Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ট্রেক করতে করতে আমসত্ত্ব খায়

বাঙালিরা খুব অতিথিবৎসল। আমি যেখানে থাকি, সেই ল্যান্ডোর-এ, ভিক্টর-মায়া বা প্রণয়-রাধিকার মতো প্রতিবেশীরা তো আছেই, উপরন্তু দিল্লি, কলকাতাতেও বাঙালি বন্ধুরা নেমন্তন্ন করলে আমি কখনও সুযোগ ছাড়ি না। সর্ষেবাটা দিয়ে ভাপা ইলিশ, রুই পোস্ত থেকে রসগোল্লা, কত চমৎকার জিনিস যে খাওয়ায়! বাঙালির আতিথেয়তা ও রন্ধনক্ষমতাকে সম্মান করি বলেই আমার ‘ল্যান্ডোর ডেজ’ বইয়ে ডাল ও আলুভাজা রান্নার রেসিপি দিয়ে থেমে গিয়েছি। পাঠক-পাঠিকাদের সহস্র উসকানিতেও ইলিশের মাথার ছেঁচকি বা মৌরলা মাছের চাটনি কী ভাবে রাঁধতে হয়, জানাইনি। ও জিনিস বাঙালি ছাড়া অন্য কারও হাতে খুলবে না।

রাসকিন বন্ড
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বাঙালিরা খুব অতিথিবৎসল। আমি যেখানে থাকি, সেই ল্যান্ডোর-এ, ভিক্টর-মায়া বা প্রণয়-রাধিকার মতো প্রতিবেশীরা তো আছেই, উপরন্তু দিল্লি, কলকাতাতেও বাঙালি বন্ধুরা নেমন্তন্ন করলে আমি কখনও সুযোগ ছাড়ি না। সর্ষেবাটা দিয়ে ভাপা ইলিশ, রুই পোস্ত থেকে রসগোল্লা, কত চমৎকার জিনিস যে খাওয়ায়! বাঙালির আতিথেয়তা ও রন্ধনক্ষমতাকে সম্মান করি বলেই আমার ‘ল্যান্ডোর ডেজ’ বইয়ে ডাল ও আলুভাজা রান্নার রেসিপি দিয়ে থেমে গিয়েছি। পাঠক-পাঠিকাদের সহস্র উসকানিতেও ইলিশের মাথার ছেঁচকি বা মৌরলা মাছের চাটনি কী ভাবে রাঁধতে হয়, জানাইনি। ও জিনিস বাঙালি ছাড়া অন্য কারও হাতে খুলবে না।

তার সঙ্গে সাংঘাতিক আমুদে ও আড্ডাবাজ। কত রকম গল্প যে সারা ক্ষণ করে চলে! তিন সেকেন্ডের বেশি চুপ করে থাকাকে বাঙালি, তার অতিথির প্রতি অপমান বলে মনে করে! এই লোকটা আমার বাড়িতে এসেছে, বা দোকানে আমার পাশে দাঁিড়য়ে চা খাচ্ছে, আর এখনও আমার ছোটকাকার সেই মজার গল্পটা এঁকে বলিনি! বাঙালির কাছে এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সে ভাবে, তার জীবনের রস-ভরা গল্পগুলো পৃথিবীকে নিরন্তর বিলিয়ে যাওয়া তার পবিত্র কর্তব্য। এই একটা জায়গায় সব বাঙালিকেই লেখকের সঙ্গে এক বেদিতে বসানো চলে!

মনে আছে, তুঙ্গনাথে ট্রেক করতে গিয়েছি, বচন সিংহের ঝুপড়ি হোটেলে হু-হু ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপছি। দুই বাঙালি ট্রেকারের সঙ্গে আলাপ, তাঁরা গল্প করতে করতে আমসত্ত্বের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। অন্যরা উত্তরাখন্ডে ট্রেক করতে এলে চিউয়িং গাম, ঝুরিভাজা নিয়ে আসে। কিন্তু বাঙালি সঙ্গে আমসত্ত্ব, হজমি রাখতেও ভোলে না। এর পরেও এই জাতের প্রশংসা না করে থাকা যায়?

আর, বই পড়তে ভালবাসে। এক বার দেহরাদূন থেকে শেয়ার ট্যাক্সিতে মসুরি ফিরছি। সামনের সিটে শাড়ি-পরা এক ভদ্রমহিলা, তাঁর হাতে আমার লেখা ‘আওয়ার ট্রিজ স্টিল গ্রো ইন ডেহরা’। আমি উত্তেজিত হয়ে পাশের সিটে বন্ধুকে বললাম, ‘দ্যাখ, আমার বই।’ ভদ্রমহিলা ঝটিতি ফিরে বললেন, ‘কে বলেছে, আপনার? এটা আমার বই।’ লেখককে কেউ চিনতে না-ই পারেন, তাতে এ জীবনে আর বিব্রত হই না। মসুরিতে এক বার এক জন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনার নো ফুল স্টপস ইন ইন্ডিয়া পড়ে মুগ্ধ হলাম।’ তাঁকে সবিনয়ে বুঝিয়েছিলাম, ওটা আমি নই ভাই, মার্ক টুলি। উনি পাইপ টানেন, আমি নই। এমন কোনও বাঙালি বাড়ি আমি দেখিনি, যেখানে লোকেরা সাহিত্য নিয়ে কথা বলে না। ভিক্টরকেই কত বার দেখেছি, রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে ছোটদের জন্য গল্প লিখছে। বাঙালি আমার বইকে সম্মান দিয়েছে, লেখা নিয়ে পজেসিভ হয়েছে, কিন্তু জেম্স বন্ডের সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলেনি। এই গুণটি চমৎকার লাগে।

অতিথিবৎসল, ভোজনরসিক, পড়ুয়া এবং ফুটবল-প্রেমিক। এখন লোকে গোয়া, কেরল, আই লিগের কথা বলে। কিন্তু মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা ময়দানের কথা আমিও জানি। সিমলার স্কুলে গোলকিপার পজিশনে খেলতাম কি না! আমার চার বছরের ছোট্ট বন্ধু গৌতম অবশ্য বিশ্বাস করে না। সে আমাকে এক বার বলেছিল, ডাইভ দিয়ে দেখাও তো। এই বয়সেও মাঠে ঝাঁপানোর পর গৌতম গম্ভীরসে বলেছিল, ‘হয়নি। তুমি তো বারপোস্টে ঝাঁপালে। বল ধরতে পারতে না।’ ল্যান্ডোরের পাহাড়ি মাঠ না হয়ে কলকাতা ময়দান হলে গৌতম নিশ্চয় আমার প্রতিভার কদর করত!

বুড়ো হাড়ে এখন বড্ড ঠান্ডা লাগে। ল্যান্ডোরে এই বসন্ত, গ্রীষ্ম, মায় শরৎকালটিও চমৎকার। কিন্তু শীতকালটা আর যেন সহ্য হয় না। স্কুলগুলিতে শীতের ছুটি পড়ে যায়, ছেলেরা পাহাড়ের রাস্তায় স্টিকি জ এবং বিভিন্ন চকোলেট কেনার জন্য ভিড় করে না। গাছগুলির পাতা ঝরে যায়, আগে মসুরি, ল্যান্ডোর এলাকায় যা সবুজ ছিল, এখন তার কিছুই নেই। শুধু টুরিস্ট গাড়ির গর্জন, ডিজেলের ধোঁয়া আর কেনাকাটার ভিড়। এই পরিবেশে খুব ক্লান্ত লাগে, ঠান্ডা লাগে। গরমের সময়টা এখানে, আর বাকি তিন মাস কলকাতায়, বাঙালি পরিবেশে থাকতে পারলে দিব্য লাগত। ওটাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানি, কলকাতাতেও গাছ কাটা হয়, ধোঁয়াশার চোটে চারদিক দেখা যায় না, ফুটপাত বলে কিছু নেই, পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ। কিন্তু শীতের কলকাতা? ফুলকপি, বাঁধাকপি দিল্লি, মুম্বই সর্বত্র পাবেন। মসুরির বাজারও ব্যতিক্রম নয়। রুই, কাতলা অনেক মাছই পাওয়া যায়। কিন্তু আমার স্বপ্ন অন্যত্র। জয়নগরের মোয়া আর নতুন গুড়ের সন্দেশ। ওটা বাঙালি ছাড়া অন্যরা কেউ আজ অবধি আমাকে খাওয়াননি।

এর পরও বাঙালিদের কেন ভাল লাগে, নতুন করে বলে দিতে হবে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy