Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

তিস্তা একটি মেয়ের নাম

রাস্তার উপর রেল লাইনের পাশেই ছিল দোকানটা। সুস্বাদু মোমো পাওয়া যেত, তার সঙ্গে চা। ময়দার আবরণের ভিতর স্কোয়াশ কিংবা চিকেনের পুর দেওয়া মোমো এখন তো সব জায়গায় পাওয়া যায়।

ছবি: বৈশালী সরকার

ছবি: বৈশালী সরকার

আজিজ আহমেদ
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে পড়ে মেথিবাড়ি। সুকনা মিলিটারি ক্যাম্পের কিছুটা আগে সেই জায়গা। ওই পুরো এলাকাটা আমার চেনা ছিল। কিন্তু সে তো অনেক বছর আগে। প্রায় দশ বছর পার হয়ে গিয়েছে। তবুও গতকাল সন্ধে থেকে একটা দমকা হাওয়া আমার স্মৃতির দরজায় এসে বারবার আছড়ে পড়ছে। মনে রাখার মতো তো কিছুই ছিল না। তবুও সব কিছু চোখের সামনে ভাসছে মেয়েটিকে দেখার পর থেকে। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো, সত্যিই কি এই সেই মেয়েটি?

রাতে ভাল করে ঘুমাতে পারিনি। এত ভোরে উঠি না কোনওদিন। আজ রবিবার। বাবা-মার সঙ্গে আমার মেয়েও ঘুমোচ্ছে। ঘুমাক আর একটু। শান্ত সকালের মৃদু ঠান্ডা হাওয়া এই বারান্দায় মনকে আরও বেশি অশান্ত করে তুলছে কেন জানি না। কাগজের খবরে মন নেই। কফিটাও একটু বেশি তেতো লাগছে। কাল সন্ধেবেলা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলবিন্দর ফোন করে বলেছিল, ‘‘স্যর কাজটা হয়ে গেছে। যদি পারেন তো একবার এসে দেখে যান।’’

গিয়েছিলাম কর্নাটপ্লেস পুলিশ স্টেশনে। বাকিদের ভিড় ছাপিয়ে এক গভীর দৃষ্টিতে দেখছিল মেয়েটি আমাকে। হয়তো বোধহয় চেনার চেষ্টা করছিল আমাকে। আমি কথা বলিনি। অন্য কেসের ফাইলে ব্যস্ত করে নিয়েছিলাম নিজেকে। কিন্তু এখন তো কোনও ব্যস্ততা নেই। তবে সেই মুখটা কেন এত অস্থিরতা ছড়াচ্ছে আমার মধ্যে।

আর্মিতে চাকরি পাওয়ার পরের বছরই বদলি হয়ে গেলাম উত্তরবঙ্গে। দার্জিলিং যাওয়ার পথে পড়ে সুকনা মিলিট্যারি ক্যাম্প। থাকতাম সেখানে। বছর দশেক আগে, তখন আমার, সাতাশ-আঠাশ বছর বয়স। দিল্লিতে মানুষ হয়েছি, তাই বোধ হয় জায়গাটা বেশ ভাল লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, অন্য জায়গার চেয়ে বেশ আলাদা। দূরে পাহাড়, পিছনে সুকনা ফরেস্ট আর চায়ের বাগান, সামনের রাস্তা দিয়ে দিনে দু’বার টয়ট্রেনের কু-ঝিকঝিক... অসাধারণ দৃশ্য। প্রতিদিন বিকেলে সহকর্মীর সঙ্গে টয়ট্রেনের লাইন ধরে হেঁটে বেড়াতাম। কিছুটা দূরে মেথিবাড়ির লোকালয়ে একটা দোকানে প্রায় চা আর মোমো খেতে যেতাম।

রাস্তার উপর রেল লাইনের পাশেই ছিল দোকানটা। সুস্বাদু মোমো পাওয়া যেত, তার সঙ্গে চা। ময়দার আবরণের ভিতর স্কোয়াশ কিংবা চিকেনের পুর দেওয়া মোমো এখন তো সব জায়গায় পাওয়া যায়। কিন্তু আমি তখন খেয়েছিলাম জীবনে প্রথম বার। কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা আর পুদিনার চাটনির সঙ্গে। সেই স্বাদ যেন এখনও জিভে লেগে আছে। তবে ওই দোকানে প্রতিদিন যাওয়ার পিছনে আরও একটা কারণ ছিল। তা হল, নেপালি বুড়ো দোকানদারের মেয়েটি। বাবা আর মেয়ে মিলে দোকানটা চালাত। মেয়েটি বেশ সুন্দরী। বয়স আঠেরো-ঊনিশের মধ্যে। মেয়েটির কিন্তু পুরোপুরি নেপালিদের মতো দেখতে ছিল না। বাবা নেপালি হলেও মা হয়তো বাঙালি ছিল। বাংলা এবং নেপালি দুটো ভাষাতেই কথা বলতো মেয়েটি। কাঠের তৈরি দোকানটার ভিতরে কয়েকটা বেঞ্চ আর প্লাস্টিকের টেবিল ছিল। অর্ডার দিলে মেয়েটিই খাবার নিয়ে আসত। আমরা কয়েকজন ওদের রোজকার খদ্দের ছিলাম। মোমো আর চা খেতে খেতে গল্পে গল্পে অনেকটা সময় ওখানে চলে যেত। মেয়েটি আমাদের ডাকত মিলিটারিবাবু নামে। এমন করে কাটছিল দিনের পর দিন। বলতে বাধা নেই, অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করতাম ওই দোকানটার প্রতি। ওই মেয়েটিকে আমার বেশ ভাল লাগত। মেয়েটির মধ্যে কোনও জড়তা ছিল না। সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলত। যাকে বলে মিষ্টি স্বভাবের ছিল সে। শুনেছি পড়াশোনাও জানত কিছুটা। বুড়োর স্ত্রী ঘরের ভিতরই থাকত। অসুস্থ ছিল সে। বুড়োর আর একটি মেয়ে ছিল। ওই মেয়েটির চেয়ে ছোট। পুরো সংসারের হাল এক অর্থে মেয়েটিকেই ধরতে হয়েছিল দোকানটা চালিয়ে। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই দোকানে যত নেপালি ছেলে-ছোকরাদের ভিড় তা ওই মেয়েটির জন্য। দেখতাম, আমার তিনটে মোমো খাওয়া হলে ও আবার আমার প্লেটে চাটনি দিয়ে যেত। ও লক্ষ করেছিল, তিনটে মোমো খাওয়ার পর আমার প্লেটে চাটনি খতম হয়ে যায়। প্লেটে আবার চাটনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসত। ওই হাসিটা প্রতিবারই ভাল লাগত। আমাদের মধ্যে কথা হত, তবে বেশ কম। এক জন দোকানির সঙ্গে খুব বেশি আর কী কথা হতে পারে। খুব শান্ত দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকাতো, আর সেই দৃষ্টির ভাষা বোঝার জন্য আমিও ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ফলাফল যদিও শূন্য ছিল। ব্যাপারটা সহকর্মীদের নজর এড়িয়ে যেত না। ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তারা কথার ছলে মেয়েটির কথা তুলে আমাকে নিয়ে মজা করত। আমি গুরুত্ব না দিয়ে চলে যেতাম। ব্যস ওখানেই গল্প শেষ হয়ে যেত।

দেড় বছর পর বদলি হয়ে গেলাল জম্মুতে। যত দূর মনে পড়ে শেষ দিন এক বার গিয়েছিলাম ওই দোকানে। জানি না কিসের টানে। হয়তো মেয়েটিকে একবার দেখার জন্য। দেখে ফিরে এসেছিলাম। বলে আসিনি যে, তোমার দোকানে মোমো খেতে আমি আর আসব না। বলে আসার প্রয়োজন বোধও করিনি। মেয়েটির নামও আমার জানা হয়নি।

তার পর সময়ের পিঠে চড়ে পার করেছি অনেকগুলো বছর। কখনও সময় চড়েছে আমার পিঠে। ঠিক সময়ে বিয়ে করেছিলাম। ঠিক সময়ে বাবাও হয়েছিলাম। দিল্লিতে বাবা মার সঙ্গে স্ত্রী আর মেয়েকে রেখে পড়ে থাকতাম জম্মুতে। ওদের জন্য মন কেমন করত। তার পর ভগবান এক দিন হঠাৎ স্ত্রীকে ডেকে নিলেন নিজের কাছে। মেয়ের বয়স তখন বছর চার। স্ত্রীর অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে বাবা-মা আর মেয়ের কাছে ফিরে এসেছিলাম সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইতি টেনে।

মেয়েকে আগলে-আগলে রাখতাম। তখন আমিই ওর মা আমিই ওর বাবা। এ ভাবেই কয়েকটা বছর পার হল। মেয়ে বড় হল। আস্তে আস্তে একা হলাম। বোরড হতাম ঘরে বসে বসে। পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাকরিও জুটিয়ে ফেললাম একটা। স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ, দিল্লি পুলিশ। আর সেই সূত্রেই এই এত বছর পর আবার সেই মেথিবাড়িতে। কাল সন্ধেবেলা পুলিশ স্টেশনে হঠাৎ সেই মোমোর দোকানের মেয়েটিকে দেখে মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের ঝড় উঠছে।

মোবাইলটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলাম সকাল ভালই হয়েছে। মেয়ে আজ দাদুর
সঙ্গে সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছে। ফোনটা ছিল বলবিন্দরের। ‘‘হ্যালো’’ বলতেই বলবিন্দর বেশ উদ্বিগ্নতার সঙ্গে বলল, ‘‘গুডমনিং স্যর। একটা খারাপ খবর আছে। কাল কমলা মার্কেটের সেক্স র‌্যাকেট থেকে যে মেয়েগুলোকে আমরা অ্যারেস্ট করেছিলাম তাদের মধ্যে এক জন রাতে আত্মহত্যা করেছে। হাতের শিরা কেটেছে। একটা নোটও আছে। বাঁচার সম্ভবনা কম। আমরা হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আপনি একবার আসবেন প্লিজ?’’

জানি না কেন আমি হাসপাতালে না গিয়ে পুলিশ স্টেশনে গেলাম। হয়তো নোটটা দেখার জন্য। বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি আনচান করছিল। জানার জন্য মন ছটফট করছিল, ওদের মধ্যে কোন মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে? আমার মন বলছিল মোমো-দোকানি। অনুমান সত্যি হল। বলবিন্দরের কাছ থেকে সুইসাইড নোটটা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। পড়তে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে এক অস্থিরতায় আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছিলাম না। আমার আগে বাকিরা কি সবাই এ নোট পড়ে ফেলেছে! জানার প্রয়োজন ছিল না। আমার কথা মতো ড্রাইভার এখন বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছে। আমি চলেছি হাসপাতালে। মেয়েটির সঙ্গে এক বার অন্তত কথা বলতে চাই। গাড়িতে বসে চিঠিটা আবার পড়ার চেষ্টা করলাম।

******

মিলিটারি বাবু,

আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। কিন্তু আমি আপনাকে চিনেছি। আসলে আমি তো আপনাকে ভুলিইনি কোনওদিন। এত বছর পর এই ভাবে আপনাকে দেখতে পাব ভাবতে পারিনি। আমি একটা বোকা মেয়ে। কোথায় আমি আর কোথায় আপনি। তবুও প্রতিদিন বিকেলে অপেক্ষা করেছি আপনার জন্য। বুঝতে পারিনি, আমাকে দেখার জন্য আপনি আর কোনওদিনই দোকানে আসবেন না। আপনাকে খুব ভাল লাগতো আমার। ভালবেসে ফেলেছিলাম আমি। সে কথা বলতে পারিনি কাউকে। আপনাকে তো নয়ই।

শীতের রাতে এক দিন বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা থেকে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল কয়েকজন। রেপ করে চা বাগানের মধ্যে ফেলে রেখে গিয়েছিল। চিনতে পেরেছিলাম দলের পান্ডা শয়তানটাকে। রাজু ছেত্রি। আমাদের পাড়ার ছেলে। সবার কাছে বাবার নাম খারাপ হল। জোয়ান মেয়েকে দোকানে বসিয়ে বাবা ধান্দা করছে এমন অপবাদও জুটল। গ্রামের লোকেরা বাবাকে মারধোর করে আমাদের দোকান বন্ধ করে দিল। অসুখে ভুগে ভুগে বাবাও মারা গেল। আমার বিয়ে তো দূরের কথা আমার বোনকেও বিয়ে করতে চায়নি কেউ। রাজু বলেছিল সে আমাকে বিয়ে করবে, শহরে গিয়ে চাকরি করবে, আমাদের অভাব আর থাকবে না। বিশ্বাস করেছিলাম। আমি তো বোকাই ছিলাম। দিল্লিতে নিয়ে এসে রাজু আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তার পর বিক্রি হয়েছি অনেক বার। পালাতে পারিনি কারণ রাজু আমার মা আর বোনকে মেরে ফেলার ভয় দেখাত। ওর চোখ এখন আমার বোনের উপর।

আপনাকে এসব কথা কেন বললাম জানি না। তবে বুকটা একটু হালকা হল। পুলিশ রাজু ছেত্রিকে অনেক দিন ধরে খুঁজছে। ওর আসল ঠিকানা কেউ জানে না। জি বি রোডের আটষট্টি নম্বর বিল্ডিংএ ওকে পেয়ে যাবেন। ওকে শাস্তি দেবেন দয়া করে। আমার বোন ও বোনের মতো আরও অনেক মেয়েদের জীবন প্রতি দিন নষ্ট করে চলেছে রাজুদের মতো লোকেরা। ভবিষ্যতেও করবে। আমার জীবনের আর কোনও মূল্য নেই। রাজু ধরা পড়লে কিছুটা মূল্য পাবে এই জীবন। আমার এই নোংরা মুখ নিয়ে আপনার জেরার সাম্মুখীন হতে পারব না। আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করছি না। আপনি ভাল থাকবেন মিলিটারিবাবু।

ইতি

মোমো দোকানি।

******

‘‘স্যর আমরা পৌঁছে গেছি...স্যর..স্যর...’’ ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরল আমার। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলাম হাসপাতালের ভিতর। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। আমার পরিচয় দিলাম। মেয়েটির অবস্থার কথা জানলাম। অনেক রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে। তবুও ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। অনেক শক্তি সঞ্চয় করে ধীর পায়ে মেয়েটির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাঁচের ভিতর দিয়ে ডাক্তার আর নার্সরা ওকে ঘিরে আছে। হয়তো শেষ চেষ্টা চলছে। ভিতরে ঢোকার অনুমতি না নিয়েই গিয়ে দাঁড়ালাম মেয়েটির সামনে। সেই চেনা মুখ। সেই চেনা চোখ। তবু যেন সব কিছু অচেনা লাগছে। এক মলিন দৃষ্টিতে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এত ক্ষণ বোধ হয় ও আমারই জন্য বেঁচে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে খুব ধীর গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘‘মিলিটারি বাবু...’’

ডাক্তার আমাকে বাইরে চলে যেতে বলছিলেন। আমি গেলাম না। মেয়েটির কপালে আলতো করে হাত রেখে, মুখটা কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তোমার নাম কি?’’ একটা ক্ষীণ হাসির চেষ্টা, তার পর উত্তর,‘‘আমার নাম তিস্তা।’’

জীবনে প্রথমবার নিজের চোখের সামনে কাউকে চিরতরে চলে যেতে দেখলাম। জীবনে প্রথম বার একটি মেয়ের জন্য নিজের চোখে তিস্তা বইতে দেখলাম।

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy