কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম চিত্র- পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জের বাড়িতে। বয়স এখন সাতানব্বই। ভাবলাম, বিজয়াতে একটা প্রণাম করে আসি। বার্ধক্য-জনিত অসুস্থতা। সব সময় শুয়ে থাকেন। খুব জোরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকলে সাড়া দেন। বড় ছেলে অভিজিৎ আর নাতনি অনিকা জোরে জোরে বলল ‘দেবপ্রসাদবাবু এসেছেন জিজ্ঞেস করছেন কেমন আছ? ‘ভাল আছি’ বলে দেবপ্রসাদবাবু আবার চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন। ভাবছিলাম, কী গর্বের উত্তরাধিকারই না বহন করে চলেছেন! বিখ্যাত সাহিত্যিক বনফুল তাঁর অগ্রজ। শান্তিনিকেতনে পড়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। আর কী সব অসাধারণ ছবিই না তৈরি করেছেন! ছবি হিসাবে দুর্দান্ত, আবার অরবিন্দবাবুর ছবি মানেই কালজয়ী সব গান—আহ্বান, নিশিপদ্ম, মৌচাক, ধন্যি মেয়ে, নতুন জীবন, অজস্র ধন্যবাদ, মন্ত্রমুগ্ধ, পিতাপুত্র, নদী থেকে সাগরে, অর্পিতা, গানের ব্যাপারে তিনি কোনও কম্প্রোমাইজের মধ্যে নেই। নিশিপদ্ম ছবির একটা সিচ্যুয়েশন। গানের কথা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। তিন জন গীতিকারকে দিয়ে ওই একই সিচ্যুয়েশনের উপর গান লেখালেন। শেষ পর্যন্ত পছন্দ হল গৌরীপ্রসন্নর লেখাটা—‘যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে- যায়’। কথা তো পছন্দ হল। এ বার সুর। নচিকেতা ঘোষকে দিয়ে নানা ভাবে সুর করিয়ে শেষ পর্যন্ত ’কাঙ্ক্ষিত সুরটি পেলেন অরবিন্দবাবু। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁকে অবশ্য দু’বার চিন্তা করতে হল না। গানটি গাইবেন মান্না দে। সঠিক সিদ্ধান্ত। এ ছবির গানের জন্য মান্না দে জাতীয় পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিলেন। অরবিন্দবাবু যখন নিউ থিয়েটার্সে বিমল রায়ের সহযোগী, সে সময় কৃষ্ণচন্দ্র দে-ও নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য অরবিন্দবাবুর উপর মান্নাদা’র একটা বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। আর গানে্র ব্যাপারেও অরবিন্দবাবু সব সময় মান্নাদা’র উপর নির্ভর করেছেন। ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে মান্নাদা গেয়েছিলেন ফুটবলের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠা সেই গান—‘আহা, সব খেলার সেরা’।
মান্নাদা ও অরবিন্দবাবু একেবারে সমবয়সি। দু’এক মাসের ছোট-বড়। এ জন্য আলাদা একটা সখ্য তো ছিলই। কারও সাহায্যার্থে অনুষ্ঠান। পাড়ার ছেলেরা ধরেছে, মান্না দে’কে একটু কম পয়সায় এনে দিতেই হবে। মান্নাদা তখন ভীষণ ব্যস্ত, কিন্তু অরবিন্দবাবুর কথা ফেলেন কী করে! অনুষ্ঠান জমিয়ে দিয়ে গেলেনই শুধু নয়, উদ্যোক্তারা যখন ওই ‘অল্প টাকা’ দিতে গেল, মান্নাদা বললেন—‘‘যার জন্য এই অনুষ্ঠান করলেন, আমার তরফ থেকে তাকে এটা দিয়ে দেবেন।’’
২০১০ সালের প্রথম দিকে লিভার ফাউন্ডেশন-এর উদ্যোগে একটি অ্যালবাম হয় মূলত সুপর্ণকান্তি ঘোষের উদ্যোগে ও সুর-রচনায়। সুপর্ণদা সুর করছেন আর মান্নাদা গাইবেন না, এমনও কি হতে পারে! ওই ৯১ বছর বয়সেও কাঁকুড়গাছির স্টুডিওতে কী গানটাই না গাইলেন মান্নাদা! রেকর্ডিং শেষে কিছু ফর্মালিটি তো থাকে—নো অবজেকশন দেওয়া। সেটা হল। এর পর সুপর্ণদা যখন রেমুনারেশনের খামটা দিতে গেলেন, মান্নাদা বললেন, ‘‘দ্যাখো খোকা, (সুপর্ণদাকে এই নামেই ডাকতেন) তোমরা একটা ভাল কাজ করছ, এই টাকাটা আমি নিতে পারব না। তুমি বরঞ্চ আর একবার শুনে দ্যাখো, গানগুলো ঠিক গেয়েছি কি না।’’
মহানুভব মান্না দে’র পরিচয় সুপর্ণদা পেয়েছেন বারবার। হঠাৎ চলে গেলেন বাবা নচিকেতা ঘোষ। সুপর্ণদা তখন কলেজের ছাত্র। বাড়িতে দু’বোন। একেবারে অথৈ জলে পড়ে গেলেন। এমন অবস্থা যে, পরীক্ষার ফি জোগাড় করাই মুশকিল। কেমন করে যেন খবরটা মান্নাদা’র কানে গেল। বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন। একটা উপায় তো বের করতে হবে। সুপর্ণদা রিদম ভাল বাজায়। বাবাকে অনেক কাজে অ্যাসিস্ট করত। মুশকিল হচ্ছে, তত দিনে সুপর্ণদার সুরে মান্নাদা’র ‘সে আমার ছোট বোন’ সুপারহিট। বিশেষ করে কলকাতায়। তাকে বাজানোর জন্য কী করে ডাকেন! সে সময় কুলটিতে মান্নাদা’র একটা অনুষ্ঠান এল। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন সুপর্ণদাকে— ‘‘তোমার বাজনার যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে এসো।’’ সঙ্গত করলেন, মান্নাদাও রেমুনারেশন দিলেন। কাজটাও হল, আবার সুপর্ণদার সম্মানও থাকল। সুপর্ণদা সব সময় বলেন, ‘‘সে সময় মানাকাকু যদি ওই ভাবে আমার কলেজের ফি-টা না দিতেন, আমার পরবর্তী কালের উচ্চশিক্ষা আর হতই না।’’
একবার আমার সঙ্গে মান্নাদা’র জোর ‘তর্ক-বিতর্ক’ হয়। পড়ে গিয়ে আমার স্পাইন ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। স্ত্রীরও কিডনির সমস্যা। কলকাতায় চিকিৎসার সুরাহা হল না। অগত্যা দুজনে ভেলোর গেলাম। উদ্বিগ্ন হয়ে মান্নাদা রোজ খবর নিতেন। স্ত্রীর অপারেশন করতে হল। একদিন মান্নাদা বললেন ‘‘আপনারা ভেলোরে তো এক মাস হয়ে গেল।’’ ‘হ্যাঁ’ বলতে বললেন, ‘‘এ তো বিশাল টাকার ধাক্কা!’’ আমি আবার ‘হ্যাঁ’ বললাম। দু’দিন পরে মান্নাদা’র ফোন, ‘‘আরে মশায়, একটা ব্যাপার তো আমরা দু’জনেই ভুলে গেছি। নিউ ইয়র্কের একটি মেয়ের জন্য আপনাকে দিয়ে দশটা গান লিখিয়েছিলাম। মনে আছে তো? আমি আর মৃণালবাবু সুর করেছিলাম। আপনার রেমুনারেশন-টা তো দেওয়াই হয়নি। ওরা ডলারে হিসেব করে বলে অ্যামাউন্ট-টা ভালই হয়।’’ আমি বললাম, ‘‘দাদা, আমার টাকা তো আপনি সেই সময়েই দিয়ে দিয়েছেন।’’ কিন্তু আমি যত বলছি টাকা পেয়ে গেছি, মান্নাদা ততই বারবার বলছেন, ‘‘আর ইউ শিওর?’’ শেষ অবধি বিরক্ত হয়েই মান্নাদা ফোনটা রেখে দিলেন।
চক্রধরপুরে মান্নাদা’র অনুষ্ঠান। খোলা মাঠ। মান্নাদা সবে দশ-বারোটা গান গেয়েছেন, এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ওই ক’টা গানে কি দর্শকদের মন ভরে! মান্নাদা’র মন তো একেবারেই ভরেনি। কিন্তু উপায় কী! আয়োজকরা খুব দুঃখিত মনে মান্নাদা’কে বিদায় জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মান্নাদার মন খুঁতখুঁত করছে। তাঁর গান শোনার জন্য দর্শকরা কত আশা করে এসেছে! মান্নাদা অপেক্ষা করলেন। বহুক্ষণ পরে বৃষ্টি ধরল, মান্নাদা আবার গাইতে উঠলেন। দর্শকরা দারুণ খুশি। ভেবে দেখুন, মান্নাদা’র কারও কাছে কোনও দায় ছিল না, দায়টা ছিল নিজের কাছে। শিল্পী হিসেবে দর্শকদের কাছে তাঁর কমিটমেন্ট—কোথাও তার তুলনা নেই!
যত শিল্পীই থাকুন না কেন, মান্নাদা থাকলে তাঁর অনুষ্ঠান শেষ দিকেই থাকে, দর্শক ধরে রাখার জন্য। বাঁকুড়ায় এমনই এক অনুষ্ঠানে মান্নাদা’র গান শেষ হল প্রায় মাঝ-রাতে। ভোরবেলা কলকাতায় ফেরা। মান্নাদা প্রস্তাব দিলেন, ‘‘এটুকু সময় আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। চলুন, সবাই মিলে গান করি।’’ সে দিনের অভিজ্ঞতা বেবিদা তথা প্রতাপ রায়ের (পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানিস্ট, মান্নাদা’র যন্ত্রসঙ্গী) মুখে শুনি, ‘‘প্রথমে ভ্যাকাদা (রবীন গঙ্গোপাধ্যায়, মান্নাদার আরেক যন্ত্রসঙ্গী) রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করল।’’ চিন্তা করে দেখুন, কার সামনে কে গাইছে! সামনে বসে আছেন ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী, আর তাঁর সামনে কিনা তাঁর নিজেরই মিউজিশিয়ান গান গাইছে! অনেকেরই ইগো-য় লাগবে ব্যাপারটা! অথচ ভ্যাকাদা’র গান শুনে মান্নাদা কী করলেন? ‘‘একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন ভ্যাকাদা আর আবেগে আপ্লুত হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ মান্না দে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy