দিন যত গড়াচ্ছে, ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে সামরিক জুন্টা শাসকেরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে মহিলা ও শিশু-সহ ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির জোটবদ্ধ আক্রমণের মুখে কার্যত দিশেহারা মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার। ইতিমধ্যেই জুন্টার দখল থেকে বেরিয়ে গিয়েছে দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা। কী করে শাসন টিকিয়ে রাখা যাবে, এখন তা নিয়ে চিন্তায় ঘুম উড়েছে সামরিক শাসকদের। ক্রমশ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাই কঠোর মনোভাব ছেড়ে কাকুতিমিনতি আর আলোচনায় রাস্তায় ফেরার উল্টোসুর সামরিক শীর্ষকর্তাদের গলায়।
০২১৯
২০২১ সালে আউং সান সু চি-র সরকারের পতনের পর থেকেই তপ্ত ছিল মায়ানমার। কিন্তু এ বছর অক্টোবরের শেষ দিকে মায়ানমারের তিনটি বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলে তৈরি ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ (টিবিএ)-এর ‘অপারেশন ১০২৭’ নামক যৌথ অভিযানে টলমল দেশের সামরিক জুন্টা সরকারের আসন।
০৩১৯
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আউং সান সু চি-র ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’ (এনএলডি)-র সরকারকে উৎখাত করে দেশের ক্ষমতা দখল করে সামরিকবাহিনী। তার পর থেকে সে দেশে চলছে একচ্ছত্র সামরিক শাসন। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকারের মতো শব্দগুলি। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন কি সূচিত হচ্ছে টিবিএ হানার মধ্যে দিয়ে?
০৪১৯
লিগ সরকারের পতনের পরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে পথে নামেন বহু মানুষ। তাঁদের নির্বিচারে কারাবন্দি করে জুন্টা সরকার। সমীক্ষা বলছে, জুন্টা সরকারের আমলে সে দেশে চার হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারী এবং নাগরিক সেনার হাতে নিহত হন, কারারুদ্ধ হন কুড়ি হাজারেরও বেশি।
০৫১৯
তার পর থেকে দেশে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয় সামরিক জুন্টা সরকারের। বস্তুত, ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের ঘটনাটি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১০ সাল থেকেই সে দেশে গণতন্ত্রে সামরিক হস্তক্ষেপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। তারই সর্বোচ্চ প্রকাশ লিগ সরকারকে ফেলে দিয়ে দেশে একচ্ছত্র সামরিক শাসন জারি।
০৬১৯
সু চি-র এনএলডি এবং তার নির্বাসিত জোটসঙ্গীরা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি তৈরি করেছে। যাকে সামরিক জুন্টা সরকারের সমান্তরাল প্রশাসন বলা হচ্ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, এনইউজিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যাঁরা জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক নিন্দাপ্রস্তাব পাশ করিয়েছে। ফলে পশ্চিমি শক্তিগুলি সু চি-র পাশেই দাঁড়িয়েছে বরাবর। এ ক্ষেত্রে জুন্টার হাতের পুতুল হয়ে উঠেছিল চিন।
০৭১৯
মায়ানমারে নিযুক্ত চিনা রাষ্ট্রদূত চেন হাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন জুন্টা সরকারের বিদেশমন্ত্রী থান শোয়ে-সহ কয়েক জন সামরিক শীর্ষকর্তা। মায়ানমারের সরকারি টিভি চ্যানেল ‘গ্লোবাল নিউজ় লাইট অব মায়ানমার’-এ প্রচারিত খবরে বলা হয়, “বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, দু’দেশের জন্য লাভজনক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সীমান্তে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
০৮১৯
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকের বিষয়ে চিনা দূতাবাস বা সে দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থার তরফে বিস্তারিত কিছু জানানো হয় না। লাল ফৌজ আদৌ মায়ানমারে কোন পক্ষ নেবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। যদিও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, জুন্টার সহায়তার কথা বলে সে দেশে ঢুকে পড়তে পারলে তাতে আখেরে চিনেরই দীর্ঘমেয়াদি লাভ।
০৯১৯
অনেকেই মনে করেন, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ দিয়ে চিন সরাসরি বঙ্গোপসাগর পৌঁছে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তা ভারতের আরও বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চিনের তরফ থেকে তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। ফলে মায়ানমার সঙ্কটে চিন আদৌ নাক গলাবে কি না তা স্পষ্ট নয়।
১০১৯
এরই মধ্যে পাল্টা মার শুরু হয়ে গিয়েছে মায়ানমারে। সম্প্রতি উত্তর মায়ানমারের শান এবং সাগিয়াং প্রদেশে সাফল্যের পরে পশ্চিমের চিন এবং রাখাইন প্রদেশেও হামলা শুরু করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী— ‘তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ), ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এবং ‘মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ)-র নয়া জোট ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স’ বা ‘টিবিএ’।
১১১৯
যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। আর দিন যত গড়াচ্ছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়়ছে সামরিক জুন্টা শাসকদের কোণঠাসা হওয়ার পালা। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ইতিমধ্যেই ২৫০ জনেরও বেশি সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেন মহিলারাও। আছে শিশুরাও। পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ গৃহহারা।
১২১৯
এই পরিস্থিতিতে হারের ভয় যেন ক্রমশ চেপে বসছে জুন্টা শাসকদের ঘাড়ে। ইদানীং তাই তাঁরা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতে শুরু করেছেন। বিদ্রোহীদের যদিও দাবি, পতন নিশ্চিত জেনেই এখন রাজনৈতিক সমাধানের বুলি আওড়াতে শুরু করেছেন সামরিক শাসকেরা।
১৩১৯
জাতীয় একতা সরকার বা এনইউজির শীর্ষ প্রতিনিধি তথা বিদেশমন্ত্রী জ়িন মার অঙ বলেন, ‘‘ইতিহাসে সামরিক বাহিনীর মনোবল একটা তলানিতে কখনও পৌঁছয়নি। নিশ্চিত হার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠছেন শাসকেরা। তাই এখন রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলতে হচ্ছে। গণতন্ত্রকে পদদলিত করার সময় রাজনৈতিক সমাধানের কথা মাথায় ছিল না জুন্টা সরকারের?’’
১৪১৯
আক্রমণের তোড়ে এমনই দিশেহারা অবস্থা মায়ানমারের সামরিক শাসকদের যে, তাঁরা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে দেশভাগের আশঙ্কা পর্যন্ত করছেন। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, যদি সামরিক শাসন দুর্বলই হয়ে পড়ে তা হলে বিদ্রোহীরা গোটা দেশ দখল না করে দেশভাগ চাইবেন কেন?
১৫১৯
জ়িন মার অঙের দাবি, বিদ্রোহীরা অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন দেশ জুড়ে। জাপানের একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, যে পাঁচ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, তাঁদের পাশে থাকতেই বিশেষ নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সকলেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে রয়েছেন। সকলকে সঙ্গে নিয়েই মায়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
১৬১৯
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিরোধীদের আক্রমণ আরও কয়েক পাল্লা বৃদ্ধি পাবে বলেও ইঙ্গিত করেছেন তিনি। সে ক্ষেত্রে অবশ্য আরও প্রাণহানি এবং রক্তক্ষয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সামরিক জুন্টা সরকারের সেনাকে পুরোপুরি বদলে ফেলারও শপথ নিয়েছে বিদ্রোহী সরকার।
১৭১৯
একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক পথেও জুন্টা সরকারের ঘুম ছুটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি বলে দাবি করেছেন সমান্তরাল সরকারের বিদেশমন্ত্রী। তাঁর দাবি, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের আঁচ যেমন বাড়বে, তেমনই আইন অমান্যের মতো গণতান্ত্রিক পথেও বিদ্রোহের আঁচ বাড়ানো হবে।
১৮১৯
এ দিকে, মায়ানমারের অস্থিরতায় ভারতের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। প্রথমত, মায়ানমারের সঙ্গে প্রায় ১,৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ভারতের। মিজ়োরাম সীমান্তের অনতিদূরে একাধিক গ্রাম বিদ্রোহীরা দখলে নেওয়ায় মায়ানমারের প্রায় পাঁচ হাজার নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন ওই রাজ্যে। ভারতের চিন্তা, পড়শি রাষ্ট্রে সংঘাত তীব্র হলে উদ্বাস্তু সমস্যা বৃদ্ধি পাবে উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিতে।
১৯১৯
এই পরিস্থিতিতে ধীরে চলো নীতি নিয়েছে ভারত। কারণ, মায়ানমারের সমস্যায় চিনের হস্তক্ষেপের তাৎপর্য ভারতের কাছে ভিন্ন। জুন্টা শাসকদের সঙ্গে চিনের সমীকরণকে মাথায় রেখেই পদক্ষেপ করবে ভারত। আবার দীর্ঘ সীমান্তেরও অভিঘাত ভিন্ন। সব মিলিয়ে আগ বাড়িয়ে পদক্ষেপ চায় না নয়াদিল্লি।