গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভেঙে টুকরো টুকরো হবে পাকিস্তান। এমনটাই আশঙ্কা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। দেশ ভেঙে যাওয়ার নেপথ্যে আর্থিক কারণও বড় ভূমিকা নেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
এক দিকে চরম আর্থিক সঙ্কট। অন্য দিকে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি। সাঁড়াশি চাপে বিপাকে পাকিস্তান। লাহোর, মুলতান, ইসলামাবাদ থেকে শুরু করে রাওয়ালপিন্ডির রাস্তায় উঠছে ‘আজাদি’-র স্লোগান। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে পশ্চিমের প্রতিবেশীর তিন থেকে চার টুকরো হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। এমনটাই দাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
০২২২
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে পাকিস্তানে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। জেলবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান। তাঁর দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ বা পিটিআইয়ের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে গণবিক্ষোভ। ইমরানকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবি তুলেছে তারা।
০৩২২
এর পাশাপাশি ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ’-এর (পিএমএল-এন) নেতা তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের যুক্তি, ইমরানকে বন্দি করে অন্যায় ভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন শরিফ ও তাঁর সঙ্গীরা। আর এতে তাঁদের সাহায্য করেছে পাক ফৌজ।
০৪২২
পিটিআইয়ের এই গণবিক্ষোভ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পাক প্রশাসন। আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছে পাক রেঞ্জার্স। কিছু কিছু জায়গায় সেনাবাহিনীকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
০৫২২
কিন্তু তার পরেও পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির যে সমস্ত ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ের। সেখানে বিক্ষোভকারীদের উপর নির্বিচারে লাঠি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে দেখা গিয়েছে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে ট্যাঙ্ক।
০৬২২
পিটিআইয়ের আভিযোগ, বিক্ষোভকে বুট দিয়ে মাড়িয়ে সমূলে নষ্ট করতে পাক ফৌজের হাত খুলে দিয়েছে শরিফ সরকার। যার জেরে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানোর সাহস পাচ্ছেন সেনা অফিসার ও জওয়ানেরা। শুধু তা-ই নয়, বেছে বেছে ইমরানের কট্টর সমর্থকদের রাস্তা থেকে গায়েব করা হচ্ছে। যার নেপথ্যে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিভেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের হাত রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
০৭২২
তবে এত কিছুর পর ইমরানের দলের দমে যাওয়া তো দূরে থাক, তাদের স্বর আরও জোরদার হয়েছে। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের সামনে এককাট্টা হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে তারা। পাক রেঞ্জার্সের অত্যাচার সত্ত্বেও তাদের আন্দোলনের মাত্রা এতটুকু কমেনি।
০৮২২
মজার বিষয় হল, দেশের হাল যে এমনটাই দাঁড়াবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করেছিলেন ইমরান খান। তাও প্রায় বছর দুই আগে। ২০২২ সালের জুনে সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রথম দেশটা দেউলিয়া হবে। তার পর আমাদের পরমাণু হাতিয়ার ও পরমাণু সম্পত্তি কেড়ে নেবে। ফলে বাধবে গৃহযুদ্ধ। তখন দেশটাকে তিন টুকরো হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’’
০৯২২
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ইমরানের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চারটি মূল প্রদেশে বিভক্ত পশ্চিমের এই প্রতিবেশী দেশ। সেগুলি হল পঞ্জাব, সিন্ধ, বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া। এই প্রদেশগুলির জনজাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে জমি-আকাশের পার্থক্যই পাকিস্তান ভাগের কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
১০২২
প্রথমেই আসা যাক খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কথায়। এখানকার বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশই ‘পাশতুন’। যাঁদের মাতৃভাষা পুশতু। আফগানিস্তান লাগোয়া পশ্চিম পাকিস্তানের এই প্রদেশকে দীর্ঘ দিন ধরেই নিজেদের বলে দাবি করে আসছে কাবুল। হিন্দুকুশের কোলের দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দা পুশতুতে কথা বলেন। যা আফগানিস্তানের এই দাবিকে আরও মজবুত করেছে।
১১২২
এ হেন খাইবার পাখতুনখোয়া ও আফগানিস্তানের সীমান্ত বিবাদ আজকের নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে ওই এলাকায় গণভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। খাইবারের আমজনতার পাল্লা ঝুঁকেছিল ইসলামাবাদের দিকে। কিন্তু সেখানকার তৎকালীন শাসকেরা চেয়েছিলেন আফগানিস্তানে যোগ দিতে।
১২২২
আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায় কাবুল। খাইবারে পাশতুন আন্দোলন শুরু করেন আফগানি শাসকেরা। দাবি ওঠে পাশতুনিস্তান তৈরির। পরবর্তী কালে তৈরি হয় ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি নামের জঙ্গি সংগঠন। ইসলামাবাদের অভিযোগ, এই সন্ত্রাসীদের আড়াল থেকে সমর্থন করছেন আফগানিস্তানের বর্তমান তালিবান শাসকেরা।
১৩২২
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার পাক ফৌজের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে টিটিপি। শুধু তা-ই নয়, খাইবারের কিছু গ্রামে এই জঙ্গিগোষ্ঠী নিজেদের শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছে বলেও পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম সূত্রে এসেছে খবর। টিটিপির সঙ্গে এক রকম যুদ্ধেই নেমেছে পাক ফৌজ।
১৪২২
১৮৯৩ সালে প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের পর আফগানিস্তান ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে একটি স্থায়ী সীমান্ত তৈরি করেন ইংরেজ শাসকেরা। সেই সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে খ্যাত। দেশভাগের পর এই লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলে মেনে নেয় ইসলামাবাদ।
১৫২২
কিন্তু, প্রথম দিন থেকেই ডুরান্ড লাইনকে মান্যতা দেয়নি আফগানিস্তান। হিন্দুকুশের কোলের দেশটির দাবি, খাইবার পাখতুনখোয়া পাকিস্তানের নয়, আফগানিস্তানের অংশ। সম্প্রতি ওই লাইন বরাবর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাক সরকার। যার প্রবল বিরোধিতা করেছে তালিবান। পাক ফৌজের সঙ্গে ওই সীমান্তে তালিবদের বেশ কয়েক বার গুলি বিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। সীমান্তে পাক সেনার চৌকিতে হামলাও চালিয়েছে তালিবান।
১৬২২
অন্য দিকে পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চেয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছে বালুচিস্তান। এটি পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সবচেয়ে বড় প্রদেশ। যেখানে সোনা, তামা, লোহা, মার্বেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু বালুচদের অভিযোগ, এই সমস্ত খনিজ সম্পদের লাভ পাচ্ছেন পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দারা।
১৭২২
দ্বিতীয়ত, চিনের শিনজিয়ান প্রদেশ থেকে বালুচিস্তানের গ্বদর বন্দর পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডর তৈরি করছে বেজিং ও ইসলামাবাদ। যা নিয়ে স্থানীয় বালুচদের প্রবল আপত্তি রয়েছে। এতে তাঁদের অর্থনীতিতে চিনা অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
১৮২২
তৃতীয়ত, বালুচিস্তানে পাক ফৌজের অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বহু বালুচ যুবককে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করার অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ফলে ইসলামাবাদের থেকে স্বাধীনতা পেতে সেখানে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছে ‘বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি’ বা বিএলএ।
১৯২২
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে সবচেয়ে বেশি হিন্দুর বাস। এর রাজধানী করাচি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধিশালী শহর। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিন্ধের আর্থিক সম্পত্তি হাতেগোনা কয়েক জন করাচিবাসীর কাছে রয়েছে। যা ১৯৭০-এর দশকে ‘সিন্ধু জাতীয় আন্দোলন’-এর জন্ম দিয়েছিল। যার মূল দাবি ছিল সিন্ধু প্রদেশ তৈরি করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাক ফৌজ ও আইএসআইয়ের কার্যকলাপ সেই আন্দোলনকে নতুন করে দাবানলে পরিণত করতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
২০২২
১৯৭০-এর দশকে ভারতের পঞ্জাবে শুরু হয় ‘খলিস্তান আন্দোলন’। এই বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনের জন্মদাতাও পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। পরবর্তী কালে খালিস্তানপন্থীরা এ দেশ থেকে পালিয়ে কানাডা, আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে চলে যান। সেখানে বসেই এই আন্দোলন পরিচালনা করছেন তাঁরা।
২১২২
খলিস্তানপন্থীদের দাবি, শিখদের নতুন দেশের রাজধানী হবে লাহোর। যা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত। অর্থাৎ পাকিস্তানের ওই প্রদেশের মধ্যেই খলিস্তান তৈরি করতে চাইছেন তারা। যা ইসলামাবাদের মাথাব্যথার কারণ।
২২২২
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আর্থিক সঙ্কটের কারণেও ভেঙে টুকরো টুকরো হবে পাকিস্তান। দেশটির ৩৫ শতাংশ জনতার দৈনিক রোজগার খুবই কম। অন্য দিকে মুদ্রাস্ফীতির জেরে এক বেলা খাবারের খরচ ২০০ টাকায় পৌঁছেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, পাক জনতার একটা বড় অংশ আধপেটা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।