ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: অর্কপ্রভ সেনকে যেমন আহিরী ছাড়েনি, তেমনই সে কলেজের টিচার-ইন-চার্জ শর্মিষ্ঠা দত্তকেও ছাড়বে না বলে ঠিক করেছে। কিন্তু সকাল থেকেই তার মাথা গরম। মা বিয়ে নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে, অর্জক নামের আমেরিকাবাসী এক ছেলেকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে।
নবনী মেয়ের সঙ্গে আলাপ করালেন। খেতে খেতে দু’জনের কথা হল। বেশির ভাগটাই দেশ–বিদেশের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে। এখানকার ভাল ছেলেমেয়েরা কেন টিচিং প্রফেশনে আসতে চাইছে না, তাই নিয়ে আলোচনা। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে, কলেজে চাকরি পেতে পেতে অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে। মাঝখানে নেট পাশ করে, গবেষণা শেষ করতে হবে। তার পর কলেজ সার্ভিস পরীক্ষা। স্কুলেও তাই। বিএড-এ চান্স পেতেই দু’টো বছর লেগে যায়। পাশ করে বসে থাকো, কবে স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা হবে। ইন্টারভিউ, রেজাল্ট, পোস্টিং নিয়ে লম্বা সময়ের ব্যাপার। কোন ছেলেমেয়ে এতটা সময় বসে থাকবে? কাঁহাতক স্কলারশিপের সন্ধানে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়? এর সঙ্গে তো ধরা-করা আছেই।
এই বিষয়ে আহিরী–অর্জক দু’জনেই মোটের ওপর একমত হল। তবে একেবারেই শুকনো, কেজো কথা। আহিরী যে খুব কিছু বলেছে এমনটাও নয়, অর্জকই বলছিল। বাইরে থাকলেও সে দেশের খবর রাখে। আহিরীর বেশ ভাল লাগল। ছেলেমেয়েরা বাইরে গেলে, দেশের কিছু নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে চলতি বিষয় নিয়ে হালকা কমেন্টস দেয়, নয়তো জোকস্ ফরোয়ার্ড করে। এই ছেলে একটু আলাদা মনে হচ্ছে।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। সমস্যা শুরু হয়েছে তার পর থেকে। এই সামান্য সময়েই অর্জক আহিরীকে পছন্দ করে ফেলেছে। সাধারণ পছন্দ নয়, বাড়াবাড়ি ধরনের পছন্দ। এক দিনের আলাপে এতটা পছন্দ অবশ্যই ‘বাড়াবাড়ি’ বলে আহিরীর মনে হয়েছে। তবে নবনী এই খবর জানার পর এত খুশি হয়েছেন যে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। অর্জকের মায়ের অবস্থাও পাগল-পাগল। পাগল হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলে শেষ পর্যন্ত ‘মনের মতো মেয়ে’ খুঁজে পেয়েছে বলে কথা। মেয়েও রূপে-গুণে ছেলের যোগ্য। আমেরিকা পৌঁছে এই মেয়ে অনায়াসে স্কাইপে তার মায়ের কাছ থেকে হাতে-কলমে বড়ি-শুক্তো, সজনে ডাঁটা, মাছের ঝোল রান্না শিখে নেবে। কিচেনে ল্যাপটপ রেখে দেখে নেবে, কেমন করে বড়ি-শুক্তোয় ফোঁড়ন দিতে হবে, সজনে ডাঁটায় কতটা নুন–মিষ্টি লাগবে, মাছের ঝোলে কত ক্ষণ ঢাকা লাগবে।
এ দিকে অর্জক ফিরে গেছে পোর্টল্যান্ডে, রেখে গেছে আহিরীর কাছে গোপন বার্তা— ‘‘তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যদি কোনও দিন ইচ্ছে হয়, আমাকে কল করবেন। এই আমার ফোন নম্বর। আমি অপেক্ষা করব। সম্পর্ক এমন একটা অনুভূতি যা কোনও কিছু দিয়ে মাপা যায় না। সময় দিয়ে তো নয়ই। তাই খুব অল্প সময়ের জন্য আপনার সঙ্গে আলাপ হলেও আমি অপেক্ষা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাকিটা আপনার সিদ্ধান্ত।’’
অর্জক কোথা থেকে মোবাইল নম্বর পেল? মা’কে জিজ্ঞেস করে স্পষ্ট জবাব পায়নি আহিরী। সে নিশ্চিত, এ কীর্তি মায়ের। নবনী মেয়েকে চাপ দিতে শুরু করেছেন। কখনও ঠান্ডা মাথায়, কখনও রেগে। আহিরী সামলে চলেছে। কিন্তু কত দিন পারবে বুঝতে পারছে না। এত দিন বলে আসছিল, আগে চাকরিতে সেট্ল করবে, তার পর বিয়ের কথা। চাকরির এক বছর হয়ে গেল। ফলে সেই অজুহাত আর চলছে না। এ দিকে বিতানের কথা বাড়িতে এখনও জানাতে পারেনি আহিরী। সমস্যা আছে। বিতান ঠিকমত কোনও কাজকর্ম করে না। তার ওপর বয়সে তার থেকে প্রায় দেড় বছরের ছোট। বাবা মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু প্রায়-বেকার কাউকে মেয়ের জন্য মেনে নিতে নিশ্চয়ই মনে মনে কষ্ট পাবে। মানুষটা এই কষ্ট যাতে না পায় তার জন্য আহিরী অপেক্ষা করে আছে। বিতান ঠিকঠাক একটা কাজ পাক। মা অবশ্য বেকার এবং কম বয়স, দু’টোর একটাও মানবে না। তবে এ সবের থেকেও বড় সমস্যা বিতান। আহিরীর মনে হয়, বিতান নিজে দ্বিধায় রয়েছে। কনফিউজড। যদিও বিয়ের কথা তার সঙ্গে কখনও হয়নি। তার পরেও বোঝা যায়, ছেলেটা এক ধরনের সংশয়ে আছে। আহিরীর মতো মেয়েকে বিয়ে করবার মতো যোগ্যতা তার আছে কি না, এই নিয়ে সংশয়।
আহিরী নিজে না বললেও নবনী তার মেয়ের সঙ্গে বিতানের যোগাযোগের খবর রাখেন। কানে খবর এসেছে, তার অধ্যাপিকা মেয়ে এক জন ওঁচা ছেলের সঙ্গে মিশছে। তিনি ঠারেঠোরে মেয়েকে প্রায়ই বলেন, ‘‘ভুল সঙ্গী বাছাই জীবনের সবচেয়ে বড় গোলমাল। বেমানান, অযোগ্য সঙ্গী নিয়ে কেউ কোনও দিন সুখী হয়নি। কেবল আপশোসই করতে হয়েছে।’’
আহিরী রেগে গিয়ে বলে, ‘‘মা, তুমি কি কলেজ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে আমাকে হেঁশেল ঠেলতে বলছ? সেটাই আমার জন্য ঠিক হবে? কোনও আপশোস থাকবে না?’’
নবনী থমথমে গলায় বলেন, ‘‘হেঁশেল ঠেলতে হবে কেন? ও দেশে কলেজ-ইউনিভার্সিটি নেই? সেখানে বাঙালি ছেলেমেয়েরা পড়ায় না? আমেরিকায় গিয়ে কেরিয়ার করা, নাকি এখানে অভাব-অনটনের সংসার করা, কোনটা আপশোসের সেটা নিজেই বিচার করো। বিচারবুদ্ধি করার মতো শিক্ষা তোমাকে আশা করি আমরা দিতে পেরেছি।’’
আজও ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে এক কথা শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ সময়েই এই ঘ্যানঘ্যানানি আহিরী কানে ঢোকায় না। নিজের মতো ভাবনাচিন্তা চালায়। যাকে বলে প্যারালাল থিকিং। আজ দুম করে মাথাটা গেল গরম হয়ে। শর্মিষ্ঠা দত্তর জন্য আগে থেকেই তেতে ছিল। মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে বেড়ে গেল। শুরু হল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়।
নবনী বললেন, ‘‘এ বার একটা কিছু ফাইনাল কর। ছেলেটা কত দিন অপেক্ষা করবে?’’
আহিরী বলল, ‘‘মা, আমি তো কাউকে অপেক্ষা করতে বলিনি।’’
‘‘এ রকম করে বলছিস কেন আহি? অর্জক তো কোনও অন্যায় করেনি।’’
আহিরী বলল, ‘‘আমিও তো কোনও অন্যায় করছি না। কাউকে অপেক্ষা করতে বলিনি, শুধু সেই কথাটাই বলছি।’
নবনী বললেন, ‘‘অবশ্যই অন্যায় করছিস। এত ভাল একটা ছেলে, মাথা কুটলে পাবি?’’
আহিরী বলল, ‘‘মাথা কুটে দেখব পাই কি না। তবে এখন তো কুটতে পারব না মা। এগারোটা থেকে কলেজে পরীক্ষার ডিউটি। পর পর চার দিন ডিউটি দিয়ে টিচার-ইন-চার্জ আমাকে টাইট দিচ্ছে। এর আগেও এই কাণ্ড করেছে।’’
নবনী বললেন, ‘‘তুই কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস আহি? আমি বলছি বিয়ের কথা, আর তুই বলছিস পরীক্ষার ডিউটি!’’
আহিরী বলল, ‘‘হ্যাঁ করছি। রোজ এক কথা বললে ঠাট্টা ছাড়া আর কী করব? সিরিয়াস মুখে আলোচনাসভা বসাব? আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি এখন বিয়ে করব না। তুমি তাও বলে যাচ্ছ।’’
‘‘তিরিশ বছর বয়েস হয়ে গেল, তার পরেও কেন বিয়ে করবি না জানতে পারি? বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে গেছে। এই বয়েসে আমার বিয়ে তো কোন ছার, তুই হয়ে হঁাটতেও শিখে গেছিস।’’
আহিরী বলল, ‘‘কী করা যাবে মা, সবাই তো সমান নয়। আমার ছেলেপুলে হলে তারা না-হয় কিছু দিন পরেই হাঁটতে শিখবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ডেস্টিনেশনে পৌঁছনো নিয়ে কথা। তাড়াহুড়ো করে খরগোশের কী হাল হয়েছিল মনে নেই?’’
নবনী থমথমে গলায় বললেন, ‘‘ফাজলামি বন্ধ কর। কেন বিয়ে করবি না জানতে পারি?’’
‘‘না, পারো না। মা, তিরিশ কেন, এখন যদি আমার বয়স তিরানব্বইও হয়, তা হলেও আমি বিয়ে করব না।’’
নবনী গলা তুলে বললেন, ‘‘চুপ কর। এটা তোর কলেজ নয়, আমিও তোর ছাত্রছাত্রী নই যে যা বলবি শুনতে হবে। তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু জানি না? সব জানি। জানি তুই কেন এই বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না । জেনে রাখ, আমিও আটকাব।’’
আহি বলে, ‘‘কী জানো তুমি?’’
নবনী বলেল, ‘‘সময় হলেই বলব কী জানি।’’
এর পরে না রেগে উপায় আছে? এই ছিল দিনের প্রথম রাগের সূত্রপাত।
দ্বিতীয় বার মাথা গরম হল বাথরুমে ঢুকে। আহিরী গিজার অন করে দিয়েছিল আগেই। স্নানের জন্য শাওয়ার খুলতে দেখল, জল গরম হয়নি। গিজার গোলমাল করেছে। যতই গরম পড়ুক, সকালবেলার স্নান অল্প গরম জলে করাটা আহিরীর অভ্যেস। সন্ধেয় কলেজ থেকে ফিরে গা ধোয়ার সময় গরম জল লাগে না। মা এই নিয়ে কম বকাবকি করেনি।
‘‘এ আবার কী ব্যাড হ্যাবিট বানিয়েছিস আহি? দিনে গরম রাতে ঠাণ্ডা! শরীর খারাপ করবে যে।’
আহিরী বলে, ‘‘গরম জলে তেজ বাড়ে, ঠান্ডা জলে ক্লান্তি দূর হয়। মা, সকালে আমার তেজ দরকার। সারা দিনের ফুয়েল।’’
‘‘বাজে বকিস না। অসুখে পড়লে বুঝবি।’’
আজ সকালে ঠান্ডা জলেই স্নান সারতে হল। গ্যাসে যে একটু জল গরম করে নেবে সে সময়ও ছিল না।
তিন নম্বর রাগের কারণ একটা ছাই রঙের গাড়ি। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার গাড়ি পার্ক করার জায়গায়।
আহিরী বঁাক নিল। ছাতাটা নেওয়া উচিত ছিল। মাথা গরমের কারণে ছাতা গাড়ি থেকে নিতে ভুলে গেছে। কম্পাউন্ডের পশ্চিম দিকে বিশাল বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার ছায়া এসে পড়েছে লনে। আগাছা, ইট, গর্তের জন্য লন দিয়ে হঁাটা যায় না। গেলে একটু শর্ট-কাট হত। আহিরী হঁাটার স্পিড বাড়াল।
কলেজের নতুন ভবন হচ্ছে। সাত না আট তলা হওয়ার কথা। চারতলা পর্যন্ত উঠে কাজ থমকে গেছে। টাকা–পয়সা নিয়ে কী নাকি গোলমাল। বাড়িটা শেষ হলে কলেজ অনেকটা বড় হয়ে যাবে। নতুন ফ্যাকাল্টি হবে। অনেক ডিপার্টমেন্ট সরে আসবে। পুরনো বাড়িতে জায়গার সমস্যা হয়। ছাত্রছাত্রী অনেক বেশি হয়ে গেছে। অনেক সময় ক্লাসরুম পাওয়া যায় না। নতুন ভবনের কাজ বন্ধ হওয়া নিয়ে কলেজে টেনশন আছে। বেশ কয়েক বার গর্ভনিং বডির এমার্জেন্সি মিটিং হয়েছে। স্টুডেন্টস অ্যাজিটেশনও হয়েছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই বড় গোলমাল পাকবে। আহিরী এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না। টিচার্স রুমে কেউ কিছু বললে চুপ করে থাকে। চাকরিতে জয়েন করার আগে বাবা বলেছিল, ‘‘আহি, এই প্রথম চাকরি করতে যাচ্ছিস, কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখবি।’’
সব কথা না মানলেও বাবার পরামর্শ শুনতে আহিরীর ভাল লাগে। আসলে মানুষটাকেই তার খুব ভাল লাগে। মায়ের ঠিক উলটো। ঠান্ডা মাথা। ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’ বোধহয় একেই বলে। এক জন ভদ্রলোকের যা যা গুণ থাকা দরকার, বাবার মধ্যে তার সব ক’টাই আছে বলে আহিরীর ধারণা। এমনি এমনি তো মানুষ বড় হয় না। কমলেশ রায় আজ যে এত বড় চাকরি করেন, তার জন্য অনেক যোগ্যতা লাগে। বাষট্টি বছর বয়স হয়ে গেল, কোম্পানি তাকে ছাড়ার কথা ভাবতে তো পারছেই না, উলটে দায়িত্ব বাড়াচ্ছে।
ছোটবেলা থেকেই আহিরী দেখে আসছে, বাবা অন্য মানুষকে মর্যাদা দেয়। আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা পছন্দ না হলে চুপ করে যায়, কিন্তু অপমান করে না। বাবা কখনও ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করেছে বলে আহিরী বিশ্বাস করে না। তার ‘না’ বলাটাও মার্জিত। আবার কেউ বলতে পারবে না মানুষটা দাম্ভিক। হালকা বা তরল মনেরও নয়। তার চারপাশে সব সময়ে একটা কঠিন অথচ মধুর ব্যক্তিত্বের দেয়াল। একেই বোধহয় বলে প্লেজেন্ট পার্সোনালিটি। নিজের নীতি, আদর্শ থেকে মানুষটাকে সরানো কঠিন। আহিরী কত বার দেখেছে, চাকরি চাইতে বাড়ি পর্যন্ত লোক চলে এসেছে। আত্মীয়স্বজন, নেতাদের রেফারেন্স, এমনকী মায়ের পরিচিতজনও। হাতেপায়ে ধরেছে। বাবা ভদ্র ভাবে ফেরত পাঠিয়েছে। ছোটবেলার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আহিরী তখন ক্লাস নাইনে। ঠিক হল, ফান্ড তোলার জন্য তাদের স্কুলে বড় ফাংশন হবে। স্যুভেনিরে বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক স্টুডেন্টের সঙ্গে আহিরীর হাতেও ফর্ম দেওয়া হল। যাদের বাবা-মা বড় চাকরি করে বা নিজে ব্যবসা করে, তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার বিজ্ঞাপন চাই। বাবা বিজ্ঞাপন দেয়নি। আহিরী অনেক আবদার করেছিল। কান্নাকাটি করতেও ছাড়েনি। বাবা তার পরও দেয়নি।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy