Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

টিকিট

সকাল-বিকেল প্রতি ব্যাচে খানদশেক ছেলেমেয়ে, একতলার বড় ঘরটায় মাদুর পেতে দিব্যি ক্লাস চলে রোজ, শুধু রবিবার বাদ। এই একটা দিন নিজের জন্য বরাদ্দ। অঙ্কের মাস্টার হিসেবে নামডাকও মন্দ হয়নি পরাশরের।

ছবি: সৌমেন দাস

ছবি: সৌমেন দাস

সুদীপ সরকার
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:৩০
Share: Save:

শীতের হালকা রোদে হাঁটতে খারাপ লাগছিল না। স্টেশনে যাওয়ার রাস্তাটায় অন্য সময় ভিড় থাকলেও দুপুরে বেশ ফাঁকা। পরাশর খেয়েদেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। অনেক দিন পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে নৈহাটিতে, মিনতিকে নিয়ে ফিরবে কাল। মিনতির অনেক গঞ্জনা আর ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মনস্থ করেছে পরাশর। স্কুলের চাকরি আর প্রাইভেট টিউশন করে সময় কোথায় তার বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর! সকাল-বিকেল প্রতি ব্যাচে খানদশেক ছেলেমেয়ে, একতলার বড় ঘরটায় মাদুর পেতে দিব্যি ক্লাস চলে রোজ, শুধু রবিবার বাদ। এই একটা দিন নিজের জন্য বরাদ্দ। অঙ্কের মাস্টার হিসেবে নামডাকও মন্দ হয়নি পরাশরের। ডাক্তারির মতোই, এই পসার জমাতে কম খাটতে হয়নি ওকে। কাজকর্ম শিকেয় তুলে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মানে তো এক প্রকার বিলাসিতাই বটে।

******

বাসরাস্তা থেকে মিনিট চার হাঁটলেই খড়দা স্টেশন। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল পরাশর। বছর কয়েক আগেও এই সব এলাকা আজকের মতো ছিল না। খাটাল থেকে আরম্ভ করে ছোট সাইকেল সারানোর দোকান— কত কিছুই না ছিল রাস্তার ধারে ধারে। সে সব সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেহারা পাল্টেছে এলাকার। সময় বোধহয় সব কিছুই পাল্টে দেয়, মানুষও পালটে যায় সময় বুঝে, যারা পারে না, তারা হারিয়েও যায় বিবর্তনের নিয়ম মেনে। স্টেশনের গেট দেখা যাচ্ছে এ বার। পরাশর একটু পা চালাল, ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে বোধহয়। লেভেল ক্রসিং-এ গেট পড়ে আছে। ট্রেন আসার ঘোষণা শুনতে পেল পরাশর— রানাঘাট লোকাল ঢুকছে, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে। পরাশর হুড়মুড়িয়ে স্টেশনে ঢুকল, এক বার আড়চোখে টিকিট কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল, মাত্র দুটো লোক লাইনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ট্রেন ঢুকে পড়ল বলে, পরাশর সোজা প্ল্যাটফর্মে উঠে এল। টিকিট না কাটার বহু পুরনো অভ্যেসটা মাথার ভিতরে নড়াচড়া করতে লাগল। নিজের মনেই যুক্তি সাজাল পরাশর, টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়ালে ট্রেনটা অযথা মিস হত। আর ভারী তো খানচারেক স্টেশন, দুপুর বেলার ফাঁকা গাড়ি। কুছ পরোয়া নেহি!

******

ট্রেন ঢুকল প্ল্যাটফর্মে। কামরাগুলো বেশ ফাঁকা। পরাশর ট্রেনে উঠে জানালার ধারে একটা সিটে বেশ গুছিয়ে বসল। আহ্‌! এই রকম সিট মানে যেন লটারি পাওয়া। কলেজে যাওয়ার সময় কতই না ধস্তাধস্তি করে যেতে হত। প্রথম ক্লাসটা কত দিন যে মিস হয়েছে। পরে বিকাশ বা তরুণের কাছ থেকে নোট নিয়ে মেক-আপ করা। টিকিট না কাটার যুক্তিটা যতই মজবুত হোক না কেন, ভিতরে একটা চোরা অস্বস্তি যেন রয়েই গিয়েছে। হাজার হোক, এখন তো সে আর কলেজের ছাত্র নেই যে টিকিট না কাটলেও সাত খুন মাফ! তবু তো কত বার বিনা টিকিটে সে ট্রেনে উঠেছে।

পরাশরের চেহারা বেশ স্মার্ট। আর সেটার সুবিধে সে নিয়েছে। চেকারের সামনে দিয়েই বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কতবার। আর এ তো দুপুরের ফাঁকা ট্রেন। ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যায় একটার পর একটা স্টেশন। সামনের সিটের মহিলার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল পরাশরের, মাঝে মাঝে। বেশ সুশ্রী। সদ্য বিবাহিতা হবে, পাশের ছোকরাটা বোধহয় ওর স্বামী। পরাশর মনে মনে তুলনা করতে থাকে। মিনতি এর চেয়ে কম সুন্দরী নয়, প্রায় ছ’বছর হল বিয়ে হয়েছে মিনতির সঙ্গে পরাশরের। এখনও আগের মতোই আকর্ষণীয় আছে। শুধু একটু মোটা হয়েছে আগের চেয়ে, তাতে অবশ্য লাবণ্য বেড়েছে বই কমেনি।

ঠান্ডা হাওয়ায় নিশ্চিন্ততায় একটু ঝিমুনি আসছিল। শ্যামনগর স্টেশন পেরিয়ে গেল। কোথা থেকে দু’জন কালো কোট পরা টিকিট চেকার এসে উদয় হল কামরায়। পরাশরের বুকের ভিতরটা কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। দুপুরে ফাঁকা ট্রেনে চেকার কোথা থেকে এল রে বাবা! ইস, খুব ভুল হল, কত বার ভেবেছে এই শেষ, তাও আবার সেই একই কাণ্ড করেছে। কী জানি, হয়তো একটা রোমাঞ্চ আছে এই টিকিট-ছাড়া রেল ভ্রমণে। কিন্তু, এখন কী হবে? সামনের মহিলার দিকে এক বার তাকাতে ইচ্ছে করল পরাশরের। কিন্তু খানিক ক্ষণ পরে কী হতে পারে ভেবে মুখ ঘুরিয়ে সোজা তাকাল জানালার বাইরে। বড় বড় জলা, ছোট ছোট ঘরবাড়ি পেরিয়ে, দুলে দুলে, ঝিকঝিক করে ট্রেন ছুটছে নিজের মেজাজে। যা হবে দেখা যাবে, মনে সাহস এনে পরাশর তাকিয়ে থাকল জানালা দিয়ে, যেন কিছুই হয়নি। কালো কোট টিকিট দেখতে দেখতে এগিয়ে আসে। পরাশর, পালাও!

“টিকিট দেখাবেন প্লিজ়,” ঠান্ডা গলা কালো কোটের।

পরাশর পকেটে হাত ঢোকায়, খুঁজতে থাকে টিকিট। ডান পকেট ছেড়ে বাঁ পকেট। তার পর পিছনের পকেট। অবাক দক্ষতায় খোঁজ চালাতে থাকে পরাশর। কয়েক জোড়া চোখ তত ক্ষণে ওর দিকে তাকিয়ে। ও লোকজনের দিকে না তাকালেও, সবাই যে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে তা ভালই বুঝতে পারে ও। কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই পরাশরের চোখে-মুখে।

“কী হল? টিকিটটা দিন এ বার,” বিরক্তি প্রকাশ করে কালো কোট।

“পকেটেই ছিল, মনে হচ্ছে রুমাল বার করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে,” আক্ষেপের সুরে বলে পরাশর।

“নো প্রবলেম, ফাইন দিয়ে দিন,” চালান-বই বার করে কালো কোট।

মহিলার দিকে এক বার তাকায় পরাশর। কপালে বোধহয় একটু ঘাম, সপ্রতিভ ভাবটা অটুট রেখেও স্নায়বিক চাপ অনুভব করে ও।

“টিকিট কাটার পরও ফাইন দিতে হবে? সামান্য পাঁচ টাকার জন্য কি টিকিট কাটব না? অযথা হয়রানির মানে কী?” ক্ষোভ উগরে দেয় পরেশ।

“ও রকম হয় দাদা, আমারও এক বার হয়েছিল মেচেদা লাইনে। কী করবেন, কেউ তো বিশ্বাস করবে না,” স্বগতোক্তি করে মহিলার ছোকরা স্বামীটি।

কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম আরও বাড়তে থাকে পরাশরের। এ বার আর বোধহয় পার পাওয়া গেল না। ফাইন দিয়ে তবু মান রাখাই শ্রেয় মনে হল সপ্রতিভ পরাশরের। মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে এগিয়ে ধরল কালো কোটের দিকে, “নিন, রসিদ কাটুন। আমার নাম পরাশর, পরাশর দত্ত।”

২৫১ টাকার ফিরতি দিয়ে রসিদ লিখতে শুরু করলেন চেকারবাবু। ভিতরে ভিতরে চূড়ান্ত আক্ষেপ সত্ত্বেও পরাশর কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। ঘাড় ঘোরানো লোকগুলো উৎসাহ হারিয়ে, আবার জানালার বাইরে তাকাতে শুরু করেছে। নিজের ভিতরে এ বার একটা বিদ্রোহের খোঁচা অনুভব করল। এতগুলো টাকা যখন গচ্চা গেলই, কথা তো একটু শোনানো যেতেই পারে।

“অত্যন্ত অবিচার হল এটা, বৈধ যাত্রী হয়েও হেনস্থা হলাম। আমি এক জন শিক্ষক, এই ভাবে অপমানিত কখনও হইনি,” পরাশর ক্ষোভ জানাল মৃদু স্বরে।

কালো কোট কি একটু হোঁচট খেল? রসিদ লিখতে লিখতে কি একটু হলেও হাত কাঁপল ওর? পরাশর লক্ষ করতে চেষ্টা করল। না, কিছু বলল না কালো কোট। চুপচাপ রসিদ ধরিয়ে এগিয়ে গেলেন চেকারবাবুটি। পরাশর নিশ্চিন্তে বসে আবার তাকাল বাইরের দিকে। এ সব কথা মিনতিকে বলা যাবে না, খুব বকুনি দেবে। নিজের উপরেই রাগ হল, কেন যে টিকিট না কাটার রিস্ক নিতে গেল! ফালতু ফালতু ২৪৯ টাকা খসল। একে আগুনে বাজার, তার উপর শুধু শুধু গচ্চা গেল এতগুলো টাকা। যাক গে। এত লোকের সামনে সম্মান নিয়ে টানাটানি হওয়া থেকে যে বাঁচা গিয়েছে, এই অনেক। ভাগ্যিস পাঁচশো টাকার নোটটা পকেটে ছিল, না হলে যে কী হত, ভাবলে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। আজকাল তো এটিএম থেকে টাকা তোলার সুবিধে আছে বলে বেশি টাকা পকেটে রাখাই হয় না।

******

ভাবতে ভাবতে নৈহাটি চলে এল। বেশ লম্বা লাইন পড়েছে গেটের মুখে। পরেশ নেমে এল ট্রেন থেকে। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল ওভারব্রিজের দিকে, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম হয়ে ফেরিঘাটের রাস্তা ধরবে। ট্রেন থেকে বহু মানুষ নেমেছে, এত ভিড়ের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। কে যেন পিছন থেকে ডাকল মনে হল, “স্যর, এক মিনিট!”ট্রেনের হেনস্থার পর থেকেই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, পরাশর নিজের খেয়ালেই এগিয়ে চলে ভিড় ঠেলে। আবার কেউ ডাকল মনে হল, “স্যর একটু দাঁড়ান প্লিজ়।”

“ফাইন তো দিয়েছি, তার পরেও হেনস্থা করবেন না কি?” মনে মনে বলে পরাশর। ওভারব্রিজে ওঠার মুখে এসে ঘুরে দাঁড়ায়, মনে সাহস আনার চেষ্টা করে।

“কী ব্যাপার? আবার কী বলছেন? ফাইন তো দিলাম, এ বার কি অ্যারেস্ট করবেন না কি?” বিরক্তি প্রকাশ করে পরাশর।

“স্যর কিছু মনে করবেন না প্লিজ়, আমারই ভুল হয়েছে আপনাকে ফাইন করা। আপনি এক জন শিক্ষক মানুষ, টিকিট কাটবেন না সেটা হতেই পারে না। আমার বাবাও স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন। আপনাদের দেখানো পথেই তো সবার পথ চলা। আপনি দয়া করে রসিদটা ফেরত দিন,” বলল কালো কোট পরা
চেকার বাবু।

পরাশর কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা ঘোরের মতো একটা মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রসিদটা ফেরত দিল। কালো কোট ২৪৯ টাকা ফেরত দিল পরাশরকে, “কিছু মনে রাখবেন না স্যর, ভুল তো সবারই হয়,” আবার বলল কালো কোট।

টাকা ফেরত নিয়ে পরাশর হাঁটা দিল। ওভারব্রিজ পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল। ঘোরটা যেন কাটতে চাইছিল না। ঠিক-ভুল, সততা-দুর্নীতি, ইচ্ছে-অনিচ্ছা, সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে মাথার ভিতর। সোজা হাঁটতে শুরু করল পরাশর শ্বশুরবাড়ির দিকে। মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে নিয়ে, বোধহয় ঘাড়টাও একটু নুয়ে এল তার সঙ্গে।

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy