Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Novel

মায়া প্রপঞ্চময়

দোলাচলের মধ্যেই এক সময় রাস্তার সেই মোড় এসে যায়, যেখান থেকে অন্নু চলে যাবে সামনের দিকে আর মানিক পড়ে থাকবে পিছনে। অন্নু শেষ বারের মতো চেষ্টা করে।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: অন্নুর একা থাকার সুযোগ নিতে নয়, তার কাপড়ে আগুন ধরে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মানিক। সে কথা বুঝতে পেরে মানিককে আঘাত করার জন্য অনুশোচনা হয় অন্নুর। মানিকের ক্ষতে সে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। ক্রমশ তারা কাছাকাছি আসে। পরস্পরের প্রতি দুর্বলতাও তৈরি হয়। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় অনিকেতই। মন না চাইলেও অনিকেতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে পারে না অন্নু। সে বুঝতে পারে যে, ভবিতব্যকে খণ্ডন করা অসম্ভব।

অন্নু চোখের সামনে দেখতে পায় এক দু’-রাস্তার মোড়, যার এক দিকে আলোকোজ্জ্বল রাজপথ, পথ নির্দেশক তিরের অভিমুখও সেই দিকে, আর অন্য দিকের পথ কুয়াশায় ঢাকা। ঠিক মতো বোঝাও যাচ্ছে না সামনে কী আছে, থাকলেও তা কত দূরে। কী সিদ্ধান্ত নেবে ও? ওর কাছে মনপ্রীত এক সাদামাটা, সরল উপন্যাস যার বাকি পাতাগুলো পড়া না হলেও অনুমান করে নেওয়া যায়। বিপরীতে মানিক এক ব্যতিক্রমী ছোট গল্প, যার শুরু দেখে শেষটা অনুমান করতে যাওয়া বোকামি। যে কোনও সময়ে গল্পে টুইস্ট আসতে পারে। তাই চলার পথে গল্প নয়, ওকে উপন্যাসই বেছে নিতে হবে।

অন্য দিকে মানিকের সামনে সম্ভবত এক অদ্ভুত দোটানা— কোন জীবন বেছে নেবে ও? যে জীবন এখন ওকে এখন অমৃত দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, সেটাই এক দিন বিষের পেয়ালায় পরিণত হবে যে! ওর অনুমানশক্তি ওকে এক বার বিপথগামী করেছিল এই বুঝিয়ে যে, অনামিকা এক মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ওর সান্নিধ্য খুঁজছে এবং সেটা তাকে দেওয়া দরকার। হয়তো সে প্রতারিত হয়েছে, কিংবা ওর পুরনো সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে বা যেতে চলেছে। তাই সেই সময়ে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে অতটা কাছে গিয়েছিল মানিক। এখন সেই প্রখর অনুমানশক্তি আর অনুভূতি আবার সাবধান করছে এই সম্পর্ককে এ ভাবে টিকিয়ে না রাখতে। কারণ তা হলে এই সম্পর্ক বাকি জীবন যন্ত্রণা আর অপমান ছাড়া কিচ্ছু দেবে না! শূন্যতাবোধ এমনিতেও সঙ্গী হয়ে থাকবে, তবু দূরে চলে গেলে নির্বোধ দাসত্বের অপমানটা থাকবে না। তাই ও মনের অনুশাসন মেনে সব কিছু ছেড়েছুড়ে অনামিকার থেকে দূরে চলে গিয়েছে। সেটা বজায় রাখা দু’জনের দিক থেকেই মঙ্গল।

এই দোলাচলের মধ্যেই এক সময় রাস্তার সেই মোড় এসে যায়, যেখান থেকে অন্নু চলে যাবে সামনের দিকে আর মানিক পড়ে থাকবে পিছনে। অন্নু শেষ বারের মতো চেষ্টা করে। মানিকের চোখে চোখ রেখে সে বলে ওঠে, ‘‘আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ ঘনঘন না হোক, কখনও-সখনও তো হতে পারে? যেমন এ বার হল? আমরা যদি এই আশ্চর্য ভালবাসাকে মেরে না ফেলে শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? কথা দিলেই তো হল, যে আমরা কমপক্ষে সাত হাত দূরত্ব বজায় রাখব, যদি তোমার মনে হয় যে বিয়ের পর থেকেই আমি অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছি!’’

চোয়াল শক্ত করে মাথা নাড়ে মানিক, বলে, ‘‘আমি জানি তুমি আর-পাঁচটা মেয়ের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমতী, এ বার তার প্রমাণ চাইব কিন্তু। কেন তুমি বুঝতে চাইছ না, তোমাকে অস্পৃশ্য আর অশুচি মনে করার টার্গেটটা আমি বিশেষ উদ্দেশ্যেই নিয়েছি যাতে এই প্রলোভনের অলাতচক্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি। এখন না পারলে আর কোনও দিনই পারব না এই ঘূর্ণির টান থেকে মুক্ত হতে। আমাদের আশ্চর্য ভালবাসাকে তার মতো করে একান্তে বেঁচে থাকতে দাও বাকি জীবনটায়!’’

শেষ বারের মত ওর হাত ছুঁয়ে চলে যাওয়ার আগে মানিক বলে গিয়েছিল, ‘‘খুব দরকার না পড়লে আর ডেকো না আমায়। আমিও তো মানুষ, বড় কষ্ট হয় আমার। মনে রেখো কর্ণের একাঘ্নী অস্ত্রের কথা, যা সে তুলে রেখেছিল শুধু অর্জুনের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে বলে। তোমার ডাকে আর এক বারই আমার সাড়া পাবে, তাতে যত কষ্ট, যত অসুবিধেই হোক আমার।’’

সেই আসা এসেছিল মানিক, যখন বার বার করে অন্নু লিখেছিল এক বার অন্তত আসতে ওদের বেনারসের বাড়িতে। অনুযোগ করেছিল যে, অন্যরা অনেক দূরে থেকেও মানিকের সঙ্গে যোগসূত্র রাখতে পারে, অথচ কাছে থেকেও মানিক ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না। কেন যে ও তখন মানিককে ডেকেছিল, সেটা যাওয়ার সময় মানিক ওকে স্পষ্ট করে বলেও দিয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে মানিকের আর কোনও হদিশ ও পায়নি। সত্যি বলতে কী, সে চেষ্টাও আর করেনি অন্নু। নিজের সংসারের নানা জটিলতা নিয়ে অনেকগুলো বছর কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে, ও ভাল করে বুঝেও উঠতে পারেনি। অপ্রিয় কথাগুলো মনে করিয়ে দিল অপালা। পাঁচ বছর আগে, ওর বিবাহবার্ষিকীর রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনের ঠিক আগের মুহূর্তে।

তার পর থেকেই কী যে হয়েছে ওর মনে— অল্পবয়সে আচমকা চোট পাওয়া হাড়ের ব্যথার মতো— বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ব্যথার অনুভূতি যেমন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠে কাবু করে ফেলে, তেমনটাই যেন হয়ে চলেছে ক্রমাগত। মৃত মানিক যেন জীবিত মানিকের চেয়ে বেশি জোরালো হয়ে উঠল ওর স্মৃতির পটে, যাকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও বার বার ফিরে আসে। পার্টিতে একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করলে সেই বোধটা যেন মনকে আরও বেশি দুর্বল করে দেয়। বুকের ভিতরে মন-কেমন-করা এক বোবা শূন্যতা টের পায় অন্নু।

মনে পড়ে, মানিক এক বার লিখেছিল, ‘আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা সেরে যাওয়া গভীর ক্ষতের মতো হয়ে থাকবে। সংক্রমণের ভয় থাকবে না, ব্যথার অনুভূতিও নয়, কিন্তু নতুন চামড়া গজিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক ত্বকও আর ফিরে পাওয়া যাবে না। মনের গ্রাফটিং করার টেকনিক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।’ আজকাল অন্নুর মনে হয়, সত্যি ছেলেটা সময়ের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিল বলেই হয়তো কোথাও ঠিকমতো পাত্তা পেল না। ওর কাছেও নয়, ওর লেখাপড়া বা কাজের জায়গাতেও নয়। কেন জানে না, কিন্তু অন্নুর মনে হয় ও নিজেও যেমন যোগ্যতার উপযুক্ত কদর পায়নি, তেমনই মানিকও সারা জীবন অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে।

আজকাল আত্মসমীক্ষার জন্যে অনেক সময় পায় ও। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে, যে-যার মতো প্রতিষ্ঠিত। মনপ্রীত বড় বেশি ব্যস্ত, বিশেষ করে তার ব্যবসা ইদানীং ভাল চলছে না। মাঝে-মাঝে অন্নুর মনে হয়, এই অস্থায়ী প্রাচুর্যের চেয়ে অন্য কোথাও স্থায়ী দারিদ্রই হয়তো ওকে বেশি সুখী করতে পারত। এমনও মনে হয় যে, ব্যবসার উন্নতির কথা ভাবতে গিয়ে প্রীত ওকে অবহেলা তো করছেই, এমনকি ব্যবসা বাঁচানোর খাতিরে প্রয়োজনে ওকে ব্যবহার করতেও সে দ্বিধা করবে না। এই ভালবাসাহীন সম্পর্কের জন্যই কি বেঁচে থাকা?

জীবনের এই পর্যায়ে এসে নতুন করে কিছু ভাবতে পারা বড় কঠিন। যে ভাবনা কম বয়সে ভেবে উঠতে পারেনি, তা এত বছর পর ভেবে কী হবে? শুধু মনে হয়, এক বার, মাত্র এক বারও যদি মানিক সামনে এসে দাঁড়াত, যদি বলত, ‘‘যা হয়ে গিয়েছে যাক, আমি এখনও আগের মতোই আছি। তোমাকে তখনও যে চোখে দেখতাম, এত বছর পরও সেভাবেই মনে রেখেছি।’’— তা হলেই যথেষ্ট হবে।

হঠাৎ করেই মাথায় ঘাই মারে একটা স্মৃতি, যেন ভুলে যাওয়া একটা অধ্যায় দরজায় এসে কড়া নাড়ে। এক দিন নির্জনে কথা বলার সময় অন্নু বলে বসেছিল, ‘‘আচ্ছা, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্-এর নাম শুনি অনেক, পড়া হয়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত। এ বার গীতগোবিন্দম্টা একটু বলবে সংক্ষেপে?’’

ওদের আশ্চর্য সম্পর্কটা তখন সদ্য গতি পেয়েছে, তাই মিচকে হাসি হেসে মানিক বলেছিল, ‘‘বাব্বা! গীতগোবিন্দম্ বলতে গিয়ে আবার শ্লীলতাহানির দায়ে পড়ব না তো? আসলে কাব্যটা প্রধানত শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধার মান-অভিমান, অভিসার, শৃঙ্গার ইত্যাদি নিয়ে লেখা, যার সিংহভাগই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, তবে তুমি অবশ্য অ্যাডাল্ট তাই তোমার সঙ্গে আলোচনা করাই যায়...’’

এর পর মানিক সংক্ষেপে গীতগোবিন্দম্ কাব্যের বিষয়টুকু বলে, তার পর ওর স্মৃতি থেকে জয়দেবের কিছু শ্লোক আবৃত্তি করে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অন্নু। অপূর্ব ছন্দোবদ্ধ শ্লোকগুলো, মানে বুঝতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না। এর পর একটু থেমে মানিক বলল, ‘‘জানো তো, একটা লোককথা চালু আছে। কাব্যরস আর ছন্দের নিয়ম মেনে এক জায়গায় শ্রীকৃষ্ণকে রাধিকার পা ধরতে হবে ছদ্মমান ভাঙানোর জন্য, অথচ কৃষ্ণভক্ত জয়দেব কিছুতেই সেটা লিখতে চাইছেন না। বিব্রত, বিরক্ত কবি কাছেই অজয় নদে স্নান করতে গেলেন। ফিরে এসে আবার লিখতে বসে দেখেন একটু অন্য হস্তাক্ষরে পঙ্‌ক্তির শেষটুকু লেখা। স্ত্রী পদ্মাবতীকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘কে আবার লিখবে? স্নান করতে বেরিয়ে হঠাৎ ফিরে এসে আপনিই তো কী সব লিখলেন, তার পর ফের গেলেন!’ কিন্তু জয়দেব জানেন, উনি লেখেননি, তা হলে কে লিখে গেল!

‘‘কৃষ্ণভক্তরা মনে করেন ভক্তের দ্বিধা দেখে কৃষ্ণ স্বয়ং এসে নিজের হাতে রাধিকার মানভঞ্জনের পঙ্‌ক্তিটি পূরণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। জয়দেব আর তাঁর লেখার গুণমুগ্ধ ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনিও মনে করতেন এটি ঈশ্বরের লীলা। জানো সেই পঙ্‌ক্তিটি কী?— স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসিমণ্ডনম্ দেহি পদপল্লবমুদারম্। এই ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’ অ‌ংশটুকুই ছিল একটু অন্য হস্তাক্ষরে লেখা।’’

অন্নুর মনে হয়েছিল, বাঃ, তবে রাধিকা হওয়া তো বেশ! ঘরসংসার সব ফেলে রাধা বাঁশির টানে ছুটে গিয়েছে বার বার— ভয়, লোকলজ্জা, সমাজের চোখরাঙানি সব কিছু উপেক্ষা করে। সেই খণ্ডমুহূর্তে ওর মনে হয়েছিল, সময় ওখানেই থেমে যাক! পাষাণী অহল্যার পাষাণত্ব দ্রবীভূত হয়ে আনন্দধারায় স্রোতস্বিনী হয়ে উঠেছে ওর মন! এই সময় আর সুযোগ আর কি পাবে ও? জানা নেই, ওর কিচ্ছু জানা নেই... শুধু জানে রাত পোহালে এ সব স্বপ্ন বলে মনে হবে।

সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো নিজের অতীতে ডুব দিয়ে বোধহয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল অন্নু, মোবাইলের কর্কশ আওয়াজে ঘোর কাটিয়ে ফোনটা তুলল বালিশের পাশ থেকে। এত দিন পরও সে দিনের সেই ঘটনাক্রম মনে করলে ও মনে মনে যেন রাইকিশোরী হয়ে যায়, যেখানে ওর উপর মানিক ছাড়া আর কারও অধিকার নেই। চলে-যাওয়া দিনগুলোর কথা চিন্তা করলে এই বয়সে এসেও যেন এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ শিহরন খেলে যায় সমস্ত সত্তায়। মাথাটা এমন ঝিমঝিম করছে যে কলারের নামটা ঝাপসা দেখাচ্ছে, চোখে চশমাটা লাগিয়ে দেখল অপালার ফোন। কী হল আবার, কে জানে! এই তো কালই কত সাধ্যসাধনা করে ওর মুখ থেকে কিছুই বার করা গেল না, আজ এর মধ্যে কী ঘটল আবার যে নিয়ম ভেঙে অপালা মোবাইল টু মোবাইল ফোন করছে! মনে কু-ডাক ডাকা শুরু হয়, আবার কোনও দুঃসংবাদ দেবে না তো অপালা?

ফোন ধরতেই অপালার খ্যানখেনে গলা ভেসে এল, ‘‘এই শোন, কালীপুর জ়ু থেকে বলছি। কয়েক জনকে নিয়ে সকাল ন’টা নাগাদ বেড়াতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, মানিকের সঙ্গেও দেখা করব, তোর সঙ্গেও কথা বলিয়ে দেব, যদি ও রাজি হয়। এসে দেখছি বিশ্রী ব্যাপার! মানিকের জোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে নাক-মুখ। অ্যাম্বুল্যান্সে তুলছে, ও আর বাঁচবে না রে!’’

কথাগুলো শুনে বজ্রাহতের মতো স্থির হয়ে যায় অন্নু, না কি অনামিকা!

১২

সকালে অফিসে বসে সিসি টিভির ব্যাক-আপ ফুটেজ দেখছিল অনিকেত, ডাক্তার দেবাশিস চেম্বারে ঢুকলেন। মুখে রুমাল চাপা দেওয়া, চালচলনে কেমন যেন একটা গরুচোরের ভাব! কী মনে হতে অনিকেত আচমকা বলে উঠল, ‘‘ডাক্তারবাবু, আপনার গালে কী লেগে রয়েছে?’’

বেখেয়ালে দেবাশিস মুখ-ঢাকার রুমালটা নিয়ে গাল মুছতে যেতেই চিচিং ফাঁক হল রহস্যের। ডাক্তার তাঁর মার্কামারা মার্জারপুচ্ছ গোঁফটি কামিয়ে ফেলেছেন। অনিকেত জোরে হেসে ওঠে, ‘‘ঠিকই ধরেছিলাম! আপনি শেষমেশ এত শখের গোঁফ উড়িয়ে দিলেন? পুরুষমানুষের শেষ সম্বল গোঁফটুকুও চলে গেলে আর কী রইল বলুন তো! এমন দুর্ঘটনার পিছনে নিশ্চয়ই বিশেষ কারণ রয়েছে, হয়তো ওটা আপনার গৃহযুদ্ধের মাশুল হিসেবে আত্মত্যাগ করেছে! তাই কি?’’

ডাক্তারবাবু হাল ছেড়ে-দেওয়া ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকান, ‘‘আপনি তো পেটের কথা টেনে বার করবেনই শেষ পর্যন্ত। অগত্যা সারেন্ডার করাই ভাল। হ্যাঁ মশাই, দাম্পত্য কলহের জেরেই এই দুর্ঘটনা। সকালবেলায় শেভ করার সময়ই এমন তুঙ্গে উঠলেন আমার শ্রীমতী, যে হাত-টাত কেঁপে আমার পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীকেই জবাই করে ফেললাম!’’ ডাক্তারবাবুর চোখ ছলোছলো হয়ে আসে, ‘‘আমার বয়স এখন চৌষট্টি হলে আমার গোঁফের বয়স তো ওই রকমই হবে, বলুন! চোদ্দো বছরেই আমার গোঁফের রেখা বেরিয়েছিল কি না। তবে ওকে নিয়ে মিসেসের গঞ্জনাও ওকে মুক্তি দেওয়ার একটা কারণ বলতে পারেন। সর্বক্ষণ খোঁটা দিতেন বুড়ো শিকারি বিড়ালের গোঁফ বলে। বিশেষ করে সম্প্রতি ফেসবুকে এক বাল্যকালের সহপাঠিনীর সঙ্গে একটু রসালাপ করতে দেখে ফেলেছেন উনি। তার পর থেকে মেজাজটা সপ্তমে চড়েই আছে, মশাই! এই বৃদ্ধ বয়সে অশান্তি আর সহ্য হচ্ছে না আমার।’’

অনিকেত সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘‘কী করবেন বলুন, ধরে নিন মা-বাবার মতো গোঁফও কারও চিরকাল থাকে না। আর বৌদি? ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘ঝুনো হইলে জল একটু ঝাল হইয়া যায়। রামার মা ঝুনো হইলে পর, রামার বাপ ঝালের চোটে বাড়ি ছাড়িয়াছিল।’ বাই দ্য ওয়ে, আপনার বাড়ি ছাড়ার কোনও প্ল্যান আছে না কি? থাকলে বলবেন, আমিও সঙ্গী হব।’’

ডাক্তারবাবু বলেন, ‘‘বালাই ষাট, আপনি কোন দুঃখে বাড়ি ছাড়বেন? আপনার মিসেস আর বাচ্চা, সবাই তো মাইডিয়ার টাইপ, ওদের সঙ্গে আপনার ঝামেলা বাধে বলে তো আমার মনে হয় না।’’

অনিকেত স্বীকার করে, ‘‘তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু আমার মতো অসহ্য লোককে সহ্য করতে করতে ওদেরও নাভিশ্বাস উঠে যায়। তাই ওদের রিলিফ দিতে মাঝে-মাঝেই আমি জ়ু-তে থেকে যাই আমাদের চাঁদুবাবুর গেস্ট হয়ে। আবার যখন ওরা আমার অভাব একটু-আধটু ফিল করে তখন বাড়ি ফিরি। আচ্ছা, বিপুল কেমন আছে এখন?’’ ডাক্তারবাবু উত্তর দেন, ‘‘আগের চেয়ে অনেকটা ভাল, কাকে-ঠোকরানো ঘা-গুলো শুকিয়ে এসেছে প্রায়। আমি তো বেরিয়েছি ওকে দেখতে। যাবেন নাকি? গেলে এখনই চলুন, আটটা বাজেনি, ন’টা থেকে তো জ়ু-এর গেট খুলে যাবে। ভিজ়িটররা ঢুকতে শুরু করলে আর বিপুলের সঙ্গে আপনার একান্ত সাক্ষাৎকারটা হয়ে উঠবে না।’’

হাতের কাজ গুটিয়ে অনিকেত দেবাশিসের সঙ্গে রাইনো হাউসের দিকে রওনা হয় বিপুলকে দেখতে। আসলে দু’দিন ওকে না দেখলেই মনে হয় যেন কত দিন দেখা হয়নি। বিপুলের প্রতিক্রিয়া অবশ্য আরও দর্শনীয় হয়, যেমন আজও হল। বাইরের গেটের তালা খুলিয়ে ভিতরের পরিখার পাশ দিয়ে রাইনো নাইট-শেল্টারের ফেন্সিংয়ের কাছে গিয়ে অনিকেত ডাকল, ‘‘বি-পু-ল’’ বলে। প্রথম ডাকেই কান খাড়া করল ছাবিবশ বছরের ‘বৃদ্ধ’ গন্ডার বিপুল। তার পর পায়ে পায়ে পিছিয়ে দূরের দেওয়ালটার কাছে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy