ছবি: শুভম দে সরকার
মেসেজটা ক’দিন ধরেই আসছে। প্রথম দিকে গা করেননি। কিন্তু আজ সকাল থেকে তিন বার একই মেসেজ আসার পর জগদীশের মনে হল, দেখাই যাক না! খোঁজ নিতে দোষ কী!
ফোনের বোতামে আঙুল ছোঁয়ানোর আগে আর-একবার পড়লেন— ‘নিঃসঙ্গ? বন্ধু খুঁজছেন? বন্ধু পেতে ফোন করুন...’
পড়তে পড়তে নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। তাই ওই অবধি যাওয়ার দরকার হল না।
সকাল সাড়ে দশটা। কাগজ পড়া শেষ। অঘ্রানের রোদ আর রেলিংয়ে বসা শালিক পাখিটা ছাড়া আর কোনও বন্ধু চোখে পড়ল না।
কানে যন্ত্র লাগাতেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘‘বলুন...’’
‘‘আপনাদের বিজ্ঞাপন। টেক্সট মেসেজ...’’
‘‘আগামী রবিবার। স্বর্ণময়ী স্টেডিয়াম। বেলা একটায়। কাইন্ডলি হাতে সময় নিয়ে আসবেন।’’
ফোন কেটে গেল।
স্বর্ণময়ী স্টেডিয়াম! কোথায় যেন!
বেলা একটা। খারাপ নয় সময়টা। জগদীশের অসুবিধে হবে না। কিন্তু হাতে সময় নিয়ে আসবেন! কতখানি সময়? আগে না পরে?
চিন্তা মাথায় নিয়ে স্নান করতে উঠলেন জগদীশ।
পৌঁছে বুঝতে পারলেন, কেন সময় নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। কাউন্টার থেকে এঁকেবেঁকে লাইন মাইলখানেক এগিয়ে গিয়েছে।
এত নির্বান্ধব লোক! তার মধ্যে মহিলারাও রয়েছেন।
আর বয়স? ষোলো থেকে আশি, কে নেই!
একবার ভাবলেন ফিরে যাবেন।
তার পর মনে হল, ফিরে যাবেনটা কোথায়? কেউ কি তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে? দরজা খুলে বলবে, ‘‘এত দেরি করে ফিরলে? চিন্তা হচ্ছিল। একটা ফোন করেও তো...’’
দোনোমোনো করে শেষ অবধি দাঁড়িয়েই পড়লেন লাইনের শেষে। এবং যত দেরি হবে ভেবেছিলেন, তার চেয়ে অনেকটাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলেন কাউন্টারে।
গিয়ে দেখলেন, সব কিছুই হচ্ছে একেবারে পেশাদারি দক্ষতায়। এক পাশে রেজিস্ট্রেশন। সেখানে তিনশো টাকা জমা দিতে হচ্ছে। সেই রিসিট দেখালে পাওয়া যাচ্ছে একটা ব্যাজ, প্লাস্টিকের একখানা ফোলিয়ো ব্যাগ। শেষে একজন মণিবন্ধে বেঁধে দিচ্ছে একটা ব্যান্ড।
‘‘কী জিনিস এটা?’’
প্রশ্ন করতে সহাস্যে উত্তর পেলেন, ‘‘ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড।’’
সামনেই প্রবেশপথ। ভিতরে ঢুকে হকচকিয়ে গেলেন।
এ কোথায় এসে পড়লেন?
সারি সারি স্টল। প্রত্যেকটায় গিজগিজ করছে মানুষ। বলে না দিলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না, এরা প্রত্যেকেই নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত।
একটা স্টল সামান্য ফাঁকা। দেখে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে দেখে সাগ্রহে ওয়েলকাম করলেন কাউন্টারের সেলসম্যান, ‘‘আসুন, আসুন। দেখে যান আমাদের প্রোডাক্ট। বাজারের এক নম্বর জিনিস।’’
‘‘দেখান আপনাদের প্রোডাক্ট।’’
ক্যাটালগ বের করলেন সেলসম্যান, ‘‘এখানে যাদের দেখছেন, প্রত্যেকেই কোনও না কোনও মাসাজ পার্লারের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটিই নামী প্রতিষ্ঠান। মাত্র একটি ফোন কলের দূরত্বে। ফোন করলেই এসে হাজির হবে। ঘণ্টাপিছু পারিশ্রমিক। যত ক্ষণ খুশি রাখতে পারবেন... নাইট সার্ভিসও আছে।’’
ক্যাটালগের পাতা উল্টে এগিয়ে যাবেন, সেলসম্যানটি কাছে এগিয়ে এল। কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘‘এখনও তো অন্য ক্যাটালগটা দেখানোই হয়নি। ওটায় সব মহিলা। ডিফারেন্ট এজ। কী পোশাক প্রেফার করবেন? ফর্মাল, না সুইমস্যুট?’’
‘‘থ্যাঙ্ক ইউ,’’ বলে পরের স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন জগদীশ।
এখানে ভিড় একটু বেশি। ঠেলেঠুলে তার মধ্যেই সেঁধিয়ে গেলেন জগদীশ।
চোখে ঠুলি শুনেছেন। এখানে কানে ঠুলি। ইয়ারফোন। যন্ত্র লাগালেই কানে গান। যার যেমন পছন্দ। ভজন থেকে জীবনমুখী। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে কালোয়াতি। শুনে টিক মেরে দিলেই চলবে। গায়ক বা গায়িকা স্বয়ং পৌঁছে যাবেন বাড়ি। গানের পসরা সাজিয়ে বসে পড়বেন। গানের গুঁতোয় একাকিত্ব পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
জগদীশ চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করলেন। গান কি তাঁর নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারবে? বরং গান কি আসলে নিঃসঙ্গতাই দাবি করে না? সমস্ত জাগতিক আকর্ষণ ত্যাগ করে তবেই না গানের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়!
ঘাড় নাড়লেন জগদীশ। না, এটাও তাঁর পছন্দের জায়গা নয়। এগিয়ে গেলেন।
এ বারে বই। পড়ার নয়, শোনার। ফের ইয়ারপ্লাগ। কেউ কবিতা আবৃত্তি করছেন, কেউ বা শোনাচ্ছেন গল্প। গল্পও হরেক রকম। কোনও গল্প শুনতে শুনতে হাসিতে ফেটে পড়ছে মানুষ। কেউ বা গল্পের রসে বুঁদ হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রূপকথা থেকে থ্রিলার। যার যেমন চয়েস। পছন্দটা বলার অপেক্ষা। বাকিটুকু স্টল কর্তৃপক্ষই বুঝে নেবেন। অনন্ত সাহিত্যচর্চা। নিঃসঙ্গতার ভূত না নেমে উপায় আছে?
ক্লান্ত লাগছিল জগদীশের। মনে হচ্ছিল, অনেক হয়েছে, আর নয়। তবু একটা স্টলে ভিড় অন্যগুলোর তুলনায় বেশি বলে গুটিগুটি এগিয়ে গেলেন। দেখাই যাক না, যদি মনের মতো কিছু পাওয়া যায়!
এখানে একেবারে অন্য অ্যাপ্রোচ। ফুচকা থেকে ঝুরিভাজা, অমৃতি থেকে রসমালাই, কী নেই! নিখরচায় টেস্ট করার সুযোগ। অনেকে একটু একটু চেখেই পেট ভরিয়ে ফেলছে। পছন্দ হলে অর্ডার। সার্ভ করতে স্বয়ং মাস্টারশেফ হাজির হয়ে যাবেন। রসনার তৃপ্তি! একাকিত্বেরও নিবৃত্তি। এর চেয়ে ভাল উপায় পাবেন কোথায়?
অনেকেই পছন্দের খাবারে টিক দিচ্ছে। জগদীশও খেতে ভালবাসেন। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা প্রাণভরে খেলেই মনের দৈন্য ঘুচবে? নিশ্চিত হতে না পেরে এগিয়ে গেলেন।
চারদিকে স্টল। মাঝখানে গোল করে সাজানো কয়েকটি চেয়ার। তাঁর মতো আরও যারা ঘুরে ঘুরে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, জিরোবার জন্য এখানেই এসে বসছে। একটা খালি চেয়ার দেখে বসলেন জগদীশ। পা দুটো টান করে দিলেন সামনে।
তখনই, পাশের মানুষটার দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলেন। খুব চেনা! অথচ ঠিক চিনে উঠতে পারছেন না। সেই মানুষটিও তাঁর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
হঠাৎ অপরিচয়ের কুয়াশা সরিয়ে সেই ব্যক্তি তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল, ‘‘জগা না? চিনতে পারছিস? আমি কেষ্টা।’’
‘‘কেষ্টা তুই?’’ উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন জগদীশ, বললেন, ‘‘তোর চুল কোথায় গেল? মাথাজোড়া টাক! আমি চিনতেই পারিনি!’’
‘‘কেমো। সব চুল তাতেই উঠে গিয়েছে। আর তুইও কি সেই আগের জগা আছিস? কলপ করলেই বয়স ঢাকা যায়? চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। সামনের একখানা দাঁত পড়ে গিয়ে মুখের ভোলই বদলে গিয়েছে। আয়নায় নিজেকে দেখিস, আগের চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই তফাত বুঝতে পারবি।’’
হাত ধরাধরি করে চেয়ার টেনে একটু ফাঁকায় গিয়ে বসলেন দু’জনে। জগদীশ থেকে যেমন জগা, হরেকৃষ্ণ থেকে তেমনই কেষ্টা। জগা-কেষ্টা হরিহর আত্মা। ক্লাসের সবাই তেমনই জানত। পাশ করার পর, কেষ্টার বাবার বদলির চাকরি, যশিডি বা গিরিডি কোথায় যেন বদলি হয়ে গেলেন, সেই থেকে ছাড়াছাড়ি।
‘‘সত্যি, কত দিন পর বল তো?’’
‘‘দাঁড়া, হিসেব করে বলছি... ঠিক বাহান্ন বছর পর দেখা হল। তাও চিনতে আমার ভুল হয়নি, কী বলিস?’’
কৃতিত্বটা কেষ্টাকেই দিলেন জগদীশ। জানতে চাইলেন, ‘‘কোথায় থাকছিস?’’
‘‘গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া কোঅপারেটিভ হাউজ়িং। তুই?’’
‘‘বেহালা, সরশুনা। নাম শুনেছিস?’’
‘‘হ্যাঁ। জানি তো। বাস যায়।’’
‘‘কে-কে আছে বাড়িতে?’’
‘‘একা। বিলকুল একা। না হলে এখানে আসি? বউ চলে গেল গত সেপ্টেম্বরে। স্ট্রোক। ছেলে আমেরিকায়। শিকাগো। শীতকালে ও দেশে ভীষণ ঠান্ডা। তখন আসে। বলে তোমাকে দেখতে এলাম। এক মাস থাকলে আঠাশ দিনই শ্বশুরবাড়িতে কাটায়।... তোর?’’
‘‘প্রায় তোরই গল্প। বউয়ের ক্যানসার। ধরা পড়তেই দেরি হয়ে গেল। চিকিৎসা হয়েছিল, লাভ হয়নি। মেয়ে দুবাই। আগের বার এসে গলা জড়িয়ে বলে গিয়েছে, ‘দুবাইয়ে সোনা তো সস্তা, তোমার জন্য একখানা সোনা বাঁধানো নকল দাঁত তৈরি করিয়ে দেব।’ ’’
হা-হা করে হাসলেন দু’জনে। হাসতে-হাসতেই হরেকৃষ্ণ বললেন, ‘‘ললিপপ! বুঝেছিস না, ললিপপ! ভুলিয়ে রাখতে চায় বুড়ো বাবাকে।’’
জগদীশ বললেন, ‘‘ক’দিন আগে অসিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অসিতকে মনে আছে তোর?’’
‘‘থাকবে না! সেই জগজ্জ্যোতিবাবুর ক্লাস, কালীবাবু ছাতা ফেলে গিয়েছিলেন... কালীবাবু সব সময় ছাতা সঙ্গে করে ক্লাসে আসতেন, কেন বল তো?’’
‘‘এক বার ছাতা হারিয়ে ফেলেন, মনে হয় বাড়ি গিয়ে ধাতানি খেয়েছিলেন। সেই থেকে ছাতা টিচার্স রুমেও রেখে আসতেন না।’’
‘‘তাই হবে। তা কার ছাতা, জগজ্জ্যোতিবাবু জানতে চাইলে অসিত বলেছিল, বোমকালীবাবুর!’’
‘‘আমরা তো সবাই মুখ আড়াল করে হাসি চাপতে ব্যস্ত। মনে হয়, জগজ্জ্যোতিবাবুরও হাসি পেয়ে গিয়েছিল। তবু মুখ গম্ভীর করে বলেছিলেন, শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইদের সম্বন্ধে ও রকম কথা বলতে নেই।’’
‘‘আমার কী মনে হয় জানিস! অসিত তো খুব সাদাসিধে ছিল, আর সিক্সে ভর্তি হয়েছিল সবে, কালীবাবুকে যে আমরা সবাই বোমকালীবাবু বলে ডাকতাম, সেটা ও জানত না। ভেবেছিল, সত্যিই স্যরের নাম বোমকালী।’’
‘‘তবে জগজ্জ্যোতিবাবু জানতেন, ছেলেরা আড়ালে কালীবাবুকে বোমকালীবাবু বলে ডাকে। আর অসিত যে সেটা না জেনেই জগজ্জ্যোতিবাবুকে বলেছে, সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কোনও শাস্তি দেননি অসিতকে।’’
‘‘কী করছে রে অসিত?’’
‘‘অল্প সময়ের জন্য দেখা, বিশেষ কথা হয়নি। ফোন নম্বর নিয়েছি। যোগাযোগ হলে জানাব।’’
‘‘তোর নম্বরটা দে। আমি ভাল দেখতে পাই না। সেভ করে দে।’’
দু’জনের মোবাইলে পরস্পরের নম্বর সেভ করা হল। জগদীশ দেখলেন, কেষ্টার ফোনটা তাঁর ফোনের মতোই। বেসিক সেট।
‘‘স্মার্টফোন এখনও নিসনি দেখছি! এখনও ব্যাকডেটেডই
রয়ে গেলি?’’
‘‘স্মার্ট আর হলাম কবে যে স্মার্ট ফোন নেব!’’
দু’জনে দুলে-দুলে হাসতে লাগলেন। কথায়-কথায় কত ক্ষণ কেটে গিয়েছিল খেয়াল ছিল না। হঠাৎ নজরে পড়ল, হল খালি। তাঁদেরই দেখছে আয়োজকরা।
হাত ধরাধরি করে বাইরে বেরোলেন দুই বন্ধু। বাসস্টপ অবধি এক সঙ্গে গেলেন। জগদীশ জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘যাবি কিসে? একা একা যেতে পারবি?’’
‘‘বাসে। পেনশনের টাকায় কি ট্যাক্সির বাবুয়ানি হয়? আর এলাম কী করে একা? ঠিক পৌঁছে যাব, চিন্তা করিস না।’’
কলকাতায় সন্ধের আলো। আজ ছুটির দিন, বাসে ভিড় কম।
হরেকৃষ্ণ চেপে ধরলেন জগদীশের হাত, ‘‘কী ভাল যে লাগল! ফোন নম্বর রইল, যোগাযোগ রাখিস। ভুলে যাসনি যেন!... সত্যি সময়টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল!’’
অন্য হাতের উল্টো পিঠে চোখের কোণে জমে ওঠা জল মুছে নিলেন হরেকৃষ্ণ। নাক টানলেন শব্দ করে।
কেষ্টার শীর্ণ হাতের আঙুল জগদীশের মণিবন্ধে চেপে বসেছে। একটা হারিয়ে যাওয়া উষ্ণতা ছড়িয়ে যাচ্ছে হাত থেকে হাতে। কেষ্টার হাতের উপর হাত রাখলেন জগদীশ।
‘‘ভাবিস না। কালকেই ফোন করব তোকে।’’
বাস এসে গিয়েছিল। ধরে ধরে তুলে দিলেন বন্ধুকে। যত ক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়, দু’জনের দৃষ্টি ছুঁয়ে রইল দু’জনকে।
বাসটা চলে যেতেই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন জগদীশ।
আরে! ঢোকার সময় একটা ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড বেঁধে দিয়েছিল না আয়োজকরা?
মণিবন্ধের ঠিক উপরে, যেখানে একটু আগে হাত রেখেছিল কেষ্টা!
কখন খুলে পড়ে গিয়েছে ব্যান্ডটা! খেয়ালই করেননি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy