বিহারীলাল চক্রবর্তী।
আহিরীটোলার ছেলে। বিপুল দেহ। ডাকাবুকো শুধু নয়, কিঞ্চিৎ গুন্ডা গোছেরও। এক দিন একটি ছেলের সঙ্গে তুমুল বিবাদ। ছেলেটি বুঝল, খালি হাতে এঁটে ওঠা যাবে না। তাই লাঠির মধ্যে গোপনে রাখা গুপ্তি চালিয়ে দিল বিশালদেহী সেই প্রতিপক্ষের মাথায়। রক্তস্রোত আর বাঁধ মানে না! কাছেই এক পাহারাওয়ালা ছিল। সে ছুটে এসে জানতে চাইল কী হয়েছে। অপরাধীকে খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু আক্রান্ত ছেলেটি ভাবল, পুলিশের কাছে নালিশ জানানো কাপুরুষতা! তাই পুলিশকে বলল, “কিছু হয়নি। কেউ মারেনি। চৌকাঠে মাথায় চোট লেগে এমন হয়েছে।”
আঘাতকারী ছেলেটি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনে ঘাবড়ে গেল। ভাবল, বিহারী স্বয়ং তাকে খুন করবে বলে পুলিশকে এড়িয়ে গেছে। ভয় পেয়ে সে নিজে এসে বিহারীর পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করল। বিপুল দেহের মতো বিহারীর হৃদয়ও ছিল প্রশস্ত। বিবাদ মিটল। বিহারীর ঔদার্যে চিরবশ্যতা মানল সে ছেলে। শুধু কি তাই! বিহারীলালের দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ সমীহ আদায় করে নিত গোরা পুলিশেরও। এক বার “বড়বাজারের বাঁশতলার গলির ভিতর দিয়া মহা সমারোহে বর যাইতেছিল। অত্যন্ত ভিড় হইয়াছিল। রাস্তার দুইধারে বিস্তর লোক বর দেখিবার জন্য গোলমাল ও হুটোপাটি করিতেছিল। এরূপ স্থলে যাহা হইয়া থাকে তাহাই হইতেছিল; পুলিসের লোক দু’ধারে ডাণ্ডা চালাইতেছিল; তাহার মধ্যে এক জন গোরা কনস্টেবল ছিল,… বিহারী সেই সময়ে পথের ধারে এক রোয়াকের উপর দাঁড়াইয়া ছিলেন। গোরা তাঁহার নিকট আসিয়া তাঁহার দিকে ডাণ্ডা উত্তোলন করিল। … তখন তিনি (বিহারী) আর কিছু না করিয়া অম্লানবদনে গোরার বুকের উপর এমনই সজোরে এক লাথি হাঁকড়াইলেন যে তাহাতে (গোরাকে) চিৎপাত হইতে হইল।”— বন্ধু, পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য কথিত এই বিহারীই আবার বেদনার্ত হন মৈত্রীবিরহ বা প্রীতিবিরহে। তাঁকেই কাব্যগুরু মানেন রবীন্দ্রনাথ। বলে ওঠেন ‘ভোরের পাখি’। তিনি বিহারীলাল চক্রবর্তী।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে (৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৪২) তারিখে বিহারীলালের জন্ম কলকাতায়। বাবা দীননাথের পেশা ছিল যজমানি, অর্থাৎ পৌরোহিত্য। বাল্যেই বিহারীলালের মাতৃবিয়োগ। পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ় ইনস্টিটিউশনে। তবে সেখানে বেশি দিন পড়াশোনা করেননি। তার পর সংস্কৃত কলেজে বছর তিনেক।
প্রথাগত পড়াশোনায় মন ছিল না কোনও দিনই। কিন্তু বাড়িতে রীতিমতো মন দিয়ে পড়েছেন সংস্কৃত। বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিলই। সঙ্গে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যও। লর্ড বায়রনের ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ’ যেমন তাঁর প্রিয় পাঠ্য ছিল, তেমন পড়েছেন শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়ার’ ইত্যাদি। অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন পদ্য। কৃষ্ণকমলের মতে, “সেই পদ্যগুলিতে প্রথমাবধিই আমি একটি নূতন ‘ধর্ত্তা’ লক্ষ্য করিয়াছিলাম।… সেই ‘ধর্ত্তা’ উত্তরকালে তাঁহার সমস্ত লেখাতেই লক্ষিত হয়।… ‘সংগীতশতক’ গ্রন্থ একশত বাঙ্গালা গানে গ্রথিত। গানগুলি ‘কাণু ছাড়া গীত নাই’ সে ধরনের গান নহে।”
এই যে স্বাতন্ত্র্য বিহারীলালের লেখায়, রবীন্দ্রনাথ তা লক্ষ করেছেন ‘অবোধ বন্ধু’র পাতায়। বন্ধু কৃষ্ণকমল চিনেছিলেন ‘বেহারী’র (এই নামেই ডাকতেন) কাব্যে নিজস্বতার লক্ষণ। আর বিহারীলাল ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যের উপহার অংশে কৃষ্ণকমলকে ‘প্রিয়তম সখা সহৃদয়’ বলে উল্লেখ করে লিখেছেন, “হেরিলে তোমার পানে/ তৃপ্তি দীপ্তি আসে প্রাণে/ মনের তিমির দূর হয়।”
অথচ, বিহারীলালের প্রথম বই ‘স্বপ্নদর্শন’ গদ্যরচনা। তখন তিনি সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয় এবং এটিই তাঁর একমাত্র গদ্যরচনা। স্বপ্নের আড়ালে এক তরুণ মনের দেশাত্মবোধ ব্যক্ত হয়েছে এই রচনায়। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কারণ ও স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে রচনাটিতে। কেমন সে গদ্য? গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৬৬ বছর আগের সে গদ্যে কোনও জড়তা নেই— “ভ্রাতাস্বরূপ স্বদেশীয়দিগের মলিন মুখ ও ছলছল নেত্র দেখিয়া এবং দুঃখী লোকের হাহাকার চীৎকার শুনিয়া তাহাদের শুষ্ক হৃদয়ে কি দয়ার সঞ্চার হয় না! দেশশুদ্ধ দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর গ্রাসে পতিত হইলে তাহাদেরও স্ত্রী পুত্র পরিবার সেইরূপ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইবে, ইহা কি তাহারা একবারও চক্ষুরুন্মীলন করিয়া দেখে না?”
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সঙ্গীতশতক’ (১৮৬২) শোনায় নতুন পদ্যধ্বনি— “কোথায় রয়েছ, প্রেম, দাও দরশন/ কাতর হয়েছি আমি করি অন্বেষণ।” এই লিরিক বাংলা গানের পালা বদলে দিল। যদিও অধ্যাপক অলোক রায় মনে করেন, বিহারীলালের কাব্যে ‘কবির নিজের কথা’ প্রথম শোনা গেল, এমন নয়। প্রসঙ্গত তিনি মধুসূদনের ‘আত্মবিলাপ’ ও ‘বঙ্গভূমির প্রতি’-র কথা উল্লেখ করেছেন। বিহারীলালের উপর রবীন্দ্রনাথ-কথিত শেলির প্রভাবও মানতে চাননি তিনি। ‘বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র ভূমিকায় অলোকবাবুর বিশ্লেষণ, “বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিহারীলাল সন্ধিক্ষণের কবি— একদিকে কবিগানের দেশজ ধারা, মাটির সঙ্গে যোগ, অন্যদিকে রোমান্টিক গীতিকবিতার বিদেশি ধারা, ভোরের পাখি— দুই ধারার মিলন-মিশ্রণে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত কবি।”
অভয়া দেবীর (প্রয়াত কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের কন্যা) সঙ্গে যখন উনিশ বছর বয়সি বিহারীলালের বিয়ে হয়, তখন অভয়া মাত্র দশ বছরের বালিকা। জানা যাচ্ছে, পাত্রী চক্রবর্তী-পরিবারের পূর্ব পরিচিত। বিহারীলালদের বাড়ির পাশেই তাঁরা থাকতেন। দাম্পত্যপ্রেমের নিবিড় অনুষঙ্গ যখন আলো ছড়াচ্ছে ভবিষ্যতের অপেক্ষায়, তখন আকস্মিক বিপর্যয় চুরমার করে দিল সব। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মা হতে গিয়ে মৃত সন্তান প্রসব করে চলে গেলেন অভয়া। এই আকস্মিকতায় ভেঙে পড়লেন পত্নীহারা কবি। ‘বন্ধু বিয়োগ’ কাব্যের ‘সরলা’ নামক সর্গে ধরা আছে সেই প্রেমিক কবির বিরহ-বিলাপ— “যে গুণ থাকিলে স্বামী চির সুখে রয়,/ সে সকলে পূর্ণ ছিল তাহার হৃদয়।… যেন কোন স্বর্গকন্যা আসিয়ে ভূতলে,/ মানবের মাজে ছিল মানবের ছলে।”
পিতা দীননাথ অচিরেই ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিলেন। পাত্রী কাদম্বরী দেবী বৌবাজার নিবাসী নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা। তাঁর গর্ভেই বিহারীলালের সন্তানদের জন্ম।
‘সঙ্গীত-শতক’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘নিসর্গসন্দর্শন’, ‘বন্ধু বিয়োগ’, ‘প্রেম প্রবাহিনী’, ‘সাধের আসন’-সহ একাধিক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন বিহারীলাল। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘সারদামঙ্গল’। ‘পূর্ণিমা’, ‘সাহিত্য সংক্রান্তি’, ‘অবোধ বন্ধু’— এই তিনটি মাসিক পত্রিকা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। মহর্ষি তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী তাঁর লেখার ভক্ত ছিলেন। তিনি কবিকে স্বহস্তরচিত একটি আসন উপহার দিয়েছিলেন। ‘সাধের আসন’ গ্রন্থটি সেই উপলক্ষে লেখা। ‘সারদামঙ্গল’-এ কবি যখন লেখেন— “এত যে যন্ত্রণা জ্বালা/ অবমান অবহেলা/ তবু কেন প্রাণ টানে কি করি, কি করি!” তখন বোঝা যায়, একান্ত ব্যক্তিগত এই উচ্চারণই বিহারীলালকে আলাদা করে চিনিয়েছিল। বন্ধু কৃষ্ণকমল কিংবা রবীন্দ্রনাথের অনুভবে যা বাংলা কবিতার অভূতপূর্ব উন্মোচন, বাংলা কবিতার অভ্যস্ত পথরেখা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ‘অবোধ বন্ধু’র পাতায়, “সর্বদাই হু হু করে মন,/ বিশ্ব যেন মরুর মতন;/ চারিদিকে ঝালাফালা,/ উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা!/ অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন” পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, এই বক্তব্যই যেন প্রথম আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে কোনও কবির নিজের কথা। ‘সারদামঙ্গল’-এ সেই নিজের কথা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল— “বিচিত্র এ মত্তদশা,/ ভাবভরে যোগে বসা,/ হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে!/ কি বিচিত্র সুরতান/ ভরপূর করে প্রাণ,/ কে তুমি গাহিছ গান আকাশমণ্ডলে!” বাংলা কবিতার এই নতুন পথের দিশারিকে রবীন্দ্রনাথ কখনও ভুলতে পারেননি। ভুলতে তো পারেনইনি, পরন্তু, কাব্যজীবনের সূচনাপর্বে তাঁর বাসনা ছিল, বিহারীলালের মতো কবি হওয়ার— “বিহারীবাবুর মতো কাব্য লিখিব।”
‘জীবন স্মৃতি’র ‘গীতচর্চা’ শীর্ষক রচনার প্রথম পাণ্ডুলিপিতে (পরে গ্রন্থে পরিবর্তিত) দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল সংগীত আর্যদর্শনে বাহির হইতেছিল এবং আমরা তাহাই লইয়া মাতিয়া ছিলাম। এই সারদামঙ্গলের আরম্ভ-সর্গ হইতেই বাল্মীকি প্রতিভার ভাবটা আমার মাথায় আসে এবং সারদামঙ্গলের দুই-একটি কবিতাও রূপান্তরিত অবস্থায় বাল্মীকি প্রতিভায় গান রূপে প্রকাশ পাইয়াছে।”
সেই কাব্যগুরুর কনিষ্ঠ পুত্র শরৎকুমারের সঙ্গে যখন বড় মেয়ে মাধুরীলতার (বেলা) বিয়ের কথা হল, তখন নিশ্চয়ই খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সে খুশি মিলিয়ে যেতেও দেরি হল না। পাত্রপক্ষের তরফে বিপুল অর্থ পণ চাওয়া হল। বিয়ে হল বটে, কিন্তু ঘটনায় ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে (বিবাহের মধ্যস্থতাকারী) লিখলেন, “এ বিবাহে আমার এবং বেলার মা’র উভয়েরই মনের মধ্যে একটি ক্ষতরেখা রহিয়া গেল, এমনকী তিনি কন্যার মাতা হইয়াও এ বিবাহে যথেষ্ট উৎসাহী হন নাই।”
১৯০১ সালের ১১ জুন বিয়ে হয় বেলার। বিহারীলাল জানতে পারলেন না কিছুই। এর সাত বছর আগে, ১৮৯৪ সালের ২৪ মে, বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি!
তথ্যঋণ: সাহিত্য সাধক চরিতমালা— ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পুরাতন প্রসঙ্গ— বিপিনবিহারী গুপ্ত, বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা— অলোক রায় সম্পাদিত।
সৌজন্য: উদয়শঙ্কর বর্মা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy