Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

যখন যে ভাষায় গান গেয়েছেন, সেই ভাষা সযত্নে শিখেছেন

এ সব গানই আধুনিক ও সিনেমার গান। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীবাংলার মা রত্নগর্ভা। যে দিকেই ফিরে তাকানো যায়, আমরা পেয়েছি অসাধারণ সব প্রতিভা—সাহিত্যে, রাজনীতিতে, চিত্রশিল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি শাখায়। খেলাধুলোয় যেটুকু অপরিপূর্ণতা ছিল, তা-ও ভরিয়ে দিয়েছেন লিয়েন্ডার পেজ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

বাংলার মা রত্নগর্ভা। যে দিকেই ফিরে তাকানো যায়, আমরা পেয়েছি অসাধারণ সব প্রতিভা—সাহিত্যে, রাজনীতিতে, চিত্রশিল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি শাখায়। খেলাধুলোয় যেটুকু অপরিপূর্ণতা ছিল, তা-ও ভরিয়ে দিয়েছেন লিয়েন্ডার পেজ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আলাদা ভাবে বলছি সঙ্গীতের কথা—এই বাংলার মতো শিল্পীসমন্বয় আর কোথাও ঘটেনি। শুধু আধুনিক গানের পুরুষ শিল্পীদের কথাই ধরুন। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি—পঙ্কজ মল্লিক, সুধীরলাল, রবীন মজুমদার, জগন্ময় মিত্র, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সত্য চৌধুরী, অখিলবন্ধু, মানবেন্দ্র, শ্যামল, সতীনাথ—সর্বোপরি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে। শ্রোতা মাত্রই বলবেন, অসাধারণ, কালজয়ী কত গান আমরা উপহার পেয়েছি এঁদের কাছ থেকে। আনন্দে শেয়ার করেছি, বিরহে কেঁদেছি সেই সব গানে—সব সত্যি। কিন্তু সবার থেকে আলাদা মান্না দে এবং মান্না দে-র গান। তিনি একক, তিনি অনন্য। সবার থেকে আলাদা। মান্না দে।

মান্না দে নিজেকে সব সময় বলতেন আধুনিক গানের শিল্পী। রাগ সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন, যখন যে ভাষায় গান গেয়েছেন, সেই ভাষাটি সযত্নে শিখেছেন। মুম্বই তাঁর অন্যতম সঙ্গীত ক্ষেত্র ছিল বলে উর্দু ভাষা শিখেছিলেন মাতৃভাষার মতোই। কিন্তু সবই আধুনিক ও সিনেমার গান অনায়াসে গাইবার জন্য। কোথাও যেন কোনও ভাবে না আটকায়।

মান্নাদার প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড ১৯৫৩ সালে। শেষ অ্যালবাম ২০১০ সালে। এই বিশাল ব্যাপ্ত সময়ে মান্না সৃষ্টি করেছেন এক অতুলনীয় ইতিহাস। প্রথম অ্যালবামেই চমক। একটু স্মরণ করে দেখুন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যে আধুনিক গান হত, প্রায় সব গানেরই বিষয় ছিল প্রেম। সেই প্রথা ভাঙলেন মান্নাদা। প্রথম গানটিই ফিলজফিকাল। সেই সময়ের নিরিখে যা একটা ট্রেন্ড সেট করেছিল— কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল, কোথায় পথের প্রান্ত/ ঠিকানা হারানো চরণের গতি/হয়নি কি আজো শ্রান্ত।’ তখন তো দুটি করে গান হত—অন্য গানটিতে আরও বৈচিত্র। ইংরাজি গানের প্রতি মান্নাদার ভালবাসা এবং টান নিয়ে আগে লিখেছি। মান্নাদার অত্যন্ত প্রিয় একটি ইংরেজি গান, যে গান তিনি শিখেছিলেন সুলোচনাদেবীর কাছে, সেই ‘I was dancing’ গানের সুরে গৌরীপ্রসন্নকে দিয়ে লেখালেন—‘হায়, হায় গো, রাত যায় গো, দূরে তবু রবে কি।’ লতা মঙ্গেশকরের জন্য গান দুটি তৈরি করেছিলেন। লতাজি সে গান গাইতে না-পারার জন্য মান্নাদাই গান দুটি রেকর্ড করেন। সেই বিশেষ পরিস্থিতির কাছে বাংলা সঙ্গীত চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ রইল।

১৯৫৩ সালে সেই যে মান্নাদার পথ চলা শুরু, তারপর তো শুধু ইতিহাস। গাইলেন অসাধারণ সব প্রেমের গান, কখনও আনন্দের, কখনও বিরহের। গতানুগতিকতার বাইরে একদম অন্যরকম—কী কথায়, কী সুরে। তাঁর গানের সুরে মানুষ বলতে লাগল ভালবাসার কথা—আমার না থাকে যদি সুর, শুধু একদিন ভালবাসা, যদি কাগজে লেখো নাম, আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে, ওগো বরষা তুমি, জানি তোমার প্রেমের, খুব জানতে ইচ্ছে করে দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি— এ তালিকা চলতেই থাকবে।

প্রেমের গানের বাইরেও মান্নাদা যে কত ধরনের বেসিক আধুনিক গান গেয়েছেন, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। গাইলেন ফিলজফিকাল গান—সবাই তো সুখী হতে চায়, আমি আজ আকাশের মতো একেলা, চাঁদের আশায় নিভায়েছিলাম, আকাশ দ্যাখো মুখ সাগরের আয়নায়, আমি স্বপ্ন দেখব বলে।

বাংলা গানে বরাবরই এক ছক— মুখরা, অন্তরা, স়ঞ্চারী, আভোগ। পঞ্চাশের দশকের একদম শুরুতে সেই ছক ভেঙেছিলেন সলিল চৌধুরী—মূলত কবিতায় সুর দিয়ে তৈরি করেছিলেন পাল্কির গান, রানার, গাঁয়ের বধূ, ধান কাটার গান, নৌকো বাওয়ার গান। মান্নাদা কিন্তু ঠিক সেই একই পথে গেলেন না।

টাটকা লেখা ও সুর করা নতুন নতুন কাহিনিমূলক গান গাইলেন—কফিহাউস, সে আমার ছোট বোন, দশ বছরের বংশী, খেলা ফুটবল খেলা, তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে। প্রত্যেকটি গান চিরদিনের জন্য অমর হয়ে রইল। এ জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য আরও কয়েক জনের—গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মিন্টু ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ।

মান্নাদা গাইছেন, আর একটু রাগপ্রধান হবে না তা কি হয়। লক্ষ করে দেখবেন প্রয়োজন না হলে মান্নাদা গানের ভিতরে কখনও কালোয়াতি করেননি। মান্নাদা কয়েকটি অপূর্ব গান তৈরি করলেন—যেখানে রাগের প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। এমনই বাঁধুনি, রাগ-রাগিণী না বুঝলেও ক্ষতি নেই। গায়কি এবং গানের চলনই শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেয়—অভিমানে চলে যেও না, রাত জাগা দুটি চোখ, স্বপনে বাজে গো বাঁশি, এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। মান্নাদা তখন আমেরিকায় বড় মেয়ের কাছে। একদিন ফোন করে বললেন, মাথায় প্রচুর সুর আসছে, তাড়াতাড়ি কথা পাঠান। সঙ্গে সঙ্গে আমি লেখা পাঠালাম। সেই সময়ের সুর করা একটি গান মান্নাদা গাইলেন তাঁর শেষ পুজোর অ্যালবামে ‘আকাশ দ্যাখে মুখ সাগরের আয়নায়’ (অ্যালবাম: ঠিক ছবির মতো ২০০১)। দমদমে এইচএমভি স্টুডিও-তে গানটির রেকর্ডিং-এর সময় মান্নাদা অনেক সিনিয়ার মিউজিসিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘বলো তো, কোন রাগে গানটাকে বেঁধেছি?’ কেউই বলতে পারল না। তখন মান্নাদা হেসে বললেন—‘আমিও ঠিক জানি না। সারা জীবন কত রাগ-রাগিণী শিখেছি। গানটি সুর করে দেখছি কে কোথা থেকে যেন ঢুকে পড়েছে।’

মান্নাদা গাইলেন বাংলায় কাওয়ালি গান—‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, গজলাঙ্গের গান—‘আজমীর শরিফ তীর্থে গেলে মক্কা যাওয়ার মেলে ফল।’

এর পরে মান্নাদার অসামান্য সব থিম মিউজিক উপহার। এই সব গানের মূল্য এতটাই যে পৃথিবীর সব সম্পদ একত্রিত করলেও তার সমমূল্য হয় না। জীবন এবং ঋতুর বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ‘সারা জীবনের গান’, ‘সারা বছরের গান’। কী সব অসাধারণ গান—এসো যৌবন এসো হে, আমি রাজি রাখ বাজি, আমায় চিনতে কেন পারছ না মা, গহন মেঘের ছায়া, মা মাগো মা, মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। অসাধারণ লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অসাধারণ সুপর্ণকান্তির সুর।

আগে তেমন ভাবে বেসিক ভক্তিগীতি গাননি। খুব নিমরাজি হয়ে গাইলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘মা আমার মা’ অ্যালবামে। গানগুলো সব বয়সী শ্রোতারই মন জয় করল—কী আশ্চর্য দেখুন, ভক্তিগীতি অথচ কোনও কলেজের অনুষ্ঠানেও মান্নাদার কাছে অনুরোধ আসত ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’ গানটি গাইবার জন্য। খুব বাড়াবাড়ি হবে না যদি বলি ১৯৯৮ সালে গাওয়া মান্না দে-র এই গানটিই বাংলা বেসিক গানের শেষ চিরকালীন হিট গান। এ গান আজ পান্নালাল ভট্টাচার্যের অবিস্মরণীয় ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না ফুরিল’ গানের সঙ্গে একই আসনে জায়গা লাভ করেছে। মা আমার মা অ্যালবামের গান মান্নাদা যখন রেকর্ড করেন তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি বছর। ভাবা যায়!

মান্নাদার থিম মিউজিকের এক একটি অ্যালবাম, বাংলা গানের এক-একটি মাইলস্টোন। গাইলেন পুরনো কলকাতা নিয়ে। এর পরে বাবা-মেয়ের চিরকালের সম্পর্ক নিয়ে মেয়ে সুমিতাকে নিয়ে গাইলেন—‘‘বাবা মেয়ের গান’ (পুলক/সুপর্ণকান্তি)।

এই শতাব্দীর শুরুতেই ২০০১ সালে মান্নাদা একটি অসাধারণ বিষয় নিয়ে গাইলেন বাংলার ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ (শ্যামল গুপ্ত/মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। এখানেও মান্নাদা অন্য সব শিল্পীর থেকে আলাদা। শুধু গতানুগতিক প্রেমের গানই গেয়ে গেলাম, এতে মান্নাদার চলবে না। যদি না নানা বিষয়ে গান করা যায়, বাংলা গানের বিষয় ভাণ্ডার বাড়বে কী করে?

মান্নাদা ভাবছেন। সঙ্গীতে বাংলার মনীষীদের নিয়ে বিশেষ কাজ হয়নি। স্বামীজি, গিরিশ ঘোষ, রামমোহন রায়... বাংলার এমন কত মনীষী যাঁদের কর্মধারা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানেই না। ২০০৩ সালে মনীষীদের নিয়ে গাইলেন বারোটি গান। ‘আমার প্রিয় মনীষী’ অ্যালবামে (দেবপ্রসাদ/ মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়)।

পরের বছর। মান্নাদা বললেন—‘ভাবুন, ভাবুন নতুন কী বিষয়ে গান করা যায়।’ মৃণালদা আইডিয়া দিলেন ভারতের বিভিন্ন তীর্থ নিয়ে গান করলে কেমন হয়। বিষয়টি মান্নাদার মনে ধরল। ২০০৪ সালে মান্নাদা গাইলেন ‘ভারততীর্থ’ (দেবপ্রসাদ/মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। এই অ্যালবামের সব কটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ইতিহাস বলছে, এটিই বাংলায় মান্নাদার একমাত্র ভিডিও অ্যালবাম।

এ শুধু মান্নাদার বাংলা বেসিক গানের খানিকটা অংশমাত্র। একজন মুম্বই প্রবাসী বাঙালি শিল্পী শত ব্যস্ততার মধ্যেও যে আধুনিক গান উপহার দিয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই। কী বিষয়বৈচিত্র, কী গায়কি— মান্না দে-কে আপনার আলাদা করে রাখতেই হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE