তখন তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র। সদ্য পড়েছেন রোমান কবি ওভিড-এর লেখা ‘এপিস্তুলাই হেরোইদুম’ বা, ‘হেরোইদেস’। যেখানে গ্রিক পুরাণের নারীরা আবেগে-আশ্লেষে চিঠি লিখেছেন তাঁদের প্রেমিকদের। এমন কাব্য তো বাংলায় নেই, মনে হয়েছিল ছাত্রটির। নাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ভাবলেন, এর অনুকরণে নতুন এক কাব্য লিখলে হয় না? সেখানে ভারতীয় পুরাণের নারীরা প্রশ্ন-অভিযোগ-আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখবেন তাঁদের স্বামী অথবা প্রেমিককে। চিঠির আদল হবে পৌরাণিক, কিন্তু অন্তরে থাকবে সমকালের স্বর। মাথায় ঘুরতে থাকা পরিকল্পনা তখনই জানিয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে।
এর বেশ কয়েক বছর পরে মাইকেল লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য— ‘বীরাঙ্গনা কাব্য।’ তত দিনে জীবনের পরিচিত ছন্দ থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। জাতপাতের গণ্ডি মেনে বাবা রাজনারায়ণ দত্তের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়েতে তাঁর বেজায় আপত্তি। অচেনা-অজানা এক মেয়ের সঙ্গে কী ভাবে যে আজীবনের গাঁটছড়া বাঁধা যায়, হিন্দু কলেজের ছাত্রটির মাথায় তা ঢোকে না। ধর্ম বদলে খ্রিস্টান হলেন তিনি। মধুসূদনের আগে জুড়ে গেল ‘মাইকেল’। বাড়ি, কলকাতা ছাড়লেন। মাদ্রাজে গিয়ে প্রেমে পড়লেন রেবেকা নামে একটি মেয়ের। বিয়ে করলেন তাঁকে। কিন্তু বিয়ে টিকল না রেবেকার সঙ্গে। তার পরে তিনি আবার বিয়ে করেন ফরাসি তরুণী হেনরিয়েটাকে।
‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর পরে, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। শকুন্তলা, তারা, রুক্মিণী, কৈকেয়ী, শূর্পণখা, ভানুমতী, দ্রৌপদী, দুঃশলা, জাহ্নবী, ঊর্বশী, জনা— এগারো জন পৌরাণিক নারী চরিত্র ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ তাঁদের প্রেমিক অথবা স্বামীকে চিঠি লিখলেন। সে চিঠির সুর কখনও অনুনয়ের, কোথাও বা প্রশ্ন আর অভিযোগে তীক্ষ্ণ।
পুরাণের প্রচলিত ছাঁদ, চেনা গল্পকে সম্পূর্ণ দুমড়ে তাকে নতুন খাতে বইয়ে দিলেন মাইকেল। যে প্রবণতা মেঘনাদবধ কাব্যে আছে। সংস্কৃত সাহিত্য, পুরাণ, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বা ভার্জিলের ‘দ্য ইনিড’ পড়া মুক্তমনা মাইকেল এমন এক সমাজের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী প্রশ্ন তুলবে, বুঝে নিতে চাইবে নিজের অধিকার। যা সে সময় ছিল আকাশকুসুম চিন্তা। তাই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ কথা দিয়ে কথা না রাখা স্বামীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কৈকেয়ী। রুক্মিণী স্বেচ্ছায় অপহৃতা হতে চেয়ে পত্র পাঠিয়েছেন দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণের কাছে। মাইকেলের বীরাঙ্গনারা কুণ্ঠা কাটিয়ে জগৎকে জানাতে চান নিজের ইচ্ছের কথা। নিছক সংস্কারবশে মেনে নেন না স্বামী বা প্রেমিকের প্রবঞ্চনা।
কিন্তু প্রথম থেকেই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর সবচেয়ে বিতর্কিত পত্র ‘সোমের প্রতি তারা’। প্রত্যেক নায়িকার চিঠির শুরুতেই মধুসূদন কাহিনিসূত্র দিয়েছেন। সেখানে বলা থাকে, কোন পরিস্থিতিতে সেই নায়িকা অমুককে ওই চিঠিটি লিখেছেন। তারার চিঠির মুখবন্ধ থেকে জানতে পারি, দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রমে বিদ্যালাভের জন্য এসেছিলেন যুবক সোমদেব। রূপবান এই তরুণের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন বৃহস্পতির স্ত্রী তারা। শিক্ষাশেষে ছাত্র ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে গুরুপত্নী চিঠি লেখেন সোমদেবকে। যেখানে মেলে ধরেন তাঁর অনুক্ত কামনা। মধুসূদন লিখছেন, “সোমদেব যে এতাদৃশী পত্রিকাপাঠে কি করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহার পরিচয় দিবার কোন প্রয়োজন নাই। পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা অবগত আছেন।” আর গোল বাধে এখানেই। আসলে কী করেছিলেন সোমদেব?
পুরাণে আছে, সিক্তবসনা তারাকে দেখে সোমদেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এমনই সে উত্তেজনা যে সব কিছু ভুলে তিনি অপহরণ করেন তারাকে। তারা যথাসাধ্য বাধা দেন। বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকেন কে তিনি। পতিব্রতা গুরুপত্নীকে জোরপূর্বক সঙ্গম করলে যে সহস্র ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়, সে কথাও জানাতে ভোলেন না। কিন্তু কামোন্মত্ত সোমদেব জল-স্থল-পাতালের নানা জায়গায় তারাকে নিয়ে যান, আর মেতে থাকেন উদ্দাম সঙ্গমে।
অবশেষে প্রজাপিতা ব্রহ্মা ও মহাদেবের মধ্যস্থতায় বৃহস্পতি ফিরে পান তাঁর স্ত্রীকে। তারা তখন গর্ভবতী, ক্রমে সোমদেবের ঔরসে জন্ম হয় বুধের। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের এই কাহিনি উল্টে যায় মাইকেলের লেখায়। সেখানে দেবী তারাই কামনা করলেন চন্দ্রকে। তারা চন্দ্রের উদ্দেশে লিখলেন, ‘তুষেছ গুরুর মন: সুদক্ষিণাদানে,/ গুরুপত্নী চাহে ভিক্ষা, দেহ ভিক্ষা তারে।’ অদম্য শরীরী আহ্বান। যেখানে স্পষ্ট এক নারীর যৌন স্বাধিকারের কথা।
কিন্তু মাইকেল পুরাণের বদল ঘটালেন কেন? উত্তর খুঁজতে আর এক পৌরাণিক প্রসঙ্গের গিঁট খুলতে হয়। মহামতি অঙ্গিরার পুত্র উতথ্য ছিলেন বৃহস্পতির বৈমাত্রেয় দাদা। উতথ্যর স্ত্রী মমতা যখন গর্ভবতী, এক দিন বৃহস্পতি মমতার অসম্মতি সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে রমণে উদ্যত হন। মমতা বাধা দেন। এমনকি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানটিও মায়ের জরায়ুপথ আটকানোর চেষ্ঠা করে। সম্ভোগ ব্যাহত হওয়ায় ক্রুদ্ধ দেবগুরু সেই সন্তানকে অন্ধত্বের অভিশাপ দেন। মমতাও পাল্টা অভিশাপ দেন বৃহস্পতিকে— এক দিন তাঁর স্ত্রী তারা-ও পরপুরুষের ভোগ্যা হবেন। তাই তারার নারীত্বের অবমাননা বুঝি একপ্রকার অনিবার্যই ছিল। এক বিকৃতকাম পুরুষের লালসার ফলশ্রুতিতে অন্য এক পুরুষের কামনার শিকার হলেন আর এক নারী।
মধুসূদন এই পৌরাণিক অশালীনতার প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলেন সদর্পে। পুরাণকথার অভিমুখটাই তিনি দিলেন ঘুরিয়ে। মূল পুরাণে সোমদেবের লাম্পট্যের গল্পের পরিবর্তে এখানে চালিকার আসনে বসালেন তারাকে।
মাইকেল ছন্দ ভাঙলেও সেই সময় সমাজ তো ছন্দ ভাঙতে শেখেনি। পুরাণের গল্প পাল্টে গেল— নারী তাঁর অধিকার নিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করছে, সমালোচনার ঝড় ওঠার কথা। কিন্তু এই কাব্য তার বিষয় আর আঙ্গিকের অভিনবত্বে সেই সময় এতই আলোড়ন ফেলেছিল, বীরাঙ্গনাদের চিঠির উত্তর লেখার একটা প্রবণতা চোখে পড়ে পরের পঞ্চাশ বছর জুড়ে।
প্রকাশকালের বছর দশেক পরেই অসমের বরাক উপত্যকার রামকুমার নন্দী মজুমদার লিখে ফেলেন ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য’। যেখানে চাঁদ বলছে— “কলঙ্কী শশাঙ্ক কেহ বলে নাই সতি!/ এত দিন, কিন্তু তব ভবিষ্যত-কথা/ দৈববাণী সম এবে ফলিবে দাসেরে;/ ধরিবে কলঙ্ক এ কিঙ্কর তব নামে—/ শোভিবে সোমের অঙ্কে সে কলঙ্করেখা,/ ভৃগুপদচিহ্ন যথা মাধবের হৃদে।/ তারানাথ নাম মম তেয়াগিয়া আজি,/ হইব তারার দাস জনমের মত!” ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় কী ভাবে উত্তরসূরিরা আঁকড়ে ধরেছিলেন মধুসূদনকে, তারই আভাস পাওয়া যায় এই ‘উত্তর-বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য’ পড়লে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy