ছবি: রৌদ্র মিত্র
যতই আগে থেকে তাড়াহুড়ো করি না কেন, বেরনোর সময় ঠিক দেরি হয়ে যায়। বাবা বলত, “অফিসবাবু, কব্জিতে ঘড়ি বাঁধো শক্ত করে।”
বাবাকে দেখেছি ঘুম থেকে উঠেই হাতে ঘড়ি পরে নিত। দম-দেওয়া ঘড়ি। বিয়েতে পাওয়া। বলত, “বিয়েতে দুটি দামি জিনিস পেয়েছিলাম। একটি দেশি, আর একটি বিদেশি।”
আমার দেশি মা অনেক দিন আগেই থেমে গিয়েছিল। বিদেশি ঘড়িটা অবশ্য চলেছিল শেষ পর্যন্ত। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো।
বাবা ছিল সনাতনী নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। কাজ সারত সময় মেপে। রাত থাকতে উঠে পড়ত। ভোরের আলো ফোটার আগে। তার পর কলঘর। জলের আওয়াজ। দৃঢ় মুখ শ্মশ্রুগুম্ফহীন করে দৃঢ়তর করা। তার পর বাঁ হাতে সেই দম-দেওয়া বিদেশি ঘড়িটি বেঁধে খবরের কাগজ হাতে দক্ষিণের বারান্দায় আরামকেদারায় বসে পড়া। কোনও দিন এই নিয়মের অন্যথা হতে দেখিনি।
আমার ভোরের আরামের ঘুম ভেঙে যেত। অনিন্দিতাও উঠে পড়ত। চালু করে দিত সংসারের জটিল যন্ত্র। আমি ছিলাম উল্টো পথের। ঘাপটি মেরে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। বিছানার পাশে জানলা। শুয়ে শুয়ে পুবের আকাশ দেখতাম। ভেসে যেতাম নব আলোকিত মেঘেদের সঙ্গে। এটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
আজও বিছানা আঁকড়ে পড়ে ছিলাম। হয়তো একটু বেশি সময় ধরে। অনিন্দিতার তীব্র ঝাঁকুনিতে উঠে পড়তে হল, “ক’টা বাজে খেয়াল আছে? সময়জ্ঞান নেই!”
আমি ঘড়ি পরি না। ঘড়ি পরতে ভাল লাগে না। মনে হয় বুঝি বাঁধা পড়ে গেলাম চেনা আবর্তে। সময় দেখার একটু-আধটু যা প্রয়োজন, মোবাইলেই তার কাজ চলে যায়। অনিন্দিতা জানে আমার সময়জ্ঞান কম। বাবাও তেমনই মনে করত। তবু বাবা আমাকে একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। দম-দেওয়া ঘড়ি। তখন আমি ক্লাস এইট।
অনিন্দিতা আরও কিছু বলছিল। সব কিছুই আমার অপদার্থতা প্রসঙ্গে। মাঝে মাঝেই বলে। গায়ে মাখি না। মাখলে ভোরের এই অপার্থিব আয়েশ আর উপভোগ করা যাবে না। আজ রবিবার। বাড়তি এই আয়েস আমার হকের পাওনা। তবু বঞ্চিত হতে হল। প্রতিবাদ করা যাবে না। করলেই সংঘাত। প্রাপ্ত আয়েশের রেশটুকুও কেটে যেতে পারে। বিনা প্রতিবাদে বিছানাকে বিদায় জানালাম।
ক’দিন ধরে অনিন্দিতা এক অদ্ভুত বায়না ধরেছে। আমাকে ঘড়ি পরতে হবে। বাবার মতো। আরে বাবা, পৃথিবীর সব মানুষ কি এক ছাঁচে হয়! বাবা ছিল বাবার মতো। আমি আমার মতো। কিন্তু সেটা বোঝাবে কে তাকে! তবে এই বায়না বিষয়টি তেমন ভয়ের নয়। ওই রকম নানা ধরনের বায়না ওর মাথায় মাঝেমধ্যেই নেচে ওঠে। আবার নিভেও যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভয়টি হল যে, বায়নাটি ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। বর্ষণ অনিবার্য।
বিছানা ছেড়ে মুখ-হাত ধুয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসলাম। এই টেবিল আমাদের দেওয়ান-ই-খাস। এই টেবিলেই আমরা আমাদের ব্যক্তিগত দাবিদাওয়া পেশ করি। এবং আলোচনা সাপেক্ষে তা গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যান এই টেবিলেই সেরে ফেলা হয়। মা-র আমল থেকেই এই প্রথা চলে আসতে দেখেছি। মা চলে যাওয়ার পরও তার বদল হয়নি। শুধু ভেক্টর রাশির মতো অভিমুখ পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। বাবা ছিল পরাক্রান্ত। তখন বাবা বলত, মা শুনত। মা-র অনুপস্থিতে বাবার ভূমিকা ছিল অনুঘটকের মতো। বৌমার প্রতি বাবার প্রবল আস্থা ছিল। বাবা চলে গিয়েছে। দেওয়ান-ই-খাস এখনও চালু আছে। প্রজা আমি।
কোনও প্ররোচনা ছাড়াই অনিন্দিতা শুরু করল, “তোমার ঘড়িটা কোথায়?”
আমি প্রমাদ গুনলাম। কত দিন দেখিনি। দম দেওয়া হয়নি। বাবা থাকতে ঘড়িটা দম পেত। ওর তিনটে কাঁটা ঘুরত যে যার মতো নিয়ম মেনে। পরীক্ষার সময় ছাড়া ওই ঘড়ির কোনও প্রয়োজন হয়নি আমার। অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, “বোধহয় বাবার আলমারিতে।”
“আজ বার করবে। দম দিয়ে চালু করবে ওটাকে।”
“কেন, দেওয়ালঘড়িটা ঠিকঠাক চলছে না?”
“ওটা কি তুমি পিঠে বেঁধে ঘুরবে?”
“ধুস! তাই কি কেউ ঘোরে নাকি?” আমি পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করি। কিন্তু মনে মনে বুঝে নিই, ওই ঘড়িকে আজ দিনের আলো দেখাতেই হবে।
উঠে গিয়ে বাবার আলমারিটা খুলে ফেললাম। বাবা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম বাবার আলমারিতে হাত দিলাম। এত দিন এড়িয়ে যেতাম। এখন বাবার সঙ্গে আমার সংযোগটা খুব বুঝতে পারি। দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকলে একে অন্যের পরিপূরকের কাজ করে। তখন অভাবটা বোঝা যায় না। অনুপস্থিতি অভাববোধকে তীব্র করে। এখন বাবার কথা মনে হলেই একটা গভীর অবসাদ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। অনেক কিছু জানার ছিল মানুষটার
কাছ থেকে।
একটু নাড়াচাড়া করতে দুটো ঘড়িই দেখতে পেলাম, পাশাপাশি শোয়ানো। আমারটা দেশি, বাবারটা বিদেশি। দুটোই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাবা প্রতিদিন নিয়ম করে দম দিয়ে চালু রাখত। প্রতিদিন সকাল আটটায়। ঘড়ি পরতে ভালবাসি না বলে কখনও জোর করত না আমাকে। ঘড়ি ভালবাসত বলে বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে একটা দামি কোয়ার্টজ় ঘড়ি কিনে দেওয়ার। বাবা রাজি হয়নি। মজা করে বলত, “গিয়ার ছাড়া গাড়ি চালিয়ে যেমন পানসে লাগে, দম ছাড়া ঘড়িও তেমন।”
ঘড়ি দুটো হাতে নিয়ে দম দিতে গিয়ে কেমন হাতটা কেঁপে উঠল যেন। মনে হল তেমন জোর কি আমার আছে! তবু চেষ্টা করে দম দিয়ে ফেললাম দুটো ঘড়িতেই। আমার ঘড়িটা চলতে শুরু করল। দেওয়ালঘড়ি দেখে সময়টা মিলিয়ে নিলাম। কিন্তু পরতে গিয়ে কেমন বাধো বাধো ঠেকল। বাবা শখ করে আমাকে কিনে দিয়েছিল। তখন পরিনি। এখন অনিন্দিতার চাপকে উপেক্ষা করতে পারছি না।
বাবার ঘড়িটা চাবি দেওয়া সত্ত্বেও কিন্তু চলল না। সাদা ডায়ালের উপর ঘণ্টার কাঁটা আর মিনিটের কাঁটা দুটো পঞ্চান্ন বেজে থেমে আছে। এখন সকাল সাতটা। বাবা বলত পরলে ঘড়ি সচল থাকে। কথাটা মনে হতেই আমি বাবার ঘড়িটা পরে ফেললাম। তার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। মনে হল
চেষ্টা করেও কোনও দিন আমি বাবার মতো সুপুরুষ হতে পারব না। অনিন্দিতা বলল, “ও মা, বন্ধ ঘড়িটা পরে আছ কেন?”
অনিন্দিতার কথার উত্তর দিলাম না। দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বাবার আরাম কেদারাটায় বসলাম। একটু পরে অনিন্দিতা চা এনে সেন্টার টেবিলে রাখল। তার পর আমার হাতটা টেনে নিয়ে ঘড়িটা দেখতে দেখতে বলল, “ঘড়িটা কিন্তু বেশ দেখতে। সারিয়ে নিয়ে আসতে পারো তো।”
কথাটা আমিও ভাবছিলাম। পরের দিন অফিস যাওয়ার সময় অজয়কাকুর দোকানে দিয়ে যাব ঘড়িটাকে। ব্যাটারির ঘড়ি এসে যাওয়ার পর সব দোকানে এখন এই ঘড়ি সারায় না। অজয়কাকু সারাত। বাবাকে দেখেছি অজয়কাকুর দোকানে বছরে এক বার অয়েলিং করাতে নিয়ে যেত। চোখে ঠুলি পরে অজয়কাকু খুব মন দিয়ে কাজ করত। বাবার সঙ্গে আমিও গিয়েছি ওই দোকানে কয়েক বার। অজয়কাকু মারা যাওয়ার পর বাবা আর ওই দোকানে যায়নি। তার পর খুব সম্ভবত ঘড়িদুটো বছরদুয়েক আর অয়েলিং হয়নি। আর এখন তো মাসছয়েক এমনিই পড়ে রয়েছে।
অফিস যাওয়া-আসার পথে দেখেছি অজয়কাকুর দোকানটা খোলা থাকে। একটি ছেলে বসে থাকে। সে কর্মচারী কি না জানি না। ঘড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কম থাকায় তেমন লক্ষ করিনি। তবে ছেলেটি কিন্তু অজয়কাকুর চেয়ারেই বসে। একই ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ে কাজ করে।
অফিস যাওয়ার সময় একটু তাড়াহুড়ো থাকে। তবু বাবার ঘড়িটা ব্যাগের বাইরের পকেটে ভরে নিলাম। অফিস যাওয়ার পথে দিয়ে যাব। ঘড়িটার এমন বন্ধ হয়ে থাকাটা আমার ভাল লাগছে না।
দোকানের সামনে পৌঁছে দেখলাম ছেলেটি সবে দোকান খুলছে। জিজ্ঞেস করলাম, “দম-দেওয়া ঘড়ি সারান?”
দোকান খোলার প্রারম্ভিক কিছু কাজ করতে করতেই ছেলেটি ঘাড় নেড়ে সায় দিল। বুঝলাম ছেলেটি স্বভাবগম্ভীর। কথা কম বলে। আমি ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বার করে বললাম, “দেখুন তো ভাই, ঘড়িটা চালু করা যায় কি না।”
ঘাড় উঁচিয়ে ঘড়িটাকে দেখে বল, “রেখে যেতে হবে, দেখে বলব।”
“আজ পাব তো ?”
“রেখে যান, চেষ্টা করব।”
ঘড়িটা ছেলেটার হাতে দিয়ে প্রায় দৌড়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।
সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার পথে অজয়কাকুর দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুজন খদ্দের দাঁড়িয়ে ঘড়ি দরাদরি করছিল। কাকু যে টেবিলে বসে কাজ করতেন, ঠিক তার উপরের দিকে দেওয়ালে টাঙানো কাকুর একটা জীবন্ত ছবি। মুখে স্মিত হাসি। যেন এক্ষুনি জিজ্ঞেস করবেন, “বাবা কেমন আছেন?”
পাশে টাঙানো একটা চাবি-দেওয়া পুরনো দেওয়াল ঘড়ি। বন্ধ। শোকেসের ভিতরে রাখা পঞ্চাশ-ষাটটা ঘড়ি। কোনওটা চলছে, কোনওটা বন্ধ। এক কোণে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। এই চেয়ারেই বাবা এসে বসত। কাকুর সঙ্গে গল্প করত।
খদ্দের সামলে ছেলেটি আমার কাছে এসে বলল, “চা খাবেন?”
আমি খানিকটা অবাক। সকালের সেই গাম্ভীর্যটা বেবাক উধাও! ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “ঘড়িটা দেখেছিলেন?”
ছেলেটি আবার গম্ভীর হয়ে পড়ল। বলল, “দেখেছি, পুরনো বিদেশি ঘড়ি। পার্টস অ্যাভেলেবল নেই। সারানো যাবে না।”
“ঘড়িটা কি কোনও ভাবেই চালানো যাবে না?”
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে জানাল ঘড়িটা আর চলবে না। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর কথা না বাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “তবে দিন ঘড়িটা।”
ছেলেটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একটু বিরক্ত হলাম। বললাম, “কী হল! ঘড়িটা দিন। অফিস থেকে ফিরছি, বাড়ি যেতে হবে।”
ছেলেটি শান্ত স্বরে বলল, “ঘড়িটা তো আর চলবে না, বিক্রি করবেন?”
ছেলেটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললাম, “বন্ধ ঘড়ি নিয়ে আপনি কী করবেন? তা ছাড়া ওই ঘড়িটার সঙ্গে আমার একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”
ছেলেটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলল, “আমারও।”
বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনার আবার কোন স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘড়ির সঙ্গে?”
ছেলেটা বলল, “এটা আমার বাবার ঘড়ি।”
আমি প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই ছেলেটা তার কথা সংশোধন করে বলল, “এই ঘড়িটার ব্যাক লিডে আমার বাবার নিজের হাতের সই রয়েছে। আড়াই বছর আগের। বাবা মারা যাওয়ার দু’দিন আগে সইটা করেছিলেন।”
কোনও কথা বলছি না দেখে ছেলেটি আবার অনুনয় করে বলল, “অয়েলিং করার সময় বাবা সই করে তারিখ দিয়ে রাখতেন। বোধহয় এটাই তাঁর শেষ অয়েলিং করা ঘড়ি। ঘড়িটা আমি কাছে রাখতে চাই। দাম নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
বললাম, “তুমি অজয়কাকুর ছেলে?”
ছেলেটা মাথা দুলিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে সামনে টাঙানো ছবিটার দিকে মুখ ফিরে দাঁড়াল। আমার কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছি না। বাবার এমন স্মৃতি কি কাউকে দিয়ে দেওয়া যায়? সামনে অজয়কাকুর ছবিটা এখন যেন উজ্জ্বলতর। আমি চোখ বুজলাম। সামনে বাবার মুখটা ভেসে উঠল। বাবা যেন বলছে, ‘আমি তো সময়কে পেরিয়ে এসেছি। এটার আর কী প্রয়োজন?’
কত ক্ষণ চোখ বুজে ছিলাম জানি না। হাতে একটা স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললাম। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “এটা কার ঘড়ি?”
“আমার বাবার, উনি মাসছয়েক আগে...”
ছেলেটার চোখ দুটো লাল। কোনও কথা না বলে ড্রয়ার থেকে ঘড়িটা বার করল। তার পর ঘড়িটা আমায় ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এর ঘুম আর কোনও দিন ভাঙবে না। তবু মাঝে মাঝে নিয়ে আসবেন, অয়েলিং করে দেব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy