Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৩

পরিক্রমণ

পূর্বানুবৃত্তি: ছেলেকে প্রাতরাশ তৈরি করে দিতে গিয়ে স্ত্রী বিপাশার অদ্ভুত আচরণের সামনে পড়ে অরুণ।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: ছেলেকে প্রাতরাশ তৈরি করে দিতে গিয়ে স্ত্রী বিপাশার অদ্ভুত আচরণের সামনে পড়ে অরুণ। ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। প্রাতরাশ সারে মধুর কচুরির দোকানে। সেখানে এসে জানতে পারে, মধুর স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে অরুণের চেম্বারে গিয়েছিল। তাকে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে ‘ডাক্তার নেই’ বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় বিপাশা।

সবাই এক কথায় রাজি। এ ধরনের জমায়েত সকলেরই পছন্দ। এ বার জল্পনা শুরু হয়ে যায় কবে কখন কার বাড়িতে পরের মিটিংটা হবে। অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। আর না দাঁড়িয়ে গাড়িতে স্টার্ট দেয় অরুণ। এক হাত এগিয়েছে কি এগোয়নি, তার মধ্যেই তারস্বরে বেজে ওঠে মোবাইল। তাড়াতাড়িতে গাড়িতেই রেখে নেমে গিয়েছিল অরুণ। কে জানে আরও কত বার কল এসেছে এর মধ্যে! কান আর ঘাড়ের অদ্ভুত কায়দায় ফোনটা প্লেস করে ‘হ্যালো’ বলে ও। আর সঙ্গে সঙ্গেই একঝাঁক ইট-পাথর লোহালক্কড় যেন একসঙ্গে কেউ ছুড়ে মারতে শুরু করে। বিপাশার মতো এক জন শিক্ষিত মহিলা শিশু চিকিৎসক যে কী করে এ রকম কর্কশ ভাষা ও ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে, সেটা বিয়ের তেরো বছর পরে আজও রহস্য অরুণের কাছে। কানের পর্দায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। “কী করছিলে কী এত ক্ষণ ধরে? অ্যাঁ? কত বার ফোন করেছি তার কোনও আইডিয়া আছে তোমার? কোন চুলোয় গিয়ে ঢুকে বসে আছ? এখনও নার্সিংহোম যেতে পারোনি। বাড়িতে মন টেকে না? স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ঢলানি বৌগুলোর সঙ্গে আড্ডা না দিলে মন ভরে না? তাই ছেলেকে স্কুল নিয়ে যাওয়ায় এত উৎসাহ? আমি সমানে ফোন করে যাচ্ছি, এক বার ধরার ফুরসতটুকু নেই! অসভ্য চরিত্রহীন লোক কোথাকার ...”

অজস্র অসংখ্য নোংরা কথা নর্দমার জলের স্রোতের মতো ধুয়ে দিয়ে যায় রাজারহাট নিউটাউনের নামী ডাক্তার অরুণ সাহার কান। এখানে একটা প্রশ্ন করতেই পারত অরুণ। সে জিজ্ঞেস করতেই পারত, বাড়ি থেকে বার হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই কী এমন দরকার পড়ল বিপাশার যে এত বার তাকে ফোন করল। কিন্তু সে দিকে গেল না অরুণ। এতগুলো বাজে নোংরা অভিযোগের কোনও প্রত্যুত্তর ও দেবে না, দেয় না। শুধু যান্ত্রিক গলায় জিজ্ঞেস করে, কোনও দরকার ছিল? বলাই বাহুল্য, কোনও নির্দিষ্ট দরকারের ধারেকাছে না গিয়ে ফোন কেটে দেয় বিপাশা। কপালে ফুটে ওঠা পরিষ্কার দু’খানা ভাঁজ জোর করে মুছে ফেলে গাড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় অরুণ। চেনা পথে অনেকটা এগোনোর পর চিনার পার্ক মোড় থেকে ডানে ঘুরে যায় গাড়ি। আর দেড়-দু’কিলোমিটার সোজা গেলেই রাজারহাট মেন রোডের উপর ওর নার্সিংহোম, ‘দ্য রিকভারি’। ভুলেও চিনার মোড় থেকে বাঁয়ে তাকায় না অরুণ সাহা। বাগুইআটির ফ্ল্যাটটাকে এখন তিন ঘণ্টার জন্য মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। পর পর অনেকগুলো সার্জারি আছে, মিটিং আছে, অপেক্ষমাণ পেশেন্টের দল আছে।

রাকা দেওয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন দিকের লম্বা করিডরটা থেকে ওকে দেখা যাচ্ছে না। ওই করিডরের দু’পাশে পরপর কোর্টরুম। আলিপুরের এই কোর্টগুলোর মধ্যেই একটাতে চলছে রাকার মামলা। মামলা তো নয়, আট বছরের পিয়ার জন্য রাকা আর সুমনের টানাহ্যাঁচড়া লড়াই। দু’জনেই বাচ্চা মেয়েটার কাস্টডি পেতে বদ্ধপরিকর। আজ তিন বছর ধরে কোর্টে চক্কর কাটছে রাকা ওর রক্তমাংস দিয়ে তিলতিল করে তৈরি করা, নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে আসা মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার জন্য। ছ’বছর আগে যে দিন সুমনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল রাকা, সুমন জোর করে কেড়ে রেখে দিয়েছিল পিয়াকে। অনেক কান্নাকাটি, অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরেও পিয়াকে দেয়নি। তার বদলে ব্রিফকেস-ভর্তি টাকা দিয়েছিল। রাকা সে দিকে ফিরেও তাকায়নি। তার পর তিন বছর লেগেছে মামলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে। রাকার কোন ধারণাই ছিল না, একটা মামলা এত দিন চলতে পারে। অজস্র ধাপ পার করে অবশেষে আজকে কোর্টের সামনে পিয়াকে হাজির করানোর দিন পড়েছিল। বিচারক নিজে শুনবেন আট বছরের মেয়েটির কথা। সেই মতো সুমনও সকাল সকাল মেদিনীপুর থেকে এসে গিয়েছিল মেয়েকে নিয়ে। সঙ্গে মেয়ের ঠাকুমা, পিসি, কাকা—সবাই। রাকার চোখের সামনে দিয়েই তারা মেয়েকে ঘিরে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে বিচারকের চেম্বারে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাকার দিকে এক বার বুঝি তাকিয়েছিল পিয়া। কিছু বলার আগেই ওর ঠাকুমা মাঝখানে ভারী শরীরের আড়াল তৈরি করে প্রাচীর তুলে দিলেন। তার পর তো কোর্টের এক জন কর্মী এসে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল পিয়াকে।

রাকার উকিলবাবু তো সমানেই ওকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। তবু কেন যে ঠিক ভরসা হয় না! জ্ঞান হয়ে থেকে বাবার কাছে আছে মেয়ে। তার মুখ থেকে মায়ের ফেভারে কথা আশা করবে কী করে ও? দেখা করার ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে মাসে যা দু’বার করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটাও তো ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা সময়টুকুর জন্য। তাতে কি মেয়ের মনে একটুও রেখাপাত করতে পেরেছে রাকা? পিয়া কি কোনও দিন বুঝবে ওর জন্য ওর মায়ের আকুলতা? না! আর পাঁচটা কাস্টডি মামলার সঙ্গে এই মামলার তফাত আছে বইকি। কোনও জেদের বশে এই মামলা করেনি রাকা। সুমনকে জব্দ করা ওর উদ্দেশ্য নয়। তা হলে তো ফোর নাইন্টি এইট এ, বা ডি ভি অ্যাক্টে কেস করতেই পারত। কিংবা খুব সহজেই পারত সুমনের আনা ডিভোর্সের কেস কনটেস্ট করে বছরের পর বছর ওকে ঝুলিয়ে রাখতে। তা তো করেনি রাকা! যে বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছে সহজেই, তা থেকে মুক্তি দিয়েছে সুমনকে। কিন্তু মেয়েটাকে তো ও জন্ম দিয়েছে। একটা একটা করে রাত জেগে থেকে নিজের শরীরের মধ্যে লালন করেছে মেয়েকে। তাকে তো এত সহজে ছেড়ে দিতে পারবে না! বরং যা ওর একান্ত আপন, তাকে জোর করেই ছিনিয়ে নেবে ওই অহঙ্কারী মানুষটার কাছ থেকে।

দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে নানান কথা ভেবে চলে ও। অথবা ঠিক ভাবব বলে ভাবে না। এই কোর্ট ক্যাম্পাসে এলেই যেন সমস্ত অতীতটা ওর চোখের সামনে দিয়ে খোলা পাতার মতো ভেসে ভেসে যায়। সেই স্রোতকে আটকে রাখার ক্ষমতা নেই রাকার।

কত ক্ষণ একভাবে দাড়িয়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ বিল্বর ডাকে যেন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে। বিল্ব পিছন থেকে ছুটে এসে বলে, “দিদি দেখ দেখ, কী মিষ্টি দেখতে লাগছে পিয়াসোনাকে!’’

পিয়া মাত্র তিন-চার ফুট তফাতে সুমনের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সাদা ব্রাশোর ঝালর দেওয়া ফ্রকটায় ওকে ছোট্ট একটা পরির মতোই দেখতে লাগছে। তখন খেয়াল করেনি রাকা, এখন মনে পড়ে যায়, এই ফ্রকটা তো এ বারের জন্মদিনে ও-ই পাঠিয়েছিল। সুমন এটাই পরিয়ে নিয়ে এল ওকে? আশ্চর্য! ওই মানুষের ভিতরে কখন কী কাজ করে কোনও দিন জানতেই পারল না রাকা। কিন্তু পিয়াকে নিয়ে কি এখুনি চলে যাবে ওরা? রাকা একবারও কথা বলতে পারবে না মেয়ের সঙ্গে? ওর ব্যাগে যে পিয়ার পছন্দের চকলেট আছে, দেওয়া হবে না সেগুলোও? তা ছাড়া বিচারককে কী বলল পিয়া, সেটাও তো জানা দরকার। সামনের দিকটা অজস্র অটো আর টোটো মিলে জট পাকিয়ে গেটটা জ্যাম করে রেখেছে। হঠাৎ কোনও দিকে না তাকিয়ে অন্ধের মতো পিয়ার পিছনে ছুটে যায় রাকা। আর তখনই এক আনাড়ি চালক গাড়ি ব্যাক করাতে গিয়ে সটান এসে রাকার বাঁ দিকে ধাক্কা মারে। খুব জোরে না হলেও আচমকা লাগায় রাকা বসে পড়তে যাচ্ছিল মাটির উপর। আর তখনই দুটো শক্ত হাতের টানে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয় সোজা করে। সুমন লাফ দিয়ে এসে ধরে ফেলেছে রাকাকে। গাড়িটার জানলার কাছে কিছুটা জায়গা ভাঙা ছিল। সেখানে লেগে রাকার ব্লাউজের হাতাটা ছিঁড়ে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। ওকে নিয়ে এসে একটা চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসায় সুমন। ব্যথায় চোখ ফেটে জল আসছিল রাকার। কিন্তু সুমনের সামনে চোখের জল ফেলাটাও লজ্জার। দাঁতে দাঁত চেপে সামলাতে চেষ্টা করে নিজেকে। পিয়াটা বাবার শার্টের কোনা ধরে কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে মা’কে নয়, যেন কোনও অপরিচিত মহিলাকে দেখছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করে রাকা। বিল্বটাও কী অদ্ভুত। কোথায় দিদিকে দেখবে তা নয়, গাড়ির চালকের সঙ্গে হম্বিতম্বি জুড়ে দিয়েছে।

সুমন হাতটা তুলে ধরে, ডাক্তারি গলায় বলে, “কী মুশকিল, এ তো অনেকখানি কেটে গিয়েছে! এখনই একটা টেটভ্যাক নিতে হবে। তুমি... এস আমার সঙ্গে, গোপালনগরে ওষুধের দোকান পাওয়া যাবে।’’

“আমি পারব, থ্যাঙ্কস...”

“কী এমন ঘটল যে ও ভাবে ছুটে আসতে হল?’’ বিরক্ত সুমন। “একটু দেখেশুনে এগোতে হয়...”

দেখেশুনে এগোইনি বলেই তো আজ একা একা আদালতে চক্কর কাটতে হচ্ছে। কেন ছুটে আসছিলাম, এ কথা সুমন বুঝবে না। দশ মাস পেটে বহন করার পরে যখন সেই সন্তানের উপর কোনও অধিকার থাকে না, যখন এক ঘর লোকের সামনে সেই অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়, সেই কষ্ট কোনও বাবা কখনও অনুভব করতে পারবে না। নিজের মনে নীরব উত্তর দিয়ে যায় রাকা। তত ক্ষণে সুমন জোগাড় করে ফেলেছে বরফের টুকরো। উদাসীন গাম্ভীর্যে রাকার হাতে বরফ ঘষে দিচ্ছে সে। কাটা জায়গাটার পাশে ফোলা অংশে। রাকা প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। এ বার টেনে নেয় হাত। উঠে দাঁড়ায় বেঞ্চ থেকে। পা বাড়ায় সামনে। এক পা কী দু’পা-ই এগিয়েছে, পিছন থেকে ডাকে সুমন, “শোনো...”

চুপ করে ওর চোখে চোখ রাখে রাকা, অপেক্ষা প্রশ্নের।

“পিয়ার সঙ্গে কথা বলবে না? যে জন্য আসছিলে?’’

এটাও আর একটা চমক। যেখানে সব সময় ব্যস্ত থাকে রাকার কাছ থেকে মেয়েকে দূরে রাখতে, সেখানে আজ নিজেই মেয়েকে এগিয়ে দিচ্ছে! পিয়ার দিকে তাকায় রাকা। সে তার বাবার শার্টের কোনা ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর এক এক-বার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ভীষণ খারাপ লাগে রাকার। কী অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, মা আর মেয়ে যেখানে পৃথিবীর ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক, সেখানে মায়ের দিকে কেমন আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটা। পিয়ার দিকে একটু সহজ করে হেসে হাতটা বাড়িয়ে দেয় ও, “কী রে... এত গম্ভীর হয়ে আছিস কেন আজ? কে সাজিয়ে দিল? এই জামাটায় তো ভারী সুন্দর লাগছে তোকে!’’

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Rajarshi Basu Adhikari Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy