Advertisement
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কয়েকটা আশ্চর্য ও ছমছমে অভিজ্ঞতা

যখন পুলিশ ছিলাম

খাটের পাশে রাখা এক্সটেনশন লাইনের (তখনও মোবাইল আসেনি) ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। অক্টোবরের শেষ, শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। ফোনটা তুলতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল: গুড মর্নিং স্যর, ব্রজেন বলছি।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

প্রশান্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:


খাটের পাশে রাখা এক্সটেনশন লাইনের (তখনও মোবাইল আসেনি) ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। অক্টোবরের শেষ, শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। ফোনটা তুলতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল: গুড মর্নিং স্যর, ব্রজেন বলছি।

ব্রজেন ছিল নাইট ডিউটি অফিসার। এত ভোরে ও.সি-র কোয়ার্টারে যখন ফোন করছে, নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে। নারকেলডাঙা থানা সেই সময়ে ছিল ভীষণ আনপ্রেডিক্টেব্‌ল।

—স্যর, রেলব্রিজের নীচে খালের জলে একটা বস্তাবন্দি লাশ ভাসছে।

—পুরুষ না মহিলা?

—পুরুষ। বস্তাটা কিনারায় চলে এসেছিল, দুটো কুকুর ওটা টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে খানিকটা। সেখান দিয়েই হাতের কবজিটা বেরিয়ে এসেছে।

ধড়াচুড়ো পরে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম অকুস্থলের দিকে। ওখানে ছোটখাটো ভিড় জমে গিয়েছিল। অফিসার কাছের বস্তি থেকে দুজন সুইপার ডেকে এনে বস্তাটা রাস্তার ধারে তুলেছে। আমার নির্দেশে বস্তাটা কেটে বের করা হল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের রুগ্‌ণ চেহারার এক যুবকের মৃতদেহ।

যারা ভিড় করেছিল, কেউই বডিটা শনাক্ত করতে পারল না। ফলে আননোন, হিন্দু (তত ক্ষণে সে পরীক্ষা করা হয়ে গেছে) মেল, এজেড অ্যাবাউট থার্টি-ফাইভ ইয়ার্স— এই পরিচয়েই নীলরতন সরকার হাসপাতালের পুলিশ মর্গে পাঠানো হল।

ঘটনাটি যে খুনের, সন্দেহ ছিল না। বুকের বাঁ দিকে একটা গভীর ক্ষত। মাথায়, মুখে আরও আঘাতের চিহ্ন। খুনের মামলা রুজু করা হল। কিন্তু মৃতের পরিচয় জানা না গেলে তদন্তের এগোবে কী করে?

আশেপাশের থানাগুলোতে খোঁজ করা হল, দেখা গেল একেবারে লাগোয়া এন্টালি থানায় এই ধরনের একটা মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। করেছে নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রী বন্দনা পাল, গতকাল ভোরে। সে ডায়েরিতে লিখেছে: তার স্বামী প্রদীপ পাল এক জন ট্যাক্সি ড্রাইভার। প্রতি দিনই মালিকের কাছে গাড়ি জমা দিয়ে রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু গতকাল রাত একটার মধ্যেও সে ফেরেনি। তখন বন্দনা ট্যাক্সির মালিকের বাড়িতে যায়। মালিক বলেন, প্রদীপ সাড়ে এগারোটার সময় ট্যাক্সি গ্যারেজে রেখে হিসেব বুঝিয়ে চলে গেছে।

তার পর ওই মিসিং ডায়েরিতে প্রদীপের চেহারার বর্ণনা দেওয়া আছে। এখন ওই মৃতদেহটি প্রদীপ পালের কি না, যাচাই করা দরকার। প্রদীপের স্ত্রীই মৃতদেহটি দেখে বলতে পারে সেটি তার স্বামীর কি না।

এন্টালি থানা বন্দনার বাড়িতে খবর দিতে গিয়ে তাকে পায়নি, শুধু জানিয়েছে সে নিখোঁজ স্বামীর সন্ধানেই বেরিয়েছে। সন্ধেবেলা বন্দনা থানায় এল। সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত চেহারা, তবে চটক আছে, স্বাস্থ্যও ভাল। সারা দিন ঘুরে ও খুবই ক্লান্ত। যত দূর মনে হচ্ছে ওই মৃতদেহটি ওর স্বামীর। কিন্তু তার আগে ওকে সেটি শনাক্ত করতে হবে।

—বন্দনা দেবী, আপনাকে এক বার আমাদের সঙ্গে এনআরএস হাসপাতালে যেতে হবে।

—হাসপাতালে, কেন?

এ বার আমি কী করব? কী ভাবে বলব যে একটা মৃতদেহ দেখে বলতে হবে সেটা ওর স্বামীর কি না?

আমার দোনামনা ভাবটা লক্ষ করে ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল— আপনারা আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছেন নাকি? পরিষ্কার করে বলুন প্রদীপের কী হয়েছে!

বন্দনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি বসুন। আসলে, ওই হাসপাতালে ওই রকম বয়সেরই এক যুবক ভর্তি আছে, অজ্ঞান অবস্থায়। ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট কেস। আপনি এক বার দেখুন।

মিথ্যে বলতে হল, শুধু বন্দনাকে দিয়ে মৃতদেহ শনাক্ত করানোর জন্য। তার পর ওকে নিয়ে পুলিশ মর্গে যাওয়া হল। মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিছুতেই সেটি ছাড়বে না। সঙ্গী মহিলা পুলিশ অফিসার অনেক কষ্টে বন্দনাকে বাইরে আনলেন। সে তখনও চিৎকার করে চলেছে— তোমার এই অবস্থা যারা করল, তাদেরও আমি চিতায় তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।

বডি তো আইডেন্টিফায়েড হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন, এই নিরীহ ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কে খুন করল। তার কাছে তো টাকা-পয়সাও বেশি ছিল না। দিনের জমা টাকা সে মালিকের কাছে দিয়েও ফিরছিল। তবে কি কোনও শত্রুতা ছিল কারও সঙ্গে? কিন্তু ওই দুর্বল প্রদীপের সঙ্গে কারই বা সেই সম্পর্ক থাকবে। ও কারও সাতে–পাঁচেই থাকত না। আর একটা প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া দরকার— খুনটা হল কোথায়।

এর পর পাঁচ দিন কেটে গেছে। শোক-বিধ্বস্ত বন্দনাকে তেমন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি। প্রদীপের কোনও শত্রু ছিল কি না, এ সব তো জানা দরকার। এগুলো জানতেই প্রদীপের বাড়ির দিকে যাচ্ছি হেঁটে। সঙ্গে এন্টালি থানার এক জন অফিসার। ট্যাক্সি-মালিকের বাড়ি আর প্রদীপের কুঁড়েঘরের দূরত্ব প্রায় আড়াইশো মিটার, এর মাঝেই কোথাও খুনটা করা হয়েছে। হঠাৎ মেশিন চলার আওয়াজ কানে এল। এন্টালির অফিসারের দিকে তাকালাম। উনি বললেন, এখানে একটা করাত-কল আছে, সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে।

আমি থেমে গেলাম। করাত-কল! যে বস্তার মধ্যে প্রদীপের মৃতদেহটা পাওয়া গেছে, সেটার ভেতরে অনেক কাঠের গুঁড়োও পাওয়া গেছে।

—মনে হয় খুনটা কাছাকাছি কোথাও হয়েছে। ঠিক আছে চলুন, আগে বন্দনার স্টেটমেন্টটা নিয়ে নিই, তার পর দেখি নতুন কোনও ক্লু পাওয়া যায় কি না।

একটা মাঠের ধারেই ওদের কুঁড়েঘর, মনে হয় জবরদখল জায়গায় তৈরি হয়েছে। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। বছর দশেক বয়সের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেমন যেন ভয়ার্ত চেহারা। চোখ দুটো বড় বড় করে দেখছে আমাকে।

—মা কোথায়? তোমার নাম কী?

—মা বাজারে গেছে। আমার নাম সুস্মিতা।

আমার ইউনিফর্মটা দেখছে। ও হাঁপাচ্ছে কেন?

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী, বাবার জন্য মন খারাপ করছে?’

—না, বাবা আর আসবে না।

মনে হল একটা কান্নার ডেলা ওর গলায় আটকে গেছে।

—হ্যাঁ মামণি, কিন্তু কেঁদো না। মা তো আছে।

—মা-ই তো বাবাকে মেরেছে।

আমি চমকে উঠলাম।

—কী বলছ তুমি!

—হ্যাঁ কাকু, ঠিকই বলছি। সেই রাতে আমি আর মা খাটের ওপর শুয়ে ছিলাম। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মা উঠে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। মা বোধহয় এক বার আমাকে দেখে নিল। আমি চোখ বুজে ছিলাম। একটা ঝগড়া কানে এল, একটু দূর থেকে। মা ফিসফিস করে আপনমনে বলে উঠল— দাঁড়া, তোর আজ শেষ দিন। বলে তরকারির ঝুড়ি থেকে বড় ছুরিটা বার করে নিয়ে দৌড়ল। আমিও খাট থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, এন্টালি মার্কেটে মাছ বিক্রি করে যে তপনকাকু, সে একটু দূরে বাবাকে ধরে মারছে। মা ছুটে গিয়ে ওই ছুরিটা কাকুর হাতে দিল। তার পর মা বাবাকে ধরল, আর তপনকাকু বাবার বুকে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিল। বাবা ছটফট করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল। মা ছুরিটা নিয়ে এসে বাতায় গুঁজে দিল। ওখানেই রয়েছে। ওটা দিয়ে আর তরকারি কাটা হয় না, বাবার রক্ত লেগে আছে তো!

সুস্মিতার দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে বাঁশের বেড়ার পাশে গুঁজে রাখা ছুরিটা সিজ করা হল। পরে তদন্তে জানা গেল, মাছ-বিক্রেতা তপনের সঙ্গে বন্দনার প্রেম হয়েছিল। মানসিক ও শারীরিক তৃপ্তি বন্দনা পেত না প্রদীপের কাছ থেকে। টাকা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে সবল তপন বন্দনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তাতে বন্দনাও রাজি ছিল। তাই পথের কাঁটা প্রদীপকে সরাতে সে তপনের সঙ্গে স্বামী-হত্যায় হাত মিলিয়েছিল। এই খুনের কিনারা হওয়ায় ভাল লেগেছিল।

॥ ২ ॥

কিন্তু গার্ডেনরিচ রোডের বস্তির মেয়ে রুকসানা পাচার হয়ে গিয়েছিল পুণের কোঠি-তে— তাকে উদ্ধার করে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, অচিরেই তা পরিণত হয়েছিল দুঃখে।

রুকসানার বাবা ইমরোজ ঠেলা চালাত। ধানমন্ডির বস্তিতে একটা ঘরে তিন মেয়ে, এক ছেলে, আর বিবিকে নিয়ে থাকত। বড় মেয়ে রুকসানার বয়স তখন চোদ্দো। গরিব ঠেলাওয়ালার ঘরে জন্মেও সে পেয়েছিল পরি-র সৌন্দর্য।

গার্ডেনরিচ থানায় তখন আমি অ্যাডিশনাল ও.সি। এক সন্ধেয় দেখি, ইমরোজ বসে আছে সেরেস্তার বেঞ্চে, যেখানে ডায়েরি লেখা হয়। অনেক ক্ষণ ধরে বসে থাকতে দেখে ওকে আমার ঘরে ডাকলাম।

—কী হয়েছে?

আমার কথায় বোধহয় স্নেহের ছোঁয়া ছিল। ইমরোজ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

—স্যর, আমার মেয়ে পাচার হয়ে গেছে।

অনেক কষ্টে ওকে ঠান্ডা করে, ওর ঠিকুজি-কুলুজি জেনে, ঘটনাটা শুনলাম। খুব গরিব ওরা, দিনে এক বারই খাওয়া হয়, সন্ধেবেলায়। এক দিন রুকসানা সকালবেলায় তাদের বস্তির ঘরের সামনে বসে আছে, এক মাঝবয়সি মহিলা কাছে এসে বলে— বাঃ! বেশ দেখতে তো তোমাকে! কী নাম তোমার?

তার পর ইমরোজের স্ত্রী নিম্মির সঙ্গে আলাপ করে, পরের দিন একটা বড় কেক এনে দেয়। পরিচয় বাড়তে থাকে।

এক দিন সকালে এসে নিম্মিকে বলে, বিচালিঘাটে আমার এক চাচাতো ভাই থাকে, তার বাড়িতে রুকসানাকে নিয়ে যাই, একটু ঘুরে আসুক। দিনরাত তো এই একটা ঘরেই থাকে।

নিম্মি বলে, কিন্তু আপনার ভাইকে তো আমি চিনি না।

—কী মুশকিল! রহিম মিঞা ওর নাম। যাকে বলবে সে-ই দেখিয়ে দেবে। খেয়াঘাটে খৈনি বেচে।

ব্যস, পরিচয় যখন জানা হয়ে গেল, তখন নিম্মি আর আপত্তি করেনি। রুকসানা সে দিন গিয়ে অবশ্য সন্ধের মধ্যেই ফিরে এল। কিন্তু কয়েক দিন পরে ওই নতুন পরিচিত মাসির সঙ্গে আবার সে গেল, আর ফিরে আসেনি। রহিম মিঞার বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, মহিলা সেই যে প্রথম দিন রুকসানাকে নিয়ে গিয়েছিল, তার পর আর যায়নি।

রুকসানা তা হলে পাচার হয়ে গেছে। কিন্তু কোথায়? তদন্ত এগোবার মতো সূত্র হচ্ছে খৈনিওয়ালা রহিম। সে প্রথমে কিছু বলতেই চায় না। তার পর বলে, ওই মহিলা তার কেউ হয় না। ওর নাম রেশমি। বোম্বাইতে থাকে। অনেক দিন পর পর সে আসে, রহিমের বাড়িতেই ওঠে, তার পর শিকার পেলেই সে ফিরে যায় বোম্বাই। তবে, রুকসানা খুবই সুন্দরী। ভাল দাম পাবে এই আশায় ওকে পুণের নার্গিসের কোঠিতে নিয়ে গেছে। রহিম চেনে জায়গাটা।

বুঝলাম, মেয়ে পাচারে রহিম আড়কাঠির কাজ করে। কিন্তু ও যখন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে, তখন সেটা নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম।

পুণেতে পৌঁছে স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে নার্গিস বাঈয়ের কোঠি রেড করা হল। একটা ঘরে লুকিয়ে থাকা রুকসানাকে যখন সামনে আনা হল, তখন ওর বাবাই ওকে চিনতে পারছিল না। আমারও কেমন যেন সন্দেহ হল। স্বাস্থ্যে ঝলমল করছে, কিমোনো-পরা মেয়েটিই কি রুকসানা?

অনেক পরে যেই ওর বাবার হাতটা ধরল, সে-ও কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরল। নিখোঁজ এবং পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে খুবই খুশি হলাম।

কলকাতায় ফিরে আসার পর সপ্তাহ তিনেক কেটে গেছে। এক সন্ধেয় দেখি ঠেলাওয়ালা ইমরোজ থানায় এসেছে। ভাবলাম, আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। ঘরে ডাকলাম।

—কী ব্যাপার! লেড়কিকে ফিরে পেয়েছ, খুশি তো?

ও মাথা নাড়ল।

—কোথায় খুশি স্যর, মেয়ে কী বলছে জানেন? ও আবার ওখানে ফিরে যেতে চায়।

চমকে উঠলাম। একটা যৌনকর্মীদের ডেরা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি, সে আবার....

বললাম, ‘ইমরোজ, তোমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এখনই নিয়ে এসো ওকে।’

রুকসানা এসে আমাকে ডান হাত তুলে সেলাম জানাল। বলল, বাবা-মা’র সামনে নয়, আমি আলাদা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সেই ব্যবস্থাই হল।

বললাম, কী ব্যাপার? তুমি নাকি ফিরে যেতে চাইছ?

রুকসানা মাটির দিকে তাকিয়ে পা ঘষতে লাগল। একটু পরে বলল, স্যর, ব্রেকফাস্ট কাকে বলে সেটা আমি ওখানে গিয়েই জানলাম। ডিম, টোস্ট, কলা, জ্যাম খেতাম। দুপুরে লাঞ্চে বড় পিসের একটা মাছ। বিকেলে কেক, রাতে চিকেন বা মটন। জানেন স্যর, আমার একটা খাট ছিল। ওটাতে একা শুতাম। আর এখানে? ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার যা-ই বলুন— সব এক বারই। আর শুতে হবে মেঝেতে। চটের বিছানায় সবার সঙ্গে গাদাগাদি করে। চিত হয়ে শুতেই পারি না।

—রুকসানা, তোমার বয়স অল্প তো, তাই বিপদটা বুঝতে পারছ না। তোমাকে এত তোয়াজ করার কারণ কী তা জানো? আরবের এক শেখ আসছেন সামনের সপ্তাহে। তোমার দর ঠিকঠাক হয়ে গেছে— পাঁচ লাখ! তিনি চান একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। এখানে একটা মসজিদে নিকা করে উনি তোমাকে নিয়ে উড়ে যাবেন।

—ওঃ, সে তো দারুণ হবে! জানেন আঙ্কল, আমার না প্লেনে চড়ার খুব শখ।

বুঝলাম, ওকে বোঝানো বৃথা। কিন্তু ওকে কিছুতেই তো ওই নরকে ফিরে যেতে দেওয়া যায় না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে একটা ভাল ছেলের সঙ্গে রুকসানার বিয়ের ব্যবস্থা করা হল। ব্যবসায়ীরাই ওই ছেলেটিকে সিনেমা হলের সামনে একটা পান-বিড়ির স্টল করে দিলেন। রুকসানা তার পর সুখে ঘর-সংসার করতে লাগল।

॥ ৩॥

বড়দিনের উৎসবে শেক্সপিয়র সরণি ও পার্ক স্ট্রিট থানা ২৪শে ডিসেম্বর রাতে চূড়ান্ত ভাবে মেতে ওঠে। রাস্তায় সারা রাত লোক ও গাড়ি চলে, দুটি থানা এলাকাই একেবারে জমজমাট থাকে, সেই রাত যেন শেষ হয় না।

আমি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। শেক্সপিয়র থানাও দেখি। ওখানেই বসে ছিলাম। রাত তখন এগারোটা।

সেরেস্তায় হইচই শুনে ডিউটি-অফিসারকে দেখতে বললাম। একটু পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে নিয়ে সে আমার কাছে এল। কী ব্যাপার?

উনি বললেন— স্যর, আমি হাওড়া যাব বলে ট্যাক্সি খুঁজছিলাম। ভীষণ ডিমান্ড, পাওয়াই যাচ্ছে না। একটু পরে একটা ট্যাক্সি এসে থামল আমার সামনে। ড্রাইভার বলল, এক জন মহিলা রয়েছেন, আপনি ওঁর সঙ্গে যেতে পারেন, ভাড়াটা ভাগ হয়ে যাবে।

আমি উঁকি মেরে দেখলাম, এক সুন্দরী মহিলা কালো প্যান্ট আর মেয়েদের কোট পরে বসে আছেন। উনি মৃদু হাসলেন, আমি গেলে ওঁর আপত্তি নেই। ট্যাক্সিতে উঠলাম। কিছু দূর যাওয়ার পরেই ওই মহিলা আমার কাছে সরে সরে আসতে লাগলেন। তার পর এক সময় কাঁধের ওপরে হাত তুলে দিয়ে কাছে টানতে লাগলেন। আমি তীব্র আপত্তি জানিয়ে ড্রাইভারকে বললাম— গাড়ি থামান, আমি নেমে যাব। গাড়িটা একটু স্লো হতেই ওই মহিলা চকিতে আমার শার্টের বুক-পকেটে রাখা মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে নেমে গেলেন। আমিও তড়িঘড়ি নামলাম, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে ওকে আর খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হল, শিকার ধরতে ও ওই এলাকায় আবার আসবে। আমি তাই ওখানেই ঘুরছিলাম। একটু আগে দেখলাম, ওই বড় হোটেলটার সামনে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে। স্যর, এখনই যদি এক জন অফিসার পাঠান, তা হলে ওকে পেয়ে যাবেন। ভীষণ বদমাশ। থানায় এনে অন্তত দুটো ডান্ডা মারবেন।

আমি এক জন অফিসার পাঠালাম ভদ্রলোকের সঙ্গে, আধ ঘণ্টা পরেই এক জন সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে থানার লোকেরা ফিরল।

অফিসার ঢুকেই বলল— স্যর, মেয়েটিকে তো পেয়েছি, কিন্তু ভদ্রলোক ওখান থেকেই চলে যেতে চাইছিলেন, অনেক কষ্টে ওঁকে এনেছি।

বললাম, ঠিক আছে, আগে মহিলার কথা শুনে নিই।

ওর দিকে তাকালাম। প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, সুন্দর, লাবণ্যে ভরা মুখশ্রী, কেতাদুরস্ত পোশাকে দারুণ লাগছে।

আমি কিছু বলার আগে সে একটা মানিব্যাগ টেবিলের ওপরে রাখল।

—এইটা নিয়েই কমপ্লেন তো? এই নিন। এখন শুনুন স্যর, কী হয়েছিল। আমি তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বড়দিনের বাজার, কিছু তো কামাতেই হবে। তা ওই ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বুঝলেন যে আমি লাইনের। ঘুরে-ফিরে দেখছিলেন, তার পর সামনে এসে বললেন— কত নেবে? আমি বললাম হাজার। তবে, আমি কোনও হোটেলের রুমে যাই না। যা করার ট্যাক্সিতেই হবে। উনি রাজি হয়ে গেলেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের দেখেই বুঝল সব। বলল— পাঁচশো লাগবে। আমি বললাম, চলো।

তার পর উনি চলন্ত ট্যাক্সির মধ্যেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর শুরু করলেন। আমি চুপচাপ ছিলাম। এক সময়ে বললেন, হোটেলে তো যেতে চাও না, তা হলে ট্যাক্সির মধ্যেই... উনি আমাকে আনড্রেস করার চেষ্টা করলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম। ট্যাক্সি থামালাম। বললাম, আমার পেমেন্ট দিন, আমি নেমে যাব। উনি বললেন— তুমি কিছুই পাবে না। কিছুই হল না, তোমার রূপ দেখে আমি টাকা দেব? ভাগো!

আমি ওঁর শার্টের বুক-পকেটে রাখা মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়লাম।

গল্পটা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম— তোমার এই নাচতে নেমে ঘোমটা টানা কেন? এক জন পুরুষ তোমাকে হায়ার করল, তুমি তার দাবি না মিটিয়েই টাকা চাইলে!

মেয়েটি মুখ নিচু করে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, সেটা মেটাতাম কী করে স্যর?

—কেন?

—আমি তো মেয়ে নই।

প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

—মানেটা কী?

—আমি এক জন হিজড়ে।

চমকে উঠলাম।

—হ্যাঁ স্যর। আমি ওয়ার্ল্ড হেল্‌থ অর্গানাইজেশনের এক জন ভলান্টিয়ার। যৌনকর্মীদের মধ্যে কন্ডোম বিলি করি। দেখুন, আমার ব্যাগে ক’টা ওই জিনিস রয়েছে। আমাকে অনেকটা মেয়েদের মতো লাগছে না স্যর? একটা অপারেশন করিয়েছি সিঙ্গাপুরে গিয়ে। তাতে দেখুন না, বুকটা কী রকম ডেভেলপ্‌ড হয়েছে। আর একটা অপারেশন করলেই সেক্স চেঞ্জ হয়ে যাবে। তিন লাখ টাকা লাগবে। আমার পাসপোর্ট-ভিসা তো রেডি আছেই। সামনের বছর দেখবেন এ ধরনের কোনও কমপ্লেন পাবেন না, সব কাস্টমারকেই তখন খুশি করে দেব।

সেই খদ্দেরকে ডাকলাম।

—আপনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন?

—কী বলব স্যর, ওই মানিব্যাগটা নিতেই আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল।

মানিব্যাগটা ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিলাম, আর সুন্দরীটি আমাকে সেলাম করে থানা থেকে বেরিয়ে বড়দিনের ভিড়ে মিশে গেল।

॥ ৪॥

গার্ডেনরিচের রুকসানাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারলেও, মানিকতলার মুরারিপুকুর লেনের সন্ধ্যার ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ। এক ভাড়াটে বাড়িতে জামাইবাবুর সংসারে থাকত মা-বাবা মরা মেয়ে, বছর চোদ্দোর সন্ধ্যা। উদয়াস্ত খাটত। রাস্তার টিউবওয়েল থেকে জল আনত। এক দিন দেখল, রাস্তার বটগাছের তলায় গেরুয়া বসনধারী এক সাধুবাবা বসেছেন। অনেকে হাত দেখাচ্ছে। কৌতূহলী সন্ধ্যাও এক ফাঁকে তার ফর্সা হাতটা মেলে ধরল ওঁর সামনে।

সাধুবাবা এক বার ওকে দেখে নিলেন।

—তুই তো রাজরানি হবি রে! পরে ফাঁকা হলে আয়, ভাল করে দেখে দেব।

সন্ধ্যা পরে এক সময় গেল। উনি ওরই অপেক্ষায় ছিলেন।

—জয় মা, তোর হাত দেখা আমার হয়ে গেছে। একেই বলে ঈশ্বরের লীলা। ঝুলিতে রয়েছে আমারই শিষ্যের ছেলের এক ছবি। বড় অফিসার! তার জন্য সুলক্ষণা একটা পাত্রী দেখে দিতে হবে। পণ-টন কিছুই চায় না। শুধু ভাল মেয়ে।

সন্ধ্যা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

—কিন্তু ওরা আমাকে দেখলই না, বিয়ে করে নেবে!

—হ্যাঁ রে পাগলি, হ্যাঁ। এই সর্বানন্দ স্বামীকে ওরা দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। তবে, এখন কাউকে কিছু বলা যাবে না।

—দিদি-জামাইবাবুকে বলে আসি?

‘না!’ চিৎকার করে উঠলেন সর্বানন্দ স্বামী। একেবারে বিয়ে করে বরকে সঙ্গে নিয়ে এসে ওঁদের প্রণাম করবি।

—তা হলে আমাকে কী করতে হবে?

—কাল ভোরবেলা, কেউ কিছু জানার আগে আমার কাছে চলে আসবি। তোকে নিয়ে সোজা চলে যাব হাওড়া স্টেশনে।

—হাওড়া?

—একদম প্রশ্ন করবি না। পাত্র দূরে থাকে, আমরা ট্রেনে করে সেখানে চলে যাব। তাদের হাতে তোকে তুলে দিয়ে তবেই আমার ছুটি হবে।

সবই সাধুবাবার প্ল্যান-মাফিক হল। সন্ধ্যা পাচার হয়ে গেল চম্বল উপত্যকার একটি গ্রামে। ওখানকার এক জোতদারের বাড়িতে সে বহাল হল পরিচারিকার কাজে।

মাস তিনেক পরে, সর্বানন্দ আবার ফিরে এসেছে মানিকতলায় নতুন শিকারের খোঁজে। পাড়ার লোকেরা তক্কে-তক্কে ছিল। এই সাধুবাবা ওখান থেকে যাওয়ার পরই সন্ধ্যার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব সে-ই পাচার করেছে ওকে। জামাইবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতে কিডন্যাপিং কেস শুরু হল। ‘সাধুবাবা’ পুলিশের গুঁতোয় সব বলে দিলেন। আমরা হাজির হলাম এক ডাকাত-অধ্যুষিত গ্রামে। স্থানীয় থানা আমাদের সঙ্গে প্রচুর রাইফেলধারী পুলিশ-পাহারা পাঠিয়েছিল।

সন্ধ্যাকে খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু তাকে যে বিয়ে দেবার বদলে পরিচারিকার কাজে লাগানো হল, সেই নিয়ে তার কোনও হেলদোল নেই। ধনী জোতদারের সংসারে সব কিছুরই প্রাচুর্য। ফলে খাওয়াদাওয়ার কোনও সমস্যা নেই। আর খাটুনি? সে-ও নামমাত্র।

সন্ধ্যাকে উদ্ধার করে গ্রামের কৃষিজমির আল ধরে ফিরছি, সামনে-পিছনে রাইফেলধারী পুলিশ। সন্ধ্যা আমার পাশে হাঁটছে। হঠাৎ আমার কনুইটা ছুঁয়ে বলল— স্যর, আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? আমি এখানে তো ভালই ছিলাম।

অবাক চোখে ওকে দেখলাম!

—তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে, তুমি জামাইবাবুর কাছে আরও ভাল ছিলে এবং থাকবে।

—ছাই ভাল! শুধু খাটুনি, আর দিনেরাতে দু’বার খাওয়া। এখানে অফুরন্ত খাওয়াদাওয়া। কোনও অভাব নেই। আর বাঙালি মেয়ে বলে সমীহ করে কথা বলে।

ওর কথা শুনলে তো আমার চলবে না। কিডন্যাপিং গার্ল রেসকিউ করেছি, ওর গার্জেনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াই আমার ডিউটি।

সন্ধ্যা তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার মাসখানেক পর একটা রাস্তায় রেড করছি। ওখানে নাকি কল-গার্ল রাস্তায় দাঁড়ায়। পথ-চলতি মানুষদের বিরক্ত করে। অফিসাররা চার জন মেয়েকে ওখান থেকে ধরে থানায় নিয়ে এল। এক-এক জনকে আমার সামনে হাজির করছিল। তৃতীয় যাকে নিয়ে এল, সে এসেই ঢিপ করে আমার পায়ে প্রণাম করল। মুখ তুলে বলল, ভাল আছেন স্যর?

—সন্ধ্যা?

—হ্যাঁ স্যর। তখনই তো আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে এলেন কেন? এখানে এসে আমার অবস্থা দেখছেন, ফুটপাতে না দাঁড়ালে পরের দিন কেন, রাতের খাবারও জুটবে না।

—কেন? তোমার দিদি-জামাইবাবু রয়েছেন না?

—থেকে কী হল? আমার দিদিই আমাকে বলতে শুরু করল, দেখ সন্ধ্যা, এখান থেকে পাচার হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তোকে উদ্ধার করে। এই এক মাস তুই যাদের কাছে ছিলি, তারা কি তোকে রোজ ধান-দুব্বো দিয়ে পুজো করত? আমারও তো একটা মেয়ে আছে, তাকে পার করতে হবে। এখনই লোকে নানা কথা বলছে— আমি একটা নোংরা মেয়েকে ঘরে ঠাঁই দিয়েছি।

আমি বললাম, দিদি! কী বলছ! আমি তা হলে কোথায় যাব? দিদি বলল— যেখান থেকে এসেছিস, সেখানেই চলে যা। আমাদের ছোট্ট সুখের সংসারে আর অশান্তি আনিস না।

তার পর থেকেই তো স্যর এই লাইনে। তবু দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে তো।

॥ ৫॥

আমি তখন একবালপুর থানার ও.সি.। রাত থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। ভোরে কোয়ার্টার্সের জানালায় বসে প্রকৃতির শোভা দেখছি। হঠাৎ থানার ডিউটি অফিসার এসে হাজির।

—স্যর, একটা মেয়ে রেপ্ড হয়েছে। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। আমি ওখানে ফোর্স রেখে এসেছি, আপনারও যাওয়া দরকার।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই পোশাক পরে চলে গেলাম। ‘জয় হিন্দ’ নামে একটা হোটেলের পাশের সরু গলিতে জল-কাদার মধ্যে একটা বছর চব্বিশ-পঁচিশ বয়সের মেয়ে বসে। তার পরনের শাড়িতে রক্তের দাগও রয়েছে। মেয়েটি মূক ও বধির। সকাল থেকেই সে গোঁ-গোঁ করে কী যেন বলতে চাইছে। কয়েক জন বয়স্কা মহিলা ওর কাছে জানতে চেয়েছিলেন কী হয়েছে। সে আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে এক জন ভবঘুরে টাইপের। গত রাতে ওই গলিতে সে আশ্রয় নিয়েছিল বিশ্রামের জন্যে। বৃষ্টি নামে। রাস্তা শুনশান হয়ে যায়। সেই সময়ে একটি যুবক এসে তাকে ধর্ষণ করে। বোবা হওয়ায় তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছিল না। সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ছেলেটির গায়ের জোরের কাছে হেরে যায়।

আমরা আকার-ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করলাম— অপরাধীকে ঠিক খুঁজে বের করব এবং তার কঠোর সাজার ব্যবস্থা করব। ও এখন আমাদের সঙ্গে চলুক হাসপাতালে, ওর চিকিৎসা করার খুবই প্রয়োজন।

মেয়েটি বুঝিয়ে দিল, যত ক্ষণ না অপরাধীকে ধরে তার সামনে আনা হচ্ছে, সে ওখান থেকে উঠবে না।

এলাকায় পাওয়া গেল মূক ও বধির স্কুলের এক জন শিক্ষককে। তাঁর মারফত সাইন ল্যাংগোয়েজে কথা বলেও, মেয়েটির জেদ ভাঙা গেল না।

এ দিকে ভিড় বাড়ছে। উত্তেজনার পারদ চড়ছে। আমি ওখানে আরও ফোর্সের ব্যবস্থা করতে থানায় ফিরে এলাম। ফোনাফুনি করছি, গেট-ডিউটি কনস্টেবল বলল, এক মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, বিষয়টা খুবই জরুরি।

ওফ, এই সময়েই তার দেখা করাটা একান্ত প্রয়োজন? মনে হচ্ছে তো বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের ঝামেলার ব্যাপার। তবু আসতে বললাম, খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব।

ঘরে ঢুকলেন বছর ষাটের এক মহিলা, তাঁর হাতে ধরা আছে বছর পঁচিশের এক যুবকের হাত।

—কী ব্যাপার?

—লিজিয়ে। আপকা রেপ কেস কা বদমাসকো।

আমি তো অবাক!

মহিলা বলে চলেছেন— গত রাতে তাঁর ছেলে রফিক ঘরে ছিল না। কোথায় যেন ভিডিয়ো শো দেখতে গিয়েছিল। ভোরবেলা বাড়িতে ফিরে ও কলতলায় গিয়ে অনেক ক্ষণ ধরে পা ধুচ্ছিল। ওঁর তো তেমন ঘুম হয় না, উনি উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

—কী রে, এত কাদা লাগল কোথায়?

—ওই ভিডিয়ো শো থেকে ফেরার সময় জোরে বৃষ্টি নামল, তখনই...

—কিন্তু দুই হাঁটুর কাছেই এত কাদা এল কী ভাবে?

—এক বার পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, তখনই হয়তো...

বৃদ্ধা বাইরে এসে দেখলেন খুব হইচই হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে সব জানলেন। মনে হল, তাঁরই ছেলে এই অপকর্মটি করেছে। এলাকায় উত্তেজনা বাড়ছে, বন্‌ধ ডাকার তোড়জোড়ও চলছে।

—আপনি দয়া করে আমার ছেলেটিকে ওই মেয়েটার কাছে নিয়ে যান, দেখুন ও একে চিনতে পারে কি না।

আমি আর দেরি না করে জিপে করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে ছেলেটিকে একটু দূরে ওই ধর্ষিতা মেয়েটির সামনে দাঁড় করালাম। ওকে দেখামাত্র বিকট চিৎকার করে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। আমি তড়িৎগতিতে ওকে সরিয়ে নিলাম।

এর পর মেয়েটিকে থানায় নিয়ে গিয়ে লেডি কনস্টেবলদের সাহায্যে পরিষ্কার করিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হল।

আসামি ধরা পড়াতে এলাকায় উত্তেজনাটাও থিতিয়ে এল। আমি রফিকের মা-র সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেছিলাম।

॥ ৬॥

নারকেলডাঙা কোয়ার্টার্সে যখন ছিলাম, বাতাসী নামে এক বছর চব্বিশেকের মেয়ে আমার স্ত্রীকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করত। থানার সেপাইরাই তাকে নিয়ে এসেছিল। খালপাড়ের একটা ঝুপড়িতে থাকে। বিবাহিতা। কিন্তু বেশ চটপটে।

এক দিন সকালে আমি থানায় নামার জন্য তৈরি হচ্ছি, বাতাসী সামনে এসে দাঁড়াল।

—কী রে, কিছু বলবি?

—স্যর, আমি আজ বিকেলে কাজে আসতে পারব না।

বাতাসী দু’বেলাই আসত। সন্ধেবেলা রুটি সবজি ইত্যাদি তৈরি করে দিয়ে যেত।

আমি বললাম, ও, এই ব্যাপার? তা, কোনও কাজ আছে বুঝি?

—হ্যাঁ, আমাদের থানা ঘেরাও কর্মসূচি আছে।

বাতাসী রাজনীতি করে জানতাম, কিন্তু আমাকে কখনও কিছু বলেনি।

হাসতে হাসতে বললাম, তা আজ কোন থানা ঘেরাও করছ?

আমার চোখে চোখ রেখে বলল— নারকেলডাঙা থানা।

আমি তো অবাক! বাতাসী আমাকেই ঘেরাও করতে আসছে আগাম জানান দিয়ে!

বললাম— কেন?

—এলাকায় অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। বড়বাবু কিছুই দেখছেন না। মানুষ শান্তিতে থাকতে পারছে না, সেই জন্য।

ওকে আর কিছু বললাম না। থানায় গিয়ে, সেকেন্ড অফিসারকে ডাকলাম।

—শুনছ, আজ থানা ঘেরাও হবে।

—হ্যাঁ স্যর। আপনার কোয়ার্টারে যে মেয়েটি কাজ করে, সে-ই তো এর পান্ডা। কাল আপনি খালপাড়ের ঝুপড়িতে যে চোলাইয়ের ঠেকটা ভেঙেছেন, তার মালিককে অ্যারেস্ট করেছেন— বলাই মণ্ডল, সেই বলাই হচ্ছে বাতাসীর বর। সবাই ওকে বলেছে, তুই বড়বাবুর কোয়ার্টারে কাজ করিস, আর তোর বরকে উনিই ধরলেন! সে তো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই— এ সব কিছুই করেনি। ঘরে বসে শুধু দু-চার ব্লাডার চুল্লু বিক্রি করে। তাই আজ আপনার অপদার্থতা নিয়ে স্লোগান হবে।

আমি মুচকি হেসে ভাবলাম, এমন চাকরি কেউ কখনও দেখেছে? এত রকম আশ্চর্য অভিজ্ঞতা যেখানে সর্ব ক্ষণ হয়! চাকরি, তোমাকে সেলাম!


prosantabanerjee43@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE