Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

হস্তরেখায় বিপদ-আপদ

আজকের রাশিফল বলছে যে যাত্রাপথ শুভ। বাড়তি অর্থের আগমন হতে পারে, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

অনিন্দ্যবুকু চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

হাতের রেখাগুলোর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন সাধুবাবা।

শঙ্কিত মনে প্রশ্ন করে নীহার, ‘‘কী হল মহারাজ...অলক্ষণের কিছু দেখছেন না কি?’’

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন সাধুবাবা, ‘‘ঠিক অলক্ষণ নয়। তবে ফাঁড়া আছে সামনে। সাবধানে চলিস।’’

সে দিন থেকে অজানা এক আশঙ্কায় ভুগছে নীহার। কে জানে বাবা, কী অপেক্ষা করছে কপালে! এই সমস্ত ভাগ্যগণনা, ভাগ্যরেখা বিচারের ব্যাপারে বেজায় বিশ্বাস নীহারের। দিনক্ষণ মেনে, রাশিফল বিচার-টিচার না করে সে বাড়ি থেকে বেরয় না। এমনিতে তার যা পেশা, তাতে মাঝে-মাঝে তাকে দৌড়তে হয় এদিক-সেদিক। রেল দফতরে ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টরের পদে কর্মরত নীহার। রেলে নিয়োগ হওয়ার আগে কোনও ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছে গিয়ে তার সম্পর্কে পুরোদস্তুর খোঁজখবর নেওয়া, তার স্কুলে গিয়ে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট আদায় করা, তার পর লোকাল থানায় গিয়ে তার নামে কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কি না তা খতিয়ে দেখা— এ সমস্ত কাজই করতে হয় নীহারকে। কাজটা নেহাত কম ঝক্কির নয়। বিস্তর দৌড়োদৌড়ি করতে হয় এ কাজের জন্য। তবে এ কাজে বাড়তি অর্থের আমদানি আছে। যাকে নিন্দুকেরা ঘুষ বলে, নীহারের ভাষায় তা হল তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক। এত খেটেখুটে কারও সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে তার ভেরিফিকেশন ফর্মে ভালমন্দ কথা লেখা, এত দুরূহ কাজের পর সামান্য সম্মানদক্ষিণা পকেটে না ঢুকলে কী করে চলে! তাই আজকাল বুক চিতিয়েই এ সব ঘুষ-টুষ নিয়ে নেয় নীহার। তবে এতে তার শত্তুরদের কারও-কারও চোখ টাটায়। খুব ভাল করেই জানে নীহার, সুযোগ পেলেই এরা আছোলা পুরে দেবে তার পিছনে।

আজকের রাশিফল বলছে যে যাত্রাপথ শুভ। বাড়তি অর্থের আগমন হতে পারে, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এতগুলো ভাল-ভাল কথা দেখে বেরিয়ে পড়েছিল নীহার গাড়ি চেপে। অনেক দূর যেতে হবে আজ তাকে। সেই পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে সুদূর মুদিরপুরে। তাদের এই গোবিন্দহাটা থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে মুদিরপুর। পাহাড়ি রাস্তা। গাড়ি করে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। কিন্তু ভয়ানক এবড়োখেবড়ো রাস্তা, বাবা রে বাবা! যাত্রাপথ মোটেই শুভ নয় আজ। শ্লথগতিতে এগিয়ে চলেছে নীহারের গাড়ি। বিরক্তিভরা মুখে খবরের কাগজটা মুখের সামনে মেলে ধরল নীহার। প্রথম পাতার নীচে খবরটা দেখেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁক করে উঠল! ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধৃত সরকারি অফিসার।

ফলাও করে ছাপা খবরটা পড়তে শুরু করে নীহার। এ সব খবর এখন আর কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা নয়, বরং বলা চলে সিস্টেমের অঙ্গ। এই যে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে চলেছে নীহারের গাড়িটা, এটাও তো ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদারদের ঘুষ খাওয়ারই পরিণাম। স্মৃতিপথ বেয়ে বছরতিনেক আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় নীহারের। সে বারে সে নিজে ঘুষ খেয়ে জোর ফাঁসতে ফাঁসতেও একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিল। সে বারে এক নিয়োগপ্রার্থীর বাড়ি গিয়ে নীহার দেখেছিল, কোনও রকম ত্রুটিবিচ্যুতি নেই ছেলেটার রেকর্ডে। তবু ইনস্পেকশন করতে এতটা দূর আসা, কিছু একটা না নিয়ে গেলে কী ভাল দেখায়! তাই আকারে-ইঙ্গিতে ঘুষের দাবি করে বসল নীহার। ছেলেটাও টেঁটিয়া, বলা চলে সতীপনার পতাকাবাহক, কিছুতেই ঘুষ দিতে রাজি নয় সে। নীহারও নাছোড়, নানা ভাবে সে ভয় দেখায় ছেলেটাকে, ঘুষ না দিলে মিলবে না চাকরি। শেষে একটা রফা হল। কয়েকদিন বাদে ছেলেটা টাকা হাতে করে দিতে এল নীহারকে। আসার সময় সে খবর দিয়ে এসেছিল ভিজিলেন্সকে, যাতে টাকা নেওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় নীহার। তবে সেই পাতা ফাঁদ থেকে অল্পের জন্য পরিত্রাণ পায় নীহার। ষষ্ঠেন্দ্রিয় বাঁচিয়ে দিয়েছিল তাকে। ছেলেটার হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় কেমন একটা যেন আঁশটে গন্ধ পেয়েছিল সে, চক্রান্তের গন্ধ। তাই টাকাটা হাতে না নিয়েই স্থানত্যাগ করে সে। কিন্তু সেই নোটের বান্ডিলের উপর রয়ে যায় নীহারের আঙুলের ছাপ। সেই ছাপের সঙ্গে নীহারের আঙুল মিলিয়ে দেখার সুযোগ কোনও দিন পাননি ভিজিলেন্সের কর্তারা। কী ভাগ্যিস ছেলেটা চিনত না নীহারের অফিস! চিনলে কেলেঙ্কারির একশেষ হত সে বারে। তবে খচ্চর ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল নীহার। তার কলমের খোঁচায় সে বারে চাকরিটা পেতে পেতেও পেল না ছেলেটা।

দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রাপথ পেরিয়ে অবশেষে মুদিরপুর পৌঁছল নীহার। এ বারে যেতে হবে সিদ্ধার্থ সমাদ্দারের বাড়ি। সিদ্ধার্থ রেলে চাকরিপ্রার্থী। তারই নিয়োগের আগে ভেরিফিকেশন সংক্রান্ত কাজকর্ম মেটাতে এখানে নীহারের আগমন। বাড়িটা খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট করতে হল না। বেশ করিৎকর্মা ছেলে সিদ্ধার্থ। নিজের উদ্যোগেই সে স্কুল থেকে গিয়ে তুলে এনেছে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট। এমনকি ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে থানা থেকেও বার করে এনেছে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট। বিশেষ একটা খাটাখাটনিও করতে হল না নীহারকে। সিদ্ধার্থ তাকে খাতিরযত্নও করলে বেশ। দ্বিপ্রাহরিক ভোজটা বেশ ভালমন্দই হল। ছোকরা বেশ যত্ন করে আয়োজন করেছিল পোলাও আর খাসির মাংস। রেওয়াজ খারাপ ছিল না। খাওয়াদাওয়ার পর পানের ডিবেটা নীহারের দিকে এগিয়ে ধরে আলতো করে চোখ টিপল সিদ্ধার্থ, ‘‘আপনার কমিশনটাও রেডি করে রেখেছি স্যার... দশ হাজার ক্যাশ।’’

টাকার বান্ডিলটা চট করে ব্যাগের ভিতর চালান করে দিলে নীহার। আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বললে, ‘‘সামনের হপ্তায় হেডকোয়ার্টারে চলে এস... সব কাজ হয়ে যাবে।’’

সারাদিনটা আজ ভালয় ভালয় কাটলে কী হবে, ফেরার চিন্তাটা নাজেহাল করে দিচ্ছিল নীহারকে। সেই লজঝড়ে রাস্তা দিয়ে এতখানি পথ ফেরা, তার উপর আবার একা একা! একটা কথা বলার মানুষ থাকলে তাও না হয় কেটে যেত সময়টা! ঠিক তখনই কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল রাশিফলে লেখা কথাটা! পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

ফেরার পথে হঠাৎই নীহার দেখতে পেল যে, সৌম্য দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। সৌম্যকান্তি নীহারের ছেলেবেলার বন্ধু, তার ইস্কুলের সহপাঠী। কিন্তু এ কী বেশ সৌম্যর! পরনে গেরুয়া বসন, গলায় রুদ্রাক্ষমালা। সন্ন্যাসী বনে গেল না কি সৌম্যটা! গোবিন্দহাটায় ফেরার জন্য বাসের জন্য দাড়িয়ে ছিল সৌম্য। গোবিন্দের কৃপায় নীহারের গাড়িতে লিফ্‌ট পেয়ে গিয়ে ভালই হল তার। খোশগল্পে মেতে ওঠে দুই বন্ধু। আজ বহু দিন বাদে দেখা হল তাদের।

ফেরার পথেও ভয়ঙ্কর লাফাচ্ছে গাড়িটা। ভাঙা রাস্তার অত্যাচারে সৌম্যও প্রচণ্ড বিরক্ত, ‘‘কী হাল করে রেখেছে দেখেছিস... সুষ্ঠুভাবে চলাচলের কোনও উপায় নেই। আসলে কী জানিস, সব ঘুষখোর অফিসারের দল কাটমানি পাওয়ার নেশায় তিন নম্বরি মালপত্র দিয়ে বানাচ্ছে রাস্তাঘাট। এখন আমজনতাকে পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে।’’

বিজ্ঞের মতো সম্মতিসূচক গ্রীবা দোলায় নীহার। বন্ধুর মন রাখতে দু’-একটা চোখা চোখা গালও দিয়ে দেয় সে ঘুষখোরদের নামে। এ রকম টুকিটাকি কথাবার্তার ফাঁকে ধীর লয়ে এগোচ্ছিল গাড়িটা। হঠাৎ এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটল! বিশ গজ সামনে আচমকা একটা বোল্ডার খসে পড়ল পাহাড় থেকে। গাড়িটা আর-একটু এগিয়ে গেলেই বিশাল একটা অঘটন ঘটে যেত। ভাঙা রাস্তাটা শাপে বর হল এক দিক থেকে। ভাগ্যিস গাড়িটা আস্তে চলছিল তাই! সময়ের সামান্য উনিশ-বিশ হলেই হয়তো ঘাতক বোল্ডারটা ভেঙে পড়ত তাদেরই মাথায়। জ্যোতিষীর করা ভবিষ্যদ্বাণী হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় নীহারের। মরণ ফাঁড়া বুঝি কেটে গেল এই ছুতোয়।

তবে ফাঁড়া যে অত সহজে পিছু ছাড়ে না তা অচিরেই বুঝতে পারল নীহার। তত ক্ষণে তারা পৌঁছে গিয়েছে গোবিন্দহাটায়। শহরের এই অংশে সারি-সারি সরকারি আবাসন। তারই একটার সামনে গাড়ি থামাতে বললে সৌম্য। গাড়ি থেকে নেমে হাসিমুখে সে এসে দাঁড়ালে দরজার সামনে, ‘‘তোকে আসল খবরটাই দেওয়া হয়নি নীহার... একটা ভাল চাকরি পেয়েছি জানিস! ভিজিলেন্স দফতরে। তারই একটা কাজ সেরে এলাম এখন... এ বারে কোয়ার্টারে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে তার পর রিপোর্ট করতে যাব অফিসে।’’

একটা চোরাস্রোত শিঁরদাড়া বেয়ে নেমে গেল যেন! নীহারের হাত-পা ঘামছে কুলকুল করে। সৌম্য ভিজিলেন্স অফিসার! তা হলে তার এই বেশ! নীহারকে কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে ফের বলে চলে সৌম্য, ‘‘আসলে কাজের প্রয়োজনীয়তাতেই এই ছদ্মবেশ ধারণ... এক স্বনামধন্য অপরাধীর পিছনে দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে ছিল আমাদের দফতর। কিন্তু কিছুতেই ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনা যাচ্ছিল না তাকে... এতটাই সেয়ানা লোকটা।’’

এখনও পর্যন্ত এক বারও উল্লেখ করেনি সৌম্য, সেই অপরাধী কে। তবু নিজের পরিণতিটা যেন মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিল নীহার। দুনিয়াটা যেন বনবন করে ঘুরছে তার চোখের সামনে; সৌম্যর কথাগুলো অস্পষ্টভাবে এসে ঢুকছে কানে, ‘‘লোকটা কেবল তার পদমর্যাদার জোরে সাধারণ লোকেদের ঠকিয়ে এসেছে এত দিন ধরে। জানিস... নির্মম জল্লাদের মতো পকেট কেটেছে গরিব মানুষের। এমনকি তার বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ আছে যে, সে ঘুষ নিয়েও চাকরি দেয়নি অনেক লোককে। চাকরি দেওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার পর ঘুষ দিতে রাজি হয়নি বলে যোগ্য ক্যান্ডিডেট, ক্লিন রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও চাকরি পায়নি, ভাবতে পারিস কেমন শয়তান লোক! এমন চার্জ দেব ওর বিরুদ্ধে, জীবনে কোনও দিন জেল থেকে ছাড়া পাবে না। এত দিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম ওর আঙুলের ছাপটার জন্য, আজ কায়দা করে সেটা পেয়ে গেলাম।’’

খুব অসুস্থ বোধ করছে নীহার। গলা শুকিয়ে কাঠ। হঠাৎ সে দেখল , এক দল সাদা উর্দিধারী পুলিশ এগিয়ে আসছে তার গাড়ির দিকে। জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী এমন ভাবে সত্যি হয়ে গেল তা হলে! পুলিশের দল এগিয়ে এসে বললে সৌম্যকে, ‘‘চলুন স্যর, বড়সাহেব অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য।’’

হেসে হাত নাড়ায় সৌম্য, ‘‘চলি রে... ভাল থাকিস, আবার দেখা হবে।’’

স্থাণুবৎ চেয়ে থাকে নীহার তার চলে যাওয়া পথের দিকে। ভারী দ্বিধার মধ্যে রয়েছে সে। নিছক হুমকি দিয়ে তাকে কি এক রকম করুণা করল তার এক কালের বন্ধু, নাকি তার মতো এমন অধম জীব আরও বাস করে এই পৃথিবীতে! ‘আবার দেখা হবে’ বলে কি আসলে বলতে চাইল যে, আবার দেখা না হওয়াই নীহারের পক্ষে ভাল!

ঠিক বুঝতে পারে না নীহার।

এই নিয়ে দ্বিতীয় বার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল তির। কথায় বলে বার বার তিন বার। ফাঁড়াটা কি কাটল তা হলে... না কি...

গাড়ির ঝাঁকুনি আর তেমন গায়ে লাগছে না। ওয়ার্নিংগুলোর কথা ভাবছে আর কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরছে নীহার।

অন্য বিষয়গুলি:

Anindyabuku Chattopadhyay Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy