মান্নার বিখ্যাত আড্ডার সঙ্গী যাঁরা হতে পেরেছেন, তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান। আমার সৌভাগ্য মান্নাদার জীবনের শেষ দশ বছর। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেই আড্ডার স্বাদ পেয়েছি। অবশ্য ২০১০ সালের পরে মান্নাদা আর কলকাতায় আসেননি। তবে ফোনে আড্ডা বন্ধ হয়নি। এর আগে রসিক মান্না-দের কিছু গল্প বলেছি, পরে মনে হল, আরে ওই গল্পটা তো বলা হয়নি, ওহো ওইটা মিস হয়ে গেছে।
একজন কলাকুশলী খুবই অসুস্থ। সবারই পরিচিত। শচীনকর্তা শুনে ভীষণ দুঃখ পেলেন। খুবই আহা, উহু করছেন। এমন সময় কেউ একজন একটা প্রস্তাব দিল। চিকিৎসার তো প্রচুর খরচ, বেচারি একা আর কত করবে? সামর্থ্যই বা কোথায়? আচ্ছা শচীনদা, আমরা সবাই চাঁদা তুলে কিছু টাকা সাহায্য করতে পারি না?’ এ বার শচীনদা চুপ করে গেলেন। খানিক পরে বললেন—‘তোমার মুখরাটা সুন্দর ছিল। কিন্তু অন্তরায় আইসা সুর কাইট্যা গ্যাছে।’
‘তমান্না’ ছবিতে মান্নাদার প্রথম প্লে-ব্যাক, কিন্তু ‘মশাল’ ছবির ‘উপর গগন বিশাল’ গানটিই মান্নাদাকে শিল্পী হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা দেয়। এই বিখ্যাত গানটি প্রদীপ (গীতিকার), শচীন দেব বর্মন (সুরকার) এবং মান্নাদার সম্মিলিত সৃষ্টি। তখন কেউই তেমন ভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি। ‘মশাল’ ছবির কাজ চলছে। কাজের শেষে তিন জনই কথা বলতে বলতে মালাড স্টেশন যেতেন। একদিন শচীনদা দু’জনকে পিছনে ফেলে জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কারণটা পরে বোঝা গেল। স্টেশনের কাছে ছিল একটা ফলের দোকান। সেখানে একটু আগে পৌঁছে কয়েকটা কলা কিনলেন, দোকানি দাম চাইতে ততক্ষণে সামনে এসে যাওয়া মান্নাদাকে দেখিয়ে দিয়ে আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন।
মান্নাদার নিজের প্রিয় কোন গানটি? জিজ্ঞাসা করলে মান্নাদা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু কেউ যদি জানতে চাইত তাঁর প্রিয় অ্যালবাম কী , সব সময় মান্না বলতেন—‘মধুশালা’। বাঙালিরা এই অসাধারণ অ্যালবামের গান বিশেষ শোনেনি। এটা মান্নাদাকে খুব দুঃখ দিত। অমিতাভ বচ্চনের বাবা হরিবন্শ রাই বচ্চনের লেখা কবিতায় জয়দেবের অসাধারণ সুরারোপ। প্রথমে শিল্পী হিসেবে ভাবা হয়েছিল রফি, মুকেশের কথা। কিন্তু উর্দু উচ্চারণ এবং শিক্ষিত গায়কির জন্য মান্নাদাই গায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। বিপত্তি ঘটল রেকর্ডিং-এর সময়। মান্নাদার গাড়িতে স্টুডিও যাওয়া। সঙ্গে হরিবন্শ রাই এবং তাঁর স্ত্রী তেজি বচ্চন। গাড়ি মান্নাদাই চালাতেন। বচ্চন দম্পত্তির মান্নাদার গাড়ি চালানো সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। মান্নাদা এত জোরে গাড়ি চালাতেন, মনে হত রাস্তা দিয়ে গাড়ি উড়ে যাচ্ছে। তেজি বচ্চন তো ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিলেন। তার পর বললেন, ‘‘আচ্ছা মান্নাদা, আপনাকে কে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে বলুন তো?’ মান্নাদা যেন একটু চিন্তা করে বললেন—‘বোধহয় বোম্বে মোটর ভেহিকেলস।’
ভারতীয় ফুটবল দল যাচ্ছে আফ্রিকায়—শুভেচ্ছা সফরে। দলে রয়েছেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। মান্না দা-র অত্যন্ত প্রিয় ফুটবলার। একই ফ্লাইটে মান্নাদাও যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে, সঙ্গে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। গন্তব্য লুসাকা। তখন ভোর হয়ে এসেছে। অভ্যাসবশত সবারই চায়ের প্রয়োজন। মান্না বেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে এয়ারহোস্টেস উপস্থিত। মান্নাদা জানালেন ক’কাপ চা লাগবে। চা আর আসে না। এ বার বিরক্ত হয়ে সুরজিৎ বেল বাজালেন। এয়ারহোস্টেস এল। চায়ের, চায়ের প্রতিশ্রুতি আবার পাওয়া গেল। কিন্তু যথারীতি চা আর এল না। সেটি ছিল ‘কিনি’ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। তখনও মান্নাদার অসাধারণ রসবোধ। বললেন—‘সুরজিৎ, এটা কী ‘কিনি’ এয়ারওয়েজ, নাকি ‘দুখিনি’ এয়ারওয়েজ?’
২০০৩ সাল। মান্নাদার সঙ্গে প্রথম কাজ। সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মান্নাদার বাড়িতে। সে এক বিরাট টেনশনের দিন। মনীষীদের নিয়ে গান লিখেছি—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজি, স্বামীজি, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, রানি রাসমণি, সারদাদেবী, বিদ্যাসাগর, গিরিশ ঘোষ, রাজা রামমোহন, শ্রীঅরবিন্দ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মোট বারোটি গান। গানের কথা মান্নাদার পছন্দ হলে তবেই কাজটা হবে।
মান্নাদা একে একে সবকটি গান মন দিয়ে পড়লেন। তার পর বললেন, ‘বারোটি গান একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? আমার মনে হয় একটা ক্যাসেটে দশটা গানই যথেষ্ট’। বললাম, ‘তা হলে কোন দুটো গান বাদ দেব? মান্নাদা বললেন—‘বাংলার সব বিখ্যাত মনীষীদের নিয়ে লিখেছেন, ও ভাবে তো কাউকে বাদ দেওয়া যায় না। আচ্ছা দেবপ্রসাদবাবু, একটা কাজ করা যেতে পারে। বড় রাস্তাটা চেনেন তো ওই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ... ওখানে একটু লোকজনকে জিজ্ঞাসা করুন না, এই এতজনের মধ্যে কোন দুজনের নাম বেশির ভাগ লোকে কম শুনেছে। সেই দুজনকে নিয়ে গান না-হয় বাদ দেওয়া যাবে। মান্নাদার কথা শুনে আমি তো সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছি। এ আর এমনকী কঠিন কাজ। বাইরে বেরতে যাব, এমন সময় দেখি মান্নাদা হাসছেন। সেই প্রাণখোলা হাসি—আরে মশায়, কোথায় যাচ্ছেন, বসুন বসুন। এই বাংলায় এত মনীষী, বারোটা গানে তাদের সবাইকে কী ধরা যায়? এই ক্যাসেটে সব কটি গানই থাকবে। আমি একটু মজা করছিলাম। ভেবে দেখুন? হিমালয়ের থেকেও উঁচু একজন মানুষ, বলতে গেলে প্রথম আলাপেই এমন মজার ভিতরে আমাকে কেমন সহজ করে নিলেন।
মদনমোহন ছিলেন মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় সুরকার এবং প্রিয় বন্ধু। মদনমোহনের সুরে মান্নাদা কত যে কালজয়ী গান গেয়েছেন—কৌন আয়া মেরে মন কে ( দেখ কবীরা রোয়া), হরতরফ আব এহি (হিন্দুস্থান কী কসম), তুম বিন জীবন, ভোর আয়ি গয়া (বাবুর্চি), ভিগি চাঁদনি (সুহাগন) হোকে মজবুর (হকিকত), প্রীতম দরশ দিখাও (চাচা জিন্দাবাদ) বহু বহু গান। এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। গত বছর লতা মঙ্গেশকরের পুজোর গান লিখতে গিয়ে মুম্বইয়ে এল এম মিউজিক (লতাজির নিজের স্টুডিও)-এ একটা দারুণ জিনিস দেখেছিলাম—লতাজির প্রিয় গীতিকার, সুরকার, মিউজিক অ্যারেঞ্জারদের আলাদা আলাদা ছবির গ্যালারি—এত সুরকারদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। তাঁদের জন্য দুটি গ্যালারি। প্রতিটি গ্যালারিতে দেখলাম, যিনি লতাজির সব থেকে প্রিয় তাঁর ছবিটি বড় করে মাঝখানে। একটি গ্যালারিতে মাঝখানের ছবিটি মদনমোহনের, সুরকারদের অন্য গ্যালারিতে মাঝখানে যাঁর বড় ছবিটি জ্বলজ্বল করছে, মুগ্ধ হয়ে, গর্বিত হয়ে দেখলাম তিনি সলিল চৌধুরী। একদিন সন্ধ্যায় মান্নাদার কাছে মদনমোহনের ফোন—‘মান্নাদা, ফ্রি থাকলে চলে আসুন। একটা দারুণ জিনিস রান্না করছি। একসঙ্গে খাওয়া যাবে। ‘মান্নাদা জানতেন মদনমোহন দারুণ রান্না করে। রান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন সর্বক্ষণ। খুব মন দিয়ে মদনমোহন রান্না করছেন। সারপ্রাইজ। আগে বলা যাবে না। একদম পাতেই জানা যাবে। এল গরম মাটন। মান্নাদা বলছেন ‘কী দিয়ে রান্না করেছে জানেন? একটা ল্যাদলেদে তরকারি ঢ্যাড়শ। তাই দিয়ে কিনা মাটন-কষা। এমন উদ্ভট কম্বিনেশন ওই জানতো। তবে খেতে কিন্তু দারুণ হয়েছিল।’
এ বার শচীনদার একটা গল্প বলি শেষে। যার শুরু হাসি দিয়ে, আর শেষ....। শচীনদার ফোন ‘একবার আসো তো মান্না একখানা দারুণ সুর করছি তোমারে শেখাবো।’ মান্নাদা বড় কৃতজ্ঞ চিত্তে শচীনদার বাড়ি গেলেন, শচীনদাও খুব যত্ন করে গানটা শেখালেন। মান্নাদার গলায় গানটা শুনে শচীনদা উচ্ছ্বসিত ‘দারুণ গাইসো’। পরদিন আবার ফোন এলো শচীনদার, ‘মান্না, গানটা তুমি রফি মিঞারে শিখায় আইসো। ও ভালো গাইবে গিয়া।’ মান্নাদার সঙ্গে এমন হয়েছে বহু বার। হাসিতে শুরু, কান্নায় শেষ। ঠিক তাঁর জীবনের মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy