ্রেগরির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে তত দিনে। চলছিল কবিতা লেখা, ফোটোগ্রাফি চর্চা। নানান বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তাঁকে টেনে নিয়ে গেল প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক এবং নৃত্যশিল্পী ক্যাথরিন ডানহ্যাম-এর কাছে। তাঁর নাচের দলের সঙ্গে সফরেই নির্বাসিত চেক চলচ্চিত্র পরিচালক আলেক্সান্দার হামিদের সঙ্গে প্রেম, ১৯৪২-এ বিয়ে। হামিদের প্রভাবেই তাঁর চলচ্চিত্র-জগতে পা রাখা, হামিদই তাঁর নাম রাখলেন মায়া।
নামমাত্র খরচে নিজেদের বাড়িতে ১৬ মিমি প্রকরণে তোলা, চোদ্দো মিনিটের নীরব চলচ্চিত্র ‘মেশেস অব দি আফটারনুন’ ছাড়াও, মায়ার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি হল ‘অ্যাট ল্যান্ড’, ‘আ স্টাডি ইন দ্য কোরিয়োগ্রাফি ফর ক্যামেরা’, ‘রিচুয়াল ইন ট্রান্সফিগারড টাইম’, ‘দ্য প্রাইভেট লাইফ অব আ ক্যাট’, ‘মেডিটেশনস অন ভায়োলেন্স’ ইত্যাদি। সবগুলিই ১৬ মিলিমিটারে তোলা, স্বল্পদৈর্ঘ্যের, নীরব। মায়ার সব কাজই পরীক্ষামূলক, তাতে আছে গভীর দর্শনের প্রয়োগও। তিনি হলিউডের মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির বিরোধী, এমনকি ইতালীয় নিয়োরিয়্যালিজমের প্রতিও বিরূপ। তাঁর কাজে, লেখায় বাস্তববাদের সমালোচনা স্পষ্ট। নিয়োরিয়্যালিস্টরা মনে করতেন, সমাজ-বাস্তবতাকে যথাযথ ফুটিয়ে তোলাই চলচ্চিত্রের দায়িত্ব। ইতিহাসের শিল্পসম্মত দলিল হয়ে ওঠার তাগিদে তথ্যচিত্রের ঢংকে তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়া অন লোকেশন শ্যুটিং, অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানো, সাহিত্যনির্ভরতা ইত্যাদি এই ধারার বৈশিষ্ট্য। মায়া কিন্তু মনে করতেন, সৃজনশীলতার লক্ষ্য বাস্তবের অনুকরণ নয়, বাস্তবের সৃজন। তাঁর মতে, বাস্তবতা নিছক অভিজ্ঞতার বিষয় থাকে না, হয়ে ওঠে এক সামাজিক শাসন। আর সেই জন্যেই মানুষ বিকল্প বাস্তবতাকে ভয় পায়।
নিৎশের মতোই, মায়ার মতে শিল্প মানেই বিদ্রোহ। একই কারণে মায়া শিল্প হিসেবে সিনেমাকে তথ্যচিত্র থেকে দূরে থাকতে বলতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এও বলেছেন, বিশুদ্ধ তথ্যচিত্র বলে কিছু হয় না। ব্যক্তির নির্বাচন-নিরপেক্ষ কোনও বাস্তব নেই, এবং মানুষ তার আগ্রহ ও উদ্বেগ অনুসারেই সেই নির্বাচন করে থাকে। মায়ার এই কথায় উত্তর-আধুনিক দর্শনের প্রতিধ্বনি শোনা যায় না কি? আবার তিনি একই সঙ্গে অধীত বাস্তবতাকে ভুলে শিল্পের ভোক্তার কাছে দাবি করেন নিষ্পাপ গ্রহণক্ষমতাও।
চলচ্চিত্রের সাহিত্য-নির্ভরতারও কঠোর সমালোচক ছিলেন মায়া। আখ্যানধর্মিতার হাত থেকে চলচ্চিত্রকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। বরং শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমার নিজস্ব সম্ভাবনাগুলো খুঁজছিলেন। মায়া ডেরেন যখন চলচ্চিত্র শিল্পে এলেন, তার কিছু দিন আগে রেডিয়ো, টেলিফোন এবং বিমান আবিষ্কৃত হয়েছে। মায়ার বক্তব্য, নতুন এই সব আবিষ্কার নিরঙ্কুশ অনাপেক্ষিক স্থান-কালের ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। চলচ্চিত্র সেই পরিবর্তিত সময়েরই শিল্পমাধ্যম। একরৈখিক আখ্যানধর্মিতার বদলে সেখানে তাই সৃষ্টি করতে হবে নতুন বাস্তবতা। মায়ার ‘অ্যাট ল্যান্ড’ (১৯৪৪) ছবিতে এক নারী (মায়া নিজেই) সমুদ্রতীর থেকে উঠে আসে অভিজাত মানুষ পরিবেষ্টিত একটি ডিনার টেবিলে। পতনশীল একটি দাবার ঘুঁটিকে অনুসরণ করে মায়া নদী, বনপথ, রহস্যময় বাড়ি ইত্যাদি অতিক্রম করে আবার সমুদ্রতীরে এসে পেয়ে যান দাবার বোড়েটিকে। ফেলে আসা স্থান-কালের মায়ারা দেখে, নারীটি ফিরে আসছে পদচিহ্ন এঁকে এঁকে।
মায়া ডেরেনের ‘ডিভাইন হর্সমেন: দ্য লিভিং গডস অব আ ক্যাট’ (১৯৪৭—১৯৫৪) হাইতির রহস্যময় ধর্মাচরণের এক শিল্পসম্মত দলিল। হঠাৎ তথ্যচিত্রের প্রতি এই ঝোঁক মায়ার বন্ধুরা পছন্দ করেননি। কিন্তু বোহেমিয়ান মায়াকে কবেই বা ছকে বেঁধে রাখা গেছে! ১৯৪৭ সালে হামিদের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ; হাইতিতে থাকাকালীন মায়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে জাপানি সঙ্গীত পরিচালক তেইজি ইতো-র সঙ্গে। ১৯৬০ সালে মায়া তেইজিকে বিয়ে করেন। মায়ার নীরব চলচ্চিত্রগুলিতে শব্দারোপ তেইজির অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ। বিপজ্জনক ওষুধের প্রয়োগ এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে ১৯৬১ সালে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় মায়ার। মৃত্যুর পরে তাঁর চিতাভস্ম জাপানের ফুজি পাহাড়ের উপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কবিতার প্রতি মায়ার দুর্বলতা ছিল। তাঁকে বলা যেতে পারে চলচ্চিত্রের কবি। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর কাজে নাকি চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ কক্তোর প্রভাব আছে। মায়া নিজে অবশ্য তা অস্বীকার করেছেন। কক্তোর কাজের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছেন পরে, এমনকি তাঁর গুণগ্রাহীও হয়ে ওঠেন তিনি। মায়ার ছবিতে দালি, লুই বুনুয়েল, ফ্রয়েড–সহ আরও অনেকের প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মায়ার মতো চলচ্চিত্রকার ও চিন্তকের প্রভাব অন্য কারও উপরে পড়েছে কি না, সে আলোচনা হয়নি। মায়া তাঁর লেখায় চলচ্চিত্রের মহান পরিচালক ও অভিনেতাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন একাধিক বার, কিন্তু অন্য কারও লেখায় বা কথায় তাঁর উল্লেখ নেই বললেই চলে। পুরুষ-অধ্যুষিত শিল্পদুনিয়ায় নারী বলেই তিনি ব্রাত্য, এই ভাবনাটা মাথায় না এলেই স্বস্তি পাওয়া যেত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy