ছবি: সুমন চৌধুরী।
অ ন্ধকার ঘর, ছড়ানো-ছেটানো পোশাক-আশাক, দুপুরের এঁটো থালাটা এখনও টেবিলে, বাথরুমের কল থেকে বালতিতে খুব আস্তে আস্তে জল পড়ার শব্দ, টপ টপ টপ... সময় রাত পৌনে এগারোটা। দরজা খুলে দ্রুত পায়ে ঢুকে আসে রিয়া। ফোন কানে কারও সঙ্গে কথা বলে চলেছে, পায়ের জুতোটা ঝটকায় খুলে ফেলে, দরজায় ধাক্কা খেয়ে সেটা এক পাশে এসে পড়ে। রিয়া ডিভানে বসে কথা বলে চলেছে, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন, যা হয়েছে সবটাই ভুল! সবটাই জাস্ট ফর ফান?’ আরও কিছু বলতে বলতে উঠে এসি’টা অন করে, হাতের মেক-আপ কিট’টা সরিয়ে রাখে আয়নার পাশে। ফোনের ঝগড়া বাড়তে থাকে, মেক-আপ তুলতে ক্লেনজার’টা তুলোয় মাখিয়েও সে মুখে ঘষতে পারে না, চাপা গলায় বলে, ‘ওকে, ফাইন, এটাই তোমার শেষ কথা তো!’ ফোন কেটে দিয়ে সবার আগে ফোনটা ছুড়ে দেয় ডিভানে, হাতের তুলোটাও ফেলে দেয়, এগিয়ে যায় খাবার টেবিলের দিকে, ফলের ঝুড়ির ওপর রাখা ছুরিটা দ্রুত উঠিয়ে নিয়ে অন্য হাতের কবজিতে বসিয়ে দেয়... বাথরুমের কল থেকে তখনও শব্দ ভেসে আসে, টপ টপ টপ...
এ কোনও চিত্রনাট্য নয়, একে একে চলে যাওয়া মানুষগুলোর শেষ কিছু মুহূর্ত।
আমার পাশের পাড়ার নন্দিনী, কলেজ থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরে সেই যে দরজা দিল, তার পর... আর শ্বেতার চলে যাওয়াটাও প্রায় ছ’মাস হতে চলল, মেট্রো রেলে ঝাঁপ দিয়ে... ওদের কথা বাড়ি আর পাড়ার কয়েক জন ছাড়া আর কারও মনেও পড়ে না, উলটে ভুলে যাওয়াটা বাড়ছে। আসলে ওদের আত্মহত্যার খবরটা ফেসবুকে ২৫০ জন শেয়ার করেনি যে...
দিশা চলে গেল, চলে গেল প্রত্যুষাও, কেন এমন হয়, কীসের এত তাড়া, কেন মনে হয় এর পর আর কিছু নেই, কেন এ ভাবে চলে যাওয়া... বিনোদনের জগৎটায় কি আদৌ কোনও বিনোদন আছে... না কি ওই মন খারাপ আর রোদন...সে সব থেকে বেরতে না পারলে...‘বিদায় পৃথিবী’!
এখানে সাফল্য আর মনখারাপ দুই সহোদরা, সাফল্য এলে এক রকম থাকা, সেখানেও মনখারাপ আছে, আর সাফল্য না এলে তো মনখারাপটাই নিত্য সঙ্গী। অন্যান্য পেশায় তবু একটা অন্য ভরসা আছে, ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা, এখানে সে দুটোর খুব একটা কদর নেই। লাগলে তুক, না লাগলে তাক। আজকের এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী বছর কয়েক আগে মফস্সল থেকে এসেছিল অডিশনে, সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে, রেজাল্ট বেরয়নি, তার মাথার নারকোল তেলের গন্ধে অডিশন রুম ম-ম করছে। চরিত্রটাও ছিল অমনই এক গ্রাম্য বালিকার, তাই পছন্দ হল ওকেই। শুটিংয়ের আগেই রেজাল্ট বেরল, সে পাশও করেছে, তত দিনে সে চুক্তিবদ্ধ, সকাল থেকে রাত অবধি কাজ চলবে তো, নিজের এলাকায় ভর্তি হবে কী করে?
আমি কেন জানি না যেচেই কাকাবাবু হয়ে গেলাম, নিজের চেনাশোনা কাজে লাগিয়ে ভর্তি করে দিলাম একটা কলেজে, যেখানে বলেও রাখা হল যে ক্লাস নিয়মিত করতে না পারলেও যেন কিছু বলা না হয়। সিরিয়াল শুরু হল, কয়েক মাস পর বন্ধও হল, আবারও সে নতুন সিরিয়ালে কাজ পেল, নাম করল, ফিতে কাটায় ডাক পড়তে শুরু করল, ফ্ল্যাট বুক হল, সব হল, শুধু আর কলেজটা যাওয়া হল না, যথারীতি কাকাবাবু হেরে গেলেন।
এখন তারকা হওয়া সহজ। সব চ্যানেলের সব মেগা সিরিয়ালে দশরথ, কৌশল্যা, জনক, ঊর্মিলা, ভরত, কুম্ভকর্ণ, রাবণ, শূর্পণখা চরিত্রে সব চেনা মুখ নেওয়া হয়। রাম, লক্ষ্মণ আর সীতা হবে নতুন ফেস, ‘ভার্জিন লুক’ খুঁজে এনে চ্যানেল তখন তাদের নিয়ে ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে রাস্তায় ছুটে বেড়ায় আবিষ্কারের আনন্দে, ওটারই পোশাকি নাম, ‘প্রোমোশন’। আর এই চাওয়াটাকেই হাতিয়ার করে জেলায় জেলায় ‘অ্যাক্টিং স্কুল’। বিজ্ঞাপনে সদর্পে ঘোষণা ‘কোর্স শেষে সুযোগের গ্যারান্টি’। পিলপিল করে ছেলেমেয়েরা আসছে। না এসে কী-ই বা করবে...সেলেব্রিটি হবার লোভ কার না থাকে? আর এই ‘লাইন’-এ নেমে গেলেই স্টার। সব দোষ ওই আয়নার। তার সামনে দাঁড়ালে সে তো আমায় অসুন্দর বলে না...
ধরা যাক গল্পের নায়িকা গ্রামের মেয়ে, রোগা, শীর্ণ, কিন্তু গানের গলাটি খাসা। পিকনিক করতে গিয়ে নায়ক ওই গান শুনেই প্রেমে পড়ে গেল, এক ঝড়-জলের রাতে কোনও এক উপঘটনার চাপে তাদের বিয়েও হল, তার পর সে চলে এল শহরে, শুরু হল শাশুড়ির অত্যাচার। হইহই হিট করল সেই সিরিয়াল।
কোচবিহার বা দিনাজপুর থেকে আসা শ্যামলী তখন শুধু চেকেই শ্যামলী লেখে, বাকি সব জায়গায় সে স্মিতা। কলকাতায় শুটিং বলে সে তার চেনা গণ্ডি ছেড়ে টালিগঞ্জ এলাকায় দেড় কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিল, ফ্রিজ এল, টিভি এল, ফ্যান ক্লাব তৈরি হল ফেসবুকে, তাই ল্যাপটপ এল, ছুঁলে শিহরন ফোন এল, পনিটেল দেওয়া বয়ফ্রেন্ড এল, সেকেন্ড সানডে লং ড্রাইভ, শপিং মলের পোশাক, রাতে মুড ঠিক রাখতে ডিস্ক, রেড ওয়াইন এল, ইএমআই এল। ম্যাগাজিনে অপ্রয়োজনেও ছবি বেরতে শুরু করল...মুছে যেতে থাকল ওই মফস্সলের ছবি...এই জীবনটা আর স্বপ্ন নয়, সত্যি।
তার পর এক দিন হঠাৎ করেই চ্যানেল জানাল: আগামী মাস থেকে নতুন মেগা আসছে, তোমরা গল্প গোটাও... প্রোডাকশন হাউসকে দেওয়া হল নতুন মেগার বরাত। দশরথ, কৌশল্যা ইত্যাদিতে নামী আর্টিস্ট ব্লক করা শুরু হল, আর শুরু হল নতুন রাম-সীতার খোঁজ।
নতুন গল্পের নায়িকা শহুরে, ঝকঝকে রূপসি, ঠাকুরদার উইল মেনে কোটি টাকার সম্পত্তি পেতে তাকে বিয়ে করতে হয় ঠাকুরদার ছোটবেলার বন্ধু হরিচরণের নাতিকে, গ্রামে থাকে, মাধ্যমিক ফেল। কী হবে তা হলে স্মিতার? আবার তাকে শ্যামলী হয়ে যেতে হবে? চ্যানেল বা হাউস তাকে রিপিট করবে না, কোথায় পাবে আর একটা গ্রাম্য অসুন্দর মেয়ের গল্প? হাউসের কলটাইম জানানোর ফোন আর আসে না, স্যামি, টনি, ভিকাশদের ফোন কমে গেছে, শুধু ব্যাংকের ফোনটা নিয়ম করে আসে।
এই তো সামনেই নতুন কাজ শুরু হবে, ক’টা দিন জাস্ট গ্যাপ নিলাম, নতুন ক্যারেক্টারে ফোকাস করব তাই— প্রতিবেশী বা অল্প পরিচিতদের এ সব বলে ম্যানেজ দেওয়া যায়, কিন্তু শত কষ্টেও নিজের ছোট শহরে সে ফিরবে না। দেড় বছরের কাজে তার একটা ছোট্ট লাল টুকটুকে গাড়িও আছে, ড্রাইভারকে মিথ্যে বলে ছুটি দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সাত তারিখ আট হাজার টাকা কাটছেই... ও দিকে স্যাম নতুন মডেলদের ফোটোশুট নিয়ে ব্যস্ত, মুম্বই থেকে নাকি অর্ডার এসেছে পিয়াকে প্রোমোট করার... অল লাইটস, রোল, রোলিং, অ্যাকশন আর শুনতে পায় না শ্যামলী, যে ফোনের ব্যস্ততার কারণে তার কো-আর্টিস্টরা তাকে ‘ফোনিমাসি’ বলে খ্যাপাত, আজ সেই ফোনে বার দুয়েক মা ফোন করে দুপুর-রাতে কী খেল, রাতে কখন ফিরবে, কী খাবে জানতে চায়... স্ক্রিপ্ট না থাকলেও নিয়ম করে মাকে মিথ্যে ব্যস্ততার গল্প বলতে থাকে সে... পরদা ঢাকা ঘরে দিনের বেলাতেও অন্ধকার... স্মিতা চেয়ে থাকে ফ্যানটার দিকে....
সব দোষ কি স্মিতার? না কি পনিটেল স্যামের? না কি প্রোডাকশন হাউস বা চ্যানেলের? না কি কারওই না, সমাজের, প্রযুক্তির, বিপণনের, উচ্চাকাঙ্ক্ষার, পুঁজিবাদের? বা এই সবগুলো মিলিয়েমিশিয়ে যে আশ্চর্য জগাখিচুড়ি আমাদের চারপাশে বয়ে চলেছে, তার? যাঁরা অনেক জানেন-টানেন, প্রচুর বক্তৃতা দেন বা গম্ভীর বই লেখেন, তাঁরা এই নিয়ে অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু আমার সে জ্ঞান-বিদ্যে নেই, আমি চোখের সামনে ঢাকুরিয়া লেক-এ খুদেদের ক্রিকেট শেখার মাঠের সামনে এক মা’কে তাঁর বছর দশেকের ছেলেকে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে দেখেছি, কোচ নাকি বলেছেন ওর খেলায় ‘অ্যাগ্রেসিভ’ ভাবটা কম, তাই পর পর চড়। পেটের দায়ে মেগা সিরিয়াল আর রিয়েলিটি শো করতে গিয়ে এমন বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে।
এক বার একটা মোটা বাচ্চার খানিক নামডাক হল, একটা শুটিং-এ তার সঙ্গে দেখা, অবাক হয়ে দেখলাম, তার মা সারা দিন তাকে সময়-সুযোগ পেলেই যা পারছেন খাইয়ে যাচ্ছেন, বাচ্চাটা দমসম হয়ে ‘আর না, আর পারছি না’ বললেই বকুনি। এত খাওয়ানোর একটাই কারণ, কম খেলে যদি রোগা হয়ে যায়, বাজারটাই চলে যাবে তো!
একটা বাচ্চা এমনিতে টরটরিয়ে কথা বলত, কিন্তু তার মা তাকে ডায়ালগ মুখস্থ করাতেন সুর করে-করে, আধো-আধো উচ্চারণে, সে শটে গিয়ে তাই ত-ত করে কথা বলত, মা জানতেন এতে শিশুত্বের বাজার বেশি দিন টিকবে।
গানের রিয়েলিটি শোয়ের শুটিং গড়াত মধ্যরাত অবধি, নিজের পছন্দের রাউন্ডে এক কিশোরী চাইছে— সহজে গাওয়া যায়, তোলা আছে, এমন গান গাইতে। আর তার মা তাকে ক্রমাগত ধমকে যাচ্ছেন ‘খচ্চা করে তবে গুরুজির কাছে দিলাম কেন?’ উনি যে জানেন কালোয়াতি আর মুনশিয়ানা দেখালেই রাউন্ড উইনার, রাত দুটোয় মেয়ে পারছে না বললে হবে?
অনেক মুখ মনে আসছে, মোটে কয়েক জন আজ লাইম লাইটে, বেশির ভাগ মুখ হারিয়ে গেছে, তবু অডিশনে আগের রাত থেকে লাইন ব্ল্যাক হয়। আমার যাবতীয় শেখাটাই ভুল প্রমাণ হবে যদি আমি রিয়েলিটি শো’তে সুযোগ না পাই। একটু ভেবে বলুন তো যে কোনও জনপ্রিয় রিয়েলিটি শোয়ের শেষ তিন বছরের ফাইনালিস্ট বা উইনারের নাম... নাঃ, আপনার মনে নেই। সে এখন আজ গোবরডাঙা, কাল হলদিয়া, পরশু ধানবাদে সোনু নিগম আর উদিত নারায়ণের গান করে মাচায় উঠে। যত পারে শো করে যায়, কারণ সে-ও জানে পরের বছর আরও সাত-আট জন চলে আসবে, ক্যালেন্ডারের পাতার মতো পাবলিক তাকে উলটে দিয়ে নতুন ছবি দেখবে। দিশা বা প্রত্যুষা নিয়ে আমরা বেশি হুঁহুঁ করি কারণ কাহিনিতে মোচড় আছে... আড্ডায় বিষয়টা পনেরো মিনিটের খোরাক দেয়। আর প্রতি দিন এই দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে চলে কত জন, সে খবরে চাটনি কই? মনখারাপ, ডিপ্রেশন আমাদের জল-ভাত।
এক নায়ক-বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোর মন খারাপ হয় না? তখন কী করিস?’ সে বলেছিল, ‘চোখ বুজে রদ্দি ছবিতে সাইন করি, টাকা পাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই সেখানে, তবুও...’ সমস্যা হল, সবার জীবনে তো এমন অফারের ঢেউ থাকে না। আমার এক বন্ধু আছে, ভীষণ প্রাণবন্ত, ফ্লোরে সে যত ক্ষণ থাকে হইচইতে মাতিয়ে রাখে, জীবনের সব বিষণ্ণ ব্যাপারকে কী করে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে হয়— সকলে ওর কাছ থেকে শেখে। মাঝেমধ্যে খুব রাতে তার ফোন আসে। জড়ানো গলায় কান্না উঠে আসে তার। এই ইন্ডাস্ট্রি তাকে ভাঁড় সাজিয়েই রেখে দিল, চরিত্র হয়ে উঠতে দিল না। তার নালিশের তালিকায় বিখ্যাত বন্ধু ডিরেক্টরদের নামও আসে।
এমন অনেকেই কাজের অভাব, মূল্যায়নের সংকট থেকে বেরোতে পারে না বলেই ডুবে যায় মদ্যপানে। কেউ মোটা হয়ে যায়, কেউ রাজনীতির আনাচকানাচের খবর নিতে থাকে, সবই হয়, সঙ্গে কিন্তু চালিয়ে যেতে হয় ডিরেক্টর-প্রোডিউসারদের নিয়মিত এসএমএস। ‘বহু দিন বসে আছি, খুব খারাপ কন্ডিশন।’ গাড়ি আর ফ্ল্যাটের ভাড়ার চিন্তায় এক চেনা অভিনেত্রী সারা দিন জয়েন্ট খেয়ে যেত, রাতে মাত্রা ছাড়ানো ঘুমের ওষুধ, মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে থাকত বলে অ্যালকোহল খেতে পারত না।
টিআরপি অতি বিষম বস্তু, আজ সিরিয়াল হিট মানে তুমি সেরা। যা চাইছ, যেমনটা চাইছ হচ্ছে। কাল সেটা বন্ধ হয়ে গেলেই সব শেষ। টিভির মনে রাখার দায় প্রায় নেই, রোজ এত মুখ আসে-যায়, দু-একটা না থাকলে কিচ্ছু যায় আসে না, ও দিকে সেই হিট অভিনেতা বা অভিনেত্রী জীবনযাপনটা এমন একটা লেভেলে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে নেমে আসাটা অসম্ভব কষ্টের।
আমার এক খুব কাছের অভিনেতা দাদার কথা মনে পড়ে, আজ তিনি নেই, এক সঙ্গে অনেকগুলো সিরিয়ালে মূল চরিত্র করতে করতে তাঁর হঠাৎ মনে হল তিনি এক নম্বর— তাই রেট বাড়ানোর এটাই সময়। পার ডে’টা এর পর প্রায় দ্বিগুণ করে দিলেন, চলতি সিরিয়ালগুলো দিতে বাধ্য হল, কিন্তু সেগুলো বন্ধ হতেই সবটা পালটে গেল, ওই পারিশ্রমিকের ভয়ে কেউ আর নতুন কাজে ডাকে না, ডাকলেও টাকা কমাতে বলে, কী করবেন এখন উনি? নিজের বেঁধে দেওয়া রেট কমাবেন, না কি জেদ ধরে থাকবেন? অভিমানে কো-প্রোডিউসার হতে গেলেন, সেখানেও ব্যর্থতা। এর পর সেই ডিপ্রেশন, গাড়ি করে রাতের পর রাত আমি তাঁর সঙ্গে ওভারব্রিজ থেকে নীচের শহর দেখতাম, এটাও ওঁর নেশা। আমি তার নির্লিপ্ত সঙ্গী।
এক বার এর রিয়েলিটি শো’তে একটি ছেলেকে এক বিখ্যাত সুরকার, রিয়েলিটির শো-টির প্রযোজকের চাপে (ওই এক জন ঠোঁটকাটা নিন্দুক বিচারক থাকলে শো জমে ওঠে, তাই রাখতেই হয়) বলেছিলেন, ‘তোমার গলা সুরের পাড়ায় থাকেই না!’ ব্যস আর যায় কোথায়, সে ছেলেটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চায়। আমরা কয়েক জন বন্ধু আর বাড়ির লোক তাকে ঘিরে থাকতাম সারা দিন। পরবর্তী সময় সেই ছেলেটির প্রবল নাম হয়, মুখের ওপর জবাব দেওয়ার এমন সুযোগ ক’জন পায়? বেশ কিছু অভিনেত্রীর হাতে কাটা দাগ...কেন? এক জন বলিষ্ঠ অভিনেতা কাজ কমে এলেই বড়ি ট্যাবলেট খেতে শুরু করত, তখন তাকে আর কেউ নিত না, সে আমাকে ফোন করে প্রথমেই বলত, ‘দেখ ভাই, নেশা থেকে দূরে আছি তবু কাজ নেই।’ কী বলব, সত্যিটা তো সবার মতো আমিও জানি।
আমার এক খুব কাছের বন্ধু, ইন্ডাস্ট্রিতে একটু একটু করে উঠে বেশ খানিক নাম করেছে, কাচের গ্লাসে চা পায়, লোক চেয়ার ছেড়ে দেয় তাকে। এটুকু পেতে তাকে দিন-রাত এক করে খাটতে হয়েছে, বাড়ির মানুষদের দিকে তাকানোরও সময় পায়নি, সুসময়ে নানা অভিনেত্রী তাকে ‘গুড মর্নিং’, ‘লাঞ্চ করেছ?’ গোছের টেক্সট করে, সেই নদীতে সাঁতার না কাটলেও নদীর ধারে বসে থাকাটা বন্ধ করেনি সে, ভেবেছে ‘এগিয়েছি’-র প্রমাণ এগুলোই। ও দিকে তার বউ, দিনের পর দিন বরের থেকে সময়-সান্নিধ্য না পেয়ে, খুঁজে পায় এক স্কুলবেলার বন্ধুকে, শুরু হয় তাদের আদিম উদ্দাম প্রেম। আমার বন্ধু সে খবর পায়, ডুবে যায় চরম ডিপ্রেশনে, আমি সেই সময় তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, স্নান নেই, খাওয়া নেই, বন্ধ ঘরে শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর বমি করছে... কেন এমনটা হল, কে দায়ী? আমার বন্ধু? না কি বন্ধুর বউ? না কি সেই স্কুলের বন্ধু? না কি ওই অভিনেত্রীরা? কেউ নয়, দায়ী ওই মিডিয়ার স্পটলাইট।
দিশা, প্রত্যুষার মতো আরও অনেক নাম, অনেক মুখ ভিড় করে আসছে, কিন্তু ওই যে সিরিয়ালের শহুরে নায়িকা গ্রামে গিয়ে বিয়ে করবে সে চিত্রনাট্যটা আমিই লিখি, একটু পরেই প্রোডাকশন গাড়ি পাঠাবে পাতা তুলতে, সময় মতো যদি জমা না দিই, কালকেই অন্য কাউকে দিয়ে লেখাবে, কী হবে তখন আমার? কে দেবে আমার ইএমআই আর ফ্ল্যাটের খরচা! শুনতে পাই আমার বাথরুমের কল থেকেও জল পড়ছে... টপ...টপ...টপ...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy