শ্রদ্ধার্ঘ্য: হকনির আঁকা উল্ডগেট-নিসর্গ। (ইনসেটে) ডেভিড হকনি
দুটো প্রদর্শনীই একেবারে মোক্ষম সময়ে। এমনিতেই ব্রিটেন এখন ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’। আগামী শুক্রবার ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট নিয়ে চূড়ান্ত ভোটাভুটির কথা ছিল, কিন্তু সে-ও এখন, অন্তত কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে। ব্রিটেন সত্যিই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছে়ড়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে কি না, এলিয়ট-কথিত ‘এপ্রিল ইজ় দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’ রাজনীতিতেও সত্য হতে চলেছে কি না, সব নিয়েই ইংলিশ চ্যানেলের এ পারে এখন অনিশ্চিত কুয়াশা। ঠিক এ হেন সময়েই অ্যামস্টারড্যামের ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে শুরু হল ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ডেভিড হকনির চিত্রপ্রদর্শনী। ৮২ বছরের হকনি এই মুহূর্তে পৃথিবীর মহার্ঘতম শিল্পী, গত নভেম্বরে ক্রিস্টির নিলামে তাঁর একটি ছবি ৯ কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছিল। জীবিত কোনও শিল্পীর কাজ এত বেশি দামে আগে কখনও বিকোয়নি।
এ দিকে অ্যামস্টারড্যামের জীবিত মহার্ঘতম ব্রিটিশ শিল্পীর রং-তুলি, আইপ্যাড, ভিডিয়োতে ভ্যান গঘের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, অন্য দিকে আগামী বুধবার থেকেই লন্ডনের টেট মডার্ন গ্যালারিতে শুরু হচ্ছে ‘ভ্যান গঘ ও ব্রিটেন’ নামের এক চিত্র প্রদর্শনী। গত এক দশকে ভ্যান গঘের এত ছবি ব্রিটেনে দেখা যায়নি, দুনিয়ার বিভিন্ন গ্যালারি থেকে ধার করে-আনা ৪৫টি ছবি জানাবে লন্ডনে ভ্যান গঘের জীবন ও ব্রিটিশ শিল্পের ওপর তাঁর বিচিত্র প্রভাব। বাস্তব পৃথিবীতে যাই ঘটুক, লন্ডনের শিল্পজগৎ সদর্পে জানাচ্ছে, শিল্প-ঐতিহ্যে ব্রেক্সিট নেই। সেখানে পারস্পরিক আদানপ্রদানেই পরম্পরা।
অ্যামস্টারড্যামের এখন রোদ-ঝলমল বসন্ত। নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত টিউলিপ সবে ফুটতে শুরু করেছে। এই পরিবেশেই তো হকনির উজ্জ্বল রং আর ভ্যান গঘের চিরন্তন এক্সপ্রেশনিজ্ম মাখামাখি হয়ে বুকের মধ্যে প্রভাব ফেলে। হকনি এই আনন্দমুখর দিনের কথাই বলছেন। তাঁর মতে, ভ্যান গঘ যতই বিষাদখিন্ন থাকুন না কেন, ছবি আঁকার সময় হাসিখুশি থাকতেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এখন ব্রেক্সিট নিয়ে তর্ক আর পাল্টা তর্কের কুজ্ঝটিকাজালে যতই আচ্ছন্ন থাকুক না কেন, ইউরোপের এই ছোট্ট দেশে তার প্রভাব নেই। ভ্যান গঘ নিজেও বসন্ত ভালবাসতেন। ‘‘মাঝে মাঝেই ভাবি, এমন দেশে যাব, যেখানে চিরবসন্ত,’’ লিখেছিলেন শিল্পী। কিন্তু তার পরই ব্যক্ত করেছিলেন অন্য আশঙ্কা, ‘‘তা হলে তুষার থাকবে না, আপেল ফুল ফুটবে না, থাকবে না ভুট্টার খেতও। শীত আর বসন্তের এক্সপ্রেশনিস্ট দোলাচল তখন শিল্পীর ‘সূর্যমুখী’ মনেও। ১৮৯০ সালে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার আগে দক্ষিণ ফ্রান্সে বসবাসকালে তো তিনি ভুট্টাখেতেরই ছবি এঁকে যাবেন।
সেই ভুট্টাখেত এসেছে ভ্যান গঘ-ভক্ত হকনির ছবিতেও। বহু বছরের আমেরিকা-প্রবাস শেষে ২০০০ সালে তাঁর ইয়র্কশায়ারের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন হকনি। দেশের বাড়িতে কয়েক বছর থাকার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সবাই বসন্ত ভালবাসে। বসন্তই জানান দেয়, শীতের পালা শেষ, এ বার জেগে উঠবে সবুজ।’’ সেই চিন্তাধারাতেই হকনির হাতে জন্ম নিল বিশাল মাপের এক ছবি—‘অ্যারাইভাল অব স্প্রিং ইন উল্ডগেট’। ৩২টা প্যানেলে আঁকা ছবি, একসঙ্গে রাখলে চোখের সামনে প্রায় ৩৬ মিটার প্রশস্ত রঙিন ঝলকানি। গ্যালারির গোটা একটা দেওয়াল জুড়ে এই ছবির সৌন্দর্যই আলাদা। ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে গাছের গুঁড়িরা দাঁড়িয়ে, হাওয়ায় ঝিরঝিরে ডালপালা ও পাতা। দর্শকের চোখকে যেন আরও ভিতরে, সুদূর অরণ্যে নিয়ে যায় এই ছবি।
উল্ডগেট উড্স সিরিজের তিন নম্বর ছবিতে হকনি আবার ফিরে এসেছেন তাঁর নিশ্চিন্দিপুর ইয়র্কশায়ারে। প্রায় ১৩ বছর আগে, ২০০৬ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর অবধি এই ছবিগুলি এঁকেছিলেন হকনি। পর পর ঢাউস ছ’টা ক্যানভাসে ধরা দিয়েছে উল্ডগেটের ঋতুবদল। বসন্তের শ্যামলিমা থেকে হেমন্তের রিক্ততা, সবই রয়েছে সেখানে। হকনি-সৃষ্ট এই ছয় বিশালত্বের সামনেই ভ্যান গঘের ১৮৮৯ সালে আঁকা ‘আন্ডারগ্রোথ’। সামনাসামনি তুলনায় পরিষ্কার বোঝা যায়, উনিশ শতকে ভ্যান গঘের নিসর্গচিত্রের উত্তরসূরি এই উল্ডগেট।
শিল্পের জয়পতাকা এখানেই। অ্যামস্টারড্যামের এই ‘হকনি/ভ্যান গঘ’ প্রদর্শনী আদতে হকনির রেট্রোস্পেকটিভ নয়, নয় উনিশ শতকের শিল্পপুরুষের সৃষ্টির সঙ্গে আজকের চিত্রকলার তুলনা। হকনির আঁকা ৬০টি ছবির সঙ্গে সেখানে ভ্যান গঘের আঁকা ৮টি রঙিন ছবি ও ৩টি ড্রয়িং। রাজনীতি যতই ব্রেক্সিট নিয়ে উত্তাল হোক না কেন, দুই প্রজন্মের দুই শিল্পী এখানে পাশাপাশি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, চিত্রকলায় কোনও বিভাজন নেই।
রং আজও অমলিন। এক ঝলকে মনে হয়, গাঢ় বৈপরীত্যের রঙিন সমাহারেই দুই শিল্পীর মিল। সর্ষেরঙা হলুদের প্রেক্ষিতে তাঁরা বাছবিচার না করে, অসম সাহসিকতায় নীল ও বেগুনি ব্যবহার করতে পারেন। হকনি অবশ্য উপরিতলের এই রঙিন সামঞ্জস্যেই থেমে থাকার পাত্র নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নিছক রং নয়, পরিসরেই আসল মিল। ভ্যান গঘ ছবির স্পেস বা পরিসরটি চমৎকার ব্যবহার করতে জানতেন, সেখানেই তাঁর কাছে উত্তরকাল ঋণী।’’
অথচ প্রথম দর্শনে ভ্যান গঘের রঙের ব্যবহারই ব্রিটিশ শিল্পীকে টেনেছিল। ১৯৫৪ সালে ম্যানচেস্টারে এক প্রদর্শনীতে ১৬ বছরের হকনি প্রথম ভ্যান গঘের ছবি দেখেন। ‘‘রঙের কথাই মনে আছে। ও রকম ছবি আগে দেখিনি, আমাদের আর্ট স্কুলে উজ্জ্বল রং নয়, ধূসরতা চাওয়া হত।’’
সেই রঙ হকনির ক্যানভাসেও। তাঁর ‘অ্যারাইভাল অব স্প্রিং’ ছবিতে তাই ইলেকট্রিক সবুজ, প্যাস্টেল নীল আর তপ্ত গোলাপি একই সঙ্গে বর্ণিল বিচ্ছুরণ ঘটায়। শুধু ক্যানভাসে নয়, আই প্যাডেও একের পর এক নিসর্গ সৃষ্টি করে গিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী। এই প্রদর্শনীতেই আছে হকনির ‘উল্ডগেট অরণ্যে চার ঋতু’। ছুটন্ত জিপে ন’টা ক্যামেরা বসিয়ে বিভিন্ন পার্সপেক্টিভে বনপথকে ধরেছেন শিল্পী। সেই বিচিত্র প্রেক্ষিতই এখানে মনিটর থেকে আছড়ে পড়ছে চার দেওয়ালে। ভ্যান গঘ প্রায় তিন-চার দিন ধরে ইজেল আর রং তুলি নিয়ে চার দেওয়ালের বাইরে প্রকৃতিকে ধরতেন, হকনিও সেই ভাবে আজকের আইপ্যাডে দিনের পর দিন ধরেছেন উল্ডগেট-নিসর্গ। চিত্ররসিকেরা জানেন, ভ্যান গঘ কখনও এক গতে বন্দি থাকেননি। ন্যাচারালিজ্ম থেকে ইম্প্রেশনিজ্ম বা পোস্ট ইম্প্রেশনিজ্ম, সব ঘরানাকেই ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁর রং-তুলি। হকনিও সে রকম থেমে থাকেননি। ক্যানভাস থেকে আইপ্যাড সব ব্যবহার করেছেন।
৮১ বছরের হকনি অবশ্য রং-মিলন্তি খেলায় পূর্বসুরির সঙ্গে নিজের মিল খোঁজেন না। ‘‘রং কেমন জানেন তো? চোখে ধাঁধা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। বরং ভ্যান গঘ বুঝিয়ে দেন, ছবিটা কী ভাবে আঁকা হল। তুলির প্রতিটি আঁচড় সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’’
হকনির স্কেচ বইয়ে এক চিলতে একটা ঘাসের ছবি আছে। ‘‘যখন একটা ঘাস আঁকবেন, আরও অনেক কিছু ওই ঘাসের মধ্যে দিয়েই আপনার চোখে ধরা দেবে,’’ বলছেন তিনি। দেড়শো বছর আগে ডাচ শিল্পীও ওই রকমই ভেবেছিলেন, ‘‘এক চিলতে ঘাস মানুষকে দিয়ে গোটা উদ্ভিদটাই আঁকিয়ে নেয়।’’ ঝটিতি মনে পড়ল, জীবনানন্দও তো একদা কবিতায় ‘ঘাসমাতার শরীর ছানি’র কথা লিখেছিলেন। শিল্পের দুনিয়ায় ব্রেক্সিট নেই। পূর্ব-পশ্চিম বা বাঙালি-ব্রিটিশ বিভাজনও অবান্তর। অ্যামস্টারড্যামের গ্যালারিতে তাই উনিশ শতকের ডাচ ভ্যান গঘ থেকে গত শতকের বাঙালি জীবনানন্দ দাশ হয়ে আজকের ব্রিটিশ শিল্পী, সবাই যেন পরস্পরের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ব্যস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy