খুন হওয়া ৪৩৬ জনের বেশির ভাগই ছিলেন মহিলা বা বালিকা। তাকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছিল সেনাও। করবেটের সঙ্গে সে লড়েছিল চোখে চোখ রেখে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লিশেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:১৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৫
পরিসংখ্যান বলে, ৪৩৬ জনকে মেরে খেয়েছিল রয়্যাল বেঙ্গল সেই বাঘিনী। স্থানীয়দের কাছে পরিচিতি ছিল ‘চম্পাবতের শয়তানী’ নামে। বিপদ বুঝে কৌশল বদলে ফেলত সে। তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল সেনাও। সেই বাঘিনী বিখ্যাত করেছিল জিম করবেটকেও। তার পরেই উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষখেকো শিকারের ডাক আসত করবেটের কাছে। ত্রাতা হয়ে উদ্ধার করতেন তিনি।
০২২৫
১৮৭৫ সালে উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালে জন্ম জিম করবেটের। মানুষখেকো বাঘ আর চিতা শিকারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। উত্তর ভারত ঘুরে ঘুরে শিকার করতেন। পরে তিনিই বন্যপ্রাণ সংরক্ষক হয়ে ওঠেন। করবেটের প্রথম শিকার করা বাঘ এই ‘চম্পাওয়াতের মানুষখেকো’।
০৩২৫
১৯০০ সালের শুরুর দিকে ত্রাসে পরিণত হয়েছিল ‘চম্পাবতের মানুষখেকো’। ৪৩৬ জনকে খেয়েছিল সে। পরিসংখ্যান বলে, এত সংখ্যক মানুষ তার আগে বা পরে কোনও বাঘই খায়নি।
০৪২৫
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, জন্ম থেকে কোনও বাঘ মানুষ মেরে খায় না। তবে এক বার মানুষের রক্ত-মাংসের স্বাদ পেলে বার বার খেতে চায় সে।
০৫২৫
চম্পাবতের এই বাঘিনীর শিকারক্ষেত্র ছিল গোড়ার দিকে নেপাল। ১৮৯০ সাল নাগাদ নেপালে ত্রাস হয়ে উঠেছিল সে।
০৬২৫
কী ভাবে ওই বাঘিনী মানুষখেকো হয়েছিল, তার নেপথ্যে রয়েছে অন্য এক গল্প। শতাধিক বছর আগে মানুষ শখের জন্য শিকার করত। হিংস্র জীবকে লক্ষ্য করে ছুড়ত গুলি। সব গুলিতেই যে তাদের মৃত্যু হত, এমন নয়। আহত হত বহু পশু।
০৭২৫
সে ভাবেই কোনও এক শিকারীর গুলিতে আহত হয়েছিল চম্পাবতের ওই বাঘিনী। গুলির আঘাতে তার মুখের ডান দিকের উপর এবং নীচের পাটির ক্যানাইন দাঁত দু’টি ভেঙে গিয়েছিল। শিকার ধরার ক্ষেত্রে এই দু’টি দাঁত সব থেকে বেশি প্রয়োজনীয়।
০৮২৫
ক্যানাইন দাঁত দু’টি ভেঙে যাওয়ার কারণে শিকার ধরতে সমস্যা হত ওই বাঘিনীর। সে কারণে দুর্বল শিকার খুঁজত সে। মানুষের থেকে দুর্বল শিকার আর কী বা হতে পারে!
০৯২৫
ঠিক কবে থেকে পশ্চিম নেপালের রুপাল গ্রামে মানুষ শিকার শুরু করেছিল ওই আহত বাঘিনী, তা জানা যায় না। ১৮৯০ সাল নাগাদ গ্রামবাসীরা লক্ষ্য করেন, জঙ্গলে বা তার আশপাশের এলাকায় গিয়ে একের পর এক জন আর ঘরে ফিরছেন না।
১০২৫
বাঘের হানায় মৃত্যুর সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, স্থানীয়দের মনে হয়েছিল, এক নয়, একাধিক মানুষখেকো রয়েছে ওই এলাকায়। বহু শিকারী সেই মানুষখেকোর সন্ধানে জঙ্গলে ফাঁদ পেতেছিলেন। লাভ হয়নি।
১১২৫
সেই বাঘিনী এতটাই চালাক ছিল যে, তাকে ধরতে পারেনি শিকারীর দল। নেপাল সেনাও ওই বাঘিনীকে ধরার কাজে নিযুক্ত হয়। লাভ হয়নি। নেপালে প্রায় ২০০ জনকে মেরে খেয়েছিল সেই বাঘিনী।
১২২৫
এর পর সরকার ওই বাঘিনীকে ধরতে আরও সক্রিয় হয়। এই কাজে শিকারীর দল থেকে শুরু করে বিশাল বাহিনী নিয়োগ করা হয়। তারা বাঘিনীকে তাড়া করে। তাড়া খেয়ে সারদা নদী পেরিয়ে বাঘটি ভারতে প্রবেশ করে।
১৩২৫
এর পর উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন জেলায় ফের নিজের শিকার-সাম্রাজ্য বিস্তার করে বাঘিনী। ওই অঞ্চলে একের পর এক মানুষ উধাও হতে থাকে। বেশির ভাগই চম্পাবত এবং সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা।
১৪২৫
সাধারণত দিনের বেলায় শিকার ধরত সে। তার নিশানা হত মহিলা এবং বালিকা, যাঁরা বনে কাঠ কুড়োতে যেতেন। বাঘিনীকে ধরতে ব্যর্থ হন একের পর এক শিকারী। তাকে মারার জন্য প্রশাসন পুরস্কার ঘোষণা করে।
১৫২৫
কিন্তু সেই বাঘিনী ধরা দেয়নি। মনে করা হত, শিকারীর থেকেও বেশি বুদ্ধি ধরত সে। দিনে শিকার ধরত। তার পরে রাতে দূরের কোনও জঙ্গলে পালিয়ে যেত। দিন কয়েক পর ফিরে এসে আবার মানুষ খেত।
১৬২৫
তখনও পেশাদার শিকারী হননি করবেট। তবে বন, বন্যপ্রাণের বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান ছিল তাঁর। বন্দুকে নিশানা ছিল অব্যর্থ। ১৯০৭ সালে তাঁকে এই চম্পাবতের বাঘিনীর কথা বলেন এক বন্ধু, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক।
১৭২৫
করবেটের কাছে বাঘিনী শিকারের প্রস্তাব দেন সেই আধিকারিক। করবেট দু’টি শর্ত দেন। এক, বাঘিনী শিকারের জন্য প্রশাসন যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তা তুলে নিতে হবে। কারণ তিনি অর্থের বিনিময়ে শিকার করেন না। দুই, স্থানীয়দের সঙ্গে তিনি একাই শিকারে বার হবেন। অন্য কোনও পেশাদার শিকারী তাঁর সঙ্গে থাকবেন না।
১৮২৫
করবেটের শর্তে রাজি হয়ে যান ওই প্রশাসনিক কর্তা। এর পরেই পালি গ্রামে সেই মানুষখেকোর সন্ধান শুরু করেন তিনি। তত দিনে সরকারি মতে ৪৩৫ জনকে শিকার করে ফেলেছে সে।
১৯২৫
বাঘিনীর ৪৩৫তম শিকার ছিলেন এক মহিলা। বনে কাঠ কুড়োতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই মহিলার রক্তের দাগ অনুসরণ করে বাঘিনীকে ধাওয়া করেন করবেট। তার পর জঙ্গলের মধ্যে তার মুখোমুখি হন। বাঘিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। কিন্তু বেঁচে যায় বাঘিনী।
২০২৫
গুলির শব্দে ভয় পেয়ে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায় বাঘিনী। স্থানীয় তহশীলদারকে বলে গ্রামের কয়েক জনকে নিয়ে একটি দল তৈরি করেন করবেট। সেই দলের সদস্যেরা জঙ্গলে ঢাকঢোল বাজাতে শুরু করেন।
২১২৫
ঢাকঢোলের শব্দে ঝোপ থেকে বেরিয়ে সোজা করবেটের সামনে গিয়ে পড়ে সেই বাঘিনী। তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন করবেট। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি বিঁধে যায় বাঘিনীর শরীরে।
২২২৫
যদিও তাতে মরেনি ওই বাঘিনী। গুলি খেয়ে ছটফট করতে থাকে। অন্য দিকে, করবেটের বন্দুকের গুলি শেষ। ঘায়েল বাঘিনী সবেগে এগিয়ে যায় করবেটের দিকে। তাকে ছুটে আসতে দেখে সঙ্গী তহশিলদারের শটগান ছিনিয়ে গুলি ছোড়েন করবেট। লুটিয়ে পড়ে বাঘিনী।
২৩২৫
বাঘিনীর দেহ পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার মুখের ডান দিকের উপর এবং নীচের পাটির ক্যানাইন দাঁত দু’টো ভাঙা। সম্ভবত সে কারণেই মানুষ মারতে শুরু করেছিল সে।
২৪২৫
এর পর উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষখেকো মারতে ডাক পড়ত করবেটের। সেই সময় লাগাতার শিকারের কারণে ক্রমেই কমতে থাকে বাঘের সংখ্যা। এ সব দেখে শিকারী থেকে সংরক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন করবেট।
২৫২৫
কুমায়ুনে ‘হাইলি জাতীয় উদ্যান’ গড়তে সাহায্য করেন করবেট। সেটিই ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যান। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর এ দেশ ছেড়ে কেনিয়ায় চলে যান করবেট। ১৯৫৭ সালে ‘হাইলি জাতীয় উদ্যান’-এর নামকরণ হয় করবেটের নামে। ছবি: সংগৃহীত।