ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
পূর্বানুবৃত্তি: পুলিশ এবং দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষের মধ্যেই এনকাউন্টারের ছুতোয় কালিয়া উসমানকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল ইনস্পেক্টর যশবন্ত তাওড়ে। কিন্তু মজিদসাহেেবর সতর্ক তৎপরতায় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় সে। ডোংরি মহল্লায় তল্লাশিতেও উদ্ধার হয় বেশ কিছু নেপালি নাবালিকা। গ্রেফতার হয় মুম্বইয়ের কর্পোরেটর বাবুরাও পাটিলও। সন্তোষী নিজে গিয়ে গ্রেফতার করে সুপারমডেল রিচা মিরচন্দানিকে। বিপদের মুহূর্তে বার বার কল করেও সে নাগাল পায় না মনুভাই পারেখের।
ঠান্ডা গলা আরও ঠান্ডা শোনাল নেতাজির, “শান্ত হো যাইয়ে মনুভাই। বাবুরাও, কালিয়া উসমান আর ওদের ছেলেছোকরারা সবাই অ্যারেস্ট হয়ে গেছে। লকআপ মে সবকুছ উল্টি কর দিয়া উসমান অওর উসকা ছোকরালোগ। আপকা নাম ভি লিয়া উনলোগোঁনে। আপনার নামে ইন্টারন্যাশনাল লুক আউট নোটিস জারি করার প্রসেস চলছে সেন্ট্রাল মিনিস্ট্রি থেকে। এক ফরেন কান্ট্রিকা ইতনা সারা নাবালিক লড়কি কা চামড়া তস্করি কা মামলা হ্যায়। ইন্টারন্যাশনাল লেভেল থেকে প্রেশার আসছে গভমেন্টের ওপর। এই সিচুয়েশনে আমি তো দূরের কথা, সেন্ট্রালে আমার নেতারাও কিছু করতে পারবে না আপনার জন্য। মেরা বাত বিশোয়াস না হো, তো কোই ভি নিউজ় চ্যানেল খোলকে খুদ দেখ লিজিয়ে।”
বলতে বলতে কঠিন হয়ে উঠল নেতাজির গলা, “শুনিয়ে মনুভাই, আভি জব জি চাহে ফোন মৎ কিজিয়েগা হামকো। এক সিরিয়াস ক্রাইম অ্যাক্টমে নাম ঘুস গয়া আপকা। আপনার লাইন ট্যাপ করা হবে, খবর আছে আমার কাছে। ইন দিস সিচ্যুয়েশন, আপনি ফোন করলে আমার বিপদ হতে পারে। মনে রাখবেন কথাটা। আভি ছোড় রহে হ্যায়। জয় মহারাষ্ট্র!” কুঁ কুঁ শব্দে কেটে গেল লাইনটা।
এসে ধপ করে বিছানায় বসে মাথার মধ্যেকার দাউদাউ রাগটাকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকলেন মনুভাই। শালা নেতা কা বাচ্চা! মনুভাই পারেখকে চোখ দেখাচ্ছে! এক সময় দু’-দশ খোখা (কোটি) রোকড়া-র (টাকা) জন্য মনুর সামনে কুত্তার মতো লেজ নাড়ত শুয়ারটা! আর আজ একটু টাইম খারাপ হতেই শালা আপনা রং দিখা দিয়া। ঠিক হ্যায়, মেরা নাম ভি মনুভাই পারেখ। মেরা ভি টাইম আয়েগা। দাঁতে দাঁত ঘষলেন মনু। তবে তার আগে রিচাকে খালাস করতে হবে। ও বেচারির তো কোনও দোষ নেই। জিনিসটা পাওয়ার জন্য বাচ্চা মেয়ের মতো জেদ ধরেছিল শুধু। কিন্তু জানত না কী ভাবে জিনিসটা পাওয়া গেছে। কোর্টে বড় বড় ব্যারিস্টারদের লাগাতে হবে ওর জন্য। বার করে নিয়ে আসতে হবে ওকে। আর নিজের কথা তেমন একটা ভাবেন না মনুভাই। এখন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান যে দেশটায় আছেন, তার সঙ্গে ভারতের কোনও প্রিজ়নার এক্সচেঞ্জ ট্রিটি নেই। ফলে ওঁকে এখান থেকে বার করে নিয়ে যাওয়াটা জাস্ট ইম্পসিবল! জিন্দেগিতে যা কামিয়েছেন, সাত পুরুষ বসে খাবে। ইন্ডিয়ায় ছেলেরা আছে, ধান্দা সামলাবে। এখন ফের এক বার মায়ার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কোর্টে ব্যারিস্টার অ্যাপয়েন্ট করার ব্যাপারে। মায়াকে ফোন করে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বললেন মনুভাই। তার পর মোবাইল অ্যাপে ইন্ডিয়ার নিউজ় চ্যানেলগুলো দেখতে লাগলেন সার্ফিং করে করে। সব চ্যানেলেই ব্রেকিং নিউজ়! এক সে এক ক্যাপশন— ‘ইন্ডিয়া সে ফারার ডায়মন্ড টাইকুন মনুভাই পারেখ!’ ‘চামড়া তস্করি কে মামলে মে গিরফতার সুপারমডেল রিচা মিরচন্দানি’, ‘করাপটেড পোলিস অফিসার গট অ্যারেস্টেড ইন স্কিন ট্র্যাফিকিং কেস কানেকশন!’ ফোনের স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠছে বাবুরাও, কালিয়া উসমানদের গ্রেফতারি আর চাদরে মুখ ঢেকে থানায় ঢোকার দৃশ্য। এ সি পি শিন্ডে আর রুদ্রনারায়ণ ব্যানার্জি নামে কলকাতা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের নাম শোনা যাচ্ছে বার বার, রিপোর্টার আর অ্যাঙ্করদের মুখে। বিরক্তিতে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে ইন্টারকমে একটা স্কচের বোতল অর্ডার করলেন মনু। তার পর ফের হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।
মাঝ-আকাশে চার ধারে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের মাঝখানে উড়ছিল মুম্বই-কলকাতাগামী বিমান। জানলার ধারে বসা রুদ্র। পাশে বসা মজিদসাহেব। পেছনের সিটে সুনীল আর সন্তোষী। প্লেনের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে মেঘেদের আসা-যাওয়া দেখছিল রুদ্র, “ওই শালা মনুভাইটাকে আর কব্জায় নেওয়া গেল না স্যর। এই যা আফসোস!” হতাশা ঝরে পড়ল মজিদসাহেবের গলায়।
জানলা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মজিদের দিকে তাকাল রুদ্র, “আফসোস আমারও মজিদসাহেব। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিগুলোর মধ্যে যে দেশটায় ওই বাস্টার্ডটা রয়েছে, তার সঙ্গে আমাদের বন্দি-প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। এ ছাড়া আমাদের দেশের টপমোস্ট লেভেলেও প্রচুর কন্ট্যাক্ট বদমায়েশটার। এ সব কাটিয়ে ওকে বার করে এনে ওকে খাঁচায় ঢোকাতে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে। সময়ও লেগে যাবে অনেকটা। তার পরেও ওপরওয়ালাদের যদি সদিচ্ছা থাকে আদৌ, এ দিকে ডিসি সাহেব আর আপনি, দু’জনেই তো মাসতিনেকের মধ্যেই রিটায়ার করে যাচ্ছেন, আর আমার কথা তো বাদই দিন। আই অ্যাম নো লঙ্গার ইন ফোর্স। ফলে মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন ব্যাপারটা।”
“তা যা বলেছেন! আমাদের তো আর এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মজিদ। মানুষটার বিমর্ষ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছিল রুদ্রর। আলতো করে একটা হাত রাখল মজিদের কাঁধে, “ব্যাপারটা শুধু ওই ভাবে দেখছেন কেন মজিদসাহেব, কেসটার পজ়িটিভ দিকগুলোও দেখুন। মনুভাই এসকেপ করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু বাকি সব ক’টা শয়তানই বলতে গেলে ধরা পড়েছে। অতগুলো মেয়ে রেসকিউড হয়েছে। মুম্বইয়ের ক্রাইম ব্রাঞ্চ, ডি ডি, অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং সেকশন জয়েন্টলি ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও হয়তো আরও কিছু ক্রিমিনাল অ্যারেস্ট হবে। তাদের ইন্টারোগেট করে হয়তো এই হিউম্যান ট্র্যাফিকিং কার্টেলের আরও ভিতরে পৌঁছনো যাবে। অ্যান্ড মেনি মোর পুয়োর গার্লস উইল বি রেসকিউড। এটুকু তো এক্সপেক্ট করতেই পারি আমরা।”
রুদ্রর কথায় চকচক করে উঠল মজিদসাহেবের বিষণ্ণ চোখ, “তা যা বলেছেন স্যর! এন্ড অব দ্য ডে উই কান্ট লুজ় হোপ!”
“এ বার একটা ভাল খবর দিই শুনুন,” মজিদের দিকে তাকিয়ে হাসল রুদ্র, “এই কেসটার জন্য যেটুকু রেমুনারেশন পেয়েছি আমি, সেটা তিন ভাগে ভাগ করব। মেজর দুটো শেয়ারের মধ্যে একটা ডোনেট করে দেব আমার মিসেস, মানে পর্ণার অর্গানাইজ়েশনকে। অনেক কষ্ট করে সংস্থাটা চালায় ও, তবু কোনও ফান্ডিং এজেন্সির কাছে হাত পাতেনি কোনও দিন। অন্যটা দেব ইন্ডিয়া-নেপাল বর্ডার বেসড একটা এনজিও-কে। এ পর্যন্ত বহু ট্র্যাফিকড নেপালি মেয়েদের রেসকিউ করেছে ওই সংস্থাটা। সত্যিই খুব ভাল কাজ করে ওরা। আর থার্ড পোরশনটা…” বলে সামান্য থামল রুদ্র। সিটের খোপে রাখা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা খুলে জল খেল দু’-এক ঢোঁক। তার পর যখন ফের মুখ খুলল, কেমন যেন একটা সঙ্কোচের ছোঁয়া গলায়, “যদিও অ্যামাউন্টটা খুবই সামান্য, তবুও তাই দিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা ফিস্ট অথবা পার্টি, যা হোক কিছু অ্যারেঞ্জ করবেন আপনারা। আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বাররাও জয়েন করবেন সবাই। টাকাটা আপনার আকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেব আজকেই।”
“গ্র্যান্ড!” সোল্লাসে বলে উঠলেন মজিদ, “আমরা চার জন, সঙ্গে তারক। অনেক দিন বাদে ম্যাডাম আসবেন, সঙ্গে সবার বাড়ির লোকজন, ব্যাপক জমে যাবে পার্টি।”
“না মজিদসাহেব, আমার থাকা হবে না,” সঙ্কোচের সঙ্গে কেমন যেন একটা বাধো বাধো ভাব রুদ্রর কণ্ঠস্বরে, “অনেকগুলো বছর পর আবার কেউ আসছে আমাদের সংসারে। এ দিকে বয়সটাও তো অনেকটাই বেড়ে গেছে পর্ণার… বেশি বয়েসে কনসিভ করা... ব্যাপারটা একটু ক্রিটিক্যাল, এই সময় ওর পাশে থাকাটা জরুরি। তাই এয়ারপোর্টে নেমেই রওনা দিতে চাই ওখানে।”
“কনগ্রাচুলেশন্স স্যর!” রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই প্লেন ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মজিদসাহেব।
“কী হয়েছে?”
“হোয়াট হ্যাপেন্ড স্যর?”
পিছনের সিট থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সামনে ঝুঁকে পড়ল সুনীল আর সন্তোষী। ফ্লাইটসুদ্ধ লোক, সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে এ দিকেই।
“কিছু না, তোমরা বসে পড়ো,” গম্ভীর চোখে দু’জনের দিকে তাকাল রুদ্র। তার পর মুখ ঘোরাল জানলার দিকে।
বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ সদরঘাটে এসে দাঁড়াল ডিডি-র সাদা সুমো। গাড়ির দরজা খুলে নেমেই পিছনে চলে গেল তারক। সামনে তাকাল রুদ্র। তত ক্ষণে ঘাটে ভুটভুটি এনে ভিড়িয়ে দিয়েছে মাঝিচাচা। ডিকি থেকে রুদ্রর ব্যাগপত্তর নামিয়ে ফিরে এল তারক। ছলছল করছে চোখজোড়া। গলায় খামচে ধরা দুঃখ, “আবার তো ফিরে গিয়ে সেই মড়াতোলা গাড়ি ঠেলতে হবে স্যর। আপনি এলেন, ক’টা দিন একটু অন্য রকম ভাবে বাঁচলুম। ঠিক সেই দু’বছর আগেকার মতো।”
কথা আটকে যাচ্ছিল তারকের। মৃদু হেসে ওর কাঁধে হাত রাখল রুদ্র, “যখনই কাজটা খুব একঘেয়ে লাগবে, তখনই এই সব দিনগুলোর কথা মনে করবি— কী রকম একটা ঝোড়ো জীবন কাটিয়েছিলাম আমরা সবাই! কত বাধাবিপত্তি এসেছে, রাস্তার বাঁকে বাঁকে কত বিপদ, লোভের হাতছানি। তবু ভয় পাইনি, টলে যাইনি কেউ। ভাবলেই দেখবি সমস্ত দুঃখ, মন ভারী করে দেওয়া কাজের একঘেয়েমি, সব ফুড়ুৎ করে উবে গেছে কপ্পুরের মতো।”
বলতে বলতে কখন যে নিজের গলাটাও ভারী হয়ে এসেছে, টেরই পায়নি। সেটাকে সামলাতে তারকের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি লাগাল, “তা হলে আসি এ বার। ভাল থাকিস। আর গুটখা খাওয়াটা কমিয়ে দিস হতভাগা।”
বলে খেয়াঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল রুদ্র। বুড়ো মাঝির ভুটভুটিতে স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ। মুখ ঘুরিয়ে গাড়িতে এসে বসল তারক। তার পর ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল আশি স্পিড তুলে। আর এক বারও পেছনে না তাকিয়ে।
নদীর বাঁকে মোড় নিল ভুটভুটি। শীতের মরসুম ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। তবু শেষ মাঘের ঠান্ডা তার জায়গা ছাড়তে নারাজ এখনও। নোনাবাদার এই জঙ্গুলে গাঁয়ে অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। গাছের ডালে, নদীর পাড়ে, গরান-শুলো-সুন্দরী-বাইনের জঙ্গলে, টিমটিমে পিদিম-জ্বলা ছোট ছোট কুঁড়েঘরের চালে থুপথুপে ঘন ধূসর কুয়াশার ঘেরাটোপ। দূরে কোথাও মাছধরা নৌকো থেকে কোনও মতে ছিটকে বেরোনো ক্ষীণ এক চিলতে ডিবড়ি লম্ফের আলো। কুয়াশা আর আলো-আঁধারিতে নোনাখালের ঘাটলায় দাঁড়ানো আবছায়া সেই অলৌকিক রমণী! দ্য বেস্ট ওয়াইফ ওয়ান কুড এভার হ্যাভ! অনেক দিন আগে ছন্নছাড়া, চরম ভাগ্যবিড়ম্বিত একটা মানুষকে তার দাঁড়াবার জায়গাটুকু দিয়েছিল এখানে। কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে রুদ্র। নতুন অতিথির আগমনবার্তা ভরাট ছাপ ফেলতে শুরু করে দিয়েছে সেই রমণীর শরীরে। কুয়াশার আবছায়া-মাখা শেষ বিকেলের আলো-আঁধারিতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল সেটা। নৌকো থেকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল রুদ্র, “আমি এসে গেছি পর্ণা!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy