ইরানের উপর বড় মাপের প্রত্যাঘাত শানাতে বড় আকারের ফৌজি প্রস্তুতি নিচ্ছে ইজ়রায়েল। এই সংক্রান্ত দু’টি নথি আমেরিকার গোয়েন্দা দফতর থেকে ফাঁস হওয়ায় দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
শিয়া মুলুক ইরানকে ‘শিক্ষা দিতে’ কোমর বেঁধেছে ইহুদি দেশ ইজ়রায়েল। গোপনে চলছে তার প্রস্তুতি। কী ভাবে, কোথায় ও কখন হামলা হতে পারে, সেই পরিকল্পনায় কোনও ফাঁক রাখতে নারাজ ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। ইহুদিদের সেই অপারেশন প্ল্যানের নেপথ্যে কি আমেরিকার মাথা? ওয়াশিংটনের ওয়ার রুম থেকে সেই সংক্রান্ত নথি ফাঁস হওয়ায় উঠছে প্রশ্ন।
০২১৮
আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি অতি গোপনীয় দু’টি গোয়েন্দা নথি ফাঁস হয়েছে। সেখানেই রয়েছে ইরানের উপর ইজ়রায়েলের সম্ভাব্য আক্রমণের সামরিক প্রস্তুতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। ন্যাশনাল জিয়োস্প্যাকিয়াল-ইনটেলিজেন্স এজেন্সির (এনজিএ) মহাফেজখানা থেকে নথিগুলি সর্বসমক্ষে চলে এসেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
০৩১৮
আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহের পাঠানো ছবি বিশ্লেষণের কাজ করে এনজিএ। সূত্রের খবর, তার উপর ভিত্তি করেই ইহুদি ফৌজের সামরিক প্রস্তুতি ও মহড়া সংক্রান্ত গোপন রিপোর্ট তৈরি করেছিল এই সংস্থা। সেই রকম দু’টি নথি ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। যা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
০৪১৮
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ফাঁস হওয়া নথিগুলি ১৫ ও ১৬ অক্টোবরের। ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল ‘টেলিগ্রাম’ চ্যানেলগুলিতে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নথিতে আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহের পাঠানো ছবি ও তার ব্যাখ্যা রয়েছে। শিয়া মুলুকটির উপর হামলা চালাতে কী ভাবে আইডিএফ প্রস্তুতি নিচ্ছে, কোন কোন হাতিয়ার ব্যবহার হতে পারে, সেই সংক্রান্ত তথ্যও রয়েছে সেখানে।
০৫১৮
ফাঁস হওয়া দু’টি নথির মধ্যে একটির শিরোনাম হল, ‘ইজ়রায়েল: ইরানে প্রত্যাঘাতের জন্য বিমান বাহিনীর নিরন্তর অনুশীলন’। এই নথিতে আইডিএফের বিমানবাহিনীর কসরতের একাধিক ছবি রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মাঝ আকাশে যুদ্ধবিমানে জ্বালানি ভরানোর অনুশীলনে জোর দিয়েছে ইহুদি ফৌজ। মহড়ায় ব্যবহার হয়েছে ৪ থেকে ৫ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা।
০৬১৮
পাশাপাশি, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজের অনুশীলনেও জোর দিয়েছে ইহুদি ফৌজ। শিয়া মুলুকে ঢুকে আক্রমণ শানালে প্রত্যাঘাত আসার আশঙ্কা রয়েছে। সেই কথা মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে ইজ়রায়েল। আইডিএফের অনুমান, সে ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে শিয়া সেনা। যা মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে ‘বায়ু প্রতিরোধ ব্যবস্থা’-কে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) তৈরি রাখছে ইহুদি সেনা।
০৭১৮
দ্বিতীয় নথিতে কৌশলগত এলাকায় আইডিএফ হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফাঁস হওয়া রিপোর্টে ইহুদি ফৌজের অনুশীলনের উল্লেখ থাকলেও কোনও উপগ্রহচিত্র নেই। শুধু বলা হয়েছে, উপগ্রহচিত্র আমেরিকার গোয়েন্দারা ভাল করে পর্যালোচনা করেছেন। তবে ইরানের উপর কত বড় আকারের আক্রমণ ইজ়রায়েল শানাবে, সেই ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন।
০৮১৮
ইহুদি ফৌজ সংক্রান্ত গুপ্ত সামরিক নথি ফাঁস হওয়া নিয়ে আমেরিকার সেনাকর্তারা উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন। কী ভাবে তা সর্বসমক্ষে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তবে ফাঁস হওয়া নথিতে আমেরিকার সামরিক শক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ নেই বলে মনে করেন তাঁরা। তবে ইহুদি ফৌজের ইরানের উপর হামলার পরিকল্পনা পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়াবে বলেই মনে করছে ওয়াশিংটন।
০৯১৮
সংবাদ সংস্থা সিএনএন জানিয়েছে, নথি ফাঁসের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই এই নিয়ে তদন্তে নেমেছেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। ফাঁস হওয়া নথির সত্যতা একটি সূত্র মারফত তাঁরা নিশ্চিত করতে পেরেছেন বলে জানা গিয়েছে। টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘মিডল ইস্ট স্পেক্টেটর’-এ ‘টপ সিক্রেট’ শিরোনাম দিয়ে সেগুলিকে প্রথমে জনসমক্ষে আনা হয়েছিল। এই নথি দেখার একমাত্র অধিকারী হল ‘পঞ্চনেত্র’ (ফাইভ আইজ়)। অর্থাৎ আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দারা।
১০১৮
সূত্রের খবর, নথি ফাঁসের খবর মিলতেই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্তে নেমেছে আমেরিকার ‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ বা এফবিআই। এ ছাড়া ওয়াশিংটনের সামরিক সদর দফতর ‘পেন্টাগন’ আলাদা করে একটি তদন্ত করছে। গোয়েন্দাদের অনুমান, নথি ফাঁসের নেপথ্যে কোনও শীর্ষ আধিকারিকের হাত রয়েছে। অন্য দিকে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রিপোর্টে আইডিএফ ইরানের উপর পরমাণু হামলা চালাবে বলে কোনও কথা বলা হয়নি।
১১১৮
আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’-র (সিআইএ) প্রাক্তন অফিসার মিক মুলরয় বলেছেন, ‘‘এটা সত্যি যে ইরানের উপর প্রত্যাঘাত শানাতে ইজ়রায়েলি সেনার প্রস্তুতি সংক্রান্ত নথি ফাঁস হয়েছে। এটা একটা বড়সড় গলদ। এটা আমেরিকা-ইজ়রায়েলের সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, সেখানে বিশ্বাস একটা বড় ব্যাপার। যা নষ্ট হলে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’ সিআইএর পশ্চিম এশিয়ার ডেস্কে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করতেন মলরয়।
১২১৮
এ ছাড়া নথিগুলি ফাঁস হয়েছে, না কি হ্যাক করা হয়েছে, সেটা নিয়েও দেখা গিয়েছে দ্বন্দ্ব। ফলে ইরানের সাইবার হামলা নিয়ে বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে আমেরিকা। এই নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে পেন্টাগন ও এনজিএ। নথি ফাঁসের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
১৩১৮
চলতি বছরের নভেম্বরে আমেরিকায় হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানে রিপাবলিকানদের হয়ে ভোটের ময়দানে নেমেছেন ট্রাম্প। সরাসরি ইজ়রায়েলকে সমর্থন করছেন তিনি। তাঁর প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী তথা বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। তিনি আবার পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সওয়াল করেছেন। ইহুদি ফৌজকে সংযত হওয়ার কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
১৪১৮
এই নথি ফাঁসের ঘটনায় গোটা দুনিয়া যখন তোলপাড়, তখন জার্মানি সফরে গিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে এই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। জবাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইরানে হামলার জন্য ইজ়রায়েলি প্রস্তুতির বিষয়টি তিনি জানেন। তবে তার ব্যাখ্যা দেননি তিনি।
১৫১৮
চলতি বছরের ১ অক্টোবর ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায় ইরান। যার অধিকাংশই মাঝ আকাশে ধ্বংস করেছিল ইহুদিদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তার পরই শিয়া মুলুকে প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
১৬১৮
সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে হামলার পরিকল্পনা করে আইডিএফ। এই নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন নেতানিয়াহু। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় ওয়াশিংটন। পরে পরিকল্পনা বদলে শিয়া ফৌজের মূল ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় ইহুদি সেনা।
১৭১৮
এই পরিস্থিতিতে ‘থার্মাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড দিয়ে ইজ়রায়েলকে সাহায্য করছে আমেরিকা। পারস্য উপসাগরের তীরের দেশটি থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলে তা মাঝ আকাশেই ধ্বংস করতে পারবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পাশাপাশি, ইহুদি ভূমিতে একটি সৈন্যদলও পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন। যা থাড পরিচালনা করবে বলে জানা গিয়েছে।
১৮১৮
সম্প্রতি নেতানিয়াহুকে খতম করতে দক্ষিণ লেবানন থেকে তাঁর বাড়িতে ড্রোন হামলা চালানো হয়। ওই সময়ে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী সেখানে না থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এর নেপথ্যে ইরানের মদতপুষ্ট হিজ়বুল্লার হাত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর হিসাবেও কড়ায়-গণ্ডায় তোলা হবে বলে হুমকি দিয়েছে ইজ়রায়েল। ফলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।