আথেন্সের মহামারি: খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০, গ্রিসের আথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে শুরু হয়েছে পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ। সেই সময়ই আথেন্সে এক অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তা আকার নিল মহামারির। তবে কী রোগের কারণে এই মহামারি, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেসের বর্ণনা অনুযায়ী, “স্বাস্থ্যবান লোকেদের কপালের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেল। চোখ লাল ও জ্বালাজ্বালা ভাব। জিভ-গলাতেও লালচে ভাব।’’ এর জেরে প্রায় এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরে লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরেও এই রোগ ছড়ায়।
অ্যান্টোনিন প্লেগ: ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোম সাম্রাজ্যে ছড়িয়েছিল অ্যান্টোনিন প্লেগ। এই রোগকে গুটি বসন্তের প্রাথমিক আবির্ভাব বলে মনে করা হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরা সৈনিকদের মাধ্যমেই রোমে সাম্রাজ্যে ছড়িয়েছিল এটি। জ্বর, গলাব্যাথা, ডায়ারিয়ার লক্ষণ ছিল এই রোগে। এই অতিমারি ৫০ লক্ষ লোকের প্রাণ কেড়েছিল। এর জেরে এক দিনে দু’হাজার মৃত্যুর সাক্ষীও থেকেছে রোম।
সাইপ্রিয়ান প্লেগ: অ্যান্টোনিনের বছর সত্তর পর আর এক অতিমারির ধাক্কা সহ্য করে মানব সভ্যতা। তিউননিশিয়ার কার্থেজ শহরের বিশপ সাইপ্রিয়ানের নামে নামকরণ করা হয় এই অতিমারির। মনে করা হয়, ২৫০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে ইথিওপিয়াতে সাইপ্রিয়ান প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। উত্তর আফ্রিকা হয়ে রোমে ঢোকে এটি। তার পর ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে। অ্যান্টোনিনের সঙ্গে এই রোগের লক্ষণের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এই অতিমারিও প্রচুর প্রাণ কেড়েছিল সে সময়।
জাস্টিনিয়ান প্লেগ: ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে এর সূত্রপাত মিশরে। তার পর প্যালেস্তাইন ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্য হয়ে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামেই এর নামকরণ। এই অতিমারিকেই প্রথম দফার বুবোনিক প্লেগ হিসাবে ধরা হয়। মনে করা হয়, পৃথিবীর সে সময়ের জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশের মৃত্যু হয়েছিল এই অতিমারিতে। জাস্টিনিয়ানও আক্রান্ত হয়েছিলেন এই রোগে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও তাঁর সাম্রাজ্যের বাঁধন আলগা করে দিয়েছিল এই অতিমারি।
ব্ল্যাক ডেথ: চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির ত্রাস হয়ে উঠেছিল ব্ল্যাক ডেথ। বুবোনিক প্লেগের শক্তিশালী রূপে ফিরে আসার জেরেই ১৩৪৭ নাগাদ হয় এই অতিমারি। এই ব্ল্যাক ডেথ অতিমারির জন্য দায়ী ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামে ব্যাকটিরিয়ার এক প্রজাতি। যা আজ প্রায় অবলুপ্ত। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের দেহে বসা মাছির মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছিল।
এশিয়ায় শুরু হয়েছিল ব্ল্যাক ডেথ। পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে এটি। এর জেরে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় আক্রান্তদের দেহ গণ কবর দেওয়া হত। ব্ল্যাক ডেথ এত মানুষের জীবন কেড়েছিল যে, এই অতিমারির পর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য বদল ঘটেছিল। সে সময় ইউরোপে কাজের জন্য শ্রমিকের আকাল দেখা দিয়েছিল।
গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন: বিশ্ব জুড়ে ‘সন্ত্রাস’ চালানো ব্ল্যাক ডেথ, প্রায় ৩০০ বছর পর ফিরে আসে লন্ডনে। ১৬৬৫-র গ্রীষ্মে লন্ডন জুড়ে দ্রুত হারে ছড়াতে থাকে এই রোগ। এর জেরে লন্ডনের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ, প্রায় এক লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। সে বছর সেপ্টেম্বরের এক সপ্তাহে সাত হাজার ১৬৫ জনের মৃত্যু নথিভুক্ত রয়েছে এই মহামারির কারণে। এর কয়েক বছর আগে ইটালিতেও লক্ষাধিক লোকের প্রাণ কেড়েছিল এই প্লেগ।
প্রথম কলেরা অতিমারি: উনবিংশ শতকের শুরুর সময়ে বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ অতিমারির চেহারা নেয় কলেরা। ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমির বদ্বীপ অঞ্চলে প্রথম ছড়ায় এই রোগ। ১৮১৭-তে যশহরে প্রথম দেখা দেয় এই রোগ। তার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-সহ, বিশ্ব জুড়ে প্রায় সাত বছর ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে কলেরা। ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটিরিয়া কলেরার জন্য দায়ী। এটি মূলত জলবাহিত রোগ। ব্যাকটিরিয়া মিশ্রিত জল ও খাবারের মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছিল।
তৃতীয় প্লেগ অতিমারি: চতুর্দশ শতকের সেই বুবোনিক প্লেগ ১৮৫৫-তে নতুন করে ফিরে আসে চিনে। তার পরের বেশ কয়েক দশক ধরে এ দেশে সে দেশে মানুষকে ভুগিয়ে ছেড়েছিল। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ভারতেও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল এই প্লেগ। বেশ কয়েক দশক ধরে বিশ্বের প্রায় দেড় কোটি মানুষের প্রাণ কেড়েছিল ব্যাকটিরিয়া ঘটিত রোগ বুবোনিক প্লেগ। ১৮৯৪ সালে হংকং নিবাসী চিকিৎসক ইয়ারসিন প্লেগের কারণ হিসাবে ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটিরিয়ার প্রজাতি চিহ্নিত করেন।
রাশিয়ান ফ্লু: সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হল, গণপরিবহণ হল সহজ। ভিড় বাড়তে থাকল। আর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া তত সহজ হল। ১৮৮৯-’৯০ নাগাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের ফ্লু ভাইরাস। এই রাশিয়ান ফ্লু অতিমারির জেরে বিশ্বে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছে। রাশিয়ায় উৎপত্তি হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে এই ফ্লু-তে মৃত্যুর হার শিখরে পৌঁছয়।
১৯৫৭ নাগাদ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের নতুন রূপ আক্রমণ হানে বিশ্ব জুড়ে। যার জেরেই এশিয়ান ফ্লু অতিমারি। হংকং-এ থেকে সারা চিনে ছড়ায় এশিয়ান ফ্লু। এর পর এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও হানা দেয়। এই অতিমারির প্রকোপে প্রায় ১১ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সে সময়। শুধু মাত্র আমেরিকাতেই মারা গিয়েছিলেন প্রায় এক লক্ষ ১৬ হাজার জন।
তার পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এডস। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। এখনও অবধি বিশ্বের প্রায় সাত কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এই রোগে। প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের প্রাণ কেড়েছে এই ভাইরাস। বর্তমানে এই রোগের অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। তাই ভাইরাসটি থেকে গেলেও আগের থেকে মৃত্যু হার অনেক কমেছে।
ইবোলা ও জিকা ভাইরাস: ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায় এক অজনা জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। জানা যায় ইবোলা ভাইরাস এই রোগের জন্য দায়ী। গিনি, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওনেতে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়েছিল এটি। তার পর আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ছড়ায় এই রোগ। ২০১৫-র পর লাতিন আমেরিকাতে প্রাদুর্ভাব ঘটে জিকা ভাইরাসের। কিন্তু এই দু’টি ভাইরাসের মারণ হার বেশি হলেও, পৃথিবী জুড়ে খুব বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হননি।
এখন অবধি এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এই ভাইরাসে। বিশ্ব জুড়ে করোনা প্রাণ কেড়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের। যদিও আক্রান্ত হওয়ার পর একটা বড় অংশই সুস্থ হয়ে উঠছেন। প্রাণ কাড়লেও, আগের অনেক অতিমারির তুলনায় করোনায় মৃত্যু হার অনেকটাই কম। কিন্তু এই কম শক্তি নিয়েই সারা বিশ্বে ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলেছে করোনা। (তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স, হিস্টরি ডট কম, হু, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy