ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: গাড়ি পার্ক করে আহিরী কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার মাথা সকাল থেকেই গরম। কেমিস্ট্রির প্রফেসর অর্কপ্রভ সেন সে দিন তার স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে যাওয়া নিয়ে কথা তুলেছিলেন। আহিরী মুখের উপর জবাব দিয়েছে।
আহিরী বোকা বোকা মুখ করে বলল, ‘‘স্যর, মাধবদাকে বললে এখানে চা এনে দিত নিশ্চয়ই, কিন্তু ক্যান্টিনের চা ক্যান্টিনেই বসে খেতে হয়। নইলে টেস্ট পাওয়া যায় না। চায়ের দোকানের চা যদি আপনি বাড়ি নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে খান, ভাল লাগবে? তা ছাড়া আমি যত ক্ষণ থাকি, ওরা খুবই সম্মান করে। সব থেকে বড় কথা, চমৎকার সব গল্প হয়। এখনকার ছেলেমেয়েরা কত কী জানে! ওদের সঙ্গে না মিশলে হিশাম মাতার বা কার্ল ওভ নসগার-এর মতো লেখকদের কথা আমি জানতেই পারতাম না। জানতেই পারতাম না, কিউ বা টেন মিনিট্স-এর মতো দারুণ সব শর্ট ফিল্ম তৈরি হয়েছে। থার্ড ইয়ার ইকনমিক্সের একটি ছেলের সেতার শুনে তো আমি থ! ইউটিউবে দিয়েছে। আপনি কি শুনবেন, স্যর?’’
অর্কপ্রভ সেন গলাখাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘‘ও, তুমি ইনটেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ করতে ছেলেদের ক্যান্টিনে যাও?’’
আহিরী হেসে বলল, ‘‘এক্সারসাইজ না বক্সিং জানি না, তবে ভাল লাগে। আমির খান, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া নিয়েও আড্ডা হয়। আমি আবার হিন্দি মুভির পোকা কিনা! একটা সময়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেলেই হল-এ ছুটতাম।’’
অর্কপ্রভ সেন ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘তা হলে তো ছেলেমেয়েরা মনের মতো শিক্ষক পেয়েছে। যা খুশি বলতে পারে।’’
আহিরী বলল, ‘‘অল্প বয়সে নিজেদের মধ্যে একটু স্ল্যাং ইউজ করবে না? কান না দিলেই হল! আমি তো ওদের মোরাল শিক্ষা দিতে যাই না। আর ভালমন্দের সীমারেখাটাও এখন অত স্পষ্ট নয়। আমরা এমন অনেক কিছু ভাল বলে জানতাম, যেগুলো আসলে খুব খারাপ।’’
টেবিলের কোণের দিকে বসে খাতা দেখছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের ব্রততী মুখোটি। মুখ না তুলে বললেন, ‘‘আহা অর্কপ্রভদা, বুঝতে পারছেন না কেন, আহিরীর এখনও প্রেসিডেন্সির ঘোর কাটেনি। ওখানেই পড়ে আছে। নিজেকে স্টুডেন্ট ভাবছে। ছোট মেয়ে তো। তাই না আহিরী?’’
আহিরী বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘‘একদম ঠিক বলেছেন ব্রততীদি। যত দিন স্টুডেন্ট থেকে স্টুডেন্টদের বোঝা যায় আর কী। বড় হয়ে গেলে তো টিচার হয়ে যাব। তখন আর ছাত্রদের বোঝার ঝামেলা থাকবে না। আমাদের দেশে এই একটা সুবিধে। ছাত্রদের না বুঝেও দিব্যি শিক্ষক হয়ে থাকা যায়।’’
অর্কপ্রভ সেনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তা ক্যান্টিনে বসে তুমি ছাত্রদের কী বু্ঝলে?’’
আহিরী ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। শান্ত গলায় বলল, ‘‘পুরোটা বুঝতে পারিনি স্যর। এটুকু বুঝেছি, পড়াতে গেলে মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে হবে। ওদের মধ্যে গিয়ে বসতে হবে। ওদের মুখের, মনের ল্যাংগোয়েজ জানতে হবে। পৃথিবীর সব বড় কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন। এই বিষয়ে কোনও ট্যাবু থাকা ঠিক নয়। কলকাতা শহরের কোনও কলেজে স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে এক জন টিচারের বসা নিয়ে এত আলোচনা, ভাবতেই অবাক লাগে। ভেরি আনফরচুনেট। যাই স্যর, ক্লাস আছে।’’
অর্কপ্রভ সেন তার পর থেকে আহিরীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্রততী মুখোটি ঘটনাটা চাউর করে দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ পুরনো অধ্যাপকই আহিরীর কথা ভাল মনে নেননি। কয়েক জন অবশ্য ওকে সমর্থন করেছে। যেমন শ্রীপর্ণ বলেছে, ‘‘বেশ করেছ। অর্কপ্রভ সেন লোকটা খারাপ। ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করবে। সাবধানে থাকবে।’’ শ্রীপর্ণ এখানে দু’বছর হল বদলি হয়ে এসেছে। হিস্ট্রি পড়ায়। ভিতু, কিন্তু ভালমানু্ষ। আহিরী মৃদু হেসে বলেছিল, ‘‘চিন্তা করবেন না। আমাকে ঝামেলায় ফেললে নিজেকেও ঝামেলায় পড়তে হবে।’’
অর্কপ্রভ সেনকে যেমন ছাড়েনি, শর্মিষ্ঠা দত্তকেও তেমনই আহিরী আজ ছাড়বে না বলে ঠিক করেছে। মহিলার পিছনে অন্য কেউ আছে। আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে। অর্কপ্রভ সেনই হবে। তাকে ঝামেলায় ফেলছে। কথাটা ভেবে আরও মাথা গরম হয়ে আছে। আহিরী আজ ঘুম থেকে উঠে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ঠান্ডা মাথায় কলেজে ঢুকবে। একটু ঠান্ডা নয়, ফ্রিজে-রাখা ঠান্ডা। অতিরিক্ত ঠান্ডা মাথা ছাড়া শর্মিষ্ঠা দত্তর সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না।
শর্মিষ্ঠা দত্ত কলেজের টিচার-ইন-চার্জ। তিন বছর ধরে উনিই কলেজ সামলাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়েই নিজের ইচ্ছে মতো চলেন এবং বিভিন্ন জনকে নানা ভাবে জ্বালাতন করেন। কেউ আপত্তি করতে গেলে শান্ত ভঙ্গিতে এমন সব কথা বলেন যে মাথায় আগুন ধরে যায়। লজিক গোলমাল করতে থাকে। কিছু ক্ষণের মধ্যে ‘আপনার যা খুশি হয় তাই করুন’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। এটা মহিলার এক ধরনের ফাঁদ। ‘রাগিয়ে দাও’ ফাঁদ। যাতে কথা ভেস্তে যায়। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকতে হয়। মাথা এতটাই ঠান্ডা করে যেতে হয় যাতে গরম হতে সময় লাগে। কোনও বিষয়ে আপত্তি করতে গেলেই উনি বড় গোলপানা মুখটা এমন দুঃখী-দুঃখী করে রাখেন যে মনে হয়, উনি বড় অসহায়। নিজের কোনও স্বার্থ নেই, দেশ ও দশের সেবায় এই কলেজের টিচার-ইন-চার্জ হয়ে বসে আছেন। অন্য কেউ দায়িত্ব নিলে গঙ্গায় গিয়ে ডুব দেবেন। গঙ্গার কোন ঘাটে গিয়ে ডুব দেবেন তাও ঠিক করা আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই সামান্য কথাটা কেউ বুঝতে চাইছে না। ভাবছে তাদের ইচ্ছে করে ঝামেলায় ফেলা হচ্ছে। কলেজের টিচিং, নন-টিচিং স্টাফরা অবশ্য অন্য কথা বলে।
বলে, ঝামেলা নয়, একে বলে বংশ বিতরণ। শর্মিষ্ঠা দত্তের আলিপুরের ফ্ল্যাটে একটা ছোটখাটো বাঁশঝাড় আছে। কলেজে আসার সময় তিনি সেখান থেকে বাছাই কিছু বাঁশ কেটে নিয়ে আসেন। কলেজে এসে সেই বাঁশ বিলি করেন। বিলি করার সময় মুখ এমন গদগদ করে রাখেন যে মনে হয়, বাঁশ নয়, হাতে করে ফুল এনেছেন। আসলে মহা ধুরন্ধর মহিলা। যে বিশ্বাস করবে সেই ঠকবে।
যে তিনটি কারণে আজ আহিরীর মাথা গরম হয়েছে তার একটার জন্যও সে নিজে দায়ী নয়। দায়ী তার মা, বাথরুমের গিজার এবং ডার্ক গ্রে রঙের একটা উটকো গাড়ি।
মা সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিল। সেই এক সাবজেক্ট। বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে।
একমাত্র সন্তানের সুযোগ্য পাত্রের জন্য নিজের মতো সন্ধান চালাচ্ছিলেন নবনী। পেয়েও গিয়েছেন। এক বান্ধবী-কাম-দিদির পুত্র কম্পিউটার নিয়ে লেখাপড়া করে আমেরিকার পোর্টল্যান্ডে থাকে। সেখানেই তার কাজকর্ম, একশো চোদ্দো তলার ওপর ফ্ল্যাট, মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়ি। নবনীকে সেই দিদি শুকনো মুখে বলেছিল, ‘‘ছেলেটার সবই আছে, নেই শুধু বউ।’’
নবনী চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, ‘‘সে কী! এমন হিরের টুকরো ছেলের বউ নেই কেন?’’
‘‘সেটাই তো কথা। ছেলে না পারে প্রেম করতে, না কোনও মেয়েকে তার মনে ধরে।’’
নবনী বললেন, ‘‘এ আবার কেমন কথা? আমেরিকার মতো অত বড় দেশে বিয়ে করবার মতো কোনও মেয়ে পাচ্ছে না!’’
‘‘বলেছিল, বাঙালি মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না। এখন বলছে, বিয়েই করব না। অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ছাড়াছাড়ির হয়ে যাওয়ার থেকে বিয়ে না করাই ভাল।’’
ছেলের নাম অর্জক। চেহারা গোলগাল, ফর্সা। হাবভাব নরমসরম। নিচু গলায় কথা বলে। আমেরিকার মতো শহরে বাস করেও খানিকটা লাজুক। বান্ধবী-কাম-দিদিকে ম্যানেজ করে নবনী অর্জককে এক দিন বাড়ি নিয়ে এলেন। মেয়ের ছুটি দেখেই ব্যবস্থা করেছিলেন। কিছুই তেমন ভাঙেননি। মেয়েকে শুধু বলেছিলেন ‘বন্ধুপুত্র’। অর্জককে লাঞ্চ খাওয়ালেন। মেনুতে বড়ি দেওয়া শুক্তো, ডাঁটা চচ্চড়ি, মৌরলা মাছের ঝোলও ছিল। ছেলে পরিপাটি করে খেল।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy