কৃষক আত্মহত্যার জেরে বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে বিদর্ভ। আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ মহারাষ্ট্রের চাষিরা কেন শেষ করে দিচ্ছেন নিজেদের জীবন?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:০৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
পশ্চিম ভারতে ফের পদ্ম-ঝড়। বিপুল আসন জিতে মহারাষ্ট্র বিধানসভা দখল করেছে বিজেপি, শিবসেনা (শিন্ডে) এবং এনসিপির (অজিত পওয়ার) ‘মহাজুটি’ জোট। মরাঠাভূমির বিদর্ভ এলাকায় এ বার কমবে কৃষক আত্মহত্যা? বন্ধ হবে বালি মাফিয়াদের দাপাদাপি? নির্বাচন মিটতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
০২২১
ভারতের তথাকথিত ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্র। সেই রাজ্যের বিদর্ভ, যেন প্রদীপের নীচে অন্ধকার! আর্থিক ভাবে মরাঠা ভূমির অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে এই এলাকা। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ইতিমধ্যেই আলাদা রাজ্য তৈরির দাবি উঠেছে সেখানে। অবস্থানগত দিক থেকে দেশের একেবারে কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বিদর্ভ।
০৩২১
বিদর্ভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হল নাগপুর। এই এলাকার উপর দিয়ে বয়ে চলে বর্ষার জলে পুষ্ট বেশ কয়েকটি নদী। এদের উপস্থিতি বিদর্ভের জমিকে সুজলা-সুফলা করেছে। সংশ্লিষ্ট নদীগুলিতে রয়েছে বালি খাদান। ‘শুখা’ মরসুমে এই খাদানগুলিকে কেন্দ্র করে এই এলাকার অর্থনীতির উপর ছড়ি ঘোরায় স্থানীয় বালি মাফিয়ারা।
০৪২১
বিদর্ভের কৃষক আত্মহত্যার নেপথ্যে ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে বার বার দায়ী করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। মরাঠা প্রশাসনের দাবি, জলের অভাবে প্রত্যাশা মতো ফসল ফলাতে পারেন না সেখানকার কৃষকেরা। সমীক্ষকেরা অবশ্য জানিয়েছেন, এই দাবি একেবারেই ঠিক নয়। নদী এবং বৃষ্টির জল, কোনওটার অভাব নেই বিদর্ভে।
০৫২১
রাজ্য সরকারের আর্থিক সমীক্ষায় মহারাষ্ট্রকে মোট ছ’টি রাজস্ব এলাকা বা ডিভিশনে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হল কোঙ্কন, পুণে, নাসিক, ঔরঙ্গাবাদ, অমরাবতী এবং নাগপুর। শেষের দু’টি ডিভিশনকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বিদর্ভ।
০৬২১
২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষের রাজ্য সরকারের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, কোঙ্কন ডিভিশনের জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৪ লক্ষ ১১ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। অন্য দিকে, মাত্র দু’লক্ষ কোটির সামান্য বেশি ছিল অমরাবতীর বৃদ্ধির সূচক। নাগপুর ডিভিশনের আর্থিক বৃদ্ধির সূচক থেমে যায় ৩ লক্ষ ৪৯ হাজার কোটিতে।
০৭২১
সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে মরাঠা রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,২৬৭। এঁদের সিংহভাগই ছিলেন বিদর্ভের বাসিন্দা। ২০২১ সালে মহারাষ্ট্রে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৮৯ । ২০২০ সালে ২ হাজার ৫৪৭ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তবে গত চার বছরে কোঙ্কন এলাকায় কোনও কৃষক আত্মহত্যা করেননি।
০৮২১
অন্য দিকে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিদর্ভে বেশি সংখ্যক চাষি আত্মঘাতী হন। এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৮৯ এবং ৩০৯। ২০২৩ সালেও ৩০০-র কাছাকাছি পৌঁছেছিল বিদর্ভের কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা। এ বছর সূচক নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন সমীক্ষকেরা।
০৯২১
বিদর্ভ এলাকার অধিকাংশ জেলার শিক্ষার হার খুবই কম। ঊর্ধ্বমুখী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে গঢ়চিরৌলি, গোন্ডানা, অরমাবতী, ভান্ডারা এবং চন্দ্রপুর। তবে এই ডিভিশনের নাগপুরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। মরাঠাভূমির আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ শহরের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে নিতিন গডকড়ির কেন্দ্র।
১০২১
মহারাষ্ট্র সরকারের দাবি, পশ্চিমঘাট পেরিয়ে দক্ষিণ- পশ্চিম মৌসুমি বায়ু কখনই বিদর্ভ এলাকায় পৌঁছয় না। ফলে মরাঠা ভূমির অন্যান্য ডিভিশনের নিরিখে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যথেষ্ট কম। দ্বিতীয়ত, বিদর্ভে রয়েছে ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার কালো মাটি। এটি সমস্ত ধরনের ফসল উৎপাদনের সহায়ক নয়।
১১২১
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য জানিয়েছেন, কালো মাটিতে ‘হরিয়ালি’ আনাজের বদলে অন্য ধরনের ফসলের চাষ করছেন বিদর্ভের কৃষকেরা। এটিই তাঁদের দুর্ভোগের অন্যতম প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, অমরাবতী এবং নাগপুরের সেচ ব্যবস্থা মোটেই ভাল নয়। এই ডিভিশনের কিছু জায়গা জঙ্গল লাগোয়া হওয়ায় বন্য পশুর জন্য ফসল নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ফি বছর ঘটে থাকে।
১২২১
একটা সময়ে বিদর্ভের চাষিরা শুধুমাত্র ডাল উৎপাদন করতেন। কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁরা তুলো, সয়াবিন এবং আখ চাষ শুরু করেন। বর্তমানে বিদর্ভের কৃষি জমির ৬২.৭৮ শতাংশে হয় সয়াবিন এবং তুলোর চাষ। কিন্তু লাভের মুখ দেখা তো দূরে থাক, ফসল বদল হওয়ায় লোকসান হচ্ছে সেখানকার চাষিদের।
১৩২১
সরকারি সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে একর প্রতি বিদর্ভের কৃষকদের ক্ষতির অঙ্ক ২৭ হাজার ৩০১ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। চাষিদের পরিবারপিছু এটি ৩২ হাজার ৭১৬ টাকা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ফসল উৎপাদন করে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ায় এখানকার কৃষকেরা আত্মঘাতী হচ্ছেন বলে সরকারের ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৪২১
বর্তমানে বিদর্ভের চাষিরা বিশেষ ধরনের যে তুলোর (পড়ুন বিটি কটন) চাষ করছেন, কালো মাটি তার জন্য উপযুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত, গত দু’বছর ধরে এই এলাকার ফসলের উপর মারাত্মক হারে চলেছে কীট-পতঙ্গের আক্রমণ। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী তুলো উৎপাদন করতে না পারায় আত্মহত্যার পথ পেছে নিচ্ছেন বহু কৃষক, জানিয়েছেন সমীক্ষকেরা।
১৫২১
সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রে আবার জলের সমস্যা রয়েছে। এই ফসলের ক্ষেত্রে ২৫ দিনের মাথায় প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিদর্ভ পশ্চিমঘাটের অপর প্রান্তে হওয়ায় মৌসুমি বায়ু কখন সেখানে পৌঁছবে, তার নিশ্চয়তা নেই। পাশাপাশি, সেচ ভাল না হওয়ায় সয়াবিন চাষও মার খাচ্ছে।
১৬২১
একই সমস্যা রয়েছে আখ চাষের ক্ষেত্রেও। এই ফসল চাষের জন্যেও প্রচুর জলের প্রয়োজন। সেচ ভাল না হওয়ায় ভূগভর্স্থ নলকূপ খুঁড়ে সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছেন এখানকার কৃষকেরা। ফলে বিদর্ভের মাটির নীচের ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে জলের স্তর। চিনিকলগুলির থেকে বেশি টাকা পাওয়ার লোভে এই চাষ ছাড়তেও পারছেন না চাষিরা।
১৭২১
সমীক্ষা বলছে, বিদর্ভের ০.৫ শতাংশ কৃষক ঋণের কারণে আত্মহত্যা করেন। নেশার জেরে আত্মঘাতী হওয়া চাষির সংখ্যা ০.২ শতাংশ। এ ছাড়া ফসল নষ্ট হওয়া, পারিবারিক এবং সামাজিক চাপে জীবন শেষ করে দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। সুদখোর মহাজনদের অত্যাচারকেও কৃষক আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বলা হয়েছে।
১৮২১
বিদর্ভের কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলির কোনও হেলদোল নেই, তা কিন্তু নয়। গত কয়েক বছরে এখানকার ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে তারা। যদিও স্থানীয় চাষিদের দাবি, সেই প্রতিশ্রুতি কোনও সরকারই পালন করেনি। ফলে তাঁদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না।
১৯২১
মহারাষ্ট্রের বণিক সংগঠনগুলি আবার কৃষক আত্মহত্যা ঠেকাতে বিদর্ভের অর্থনীতিতে আমূল বদলের পক্ষে সওয়াল করেছেন। কৃষির পরিবর্তে সেখানে অস্ত্র কারখানা বা শুষ্ক বন্দর (ড্রাই পোর্ট) নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এলাকাটি দেশের একেবারে মধ্যস্থলে হওয়ায় এই দু’টি তৈরি করা বেশ সহজ হবে বলে দাবি করেছে মরাঠা ভূমির অধিকাংশ বণিক সংস্থা।
২০২১
বিদর্ভের উপর দিয়ে চারটি জাতীয় সড়ক গিয়েছে। নাগপুর থেকে মুম্বই পর্যন্ত রয়েছে চার লেনের হাইওয়ে। বিশাখাপত্তনম থেকে এলাকাটির দূরত্ব মেরেকেটে ২০০ কিলোমিটার। ফলে শুষ্ক বন্দর নির্মাণ লাভজনক হতে পারে। এ ছাড়া ‘শুকনো ছাই’ (ড্রাই অ্যাশ), পেপার মিল এবং বাঁশনির্ভর শিল্পে নজর ঘোরানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
২১২১
বিদর্ভ এলাকাতেই রয়েছে তাডোবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র সংরক্ষণালয়। একে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও লাভের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করে মহারাষ্ট্রের বণিক গোষ্ঠী। আগামী দিনে এই ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি হলে আত্মহত্যার হার কমে কি না, সেটাই এখন দেখার।