রাবণ ‘বধ’ নয়, ভারতের এই জায়গাগুলিতে পূজিত হন দশানন
ভারতের এমন বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে শয়তান হিসাবে নয়, ভগবান জ্ঞানে স্থানীয়রা রাবণকে পুজো করেন।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৫৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
বিজয়া দশমী এবং দশেরা। এক দিকে বিসর্জনের বিষাদ, অন্য দিকে অশুভ শক্তির দমন। এক দিকে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জন পর্বে একত্রিত হন বহু মানুষ। অন্য দিকে রাবণের পুতুল পুড়িয়ে শুভ শক্তির জয়ের উৎসবে মাতেন অনেকে।
০২১৮
কিন্তু, সর্বত্র কি একই নিয়ম মেনে চলা হয়? ভারতের এমন বহু জায়গা রয়েছে যেখানে রাবণকে শয়তান হিসাবে নয়, ভগবান জ্ঞানে পুজো করা হয়।
০৩১৮
হিমাচল প্রদেশের কাঙ্গরা জেলা। সেখানকার বৈজনাথ মন্দির ভারতের শিব মন্দিরের মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে রাবণের জীবনগাথা। শিবের ভক্ত ছিলেন রাবণ। শিবকে সন্তুষ্ট করতে কৈলাসে গিয়ে পুজো করতে শুরু করেন রাবণ। এমনকি, তাঁর মাথাও নাকি যজ্ঞের আগুনে সমর্পণ করেন।
০৪১৮
রাবণের ভক্তিতে শিব সন্তুষ্ট হন। ভক্তের মনোবাঞ্ছা জিজ্ঞাসা করায় রাবণ জানান, তিনি নাকি শিবকে লঙ্কা নিয়ে যেতে চান। শিবও তাঁর অনুরোধে রাজি হন। রাবণকে একটি শিবলিঙ্গ দিয়ে বলেন লঙ্কা নিয়ে যেতে। কিন্তু যাত্রার সময় তিনি যদি পথে কোথাও শিবলিঙ্গটি ভুলবশত রেখে ফেলেন, তবে শিবও অর্ধনারীশ্বর রূপে সেই স্থানেই প্রতিষ্ঠিত হবেন।
০৫১৮
শিবের সতর্কবাণী মেনে লঙ্কার পথে যাত্রা শুরু করেন রাবণ। পথে এক মেষপালকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তৃষ্ণা মেটাতে মেষপালকটির কাছে পানীয় জল দেওয়ার অনুরোধ করেন রাবণ। আসলে, তিনি কোনও সাধারণ মেষপালক ছিলেন না, শিব-পুত্র গণেশ মেষপালকের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন।
০৬১৮
জলপান করার সময় রাবণ মেষপালককে শিবলিঙ্গটি কিছু ক্ষণের জন্য ধরতে বলেন। কিন্তু মেষপালকরূপী গণেশ মাটিতে শিবলিঙ্গটি নামিয়ে রেখে দেন। শিবের কথা মতো, সেখানেই তাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। এই শিবলিঙ্গকে ঘিরেই নাকি পরে তৈরি হয় বৈজনাথের মন্দির।
০৭১৮
ভারতের প্রায় সর্বত্র রাবণ বধ পালন করা হলেও এই মন্দিরে কখনও রাবণের পুতুল জ্বালানো হয় না। পুরাণ অনুযায়ী, রাবণ শিবের অন্ধ ভক্ত। স্থানীয়রা মনে করেন, শিবভক্ত রাবণকে কোনও রকম অসম্মান করলে ভগবান তাঁর রুদ্ররূপ নিয়ে হাজির হবেন। তাই, রাবণকে তাঁরা শয়তান রূপে দেখেন না। ফলে দশেরা পালন থেকেও শত হস্ত দূরে থাকেন এই অঞ্চলের অধিবাসীরা।
০৮১৮
মধ্যপ্রদেশের মন্দসওর এবং বিদিশা জেলার বাসিন্দারা রাবণকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন। স্থানীয়দের মতে, রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর জন্ম নাকি এই মন্দোসওরেই। এখানকার নামদেও বৈষ্ণব সমাজের মতানুযায়ী, জন্মসূত্রে মন্দোদরী এই শহরের মেয়ে, তাই রাবণ সেই সূত্রে তাঁদের জামাই।
০৯১৮
তাঁরা কোনও ভাবেই তাঁদের জামাইকে অসম্মান করতে পারেন না। তাই ‘রাবণ দহন’ পালন করেন না এই অঞ্চলের বাসিন্দারা। মন্দসওর জেলার খানপুর এলাকায় ৩৫ ফুট লম্বা রাবণের একটি মূর্তি রয়েছে।
১০১৮
রাবণের সঙ্গে লঙ্কার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও তাঁর জন্ম লঙ্কায় নয়। উত্তরপ্রদেশের বিশরাখ গ্রামে নাকি রাবণের জন্ম। তাঁরা বাবার নামেই নাকি এই গ্রামের নামকরণ হয়েছে। রাবণের বাবাও শিবের ভক্ত ছিলেন। শোনা যায়, শিবের পুজো করতেই তিনি এই গ্রামে আসেন।
১১১৮
প্রতি বছর এই গ্রামের বাসিন্দারা নবরাত্রি উদ্যাপনের পর এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেন। রাবণের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনাও করেন তাঁরা।
১২১৮
মহারাষ্ট্র সাধারণত গণেশ পুজোর জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এই রাজ্যে এমনও এক জায়গা রয়েছে যেখানে রাবণকে দেবতাজ্ঞানে মানা হয়। পরসওয়াড়ি, গঢ়চিরৌলী এলাকার বাসিন্দারা হিন্দু নন, বরং ‘রাবণবংশী’ হিসাবে নিজেদের পরিচয় দেন।
১৩১৮
তাঁদের ধারণা, বাল্মীকির রামায়ণে রাবণকে খলনায়কের চরিত্র হিসাবে দেখানো হয়নি। তুলসীদাসই রাবণের চরিত্রের খারাপ দিকগুলি তুলে ধরেছেন। তাঁরা রাবণকে তাঁদের রাজা বলে ভাবেন যাঁকে আর্যরা এসে হত্যা করেন।
১৪১৮
রাজস্থানের জোধপুরেও রাবণ বধ করা হয় না। মনদওর এলাকার সঙ্গে রাবণের জীবনের এক বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে বলে এখানকার বাসিন্দারা রাবণকে পুজো করেন।
১৫১৮
কথিত আছে, এখানেই মন্দোদরীর সঙ্গে রাবণের বিয়ে হয়। স্থানীয় ব্রাহ্মণেরা মনে করেন, ‘রাবণ কি চানওয়াড়ি’ নামের একটি জায়গায় দু’জনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই সূত্রে, রাবণকে শয়তান নন, জামাই মেনে পুজো করেন তাঁরা।
১৬১৮
সাধারণত, সীতা অপহরণের জন্য রাবণকে অনেকে বিবাহবিচ্ছেদের প্রতীক হিসাবে মনে করলেও রাবণগ্রাম মন্দিরের কাহিনি ভিন্ন। মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলার এই গ্রামে কারও বিয়ে হলে নিমন্ত্রণের প্রথম কার্ড এই মন্দিরে রাবণের উদ্দেশে দেওয়া হয়। এই মন্দিরে পুজো দিয়ে তবেই এখানকার লোকেরা বিয়ে করেন।
১৭১৮
উত্তরপ্রদেশের কানপুরে রয়েছে দশানন মন্দির। এই মন্দিরে রাবণকে পুজো করা হলেও এর নিয়মকানুন বড় অদ্ভুত। দশেরার দিনেই এই মন্দিরের দরজা খোলা হয়। হাজার বছরের পুরনো এই মূর্তি দেখতেই মানুষের ঢল নামে। তবে, বছরের বাকি ৩৬৪ দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে।
১৮১৮
অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়াতেও রাবণকে পুজো করা হয়। কথিত রয়েছে, রাবণ নিজেই নাকি মন্দির তৈরির জন্য এই জায়গাটি নির্বাচন করেছিলেন। তবে, নিজের মূর্তি নয়, বরং শিবের মূর্তির চারপাশে এই মন্দির গড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাবণ। বর্তমানে, সেই মন্দিরেই রাবণ পূজিত হন। ভারতে রাবণের যে মন্দিরগুলি রয়েছে, সেগুলির মধ্যে কাকিনাড়ার রাবণ মন্দির অন্যতম।