Know how age old Albert Hall turned into Coffee House of Kolkata College Street dgtl
Coffee House
Coffee House: ‘ভারতসভা’র আঁতুড়ঘর, ছিল ব্রিটিশ সেনাদের আস্তানা, এক সময় প্রায় বন্ধও হতে বসেছিল কফি হাউস
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কলকাতায় কফি পানের প্রচলন শুরু করেছিলেন হেনরি পিডিংটন। উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যুবকদের মাদকের প্রতি আসক্তি কমানো।
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:৪৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
হালফিলের কফি শপ যতই আসুক, কলেজপাড়ার ‘কফি হাউস’ বাঙালির কাছে এক এবং অদ্বিতীয়। তার টেবিলে ‘আড্ডাটা আজ আর নেই’ বলে নস্টালজিয়ায় ভাসতে ভালবাসে কলকাতা। জানেন কি, কফি হাউসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের নাম? কলকাতায় কী করে শুরু হল কফি-পানের প্রচলন? কফি হাউসের জন্মবৃত্তান্তই বা কী? জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই সপ্তদশ শতকে।
০২১৬
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কলকাতায় কফি পানের প্রচলন শুরু করেছিলেন হেনরি পিডিংটন। উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যুবকদের মাদকের প্রতি আসক্তি কমানো। তবে সুরাসক্তি কিন্তু প্রচলিত ছিল সে কালের কলকাতায়। অভিজাতদের মদ্যপান তো ছিলই, বউবাজারের কাছে বিভিন্ন ঠেকে জড়ো হতেন জাহাজের খালাসিরাও। ক্রমে জন্ম হল খালাসিটোলার।
০৩১৬
অন্ধকারের পাশাপাশি আলোর উদ্ভাসও যথেষ্ট ছিল নবজাগরণের কলকাতায়। হিন্দু কলেজের (আজকের প্রেসিডেন্সি) সুবাদে নির্দিষ্ট এলাকার নামই হয়ে গেল কলেজ স্ট্রিট। ক্রমে তার চারধারে গড়ে উঠল মেডিক্যাল কলেজ। মাধববাবুর বাজারের জায়গায় নির্মিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই অঞ্চলে ছাত্রদের বসবাস বাড়ল। আনাগোনা শুরু হল বিদ্যোৎসাহীদের। তবে প্রথমেই কফি হাউস কিন্তু গড়ে উঠল না। তার বদলে, আগের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল ‘অ্যালবার্ট হল’।
০৪১৬
এই বাড়ির মালিক ছিলেন ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের ঠাকুরদা রামকমল সেন। তিনি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘অ্যালবার্ট ইনস্টিটিউট’। রামকমল ছিলেন হিন্দু কলেজের ম্যানেজার। তার আগেই তিনি তাঁর বাসভবনের নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যালবার্ট হল’। রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্ট, প্রিন্স কনসর্টের নামেই এই নামকরণ। বাড়ির দোতলায় থাকতেন হিন্দু কলেজের (আজকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববদ্যালয়) প্রথম অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন। বিশাল বাগানবাড়ি কেলসল হাউজ ছেড়ে তিনি এই বাড়িতে থাকতে এসেছিলেন।
০৫১৬
তবে অ্যালবার্ট হলের ঔজ্জ্বল্য বেড়েছিল কেশবচন্দ্র সেনের সময়ে। সমকালীন ব্রাহ্ম সমাজের অগ্রণীদের আবির্ভাবে মুখরিত থাকত এই ভবন। নামে সাহেবিয়ানা থাকলেও ধীরে ধীরে এই ভবন হয়ে উঠল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও অন্যান্যদের উদ্যোগে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারতসভা’। ১৮৮৩ সালে এখানে হয়েছিল ‘ভারতসভা’-র জাতীয় সম্মেলন।
০৬১৬
জাতীয়তাবাদী নেতাদের বক্তৃতা শুনতে অ্যালবার্ট হলে উপচে পড়ত শ্রোতাদের ভিড়। পাশাপাশি, ১৯২৮ সালে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজ্যান্টস পার্টির সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে এই হল আলাদা করে ভাড়া নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার এখানে এয়ার রেড প্রিকশন সেন্টার খুলেছিল। কলকাতার আকাশে তখন বোমারু যুদ্ধবিমানের গর্জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পট পরিবর্তন। অ্যালবার্ট হল ছেড়ে চলে যায় গোরা পল্টনরা।
০৭১৬
এই সময়ে ১৯৪১ সালে কলেজপাড়া নয়, মধ্য কলকাতায় ‘কফি হাউস’ শুরু করল ভারতীয় কফি বোর্ড। সেখানে দু’টি মহল ছিল। একটি সাধারণদের জন্য ‘হাউস অব কমন্স’। অন্যটি, ‘হাউস অব ইন্টেলেকচুয়ালস’। কবি সমর সেন, পরিচালক চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেন নিয়মিত আড্ডা দিতেন এই কফি হাউসে।
০৮১৬
তবে মধ্য কলকাতার এই কফি হাউজ বরাবরই ছিল ‘ফর দ্য ক্লাস’। সে ভাবে কোনও দিন আমজনতার হয়ে উঠতে পারেনি। সাধারণ মানুষ আড্ডা দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন বইপাড়ার অ্যালবার্ট হলকেই। চল্লিশের দশকে সেখানে ‘কফি হাউস’ শুরু করল ভারতীয় কফি বোর্ড। ধূমায়িত কফির কাপের সঙ্গে চলত বই পড়া। স্বাধীনতার পরে ‘অ্যালবার্ট হল’ পরিচয় আড়ালে চলে গেল। ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ‘কফি হাউস’ হয়ে উঠল বাঙালির একান্ত কফিঘর।
০৯১৬
কফি হাউস শাসন করেছেন যাঁরা, সেই মুখগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে। এক সময় এখানে আড্ডা জমত সাহিত্যিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, সমরেশ বসু, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, মণিশঙ্কর, বিমল মিত্র, ভবানী মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। পাশাপাশি, আসতেন শিবরাম চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, তরুণ স্যান্যাল, অমিতাভ দাশগুপ্তরাও।
১০১৬
আসতেন নাটক এবং ছবির জগতের দিকপাল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং অপর্ণা সেনরা। শুধু সাহিত্য এবং রঙ্গমঞ্চই নয়। কফির কাপে তুফান তুলতে কফি হাউস-এ জড়ো হতেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাস, অসীম দাশগুপ্তের মতো বামপন্থী নেতারাও।
এই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আরও একটি পট পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯১২ সালে অ্যালবার্ট হলের মালিকানা বদল হয়ে গিয়েছিল। চোরবাগানের জমিদার অভিরাম মল্লিকের পরিবার কিনে নিয়েছিল এই বাড়িটি। তার দু’টি তলা ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল কফি হাউস। ১৯৫৮ সালে ভারতীয় কফি বোর্ড জানাল, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস তুলে দেওয়া হবে। কারণ, অলাভজনক এই ব্যবসা আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
১৩১৬
কফি বোর্ড বনাম বুদ্ধিজীবীদের দ্বৈরথে অবশেষে জয়ী হল দ্বিতীয় পক্ষ। অধ্যাপক নির্মল ভট্টাচার্য, অধ্যাপক সমীর গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি মিহির মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক উদ্যোগে তৈরি হল ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কারস কো অপারেশন। রিকুইজিশন করে মালিকপক্ষ মল্লিকদের কাছ থেকে কফি হাউসের নির্দিষ্ট অংশ সমবায় গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয় তৎকালীন রাজ্য সরকার। কিছু দিন বন্ধ থাকার পরে আবার নতুন যাত্রা শুরু হয় কফি হাউসের। সেই সমবায় ভিত্তিতেই এতদিন ধরে চলছিল কফি হাউস।
১৪১৬
কিন্তু এই অধিগ্রহণ-ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল না চোরবাগানের মল্লিক পরিবার। নব্বইয়ের দশকে প্রকাশ্য সংঘাতের আকার নেয় মালিক পক্ষের সঙ্গে সমবায়ের মতবিরোধ। ১৯৮৬ সালের সংশোধিত জমি অধিগ্রহণ আইনে বিপাকে পড়ে সমবায় সংস্থা। এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে কোর্টের রায়ে কফি হাউস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
১৫১৬
সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, রিকুইজিশনের কোনও কিছুই ২৫ বছরের বেশি অধিগ্রহণ করে রাখা যাবে না। এই জটিল পরিস্থিতিতে সামনে চলে আসে এক প্রোমোটার সংস্থা। মূলত সেই সংস্থার সঙ্গেই যুদ্ধে কফি হাউস অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে। এই সময়ে তৎকালীন বাম সরকার সিদ্ধান্ত নেয় কফি হাউস কিনে নেওয়ার। বহু টানাপড়েন এবং আইনি জটিলতা পেরিয়ে ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কফি হাউসের নির্দিষ্ট অংশ কিনে নেয় রাজ্য সরকার। তারপর সেটি তুলে দেওয়া হয় কফি হাউস সমবায়ের হাতে।
১৬১৬
বারবার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে কফি হাউস। প্রতি বারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ঝাঁ চকচকে কফিশপগুলিও। তাদের জৌলুসের কাছে ম্লান লাগে কফি হাউসের গুণমান। তারপরেও জেগে থাকে ২৫০ বছরের বেশি প্রাচীন বাড়ির দোতলায় কফির কল্লোল। গুঞ্জরিত হয় তার উপরের তলায় নিভৃতচারীদের গুঞ্জন। আড্ডার পাশাপাশি চলুক উপযুক্ত পরিমাণে কফি পান। সঙ্গে অর্ডার হোক স্ন্যাক্সেরও। না হলে, কট্টর প্রতিযোগিতার যুগে শব্দহীন হয়ে যাবে কফি হাউসের ‘হোক কলরব’। (ঋণস্বীকার: ‘কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে’: অজিতকুমার বসু, ‘কলিকাতা দর্পণ’: রাধারমণ মিত্র, ছবি: আর্কাইভ, সোশ্যাল মিডিয়া)