Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২১

পরিক্রমণ

অভিরূপ হাসে। ভারী করুণ দেখায় হাসিটা। আবার বুকের তলায় মোচড় পড়ে তিয়াষার। ইচ্ছে হয় দু’হাতে ওই অভিমানী মানুষটার মুখ বুকে জড়িয়ে ধরে সব কষ্ট সব তিক্ততা নিজের মধ্যে শুষে নিতে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯ ০৭:৪৩
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: ডাক্তার অভিরূপের উপর লেখাটা শেষ করতে পারে না তিয়াষা। তার মন চাইছে আর এক বার অভিরূপের সঙ্গে দেখা করতে। তাই তার কাগজের সম্পাদকের কাছে আরও একটা দিন চাইতে গিয়ে একেবারে অন্য পরিস্থিতিতে পড়ে সে। সম্পাদক তড়িঘড়ি তাকে নিয়ে অভিরূপের হাসপাতালে পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অভিরূপের গ্রেফতারের দাবিতে বেশ কিছু লোক হাসপাতালের গেটে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তিয়াষা চায় ডাক্তারের সঙ্গে আর এক বার কথা বলতে।

মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে লিখেছে। চারিদিকে আমার বিরুদ্ধে মিটিং, মিছিল, স্লোগান... এর পরে আর কে শুনবে আসলে কী ঘটেছিল?’’ হতাশা অভিরূপের গলায়। তার কথা শুনে অস্থির হয়ে ওঠে তিয়াষা। অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকায় সে, “আমিও তো মিডিয়ারই এক জন। আমি শুনব। বলুন। ইউ হ্যাভ টু স্পিক আউট। এ ভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।’’

কিছু ক্ষণ স্থির চোখে তিয়াষার দিকে তাকিয়ে থাকে অভিরূপ। এ বার ভেঙে পড়া নয়, ওর চোখ জ্বলে ওঠে তীব্র আত্মবিশ্বাসের অনুসন্ধানে। সেই তীব্রতার দিকে তাকিয়ে ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে তিয়াষা।

“আমাকে বলা হয়েছিল বিলাস পালের অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করার জন্য। আমি রাজি হইনি। কারণ ওঁর কোনও কার্ডিও সমস্যা ছিল না। সেই নিয়ে একটা হট টকও হয়েছিল।’’

“সে কী! ওঁর হার্টের কোনও সমস্যা ছিলই না?”

“ওর প্রয়োজন ছিল লিভার প্রতিস্থাপন। সে কথাই আমি বলেছিলাম। পার্টিকে সেটা জানানো হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ ওঁর বাইপাস হল এবং রেফারেল কার্ডে দেখা গেল আমার সই। যে সইটা আমি করিনি।’’

“যারা এর সঙ্গে জড়িত আপনি তাদের নাম বলছেন না কেন পুলিশকে? ইটস আ ডিপরুটেড কন্সপিরেসি!’’

অভিরূপ হাসে। ভারী করুণ দেখায় হাসিটা। আবার বুকের তলায় মোচড় পড়ে তিয়াষার। ইচ্ছে হয় দু’হাতে ওই অভিমানী মানুষটার মুখ বুকে জড়িয়ে ধরে সব কষ্ট সব তিক্ততা নিজের মধ্যে শুষে নিতে।

“আসলে আমি বিশ্বাস করতাম নিজের কাজটা প্রাণ দিয়ে করি যখন, কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। কখনও ভাবিইনি যে নোংরামিটা এই পর্যায়ে চলে যেতে পারে। পেশেন্ট পার্টিকে দিয়ে টাকা দিয়ে অভিযোগ করানো হয়েছে। সে খবরও আমার কাছে আছে।”

“সে কী? এত বড় কন্সপিরেসি! কিন্তু পেশেন্ট পার্টির অভিযোগটা যে গট আপ সেটা কী করে জানা গেল?”

“হাসপাতালের কয়েক জন স্টাফ, নার্স, আমাকে অন্ধের মতো ভালবাসে তিয়াষা। খবর আমার কাছে আসবেই। একটা সার্কল আছে আমি জানতাম। তাদের মধ্যে কয়েক জন ডাক্তারও আছে। যারা কোনও আদর্শের ধার ধারে না। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আমার সমস্যা হচ্ছিল। প্রতি পদেই ওদের সঙ্গে মতের মিল হচ্ছিল না। কিন্তু ওরা এতটা নীচে নামবে আমি ভাবতেও পারিনি। নাউ আই অ্যাম ফিলিং রুইনড,’’ প্রথম দিকের হতাশার ভঙ্গিটা আবার ফিরে আসে অভিরূপের চোখে, গলায়, সারা শরীরে।

তিয়াষা চোখে চোখ রেখে তাকায়। হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে। টেবিলে রাখা কফির কাপে ঢেউ তুলে যায় নিথর দুপুর। “আমরা অ্যান্টিসিপেটরি বেল প্রেয়ার ফাইল করব। নোংরা পৃথিবীটার ঠিক পাশে পাশেই একটা ঝকঝকে সুন্দর পৃথিবীও আছে।’’

“আপনি... কেন বলুন তো... আপনি... মানে... আমি ঠিক বুঝতেও পারছি না। সবাই যখন এ রকম...তখন আপনি কী করে... কেনই বা... স্ট্রেঞ্জ!’’

শহরের সেরা ডাক্তার অভিরূপ শব্দ খুঁজে পায় না। সে দিকে তাকিয়ে তিয়াষা হাসে। যেন পথভ্রষ্ট নাবিককে সঠিক কূল নির্দেশের পর পরিত্রাতার তৃপ্তি মাখা রয়েছে সেই হাসিতে। এ কথা মনে মনে ওর জানা হয়ে গিয়েছে, শুধু অভিরূপকেই নয়, নিজেকেও ঠিক হোক ভুল হোক একমাত্র অপ্রতিরোধ্য পথটা ও ইতিমধ্যেই দেখিয়ে ফেলেছে। মুখে সে কথা বলার নয়। শুধু মৃদু হেসে বলে, “সব কথার উত্তর পাওয়াও যায় না, খুঁজতেও নেই। চলুন, এখান থেকেই আমার চেনা এক অ্যাডভোকেটের বাড়ি যাই। তার পর ফিরব। আর হ্যাঁ, তার পর কিন্তু আপনি হাসপাতালে প্রতিদিনের মতো এক বার রাউন্ডটা মেরে তবেই বাড়ি ফিরবেন।’’

“হাসপাতাল যাব? আমি?’’ বিহ্বল শোনায় অভিরূপের গলা।

“হ্যাঁ। যাবেন। ওটা আপনারই জায়গা। আমার নয়।”

“কিন্তু কাল যা হল, আপনি তো দেখলেন সব। আমার মানসম্মান সব তো ধুলোয় মিশে গেল।’’

“না।’’ অভিরূপকে চমকে দিয়ে, এমনকি আশেপাশের টেবিলের লোকজনকেও চমকে দিয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে তিয়াষা, “এত সহজে মানসম্মান যায় না। কতগুলো লোকের ষড়যন্ত্র বড়, না কি অজস্র পেশেন্টের ভরসা ভালবাসা বড়? ওরা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। চলুন, উঠুন।’’

তিয়াষার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অভিরূপ। অনেক কথার স্রোত ওর অনভ্যস্ত স্বরযন্ত্রের কাছে এসে বার হতে চেয়ে ঠেলাঠেলি করছে। কিন্তু সব কথার মধ্যে একটা কথাই বুকের গভীরে ঠাঁই পায়। অনেক দিন আগে কোথাও বুঝি পড়েছিল। যখন কেউ থাকে না পাশে, যখন নিবিড় কালো তিমির ছেয়ে ফেলে চারধার, তখনও বুঝি কোথাও থেকে আশ্বাস ভরা অচেনা স্পর্শ জীবনকে এক লহমায় মরুভূমি থেকে এনে দিতে পারে মরূদ্যানের মাঝখানে।

“কী হল? কী দেখছেন? চলুন।’’

অভিরূপ হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই হাতে নিজের ছোট্ট মুঠোটা তুলে দেয় তিয়াষা। এক সঙ্গে কাচের দরজা ঠেলে দু’জোড়া পা বেরিয়ে আসে বাইরে।

আকাশে তখন শেষবেলার সোনালি আভা। চেন্নাই হোটেলের বিশাল সাত তলা বিল্ডিংয়ের গা বেয়ে গড়িয়ে আসা আলোর রং। নিঃশব্দে একই তানে ছুঁয়ে যায় দুই ভিন্ন জগতের মানুষের চুল, চোখ, জুড়ে থাকা হাতের পাতা।

অভিরূপ হেসে ফেলে স্টিয়ারিং ধরার পরে। পাশে বসে তিয়াষা মোবাইলে স্ক্রল করছিল ওর পরিচিত উকিলবাবুটির নম্বর। মোটামুটি বলে রেখেছিল ঘটনাটা। সবটা ভেবে নিয়েই আজ অভিরূপকে ডেকেছিল। প্রথম থেকেই ওর মন বলছিল কিছু একটা গন্ডগোল আছেই ভিতরে। অভিরূপ এমন নিচু কাজ করতেই পারে না। ও ফাঁদে পড়েছে। আর সব শোনার পর তো এখন আর কোনও সংশয় নেই তিয়াষার মনে। এই মানুষটার পাশে থেকে আবার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনার দায়িত্বটা এখন যেন ওরই। কবে কখন কোন মুহূর্ত থেকে সে দায়ভার বর্তাল, তিয়াষা বলতে পারবে না। নদী কি জানে কখন থেকে সে মোহনা অভিমুখী?

অথবা পশ্চিম আকাশ কি জানে ঠিক কোন মুহূর্তে সে কনেবৌয়ের মতো সেজে ওঠে!

তিয়াষা নিমগ্ন ছিল নিজের মধ্যে। এ বার হাসির শব্দে সচকিত হয়ে তাকায়। “হাসছেন যে?’’

মাথা নাড়ে অভিরূপ, “না! ভাবছি।’’

“কী?” সন্দিগ্ধ হয়ে তাকায় তিয়াষা।

“ভাবছি, আমি কী অবলীলায় এক জন সাংবাদিক মহিলার সঙ্গে ভরা বিকেলে ...”

“কিছু তো করার নেই, ভবিতব্য!’’ গম্ভীর হয়ে বলে তিয়াষা।

“আমার বৌ চুমকি দেখলে যে কি রিঅ্যাক্ট করত... সেটাই ভাবছিলাম।’’ এ বার কৌতূহলী হয়েই পড়ে তিয়াষা, “কী? কী বলতেন উনি?’’

“কী বলত!, ‘ও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভাল হল, প্লিজ় এটিএম কার্ডটা দিয়ে যাও’!’’ তিয়াষা অভিরূপ এক সঙ্গেই জোরে হেসে ওঠে। পর মুহূর্তে হাসি মুছে ফেলে অভিরূপ বলে, “কাল রাতে অত কিছুর পরে যখন আমি বাড়ি ঢুকলাম ও ভীষণ চিন্তিত হয়ে বলল, এত বেশি স্যালারি অন্য হসপিটাল কি দিতে পারবে?’’

“থাক না ও সব কথা,’’ মোচড় দিয়ে ওঠা বুকের ভিতরটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে চেয়ে বলে তিয়াষা।

“তোমার কষ্ট হচ্ছে? এই জন্যই আমি হাসছিলাম। এতগুলো বছর কাটানোর পরেও আমি চুমকির কাছে একটা মানি-মেকিং মেশিন মাত্র। অথচ, কে তুমি আমার? ক’দিনের পরিচয়? এই ঘটনায় আমার চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছ তুমি।

কেন? তিয়াষা?’’

তিয়াষা চুপ করে বসে ছিল। এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ও! উত্তর তো ওর কাছেও নেই। শুধু প্রশ্ন আছে একই তারের। সত্যিই তো, কে ও অভিরূপের? কেন এত কষ্ট হয় ওর জন্য? কেন মনে হয়, ওই মানুষটার ত্রিসীমানায় যেন কোনও বিপদ না আসে?

“স্যরি। আমি ‘তুমি’ বলে ফেললাম।’’ তিয়াষাকে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখে অপ্রতিভ হয় অভিরূপ। এ বারে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তিয়াষা। চোখে তির্যক হাসি, “ সে তো বলতেই হত। আমারও আর ভাল লাগছে না আপনি আজ্ঞে করতে।’’

১৩

অরুণ এত ক্ষণে একটু ফাঁক পেয়েছে। সকাল থেকে বত্রিশ জন পেশেন্ট দেখতে হয়েছে। তার মধ্যে রিপিট ছিল মাত্র ন’জন। বাকি সব ফার্স্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এই ভিজ়িট ডেটগুলোতে প্রেশার পড়ে বেশি। অরুণের মনে হয় ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ় দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন। ও তাই চেষ্টা করে প্রথম দিনেই পেশেন্টের মনের মধ্যে ওর প্রতি ভরসার জায়গাটা তৈরি করে দিতে। তার জন্য একটু বেশি সময় ধরে তাদের কথা শোনা, জবাব দেওয়া, এগুলো দরকার। তা না হলে হয়তো এই সময়টুকুর মধ্যে ও চৌষট্টি জনকে দেখতে পারত। অন্তত আজকাল বেশির ভাগ ডাক্তার তা-ই করে থাকে। কিন্তু এ রকম প্রফেশনাল হতে অরুণ পারবে না। তাতে বিপাশা যতই আওয়াজ দিক, যতই হাসুক।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Rajashree Basu Adhikari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy