ছবি: কুনাল বর্মণ
সেপ্টেম্বর, ১৯২২। একটা চিঠি পেলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। লিখেছেন ভান্টে অগাস্ট আরহেনিয়াস। সুইডিশ বিজ্ঞানী। ১৯০৩ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ় পেয়েছেন। ১৯২২-এ তিনি আবার নোবেল ফিজ়িক্স কমিটির চেয়ারম্যান। মানে যাঁরা ঠিক করেন পদার্থবিদ্যায় কে নোবেল প্রাইজ় পাবেন, তাঁদের প্রধান। এহেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কী লিখেছেন আইনস্টাইনকে?
এখানে বলে নেওয়া ভাল, আইনস্টাইন কিন্তু তখন একজন ভিভিআইপি। বয়স ৪৩। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ এবং তিনি সুইটজ়ারল্যান্ডের বার্ন শহরে নেহাতই এক অজ্ঞাতকুলশীল পেটেন্ট কেরানি, তখন বিজ্ঞানের দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এক বছরের মধ্যে পাঁচটি পেপার ছাপিয়ে। তবু তখন তাঁর খ্যাতি সীমাবদ্ধ ছিল পদার্থবিদদের মধ্যে। পেপারগুলো ছাপানোর আগেও তিনি কলেজে মাস্টারি জোগাড় করতে পারেননি, তার অব্যবহিত পরেও না। ১৯২২ সালে তিনি বার্লিন শহরে দস্তুরমতো একজন প্রফেসর। জনারণ্যে তাঁর খ্যাতির সূত্রপাত ১৯১৯ সালে। তাঁর বিখ্যাততম তত্ত্ব জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি পরীক্ষায় ঠিক প্রমাণিত হওয়ায়। তত্ত্বটা যে ঠিক, তার প্রমাণ মিলেছিল ১৯১৬ সালেই। যখন তা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি। কিন্তু সে তো ব্যাখ্যা। পরীক্ষায় সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের ব্যাপার নয়। ১৯১৯ সালের ব্যাপারটা ভিন্ন। ওই বছর হাতে-নাতে প্রমাণ।
জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্বে আইনস্টাইন বলেছিলেন, মাস বা ভর তার চার পাশের শূন্যস্থানকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। এতটা যে, আলো— যা ভরবিহীন শূন্যস্থানে সোজাপথে চলে— তা ভরযুক্ত শূন্যস্থানে বাঁকা পথে চলে। কারণ, তখন শূন্যস্থানটাই যে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। জেনারেল রিলেটিভিটি মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটির ব্যাখ্যা দিল ওই শূন্যস্থানের দোমড়ানো দিয়ে। আইজ়্যাক নিউটন বলেছিলেন, গ্র্যাভিটি হল বস্তুতে-বস্তুতে আকর্ষণ। আইনস্টাইন বললেন, গ্র্যাভিটি হল শূন্যস্থানের ওই দোমড়ানো অবস্থা।
কার দাবি ঠিক? পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের ধার ঘেঁষে চলা নক্ষত্রের আলোর পথ বাঁকার পরীক্ষা করা হল। সূর্য ভারী, সুতরাং তার পাশ ঘেঁষে চলার সময় আলোর পথ বাঁকবে। আলোকে কণার সমষ্টি ধরে নিলে, নিউটনের হিসেবে সূর্যের আকর্ষণে নক্ষত্রের আলোর পথ এক রকম বাঁকবে। আর, আইনস্টাইনের দাবি ঠিক হলে, নক্ষত্রের আলোর দ্বিগুণ পরিমাণে বাঁকবে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে তারিখে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন হল পরীক্ষা। দেখা গেল, আলোর পথ দ্বিগুণ পরিমাণেই বাঁকছে।
ব্যস, শুরু হল ঢক্কানিনাদ। লন্ডনের খবরের কাগজ ‘দ্য টাইম্স’ হেডিং করল ‘রিভলিউশন্স ইন সায়েন্স/ নিউ থিয়োরি অব দি ইউনিভার্স/ নিউটোনিয়ান আইডিয়াজ় ওভারথ্রোন’। আর ও দিকে, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ কাগজের ছ’ধাপের হেডলাইন : ‘লাইট্স অল অ্যাসকিউ ইন দ্য হেভেন্স/ মেন অব সায়েন্স মোর অর লেস অ্যাগগ ওভার রেজ়াল্টস অব একলিপ্স অবজ়ারভেশন্স/ আইনস্টাইন থিয়োরি ট্রায়াম্ফস/ স্টার্স নট হোয়্যার দে সিম্ড অর ক্যালকুলেটেড টু বি, বাট নোবডি নিড ওরি/ আ বুক ফর টুয়েল্ভ ওয়াইজ় মেন/ নো মোর ইন অল দ্য ওয়ার্ল্ড কুড কমপ্রিহেন্ড ইট, সেড আইনস্টাইন হোয়েন হিজ় ডেয়ারিং পাবলিশার্স অ্যাকসেপ্টেড ইট’। আসলে বিজ্ঞানে মিশে থাকে রাজনীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি তখনও দগদগে ঘা। যে যুদ্ধে ইংরেজ এবং জার্মান বিবদমান শত্রু। যুদ্ধশেষে ইংরেজ বিজ্ঞানী নিউটনকে অস্তাচলে পাঠিয়ে বিজ্ঞানের আকাশে নতুন সূর্য হিসেবে আইনস্টাইনের উদয়। ওদিকে বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নাকে খত দিয়েছে জার্মানরা। দেখ, বিজ্ঞান কেমন আন্তর্জাতিক! এই হল মেসেজ!
হ্যাঁ, আটলান্টিকের দু’-পারে দুই প্রধান কাগজে ওরকম হেডলাইন বেরনোর পর আর কি আইনস্টাইনের বিখ্যাত হতে সময় লাগে? লাগলও না। রাতারাতি তিনি সুপারস্টার! একজন বিজ্ঞানীর এমন খ্যাতি সাধারণত দেখা যায় না। তাঁর বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে ফিল্ম অ্যাকট্রেসরা। ১৯২২ সালে তাঁর জাপান ভ্রমণের ব্যবস্থা পাকা অক্টোবরে। তার আগে সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াসের ওই চিঠি।
তিনি লিখেছেন, ‘আপনি যদি ডিসেম্বরে স্টকহল্ম শহরে আসতে পারেন, তা হলে খুব ভাল হয়। ... আর যদি আপনি জাপান যান, তা হলে সেটা অসম্ভব।’ এখনকার মতো জেট প্লেন তো তখন ছিল না যে, সকালে টোকিয়ো গিয়ে বিকেলে স্টকহল্মে পৌঁছনো যাবে। জাহাজে যেতে অনেক দিন লাগবে। আরহেনিয়াসের ইঙ্গিত, আইনস্টাইন যেন জাপানযাত্রা বাতিল করেন। তা হলে তাঁর পক্ষে ডিসেম্বরে স্টকহল্মে উপস্থিত থাকা সম্ভব হবে।
ডিসেম্বর মাস এবং স্টকহল্ম শহর। প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অর্থ ভালই বুঝলেন আইনস্টাইন। প্রতি বছর ওখানে ওই সময় দেওয়া হয় বিজ্ঞানের সবচেয়ে নামী পুরস্কার— নোবেল প্রাইজ়। আইনস্টাইন কিন্তু জাপান-যাত্রা বাতিল করলেন না। খানিকটা যেন বিরক্তিভরে। কাঙাল নন তিনি, তবে মনে করেন প্রাইজ়টা তাঁর পাওয়া উচিত। অথচ বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে, তিনি তা পাচ্ছেন না। বিরক্তি স্বাভাবিক।
বিজ্ঞানে সেরা ইনাম জেতার ব্যাপারে কতখানি নিশ্চিত আইনস্টাইন, তা বোঝা যাবে এ ব্যাপারটায়। আইনস্টাইন তাঁর প্রথম স্ত্রী মিলেভা মারিক-এর সঙ্গে ডিভোর্সের অন্যতম শর্ত দিয়েছিলেন যে, তিনি নোবেল প্রাইজ় পেলে, অর্থটা মিলেভার নামে লিখে দেবেন, যাতে তার সুদে মিলেভা এবং তাঁর দুই সন্তানের ভরণপোষণ চলে যায়। নোবেল জেতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হলে কি এমন শর্ত দেওয়া যায়?
বাল্যকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রেম আইনস্টাইনের জীবনে অনেক বার এসেছে। মা-বাবার অমতেই প্রেম করে বিয়ে। কলেজের সহপাঠিনী মিলেভার সঙ্গে। ১৯০৩ সালে ৬ জানুয়ারি। তার আগে অবশ্য ওঁদের এক মেয়ে হয়। বিয়ের পর দুই ছেলে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে দ্বিতীয় ছেলে জন্মানোর পর, ১৯১১ সাল থেকে। প্রথমে খিটিমিটি, তারপর তুমুল ঝগড়া। অবস্থা এমন হল যে, মিলেভা দুই ছেলে নিয়ে আলাদা থাকেন। আর আইনস্টাইন তাঁকে ফিরে এসে একসঙ্গে থাকার শর্ত দেন কিছু—
১. তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে :
ক) আমার জামাকাপড় যেন পরিষ্কার থাকে
খ) আমার ঘরে যেন তিনবেলা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়
গ) আমার শোবার ঘর আর পড়ার টেবিল যেন সাজানো-গোছানো থাকে, আমার টেবিল যেন রাখা থাকে শুধু আমার ব্যবহারের জন্যই
২. অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক প্রয়োজন ছাড়া আমার সঙ্গে সব রকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক তুমি
ত্যাগ করবে। বিশেষ করে, তুমি কখনও আশা করবে না যে,
ক) বাড়িতে আমি তোমার পাশে বসব
খ) আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাব
৩. আমাদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো তোমাকে মানতে হবে :
ক) তুমি আমার কাছ থেকে কোনও সঙ্গসুখ আশা করবে না, আমাকে গালমন্দও করবে না
খ) আমি বলামাত্র আমার সঙ্গে কথা বলা
বন্ধ করবে
গ) আমি বলামাত্র আমার শোবার বা পড়ার ঘর থেকে বিনা প্রতিবাদে চলে যাবে
৪. বাচ্চাদের সামনে আমাকে কখনও, কথায় বা কাজে, হেয় করতে পারবে না।
চাকর-বাকর হলেও কথা ছিল, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ওইসব শর্ত মেনে এক ছাদের তলায় থাকা কি সম্ভব? তবু মিলেভা শর্তাবলি মেনে আইনস্টাইনের সঙ্গে থাকতে এলেন। দুই ছেলের মুখ চেয়ে, কারণ বাচ্চারা ভালবাসে বাবাকে। ততদিনে আইনস্টাইনের জীবনে অন্য নারী এসে গেছেন। তাঁর মাসতুতো বোন এলজা লোয়েনথাল। যাঁর সঙ্গে ছোটবেলায় খেলাধুলো করতেন আইনস্টাইন। বিয়ের কিছুদিন পরে দুই মেয়েকে নিয়ে ডিভোর্সি। এলজাকে নিয়ে আইনস্টাইন-মিলেভার দাম্পত্য কলহ উঠল চরমে। দু’জনে কোর্টের দ্বারস্থ। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৯। আদালত মঞ্জুর করল বিবাহবিচ্ছেদ। ডিভোর্স পেতে আগ্রহী আইনস্টাইন কোর্টে কবুল করলেন জজসাহেব যা শুনতে চান— তিনি পরকীয়ায় লিপ্ত। ২ জুন এলজাকে বিয়ে করলেন আইনস্টাইন।
ডিভোর্সের শর্ত? আইনস্টাইন মিলেভার নামে সুইস ব্যাঙ্কে জমা করলেন ৪০,০০০ মার্ক। তাঁর এবং দুই ছেলের ভরণপোষণ চলবে সুদের অর্থে। তবে মূলধন থেকে মার্ক তুলতে গেলে মিলেভাকে আইনস্টাইনের অনুমতি নিতে হবে। আর? হ্যাঁ, নোবেল প্রাইজ়ের অর্থ থেকে ৪০,০০০ মার্ক কেটে নিয়ে বাকিটা ভবিষ্যতে রাখা হবে মিলেভার নামে। সে অর্থেরও মূলধনে হাত দিতে গেলে অনুমতি লাগবে আইনস্টাইনের। আইনস্টাইন জানতেন নোবেল তিনি পাবেনই।
সেই প্রাইজ়ই শেষমেশ এল ১৯২২ সালে। ওই বছর ঘোষিত হলেও ওটা আগের বছরের, অর্থাৎ ১৯২১ সালের প্রাইজ়। সাল ধরলে এ বছর পূর্ণ হচ্ছে আইনস্টাইনের নোবেলপ্রাপ্তির শতবর্ষ। আগের বছরের প্রাইজ় কেন? ১৯২১ সালে নোবেল কমিটি স্থির করল, বিজ্ঞানে তিন সাবজেক্ট, —ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনে— কাউকে নোবেল দেওয়া হবে না। মুলতুবি রাখা হল পুরস্কার। আইনস্টাইনকে ১৯২১-এর প্রাইজ় দেওয়া হল ১৯২২-এ। জাহাজে চড়ে জাপান যাওয়ার পথে সাংহাই বন্দরে খবরটা পেলেন তিনি। দিলেন শহরের সুইডিশ কনসাল-জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান বার্গস্ট্রম। তিনি এগিয়ে দিলেন আইনস্টাইনকে উদ্দেশ্য করে লেখা টেলিগ্রাম—‘অ্যাওয়ার্ডেড নোবেল প্রাইজ় ইন ফিজ়িক্স। মোর ডিটেল্স ফলো সুন।’
সেই ডিটেল্স এল দ্বিতীয় টেলিগ্রামে। ‘দ্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস ডিসাইডেড অ্যাট ইয়েস্টারডেজ় মিটিং দ্যাট ইউ আর অ্যাওয়ার্ডেড দ্য নোবেল প্রাইজ় ফর ফিজ়িক্স ফর ইয়োর ওয়ার্ক ইন থিযোরেটিক্যাল ফিজ়িক্স অ্যান্ড স্পেশ্যালি ফর ইয়োর ডিসকভারি অব দ্য ল অব দ্য ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট, বাট উইদাউট রিগার্ড অব ইয়োর রিলেটিভিটি—অ্যান্ড থিয়োরিজ় অব গ্র্যাভিটেশন।’ হ্যাঁ, ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা আইনস্টাইনের একটা পেপারের বিষয়। এ কেমন সিদ্ধান্ত? রিলেটিভিটি ছেড়ে ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট? আসলে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে যে পাঁচটি পেপার লেখেন আইনস্টাইন, তার প্রতিটিই এত মূল্যবান যে, তাকে দেওয়া যায় নোবেল প্রাইজ়। তবে কি না রিলেটিভিটি বলে কথা! ১৯০৫ সালে স্পেশ্যাল রিলেটিভিটির পর ১৯১৫-য় জেনারেল রিলেটিভিটি আরও উন্নত তত্ত্ব। তবুও? পিছনে এক কাহিনি।
নোবেল প্রাইজ় কে পাবে, তার নির্বাচন দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অনেকে নাম প্রস্তাব করেন, বিস্তর আলোচনার পর ঠিক হয় কাকে দেওয়া হবে পুরস্কার। আইনস্টাইনের নাম প্রথম প্রস্তাবিত হয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। প্রস্তাবকারী রসায়নে নোবেলজয়ী উইলহেল্ম অস্টওয়াল্ড। কোন সাফল্যের জন্য? অবশ্যই স্পেশ্যাল রিলেটিভিটি, যা ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার। নোবেল কমিটি পাত্তা দিল না। ওঁদের যুক্তি, ওটা বিজ্ঞান নয়, দর্শন। ১৯১০ থেকে ১৯২২, প্রায় প্রতি বছরই অনেকের তরফে প্রস্তাব এল আইনস্টাইনকে নোবেল দেওয়ার, ১৯২০ অবধি প্রতিবারই বাতিল। প্রধান যুক্তি, রিলেটিভিটি তত্ত্বের কচকচি। আসলে, নোবেল কমিটিতে বেশির ভাগ সদস্যই এক্সপেরিমেন্টালিস্ট। পছন্দ করেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নতুন আবিষ্কার। ওঁদের কাছে তত্ত্ব মূল্যহীন। ১৯১৯-এ জয়জয়কারের পরের বছরই সাত জন বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী মনোনীত করলেন আইনস্টাইনকে। ওঁদের মধ্যে আছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, ডেনমার্কের নিল্স বোর। নোবেল কমিটি অরাজি। যাকে নিয়ে অত হইচই, তাকে সিনেমায় মানায়, বিজ্ঞানে নয়। ১৯২০ সালে আরহেনিয়াস ফিজ়িক্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে যে রিপোর্ট দিলেন কমিটিতে, তাতে তিনি বললেন, গত বছরের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণকালে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মনে সন্দেহ আছে; জেনারেল রিলেটিভিটির আর এক পূর্বাভাস— সূর্যের আলো লাল রঙের দিকে হেলে যাবে; বুধ গ্রহের কক্ষপথ? তা জেনারেল রিলেটিভিটি ছাড়া অন্য থিয়োরি দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।
ভুল। রাজনীতি কলুষিত করল বিজ্ঞানকে। আরহেনিয়াসের রিপোর্টে তিন নম্বর কারণ হিসেবে যা উল্লিখিত হল, তা ওঁর নিজের কথা নয়, জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট গেহর্কে-র কথা। বার্লিনে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ আইনস্টাইনকে নিয়ে মাতামাতি সহ্য করতে পারছিলেন না। ওঁরা ওই সময়ে ছিলেন জার্মানির প্রবল ইহুদি-বিরোধিতার শরিক। নেতা-বিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড (যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯০৫ সালে, আপাতত আর্নস্ট গেহর্কে-কে প্রাইজ় পাওয়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত) মনে করেন, রিলেটিভিটি আদৌ কোনও নতুন আবিষ্কার নয়, স্রেফ তত্ত্বের কচকচানি, যেমন ইহুদিদের ভাল লাগে। তিনি নোবেল কমিটির সদস্যদের জনে জনে বলেছিলেন, আইনস্টাইনকে যেন কিছুতেই পুরস্কার দেওয়া না হয়। আরহেনিয়াস তাঁর রিপোর্টে নির্লজ্জভাবে লেনার্ডের সমালোচনা নাম করে উল্লেখ করলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ফিজ়িক্সে নোবেল পেলেন কে? আইনস্টাইনের কলেজের ছাত্র এডুয়ার্ড গিলাউম। কোন সাফল্যের জন্য? নিখুঁত মাপজোখ। এক মিটার কোন দৈর্ঘ্য? একটা ধাতুর পাতের সমান। এদিকে ধাতু আবার তাপমাত্রার হেরফেরে ছোটবড় হয়। গিলাউস সংকর ধাতুর এমন পাত তৈরি করলেন, যা উষ্ণতার হেরফেরে যৎসামান্য ছোট-বড় হয়।
১৯২১। প্রথিতযশা ১৪ জন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম সুপারিশ করলেন। বললেন, খ্যাতিতে পৃথিবীর এক নম্বর বিজ্ঞানী নোবেল না পেলে, সেটা নোবেলের অপমান। সুপারিশকারীদের মধ্যে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যেমন আছেন, তেমনই আছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। হ্যাঁ, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় নির্ভুলভাবে জেনারেল রিলেটিভিটি প্রমাণ করেছেন। সুপারিশে তিনি লিখলেন, সমসাময়িকদের মধ্যে যেমন ছিলেন নিউটন, আজকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে আইনস্টাইন তা-ই। অবশ্যই জেনারেল রিলেটিভিটির স্তুতি। তাগাদায় নোবেল কমিটি স্থির করল, রিলেটিভিটি ব্যাপারটা যাচাই করে দেখতে হবে। দায়িত্ব দেওয়া হল প্রফেসর আলভার গালস্ট্র্যান্ড-কে। যিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পেয়েছেন। ফিজ়িক্সে নয়, মেডিসিনে। মানুষের চোখের গবেষক তিনি। পঞ্চাশ পৃষ্ঠার বিরাট রিপোর্টে গালস্ট্র্যান্ড নস্যাৎ করে দিলেন রিলেটিভিটিকে। আজেবাজে যুক্তিতে। আলোর বাঁকা পথ রিলেটিভিটির প্রমাণ নয়। সাবেক বিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা আছে। রিলেটিভিটি ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৯২১-এ প্রাইজ় দেওয়া হল না বলে রিলেটিভিটি নিয়ে আর মাথা ঘামালেন না নোবেল কমিটির সদস্যরা।
১৯২২। নোবেল কমিটির সদস্য হলেন অধ্যাপক কার্ল উইলহেল্ম ওসিন। তিনি প্রস্তাব দিলেন, বিতর্কিত থিয়োরি অব রিলেটিভিটি বাদ দিয়ে অন্য সাফল্যের জন্য প্রাইজ় দেওয়া হোক আইস্টাইনকে। বিস্তর আলোচনার পর তা দেওয়া হল। আইনস্টাইন পেলেন ১,২১,৫৭২ সুইশ ক্রোনর। তখনকার হিসেবে একজন অধ্যাপকের গড় বাৎসরিক মাইনের দশগুণ। ডিভোর্সের চুক্তি অনুযায়ী, আইনস্টাইন সেই অর্থের এক অংশ দিলেন মিলেভাকে। তিনি তা নিয়ে তিনটি ফ্ল্যাট কিনলেন জুরিখে। অর্থের আর এক অংশ নিয়ে— যার শুধু সুদ তুলতে পারবেন মিলেভা— আপত্তি তুললেন আইনস্টাইনের বড় ছেলে হান্স অ্যালবার্ট। আইনস্টাইন ঠাট্টা করে তাঁকে চিঠিতে লেখেন, ‘তোমরা এত বড়লোক হয়ে যাবে যে, আমি তোমাদের কাছে ধার চাইতে পারি।’
আইনস্টাইনের নোবেল প্রাইজ় কিস্সা এখানেই শেষ নয়। ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট কী? ধাতুর পাতের ওপর আলো পড়লে ধাতুর পরমাণু থেকে ইলেকট্রন কণা ছিটকে বেরনো। মানে, আলো ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আলো কণার সমষ্টি না হলে তো এ ক্ষমতা আসে না। আলোর সে কণার নাম ফোটন। এই ফোটনের ধারণা থেকে শুরু হয়েছিল পদার্থবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স। অদ্ভুতুড়ে শাস্ত্র। নিয়ম-কানুন অদ্ভুত বলে আইনস্টাইন সারাজীবন মনে করতেন শাস্ত্রটা ত্রুটিপূর্ণ। কোয়ান্টাম বলছে, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রন কণা এক কক্ষপথ থেকে আর এক কক্ষপথে লাফ দেয় মাঝের পথটা অতিক্রম না করে। কী করে? জিজ্ঞেস করতেন আইনস্টাইন। কোয়ান্টামের আর এক দাবি, শনাক্ত করলে আছে, না করলে নেই। আইনস্টাইনের প্রশ্ন : আমি আকাশে না তাকালে চাঁদটা ওখান থেকে গায়েব হয়ে যাবে নাকি? সেই আইনস্টাইন নোবেল প্রাইজ় পেলেন এমন পেপার লিখে, যা কোয়ান্টামের ধারণাকে উস্কে দেয়! ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের প্রাইজ় আইনস্টাইনকে দিয়ে নোবেল কমিটি ১৯২২ সালের পুরস্কার দিল কোয়ান্টামের পয়লা নম্বর সমর্থক— এবং সে কারণে ওঁর সঙ্গে বারবার তর্কে প্রবৃত্ত— বিজ্ঞানী নিল্স বোরকে।
শুধু তা-ই নয়। মজার কথা এই যে, যাঁর সঙ্গে আইনস্টাইনের শত্রুতা, যিনি চাইতেন আইনস্টাইন নোবেল না পান, সেই ফিলিপ লেনার্ড কিন্তু ফোটো-ইলেকট্রিক গবেষণার পথিকৃৎ। ওঁর কাজের সূত্রে আইনস্টাইনেরও ও বিষয়ে পর্যবেক্ষণ। সুতরাং, সেই লেনার্ড কতটা চটবেন আইনস্টাইন নোবেল পাওয়ায়, তা সহজে অনুমেয়। রেগেমেগে লেনার্ড চিঠি দিলেন নোবেল কমিটিকে। আইনস্টাইন আলোর চরিত্র বোঝেননি, আইনস্টাইন একজন প্রচার-হ্যাংলা ইহুদি, জার্মান-বিজ্ঞানের ধর্ম উপলব্ধি করা ওঁর কম্মো নয়।
১০ ডিসেম্বর ১৯২২। নোবেল প্রদান অনুষ্ঠান। আইনস্টাইন সেদিন জাপানে। ওঁর হয়ে পুরস্কার নেবেন কোনও রাষ্ট্রদূত। তর্ক উঠল, আইনস্টাইন জার্মান না সুইস নাগরিক? কোন দেশের রাষ্ট্রদূত নেবেন পুরস্কার? শেষমেশ স্টকহল্মে জার্মান রাষ্ট্রদূতের হাতে দেওয়া হল প্রাইজ়। আরহেনিয়াস তাঁর ভাষণে বোঝালেন রিলেটিভিটি সম্পর্কে নোবেল কমিটির মনোভাব। বললেন, ‘অধিকাংশ আলোচনা ওঁর রিলেটিভিটি ঘিরে। ওটা মুখ্যত জ্ঞানচর্চার বিষয়। তাই দার্শনিকরা ও বিষয়ে মাতামাতি করছেন।’
সে যা-ই বলুন আরহেনিয়াস। আইনস্টাইন বুঝিয়ে দিলেন ওঁর সেরা আবিষ্কার রিলেটিভিটি। নিয়ম হচ্ছে, নোবেল পাওয়ার পর প্রাপককে এক বক্তৃতা দিতে হয়। মূল অনুষ্ঠানে ছিলেন না বলে সে বক্তৃতা তিনি দিলেন গোথেনবার্গ শহরে ১৯২৩-এর ১১ জুলাই। বিষয়? ‘ফান্ডামেন্টাল আইডিয়াস অ্যান্ড প্রবলেম্স অব দ্য থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy