ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
আচমকা ফোন বাজল মাঝরাতে। ঘুম ভাঙার পরেও ভ্যাবলা ভাব জড়িয়ে ছিল শিমুলের মগজের কোষে। শোনার আগেই শিমুল জানে, এটা কোনও দুঃসংবাদেরই সংকেত। সায়ন্তী বাপ্পা দু’জনেই বাইরে। নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কেউ। নিশ্চয়ই অ্যাক্সিডেন্ট। ফোনটা তুলতে গিয়ে শিমুল টের পেল, হাতটা কাঁপছে তিরতির করে। তিনুর গলা, ‘‘বড়দা, ছোটকাকা হঠাৎ... এই খানিক ক্ষণ আগে চলে গেল। আমরা যাচ্ছি। তুমিও চলে এস।’’
নিজের বৃত্তটি ঠিক আছে দেখে একটা আরাম ছড়িয়ে গেল শিমুলের শরীরের মধ্যে।
ভাবনাচিন্তা একটু গুছিয়ে নিয়ে শিমুল দেখল, খবরটা যথেষ্ট শোকাবহ হওয়া সত্ত্বেও সে তেমন শোকার্ত নয়। বরং এখন মাঝরাতে যা যা করতে হবে, সেটা ভেবে সে বেশি কাতর হয়ে পড়ছে। নিজেকে বড্ড ছোট মনে হল। বয়স হতে হতে অনুভূতি কমে যায় না কি! কে জানে? নয়তো নিঃসন্তান ছোটকাকা তার জন্য যা করেছেন, তার ঋণ কি কোনও দিন শোধ হবে?
খাট থেকে নামতে গিয়ে খ্যাঁচ করে কোমরে লাগল। মধ্যবয়সের রোগ জানান দিচ্ছে একটা একটা করে। শরীরটা বাঁকিয়ে-চুরিয়ে চলার মতো নমনীয় করে সে বাথরুমে ঢুকল। চোখেমুখে জল দিতে দিতে ভাবল, সে একা নয়, বাসব, তিনুরাও তো আছে। ছোটকাকার তারাই তো ছিল আপনজন। নির্জন ফ্ল্যাটে মাঝরাতে কোনটা আগে করবে, কোনটা পরে ঠিক করতে গিয়ে কোনওটাই হয়ে ওঠে না।
হু-হু করে গাড়ি ছুটছে। রাতের কলকাতা কেমন অচেনা মনে হয়। সায়ন্তী গিয়েছে বম্বে। অফিসের কাজ। বাপ্পা পুণেতে, ম্যানেজমেন্টের পাঠ নিতে। ওরা থাকলে শিমুল আর একটু মনের জোর পেত। একদম একা বলেই বোধহয় একটা ভয়, বা হয়তো ভয় না, একটা অস্বস্তি শিমুলকে ঘিরে আছে। সেটা কাটাতেই গাড়ির মিউজ়িক সিস্টেমটা অন করতে গিয়ে থমকাল সে। শ্মশানযাত্রার সঙ্গে গান কি যায়?
ছোটকাকার ফ্ল্যাট বাইপাসের ধারে নতুন গড়ে ওঠা আধুনিক এক আবাসনে। সিকিয়োরিটি আর অন্যান্য সব সুবিধের জন্য কয়েক বছর হল ওরা এখানেই। টাকা এখন এ দিকেই উড়ছে। লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট, মল, বাজার, হাসপাতাল নিয়ে এ দিকের কলকাতা কল্লোলিনীই বটে! শিমুল সব মিলিয়ে বোধহয় পাঁচ বার এসেছে। ছোটকাকার হার্টের অসুখটা ধরা না পড়লে বোধহয় এত বার আসা হত না। মধ্য কলকাতার চালচিত্রে জায়গাটা এখনও কেমন গ্রাম বলেই মনে হয় শিমুলের। বিশাল আলোকিত আবাসনের গা ঘেঁষে টালির বাড়ি, সাততারা হোটেলের পিছনে ঝোপঝাড়ে ভরা মাঠ, কংক্রিটের খাঁচার ফাঁকে হঠাৎ হেসে ওঠা দোফসলি জমি, বাইশ তলা বাড়ির পাশে শীর্ণ পুকুর জায়গাটার অতীত স্মৃতি ধরে রেখেছে।
ছোটকাকার ফ্ল্যাটের সামনে পরাগের এসইউভি। ছোটকাকিমার এই বোনপো খুবই করিৎকর্মা। সে যখন এসে গিয়েছে, তখন আর চিন্তা নেই। শিমুল খুবই নিশ্চিন্ত বোধ করে। বহুতল বাড়িটা একেবারে নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে। দুর্ঘটনার চিহ্ন হিসেবে এত রাতেও গেট খোলা, আর লিফ্টম্যান চোদ্দো তলার যাত্রীদের সেবায় তৎপর।
বসার ঘরে পরাগ আর বাসব। তিনুর বর আদিত্য মোবাইলে ব্যস্ত। ছোটকাকার ঘরে যাওয়ার আগে শিমুল ওদের কাছে এল। পরাগ শিমুলের পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে নেতাসুলভ গলায় বলল, ‘‘চিন্তার কিছু নেই। এভরিথিং হ্যাজ় বিন টেকেন কেয়ার অব। গাড়ি এসে যাবে এখনই। বডি ফেলে রাখার মানে হয় না। যা গরম পড়েছে! যাও, তুমি মাসির সঙ্গে দেখা করে এস।’’
শিমুলকে দেখে ছোটকাকিমা আবার প্রথম থেকে বললেন, যা নিশ্চয়ই আগে আরও তিন বার বলেছেন— ‘‘ভালই ছিলেন, নিয়ম মেনেই চলতেন, রাতে খাওয়ার পরেও সামান্য অস্বস্তি ছাড়া ঠিকই ছিলেন। একটা নাগাদ বাথরুমে গেলেন। তার পরেই হঠাৎ... ডাক্তারকে ফোন করার সময় পর্যন্ত পাওয়া গেল না। শিমুলের জেঠতুতো বোন তিনু কাকিমার মুখের সামনে গ্লাস ধরে বলল, ‘‘একটু জল খাও।’’
সায়ন্তীর অনুপস্থিতির জন্য শিমুলের নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। তিনুটা ভাগ্যিস এখন কলকাতায়! তার তো পায়ের তলায় সরষে। সারা ক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে শিমুল বাইরে এল। কেউ না জিজ্ঞেস করলেও কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে সে বাসবকে বলল, ‘‘ঠিক
এই সময়ে তোর বৌদি বাইরে! অফিসের কাজ।’’
পরাগের বউ গার্গী চা দিয়ে গেল সকলের হাতে। পরাগ বলল, ‘‘মাসিকে জোর করে একটু খাইয়ে দাও। সৎকার সমিতির গাড়ি আসতে এখনও দু’ঘণ্টা। সাতটার আগে কিছু হবে না।’’
তিনু চায়ের কাপ হাতে বাইরে এসে বলল, ‘‘কাকিকে একটু শুয়ে থাকতে বললাম। সেই রাত থেকে জাগা। ওরও তো বয়স হল সত্তরের উপর। আর পারছিল না।’’
বাসব বলল, ‘‘শিমুদা তুমিই তো মুখাগ্নি করবে?’’
‘‘আমি?’’
‘‘হ্যাঁ তুমিই। বংশের বড় ছেলে যখন...’’ কোনও রকম দ্বিধা, অনিশ্চিত ভাব পরাগের ধাতে নেই।
তিনু বলল, ‘‘এক দিক থেকে দেখতে গেলে আমরাই যা করার করছি, এটাই ভাল। আজকাল ছেলেমেয়েরা সব বাইরে থাকে। মারা গেলে বডি নিয়ে যা কাণ্ড! কেউ কোনও ডিসিশন নিতে পারে না। আমাদের ফ্ল্যাটের মিস্টার জোয়ারদার মারা গেলেন। ছেলে পৌঁছল চোদ্দো ঘণ্টা পরে। ক্রমাগত বরফ দিয়ে রাখা যে কী ঝামেলা!’’
‘‘কাকিমা একেবারে একা হয়ে গেলেন।’’
‘‘এই ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর একটা সুবিধে, সবাই বেশ খোঁজখবর করে। লোনলি ফিল করার চান্সই নেই। আমি তো আগে এসেছি। তখন অনেকেই ছিল। তার পরে বাসব এল। তখন সকলে বলল, এখন পরিবারের সঙ্গে থাকলেই ভাল। আমরা তো আছিই। দরকার হলেই জাস্ট ইন্টারকমে একটা খবর দেবেন।’’
‘‘এখানে তো নানা রকম কালচারাল প্রোগ্রাম হয়, মাসির কাছেই শুনেছিলাম।’’
‘‘ইদানীং কোনও একটা আশ্রমেও নাকি যাচ্ছিলেন, ছোটকাকাই বলেছিলেন। এটাও ব্যস্ত থাকার একটা খুব ভাল রাস্তা।’’
ভবিষ্যতের কর্তব্য হালকা হয়ে যাওয়ায় দলটা ক্রমশ নিশ্চিন্ত বোধ করে। তিনু এত ক্ষণ চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল, ‘‘কাজকর্ম মিটলে ছোটকাকিকে আমার কাছে নিয়ে যাব। ক’দিন থেকে আসুক। জায়গা বদলালে ভাল লাগবে। তার পর
তো নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই হবে নানান ভাবে।’’
পরাগ বলল, ‘‘গুড আইডিয়া। বোনপো, ভাইপোদের বাড়ি ঘুরে বেড়ালেই এক বছর কেটে যাবে। প্রথম বছরটাই যা ডিফিকাল্ট।’’
‘‘যা বলেছ। শুধু মনে হয়, গত পুজোতেও তো ছিল। গত জন্মদিনেও হইহই করেছিল। এক বছরের
যত উৎসব-অনুষ্ঠান, সবেতেই মনে পড়ে।’’
গার্গীর ক্ষতটা এখনও কাঁচা। দু’বছর হল মাকে হারিয়েছে সে।
আলোচনা সবই মৃত্যকে ঘিরে ঘুরছে। এদের সকলের বয়সই পঞ্চাশের আশেপাশে। সকলে অফিসের পরেই এসেছে। ক্লান্ত লাগলেও এই রকম সময়ে কেউই ঘুমিয়ে পড়ার কথা ভাবছে না। মাঝে মাঝে তাদের হাই উঠছে। চোখ টেনে আসছে। এই নিষ্কর্মা ক্লান্তিকর সময়টা তারা কোনও রকমে পার হওয়ার চেষ্টা করছিল।
পরাগের ড্রাইভার ফুল দিয়ে গেল। ছোটকাকার কপালে চন্দন পরিয়ে দিল তিনু। শিমুলের মনে হল, ফুল-চন্দন, আত্মীয়-স্বজনের জটলা, অবিকল বিয়ের দিনের মতো।
গাড়ি আসার খবরটা পরাগের ফোনে আসা মাত্র বিয়েবাড়িতে বর এসে যাওয়ার মতো তৎপরতা শুরু হল। ছোটকাকাদের সঙ্গে কম-বেশি অন্তরঙ্গতা যাদেরই আছে, সকলে এসে জড়ো হল একে-একে। শববাহক গাড়ির দুটো লোক এসেছে। শিমুল জিজ্ঞেস করল, ‘‘স্ট্রেচার কই? নেবেন কী করে?’’
লোক দুটো একে অপরকে দেখল। তার পর ওর মধ্যে যেটি মাতব্বর সে বলল, ‘‘স্ট্রেচারে স্লিপ করবে। চাদরে নিতে হবে।’’
গার্গী বলল, ‘‘লিফ্টেও তো আঁটবে না। ছোটকাকা প্রায় ছ’ফুট।’’
কী আশ্চর্য! এত ক্ষণ এই জরুরি কথাটা তারা ভাবেইনি। সকলে চুপ। একেবারে নীরব। তার পর ফিসফাস শুরু হল। গুনগুন ধ্বনি ক্রমশ গর্জনে পৌঁছলে পরাগই রাস্তা বাতলাল, ‘‘চেয়ারে বসিয়ে লিফ্টে করে নিয়ে যাব। একতলায় গিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো হবে।’’
শিমুল দেখল, পরাগের কথাটা শোনামাত্র চারদিক একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ছোটকাকার পাশের ফ্ল্যাটের মিস্টার শর্মা, যিনি আবার পারিবারিক বন্ধুও বটে, পরাগকে ডেকে গলাটা নিচু করে বললেন, ‘‘আপনি যেটা বলছেন, সেটা পসিবল নয় মিস্টার দত্ত।’’
‘‘কেন বলুন তো?’’
‘‘এটা রেসিডেনশিয়াল লিফ্ট। উই ক্যান নট অ্যালাউ আ ডেডবডি ইনসাইড।’’
এরা কি পাগল? পরাগ বহু কষ্টে নিজেকে সামলায়। সারা রাত জেগে শিমুলের মাথা টিপটিপ করছিল। অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে বলল, ‘‘ডেডবডি গেলে কী হবে? কোনও ছোঁয়াচে রোগও তো হয়নি। সিম্পল হার্ট অ্যাটাক।’’
একটি মোটাসোটা সালোয়ার-কুর্তা বলল, ‘‘বাড়ির বাচ্চারা এই লিফ্ট ব্যবহার করে। আমাদের পুজোর জিনিসপত্র, খাবারদাবার নিয়ে আমরা যাতায়াত করি। সেখানে ডেডবডি কেউ তোলে? কী করে আপনারা এটা সাজেস্ট করলেন?’’
বারমুডা বলল, ‘‘তা ছাড়া একটা পজিশনিংয়ের ব্যাপার আছে। আপনি বডি বাড়ি থেকে শুইয়ে বার করে আবার বসাতে পারেন না।’’
শিমুলের মনে হল, চারপাশের এই আধুনিক বাতাবরণ একটা মায়া। তারা আসলে অন্ধকার মধ্যযুগের থেকে এক পা-ও এগোয়নি।
হাতে লাল সুতোর গোছ বাঁধা এক জন বলল, ‘‘আপনারা কি জানেন না, ডেডবডির সঙ্গে ট্রাভেল করা শাস্ত্রে নিষেধ? আমরা দিল্লি থেকে ফিরছিলাম। ধানবাদের আগে এক জনের এই রকমই সিম্পল হার্ট অ্যাটাক হল। বডি সঙ্গে সঙ্গে খড়্গপুরে নামিয়ে দেওয়া হল। ডেডবডি নিয়ে কেউ ট্রাভেল করে না।’’
বাসবের মাথা গরম হয়ে গেল, ‘‘কোন শাস্ত্রে লিখেছে এমন কথা, শুনি এক বার?’’
‘‘এই রকম সময়ে প্লিজ় টেম্পার লুজ় করবেন না,’’ বারমুডা গলা যথাসম্ভব নরম করেই বলল।
‘‘আশ্চর্য তো!’’ পরাগ বহু কষ্টে রাগ চেপে জিজ্ঞেস করল, ‘‘আপনাদের এই ফ্ল্যাটে এর আগে কেউ মারা যায়নি?’’
‘‘শাড়ি, কুর্তা, পাঞ্জাবি সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘‘যাবে না কেন? অনেকেই গিয়েছেন, কিন্তু তারা হাসপাতাল থেকে এসেছিলেন। কমিউনিটি হল-এ ফ্যামিলি মেম্বারদের সঙ্গে উই অল পে আওয়ার লাস্ট হোমেজ। এই রকম কেঅটিক সিচুয়েশন হয়নি।’’
শিমুল তিনুকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তোদেরটাও তো মাল্টিস্টোরিড। জোয়ারদারের বরফ দেওয়া বডি নিয়ে কী করলি?’’
তিনু ফিসফিস করে বলল, ‘‘আমার ফ্ল্যাট গ্রাউন্ড ফ্লোরে। লিফ্ট ব্যবহার করার দরকার পড়েনি। কিন্তু দাদাভাই আমরা থাকি এগারো তলায়।’’
‘‘সেটা নিয়ে পরে ভাববি। এখন এখানে কী হবে?’’
পরাগের গলা চড়ছে, ‘‘তার মানে যদি কেউ বাড়িতেই মারা যায় অ্যান্ড ইফ দ্যাট পার্সন হ্যাপেনড টু স্টে অন টেন্থ ফ্লোর অ্যান্ড অ্যাবাভ, তাকে এই রকম ভাবে হ্যারাসড হতে হবে?’’
মিস্টার শর্মার গলা সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো নির্বিকার ও শান্ত, ‘‘উই হ্যাভ ফুল রেসপেক্ট টুওয়ার্ডস ডেথ। সে জন্যই কাজকর্ম ফেলে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আপনারাই শান্তি নষ্ট করছেন।’’
আর একটা গলা পিছন থেকে চাপা কিন্তু শুনতে পাওয়ার মতো, ‘‘হঠাৎ করে তো এত বাড়াবাড়ি হয় না। নিশ্চয়ই আগে থেকেই শরীর খারাপ হয়েছিল মিস্টার ঘোষের। টাইমলি হাসপাতালে নিয়ে গেলে এত ঝামেলা হত না। ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে কেসটা হয়তো ঘুরে যেত। শিয়ার নেগলিজেন্স। টাইমলি রিলেটিভরা সব হাওয়া।’’
রাগের চোটে তিনুর গলা কেঁপে যায়, ‘‘আপনারা কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন।’’
‘‘আপনারাই করাচ্ছেন।’’
শববাহক গাড়ির লোক এত ক্ষণ চুপ করে ছিল। এ বার তার মধ্যে এক জন বলল, ‘‘দাদা আমাদের ছেড়ে দিন। এক জায়গায় এত ক্ষণ হলে চলে? আপনাদের পরে যেতে হবে লেক গার্ডেন্স।’’
একটি প্যান্ট-শার্ট এগিয়ে এসে বলল, ‘‘আমাদের সঙ্গে চেঁচামেচি না করে এঁদেরই জিজ্ঞেস করুন, কী ভাবে ডেডবডি নিয়ে যায়। ওদের অভিজ্ঞতাই তো সবচেয়ে বেশি,
তাই না?’’
এই সময়ে ছোটকাকি বাইরে এসে পরাগ-শিমুলদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তোরা একটু ভিতরে আয়।’’
ফ্ল্যাটের অন্যদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বললেন, ‘‘এদের ক্ষমা করুন। লিফ্টের কথাটা এরা জানে না বলে মিছিমিছি এত গোলমাল হল। যা করার আমরা করছি।’’
গরম হাওয়ার জন্যই বোধহয় ভিড়টা একদম পাতলা হয়ে গেল। তা ছাড়া দিনের সঙ্গে সকলের কাজের চাকাও গড়াতে শুরু করেছে। এ দিকে যত ক্ষণ গোলমাল ছিল, ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সমবেতভাবে প্রতিরোধ তৈরি করার দায়িত্বও ছিল। সেটা যখন মিটেই গেল, আর তো থাকার কোনও মানে হয় না।
এরা কী করে দেখার জন্য দু’এক জন দাঁড়িয়ে রইল। ছোটকাকি বলল, ‘‘লোকদু’টোকে বেশি করে টাকা দিয়ে রাজি করা। এ ছাড়া তো আর উপায় দেখছি না।’’
পরাগ তাদের বলামাত্র তারা বলল, ‘‘টাকা তো দেবেনই। সকলেই দেয়। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব হাত না লাগালে এই লাশ আমরা দু’জনে মিলে চোদ্দোতলা থেকে নামাতে পারব? আপনারাই বলুন।’’
কথাটার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। পরাগ বলল, ‘‘আমি, শিমুল, আদিত্য, বাসব— আমরা চার জন। ফ্ল্যাটের কেউ আসবে বলে মনে হয় না। ওদের দু’জনের সঙ্গে পালা করে ধরতে হবে। আর কিছু করার নেই।
তিনু বলল, ‘‘আদিত্য বোধহয় পারবে না। স্লিপ ডিস্ক নিয়ে শয্যাশায়ী ছিল। ফিজ়িয়োথেরাপি করে সবে উঠেছে ও।’’
বাসব বলল, ‘‘চল, শুরু করে দিই। কথার পিঠে কথা আর ভাল লাগছে না।’’
চাদরে জড়িয়ে ছোটকাকার দেহটা নিয়ে শিমুল, পরাগ, বাসব আর শব বহনকারী একটি ছেলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। ঝলমলে আধুনিক আবাসনের অযত্নে পড়ে থাকা আধো অন্ধকার সিঁড়ি। এ দিক-ও দিক কুসংস্কারের মতো জমে আছে মাকড়সার জাল। শিমুল সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে ভাবছিল, সিঁড়িও তো জীবিতের চলাচলের পথ। অথচ এখানে বাধা নেই। লিফ্ট সুয়োরানি। আবাসনের গর্ব আর আদরের। সিঁড়ি যত অবাঞ্ছিত অভাজনের। চণ্ডীমণ্ডপের কাছ থেকে এই আবাসনগুলো খুব দূরে যেতে পেরেছে কি?
অনভ্যাসের দরুন খানিকটা বাদেই শিমুলের হাঁপ ধরে গেল। লম্বা করে নিশ্বাস নিতে নিতে সে ভাবল, ফ্ল্যাটবাড়ির উঁচু শিখরে নিজের ঘরে শুয়ে শেষ নিশ্বাস ফেলার মতো আহাম্মকি যেন আর কেউ না করে।
শেষ দেখতে না পাওয়া এক অনন্ত অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দলটা ক্রমাগত নীচের দিকে নেমে যেতে লাগল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy