ছবি: রৌদ্র মিত্র।
আমরা আপনাকে একটা স্যাড নিউজ় দেব। উই আর সরি টু সে... মিস্টার বিলাস পাল অপারেশন টেবলেই মারা গিয়েছেন...”
মুহূর্তে গরম চায়ের খানিকটা যেন পথ ভুলে খাদ্যনালির বদলে শ্বাসনালিতে ঢুকে পড়ে। ভয়ঙ্কর জোরে বিষম খায় অমল। চা চলকে পড়ে ওর জামায়, টেবিলের কাচে।
“কুল... কুল...অমলবাবু,” ডক্টর বেরা বলেন।
“ক... কখন... হল ডাক্তারবাবু?”
“ওর বাইপাস শেষ করে আইসিইউ-তে নিয়ে আসব তার প্রিপারেশন চলছিল... সেই সময় হঠাৎ রেগুলার সিস্টেম কোলাপস করে যায়...’’
“কিন্তু... হার্টের অপারেশনের পরেও আবার হার্ট অ্যাটাক হল কেন? তাও আবার সঙ্গে সঙ্গেই?”
“কী আশ্চর্য! আপনি কি আমাদের জেরা করছেন না কি? তা ছাড়া এটা কোনও হার্ট অ্যাটাক নয়, ইট ওয়জ় আ সিম্পল সেরিব্রাল অ্যাটাক...” ও পাশের সোফায় বসে থাকা দু’জনের মধ্যে এক জন, যারা ডাক্তার কি না জানে না অমল, বেশ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে। সেই ধমকে অমলের গলার আওয়াজ সঙ্কুচিত হয়, “না... তা বলছি না, তবে... বলাকওয়া নেই... একটা মানুষ এমন দুম করে চলে গেল তো...তাই কেমন লাগছে। আবার বলছেন হার্ট অ্যাটাকও নয়... আর ওঁর বৌকেও জানাননি এত ক্ষণ ধরে। আমি এ বার সামলাই কী করে!’’
“দুম করে কী? দুম করে কী? হি ওয়জ় অ্যাবাউট টু ডাই হোয়েন হি কেম... ইটস ফর আওয়ার ট্রিটমেন্ট দ্যাট হি সারভাইভড ফর লাস্ট টেন ডেজ়...” লোকটা হাতের কাগজ ছুড়ে দিয়ে আবারও যেন ফুঁসে ওঠে।
“আঃ বাজোরিয়া... থামো একটু,’’ ডক্টর কুলকার্নি গম্ভীর গলায় বলে থামিয়ে দেয় লোকটাকে। তার পর অমলের দিকে তাকায়। কিছু ক্ষণ চুপচাপ।
“আপনি কে হন বিলাস পালের?’’
“অ্যাঁ? আমি... মানে... ওই গ্রাম সম্পর্কে আত্মীয় আর কী... মানে ওই বিলাস পাল আমার জামাইবাবু হতেন।’’ ‘হতেন’ শব্দটা নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা শোনানোয় আচমকা চুপ করে যায় অমল। মনে মনে একই সঙ্গে অবাক লাগে ভেবে যে, এই না ক’দিন ধরে ও সমানেই ভেবে যাচ্ছে এই মানুষটা না থাকলে কী কী ফায়দা হতে পারে, তবে আর এখন এমন অশান্তির ঝাপট লাগছে কেন মনের ভিতরে! কখন কোন দিকে তার হাওয়া বয় কেউ জানে না, এমনকি যার মন সে নিজেও না। একই সঙ্গে অমলের আরও একটা কথা মনে হয়, বনানী হয়তো এখনও বিলাসের বেডের স্ট্যান্ডে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। বিলাসকে বেডে দেওয়ার পরে তাকে দেখে তবে নীচে নামবে। আজ কে জানে কেন নার্সরা কেউ আর ভিজ়িটিং আওয়ার্স নিয়ে খুব কিছু কড়াকড়ি করছে না ওদের সঙ্গে। কিংবা হয়তো বনানীকে দেখে মায়া হয়েছে ওদের। বোধহয় হাওয়ায় হাওয়ায় গন্ধ ছড়ায়, আজকে মায়া করারই দিন।
নাঃ, বনানীকে খবরটা দেওয়া দরকার। আর কারও কাছ থেকে শুনলে আর সে সময়টায় অমল পাশে না থাকলে ওকে সামলানো দায় হবে। হাজার হোক এত দিন ধরে ওদের পয়সায় খাচ্ছে অমল, একটা অলিখিত দায়িত্ববোধ ওর সুযোগসন্ধানী মনের মধ্যে থেকে উঁকি দিতে চায়। এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে ও। কিন্তু ডক্টর নম্রতা বেরা বাধা দেন। কুলকার্নি বলে, “উনি তো চলে যাচ্ছেন।”
সঙ্গে সঙ্গেই কোনার দিকের সোফা থেকে লোকটি উঠে এসে দাঁড়ায় ওর পাশে, “আপনি আর কিছু ক্ষণ বসুন,আমাদের কথা এখনও শেষ হয়নি।’’
অমল বিনা বাক্যে বসেও পড়ে। এ বার মুখ খোলেন ডক্টর বেরার পাশে এত ক্ষণ মুখ বুজে বসে থাকা আর এক জন ভদ্রলোক। ওর হাতে স্টেথোস্কোপ রয়েছে। কিন্তু এই ডাক্তার বাবুকেও অমল আগে দেখেনি। নম্রতা নিচু গলায় তাকে বলে, “প্রবাল, ইটস ইয়োর টার্ন।” সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করে, “ অমলবাবু, আপনাকে আমাদের একটা কাজ করে দিতে হবে।’’
“আপনাদের কাজ? আমি করব?’’ বেশ অবাক হয় অমল।
“হ্যাঁ। আমাদেরই। ধরুন... মানে এমন একটা কাজ যেটাতে দেশের উপকার, দশেরও উপকার। সেই সঙ্গে আমাদেরও উপকার এই আর কী!”
অমল সকলের মুখের দিকে তাকায় এক এক করে। “স্যর, আমি... আমি তো কিছুই বুঝতে
পারছি না।’’
প্রবাল হাসেন, “বুঝতে পারবেন। এখনই বলা হবে। চিন্তার কিছু নেই। যে কাজই আপনাকে করতে বলা হোক না কেন, তার বদলে একটা ভাল অ্যামাউন্ট পাবেন আপনি। ধরুন দশ হাজার।’’
এ বারে অমলের মুখ আপনা থেকেই হাঁ হয়ে যায়, সেই হাঁ আর চট করে বুজতেও চায় না। এত বড় শহর কলকাতা, তাতে এত্ত বড় হাসপাতাল। সেখানকার এত বড় বড় সব ডাক্তারবাবু। অমলের ক্ষমতা কী তাঁদের সামনে বসার বা চোখে চোখ রাখার! বিলাস পালের ভাগ্যেই সেটা সম্ভব হল। এখন ওর মতো এক গন্ডগ্রামের মানুষের কাছে এদের কী এমন দরকার থাকতে পারে যার জন্য এঁরা টাকাও দিতে রাজি? অমলের কাছে জগতের সর্বাধিক কাম্য, সর্বাধিক লোভনীয় হল টাকা। ও বরাবর এটাই শিখে এসেছে, টাকা কখনও কাউকে কোনও অবস্থায় দিতে নেই, শুধু যেমন করে হোক তা অন্যের কাছ থেকে নিজের সীমানায় নিয়ে আসতে হয়। সেই টাকা এঁরা দিতে চাইছেন অমলকে! আর একটা-দুটো নয়, একেবারে দশ দশ হাজার!
অমলের চুপ করে থাকাটা ভাবাল অন্যদের। সোফায় বসা লোকটির হাতে বোধহয় সময় খুব কম। সে বিরক্তমুখে বারবার ঘড়ি দেখছিল। এ বার অধৈর্য হয়ে বলে, “আই টোল্ড ইউ কুলকার্নি, ইনক্রিজ় দ্য অ্যামাউন্ট। আজকালকার দিনে দশ হাজারে জলও গরম হয় না।’’
“ওকে... ওকে... মেক ইট ডাবল,’’ কুলকার্নি পাথরের মতো মুখ করে বলে, “এ বার ওকে বুঝিয়ে বলো তোমরা।’’
অমলের মাথার ভিতরে বহু দূর থেকে একটা রেলগাড়ি এগিয়ে আসছে ঝনঝন করে। নিজের কানে সে দশ হাজারকে কুড়ি হাজার হয়ে যেতে শুনল। জড়ানো গলায় কোনও মতে সে বলে, “আজ্ঞে, আমাকে কী করতে হবে?”
ফাইল থেকে কাগজ বার করে এগিয়ে দেন ডক্টর নম্রতা বেরা, “ওঁর স্ত্রীকে দিয়ে এইখানটায় সই করাবেন, তার পর এটা থানায় জমা পড়বে। অ্যাজ় ইফ স্বামীর মৃত্যুর জন্য উনি কমপ্লেন করছেন।’’
‘‘কী এটা?’’ অমল হাত বাড়িয়ে ধরে কাগজটা। চোখ বোলায়। বনানী থানায় কমপ্লেন করছে, এই হাসপাতালের গাফিলতির জন্য তার স্বামী মারা গিয়েছে। ভুল চিকিৎসার ফল এই অসময়ের মৃত্যু। মনে মনে স্তম্ভিত হয়ে যায় অমল। এঁরা এই হাসপাতালের লোকজন হয়ে হাসপাতালের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে বলছেন! কী সাঙ্ঘাতিক!
কিন্তু কেন? এই চক্রান্তের পিছনে এমন কী কারণ থাকতে পারে!
অমলের চুপ করে থাকে। কথা বলে ওঠে বাজোরিয়া নামের লোকটি, “আপনারা যাই বলুন, আমার কিন্তু এই ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক লাগল না। একবারে স্পেসিফিক নাম দিয়ে দিলেই ভাল হত। ইনভেস্টিগেশনে কী আসবে না আসবে, পুলিশের ওপর অত ভরসা করাটা ঠিক না। তা ছাড়া ডক্টর মুখার্জির পপুলারিটির কথাও মাথায় রাখতে হবে। শেষে দেখা যাবে আমও গেল ছালাও গেল...’’
“আঃ! বাজোরিয়া... এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ব্যবসা চালাও? এরা গ্রাম থেকে আসা লোক। কোথায় কোন ডাক্তারের ভুল সেটা এরা জানবে কী করে বাইরে থেকে! তা ছাড়া আমাদের কাছে যা পেপার্স আছে, তাতে মুখার্জির নাম আসতেই হবে। জাস্ট দ্য কমপ্লেন ইজ় টু বি ফাইলড। ওয়েট অ্যান্ড সি...”
“ওকে, লেটস সি!” হাত ওল্টায় বাজোরিয়া, ‘‘আই হ্যাভ নো প্রবলেম উইথ মুখার্জি, ওটা আপনার সমস্যা, আই জাস্ট ওয়ান্ট দ্য হসপিটাল ইটসেল্ফ। তার পর না হয় মুখার্জিকে ফারদার অ্যাপয়েন্ট ভি করে নিব। হা... হা... হা...” বাজোরিয়া দুলে দুলে হাসে।
কী বলছে এরা, কী কী পরিকল্পনা হচ্ছে, কে ডক্টর মুখার্জি...সব হিব্রু ঠেকে অমলের কাছে। সে শুধু এইটুকু বোঝে যে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে এখানে, যার শুরুর সুতোটা অমলের হাতে। তাই এরা টাকা দিতে চাইছে। জায়গা এবং মানুষগুলোর অনুপাতে টাকাটা বড়ই কম, এ কথাটা এত ক্ষণে মাথায় এসে যায় ওর। কাগজটা হাতে নিয়ে সকলের মুখের দিকে তাকায়। ইতস্তত করে একবার-দু’বার। তার পর উঠে দাঁড়ায়।
“কী হল? আপনি তা হলে সইটা করিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন তো?” নম্রতা জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ... মানে... মানে...”
“আবার মানে মানে করছেন কেন? কুড়ি হাজার টাকা দেওয়া হবে এই জন্য, শুনলেন তো।”
“না... মানে... আমরা গ্রামের সাদাসিধে লোকজন, এ সব ঝামেলার মধ্যে যেতে হচ্ছে। বনানীকেও রাজি করানোর ব্যাপার আছে। মানে... বলছিলাম, টাকাটা যদি...আর একটু...মানে...”
এ বার বাজোরিয়া হাত তুলে বলে দেয়, “ওকে...ওকে... মেকিং ইট ফিফটি... নো মোর টক প্লিজ়...নাউ গিভ আস দ্য সাইনড পেপার ব্যাক... আজকেই চাই।’’
অমলের মাথার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া রেলগাড়ির ঝমঝম ফিরে আসে সারা শরীর জুড়ে। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায় বিলাসের বেডের দিকে, যেখানে বনানীকে সে দেখে এসেছে বহু ক্ষণ আগে। এখন অনেক কাজ। বনানীকে খবরটা দিতে হবে, যদি ওরা এত ক্ষণেও কিছু না বলে থাকে। তার পর ওর চোখের জল গরম থাকতে থাকতে সইটাও করাতে হবে। বাকিটা নিয়ে এখন আর ভাবতে চায় না অমল। বিলাস পালের সাম্রাজ্য গুছিয়ে তোলার সময় সে পাবে পরে।
ক্রমশ
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy