History of Gaza strip and why is important for Israel dgtl
Israel-Hamas Conflict
ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতে ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’-এ পরিণত গাজ়া! কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই শহর?
গাজ়া ভূখণ্ড। ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র হামাস গোষ্ঠীর সংঘাতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বিতর্কিত এই ভূখণ্ডের জনজীবন। গাজ়া ভূখণ্ড বর্তমানে হামাস গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইজ়রায়েলের কাছেও এই ভূখণ্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:২৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১৩৪
গাজ়া ভূখণ্ড। ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র হামাস গোষ্ঠীর সংঘাতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে বিতর্কিত এই ভূখণ্ডের জনজীবন। গাজ়া ভূখণ্ড বর্তমানে হামাস গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইজ়রায়েলের কাছে এই ভূখণ্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। আর তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বহু বছর ধরে।
০২৩৪
বর্তমান পরিস্থিতিতে হামাস জঙ্গিদের অস্ত্র লুট করা রুখতে গাজ়া সীমান্ত প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ইজ়রায়েল এবং মিশর। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় গাজ়ার মানুষদের খাদ্য এবং পানীয় সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
০৩৩৪
ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে লড়াই ভয়ঙ্কর রূপ নেওয়ার পর দেশের সেনাকে ইতিমধ্যেই গাজ়া ভূখণ্ডকে সম্পূর্ণ ভাবে অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী য়োআভ গালান্ত।
০৪৩৪
গত শুক্রবার গভীর রাত থেকেই আকাশ, জল এবং স্থল— তিন পথেই ইজ়রায়েলে হামলা চালাচ্ছে হামাস। পাল্টা জবাব দিচ্ছে ইজ়রায়েলি সেনাও। ইজ়রায়েলি সেনা সূত্রে খবর, ২২টি জায়গায় হামাস জঙ্গিদের সঙ্গে ব্যাপক লড়াই চলছে তাদের।
০৫৩৪
৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলে অনুপ্রবেশ করে ৯০০ জনেরও বেশি ইজ়রায়েলিকে হত্যা করে হামাস বাহিনী। পাল্টা হামলায় গাজ়ার প্রায় ৮০০ মানুষ ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। আগামী দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
০৬৩৪
ইজ়রায়েল এবং মিশর, গাজ়া সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় সেই ভূখণ্ড বর্তমানে বিশ্বের ‘বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’-এ পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৭৩৪
কিন্তু কী ভাবে গাজ়া বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডে পরিণত হল? আর কেনই বা এই ভূখণ্ড হামাসের দখলে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে ঢুঁ মেরে আসতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
০৮৩৪
গাজ়া ভূখণ্ড ৪০ কিমি লম্বা এবং ৯.৬ কিমি প্রশস্ত একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড যা পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তর-পূর্বে ইজ়রায়েল এবং দক্ষিণে মিশর দ্বারা বেষ্টিত। গাজ়া ভূখণ্ডের মধ্যেই রয়েছে প্যালেস্তাইনের বৃহত্তম শহর গাজ়া। ইজ়রায়েল থেকে কাঁটাতার দিয়ে বিচ্ছিন্ন গাজ়া ভূখণ্ড বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। যা ওয়াশিংটনের আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ।
০৯৩৪
গাজ়া একটি প্রাচীন বাণিজ্য নগরী এবং বন্দর শহর। দীর্ঘ সময় প্যালেস্তাইনের ভৌগোলিক অঞ্চলের অংশ ছিল সেই এলাকা। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে, গাজ়ায় মূলত আরবের মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল।
১০৩৪
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক এবং সংলগ্ন এলাকা ব্রিটেনের দখলে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন যখন প্যালেস্তাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন গাজ়ার বুদ্ধিজীবীরা প্যালেস্তাইনের জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন।
১১৩৪
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদি শরণার্থীদের জন্য স্থায়ী একটি দেশ গঠনের জন্য ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় ইজ়রায়েল। রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপে স্থির হয় যে, প্যালেস্টাইন ভেঙে তৈরি হবে ইজ়রায়েল। কিন্তু ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে আরব দেশগুলি। সংঘাতের সূচনা হয় তার পরেই।
১২৩৪
ইজ়রায়েল তৈরি হওয়ার পর ইজ়রায়েলি সামরিক বাহিনী দক্ষিণ প্যালেস্তাইনের ২৯টি গ্রামে বোমাবর্ষণ করে। যার ফলে হাজার হাজার গ্রামবাসী প্রাণ বাঁচাতে গাজ়া ভূখণ্ডে চলে যায়।
১৩৩৪
সেই সময় মিশরীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল গাজ়া। যা ইজ়রায়েল তৈরি হওয়ার পর মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই সময় গাজ়ায় আশ্রয় নেওয়া গ্রামবাসীদের কারণেই রাতারাতি কম জনবসতিপূর্ণ গাজ়ায় জনবসতি বাড়তে থাকে।
১৪৩৪
১৯৬৭ সালে ইজ়রায়েল এবং প্রতিবেশী আরব দেশগুলির মধ্যে ছ’দিনের যুদ্ধের পর, গাজ়া ইজ়রায়েলের দখলে চলে আসে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী গাজ়ায় দখল নেওয়ার পর সেখানে বসবাসকারী সাধারণ মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে।
১৫৩৪
গাজ়ার মানুষদের নাকি জোর করে জমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িঘর ভাঙচুর করার পাশাপাশি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বহু মানুষকে মেরেও ফেলা হয়।
১৬৩৪
এর মধ্যেই জেরুসালেমের অধিকার নিয়েও লড়াই হয় যুযুধান দুই পক্ষ প্যালেস্তাইন এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে। কারণ খ্রিস্ট, ইহুদি এবং ইসলাম— তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ওই শহর।
১৭৩৪
সংঘাত যত বাড়তে থাকে, ততই তাল ঠুকতে থাকে ইহুদি এবং আরব জাতীয়তাবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্যত দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলি অবশ্য বরাবর ইজ়রায়েলের পাশেই দাঁড়িয়েছে।
১৮৩৪
এর পর ইজ়রায়েলের দখলদারিত্বের অবসান এবং স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশায় ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ এবং ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দু’বার গণঅভ্যুত্থান হয় প্যালেস্তাইনে।
১৯৩৪
দীর্ঘ দিন ই়জ়রায়েল এবং পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে প্যালেস্তাইনের হয়ে দর কষাকষির কাজ করেছেন প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন (পিএলও)-র প্রধান ইয়াসের আরাফত। কিন্তু প্যালেস্তাইন সংঘাতের স্থায়ী সমাধানসূত্র অধরা থাকার কারণে ক্রমশ রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে আরাফতের।
২০৩৪
এই অবস্থায় প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকে হামাস। সুন্নি মুসলিম সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর রাজনৈতিক শাখা হিসাবে ১৯৮৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে হামাস। গাজ়ায় ঘাঁটি তৈরি করে নিজেদের কার্যকলাপ চালাতে থাকে এই সশস্ত্র বাহিনী।
২১৩৪
গোড়ার দিন থেকেই ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হানা এনে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল হামাস। হামাসের বিরুদ্ধে চরমপন্থায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। হামাসের হানায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ২০০৫ সালে গাজ়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ইজ়রায়েল।
২২৩৪
হামাসকে নিয়ে শত সমালোচনা এবং বিতর্ক সত্ত্বেও ২০০৬ সালের প্যালেস্তাইন নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পায় ওই সশস্ত্র বাহিনী। যা থেকে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে এই বার্তাই যায় যে, আরব জাতীয়তাবাদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে হামাস।
২৩৩৪
২০০৬ সালে নির্বাচনের অল্প সময়ের মধ্যেই হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী ফতেহ গোষ্ঠীকে সমর্থন করে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সরকার। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
২৪৩৪
২০০৭ সালে হামাস এবং প্যালেস্তাইনের অন্য এক সশস্ত্র গোষ্ঠী ফতেহর মধ্যে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর গাজ়া উপত্যকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। তার পর থেকে, গাজ়া হামাসের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জ, আমেরিকা-সহ বহু দেশ গাজ়াকে ইজ়রায়েলের অংশ বলেই দাবি করে এসেছে বার বার।
২৫৩৪
২০২৩ সালের মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেখা গিয়েছে যে ৪৫ শতাংশ গাজ়াবাসী হামাসকে সমর্থন করে।
২৬৩৪
গাজ়া ভূখণ্ডের ২০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস করেন। গাজ়ার বাসিন্দাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সেখানকার আদি বাসিন্দা। বাকি এক-তৃতীয়াংশ ১৯৪৮ সালে প্রাণ বাঁচাতে চলে আসা মানুষ।
২৭৩৪
গাজ়ার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ১৮ বছরের কম। দারিদ্রের হার ৫৩ শতাংশ। বিশ্বের অন্যতম জায়গা, যেখানে বেকারত্বের হার খুব বেশি।
২৮৩৪
এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক চিত্র সত্ত্বেও গাজ়ায় শিক্ষার হার তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই বেশি। সেখানে বসবাসকারী ৬-১২ বছর বয়সি শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশ স্কুলে পড়ে। গাজ়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ প্যালেস্তিনীয় হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন। মহিলাদের শিক্ষার হারও বেশি ওই এলাকায়।
২৯৩৪
কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে গাজ়ার তরুণ-তরুণীদের স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭০ শতাংশ। ২০২৩-এর গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাঙ্কের করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, গাজ়ার ৭১ শতাংশ বাসিন্দা হতাশায় ভুগছেন। এর অন্যতম কারণ— গাজ়াকে নিয়ে প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ইজ়রায়েল এবং মিশরের সংঘাত।
৩০৩৪
গাজ়া ভূখণ্ড নিয়ে প্যালেস্তাইন, ইজ়রায়েল এবং মিশরের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের কারণে সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি শুরু হওয়া ইজ়রায়েল-হামাস সংঘাতে তা আরও বেড়ে গিয়েছে। সীমিত খাদ্য, পানীয় এবং জ্বালানির মাধ্যমেই জীবনযাপন করতে হচ্ছে সেখানের সাধারণ মানুষকে।
৩১৩৪
গাজ়ার মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে কত দূর পর্যন্ত যেতে পারবেন তা-ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গাজ়ার মানুষদের নির্দিষ্ট কয়েকটি যাতায়াতের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
৩২৩৪
গাজ়ায় প্রতি দিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। যুদ্ধ শুরুর পর তা আরও বেড়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থাও তলানিতে এসে ঠেকেছে। অসু্স্থ রোগীদের এলাকার বাইরে নিয়ে যেতেও সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে মেধাবী পড়ুয়াদের।
৩৩৩৪
হামাসকে গাজ়া থেকে সরাতে ২০০৮-০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে চারটি বড় সামরিক হামলা করেছে ইজ়রায়েল। এই হামলায় গাজ়ায় থাকা মোট চার হাজার প্যালেস্তিনীয় মারা গিয়েছেন। গাজ়ার অর্থনৈতিক কাঠামো তলানিতে এসে ঠেকেছে।
৩৪৩৪
বিশেষজ্ঞদের মতে, হামাস-ইজ়রায়েলের সংঘাতের কারণে আরও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে গাজ়াকে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার ভারে একেবারে নুইয়ে পড়বে গাজ়ার মাথা।