আয়ের দৌড়ে আপনি হয়তো অনেকের থেকেই এগিয়ে। হাত খুলে খরচ করার পরেও থেকে যায় মোটা উদ্বৃত্ত। ফলে, দ্রুত জমে উঠছে সঞ্চয়। কিন্তু সমস্যা হল বড় আয়ের সুবাদে আপনি ঢুকে পড়েছেন উঁচু করের চৌহদ্দির মধ্যেও। আয়ের উপর ৩০% কর তো দিতেই হয়। তার উপর সঞ্চয় থেকে যে সুদ পাওয়া যায়, সেখানেও বসে করের থাবা। সব মিলিয়ে আপনার রোজগারের অনেকটা অংশই খেয়ে যাচ্ছে কর। তার উপর শুধুমাত্র ব্যাঙ্কে টাকা রাখার অভ্যেস থাকলে তো কথাই নেই। সেখানে বর্তমানে ৯ শতাংশের মতো সুদ পাওয়া গেলেও, ৩০ শতাংশ করের পর প্রকৃত সুদ দাঁড়ায় মাত্র ৬.৩০ শতাংশ। সুতরাং বেশি রোজগার করা সত্ত্বেও, যতটা টাকা আপনার জমা উচিত, আদৌ ততটা জমে উঠতে পারছে না। কারণ আপনি নিজের জন্য সেই সুযোগই তৈরি করছেন না।
অথচ ব্যাঙ্কের বাইরেও টাকা রেখে তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় রিটার্ন পাওয়ার বহু সুযোগ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। কর সাশ্রয়ের মতো সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে অনেক প্রকল্পে। কিন্তু আপনি খোঁজখবর নিয়ে দেখেননি। কিংবা দেখলেও লগ্নির অচেনা জগতে পা রাখতে ভয় পেয়েছেন। সেই ভয় কাটানোর জন্যই আমার আজকের এই লেখা। এক নজরে দেখে নেব এমন কিছু প্রকল্প যেখানে করের থাবা এড়িয়ে নির্ভাবনায় টাকা রাখা যায়। দেখব এমন দু-একটি লগ্নিস্থলও, যেখানে কম-বেশি ঝুঁকিতে টাকা রেখে শুধুু করই বাঁচানো যায় না, পাওয়া যেতে পারে মোটা লাভেরও সন্ধান। নজর দেব প্রকল্পগুলির ভাল-মন্দের দিকগুলিতে। যাতে সিদ্ধান্ত নিতে আপনার কিছুটা সুবিধা হয়।
সংস্থাগত প্রভিডেন্ট ফান্ড
যাঁদের সংস্থাগত প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা আছে, তাদের মূল বেতন থেকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক কেটে নিয়ে তা জমা করা হয় তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্টে। সমপরিমাণ অর্থ জমা করে নিয়োগকর্তাও। এই তহবিলের উপর প্রাপ্ত সুদ একটা সীমা পর্যন্ত থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। এই পর্যন্ত সবারই জানা। যেটা অনেকের জানা থাকে না তা হল, আপনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকা প্রতিমাসে মাইনে থেকে কাটিয়ে জমা করতে পারেন, যার প্রচলিত নাম ভলান্টিয়ারি প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভি পি এফ। এই জমার উপরও ৮০-সি ধারায় পাওয়া যায় কর ছাড়। এ ছাড়া করমুক্ত থাকে প্রাপ্ত সুদও। নিজেরই অজান্তে দীর্ঘমেয়াদে গড়ে ওঠে এক অতিকায় তহবিল।
পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড
স্বনির্ভর মানুষেরা তো বটেই, এমনকী সংস্থাগত কর্মীরা যাঁদের পি এফ অ্যাকাউন্ট আছে তাঁরাও খুলতে পারেন ১৫ বছর মেয়াদি পিপিএফ অ্যাকাউন্ট। খোলা যায় বড় ডাকঘর এবং বিভিন্ন ব্যাঙ্কে। এই প্রকল্পের বড় সুবিধা হল, এক দিকে জমার উপর পাওয়া যায় ৮০-সি ধারায় কর রেহাইয়ের সুবিধা। অন্য দিকে, তেমনই আবার প্রাপ্ত বার্ষিক সুদ থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। ১ থেকে ১২টি কিস্তিতে বছরে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে মোট ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা করা যায় এই অ্যাকাউন্টে। বর্তমান করমুক্ত সুদের হার ৮.৭ শতাংশ। যথেষ্ট আকর্ষণীয়। প্রকল্পের প্রাথমিক মেয়াদ শেষ হলে প্রতিবার আবেদন করে ৫ বছর করে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। অসুবিধা হল, ইচ্ছে হলেই যখন তখন টাকা তোলা যায় না। ফলে, দীর্ঘমেয়াদে গড়ে ওঠে বড় তহবিল। সুরক্ষার দিক থেকে অতি উত্তম।
করমুক্ত বন্ড
তিন বছর হল কেন্দ্রীয় সরকার করমুক্ত বন্ড ইস্যু করার অনুমোদন দিচ্ছে। অনুমোদন পাচ্ছে পরিকাঠামো শিল্পে নিযুক্ত বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা। ৪০,০০০ কোটি থেকে ৬০,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে গত তিন বছরে। এই বন্ডে লগ্নির উপর সুদ বছরে এক বারই দেওয়া হয় এবং তা থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। সুদের হারও বেশ আকর্ষণীয়। ২০১৩-’১৪ বছরের ইস্যুতে সর্বাধিক সুদ দেওয়া হয়েছে ৯ শতাংশের আশপাশে। প্রকল্পের মেয়াদ ১০, ১৫ এবং ২০ বছর। শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ করা হয় এই বন্ড। অর্থাত্ প্রয়োজনে বিক্রি করা যেতে পারে। আবার বাজার থেকে কেনাও যেতে পারে করমুক্ত বন্ড। বাজারে সুদ কমার প্রবণতা দেখা দিলে বিক্রির সময়ে প্রিমিয়ামও পাওয়া সম্ভব। এই বন্ড সাধারণত ইস্যু হয় অগস্ট থেকে পরের মার্চ মাস পর্যন্ত। বেশির ভাগ ইস্যুকারী সংস্থার বন্ডের রেটিং ‘এএ’ থেকে ‘এএএ’। অর্থাত্ এই সব বন্ডগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় উচ্চ সুরক্ষাযুক্ত। অবসরের টাকা রাখার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা। ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট না-থাকলেও লগ্নি করা যায় করমুক্ত বন্ডে।
মিউচুয়াল ফান্ড
করমুক্ত আয় হতে পারে মিউচুয়াল ফান্ড থেকেও। মিউচুয়াল প্রকল্প থেকে বণ্টিত আয় প্রাপকের হাতে থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। ইকুইটি-প্রধান মিউচুয়াল ইউনিট লগ্নির পর অন্ততপক্ষে এক বছর ধরে রেখে বিক্রি করে কোনও লাভ হলে, তার উপর কোনও মূলধনী লাভ-কর দিতে হয় না। ঋণপত্র-নির্ভর মিউচুয়াল ইউনিট বিক্রি করে কোনও লাভ হলে তার উপর শর্তসাপেক্ষে মূল্যবৃদ্ধি সূচক বা কস্ট ইনফ্লেশন ইনডেক্স প্রয়োগ করে করের বোঝা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এই কারণে ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান বা এফএমপি করদাতাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফেব্রুয়ারি মাসে এক বছরের একটু বেশি মেয়াদের এফএমপি-তে লগ্নি করলে দু’বছরের সূচক প্রয়োগ করার সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে কর দিতে হলেও তা হয় নামমাত্র। অল্প মেয়াদের জন্য টাকা রাখা যেতে পারে শর্ট টার্ম অথবা আলট্রা শর্ট টার্ম বন্ড ফান্ডে। এখানে করমুক্ত থাকে নিয়মিত ডিভিডেন্ড। উঁচু সুদের বাজারে বন্ড ফান্ড বা ইনকাম ফান্ডে লগ্নি করলে বাজারে যখন সুদ কমতে শুরু করে, তখন অনেকটা বেড়ে উঠতে পারে ঋণ-নির্ভর ইউনিটের নিট অ্যাসেট ভ্যালু। সুযোগ হয় মূলধনী লাভের।
ইকুইটি শেয়ার
বড় ঝুঁকির জায়গা হলেও একই সঙ্গে বড় লাভের জায়গাও বটে। আছে কর বাবদ বড় সুবিধাও। শেয়ারের উপর প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড প্রাপকের হাতে থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। শেয়ার কেনার পর এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে রাখার পর শেয়ার বাজারে বিক্রি করে কোনও লাভ হলে তার উপর কোনও কর দিতে হয় না।
জীবনবিমা এবং ইউলিপ
শর্তসাপেক্ষে করমুক্ত আয়ের সুবিধা পাওয়া যায় জীবনবিমা ও ইউনিট লিঙ্কড ইনশিওরেন্স প্রকল্পে লগ্নি করলেও।
যা যা করা উচিত
• সুযোগ থাকলে ভলান্টারি প্রভিডেন্ট ফান্ডে যতটা সম্ভব টাকা কাটান।
• বয়স ৪৫/৫০-এর মধ্যে হলে অবশ্যই পি পি এফ অ্যাকাউন্ট খুলুন এবং নিয়মিত টাকা জমান।
• করমুক্ত আয়ের সুযোগ নিন উপযুক্ত মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করে। ইকুইটি প্রকল্পের মধ্যে ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ড ভাল করমুক্ত আয়ের সন্ধান দিতে পারে।
• নিজের ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য বিচার করে দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নি করুন শেয়ারে। এস আই পি পদ্ধতিতেও নিয়মিত লগ্নি করতে পারেন কোনও সুবিন্যস্ত ইকুইটি ফান্ডে। ডিভিডেন্ড ছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদে ভাল করমুক্ত মূলধনী লাভের সুযোগ থাকবে।
• প্রয়োজন অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদের জীবনবিমা প্রকল্পে যোগদান করুন।
• যে সব ব্যাঙ্ক সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৬/৭ শতাংশ সুদ দেয়, সেখানে খাতা খুলে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখতে পারেন। সেভিংস অ্যাকাউন্টে প্রাপ্ত বছরে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদের উপর কোনও কর দিতে হয় না।
• যাঁদের অবসর এগিয়ে আসছে, তাঁরা আগে থেকেই করমুক্ত বন্ডের নতুন ইস্যুতে যতটা সম্ভব লগ্নি করুন। অবসরের পর করের বোঝা কমাতে প্রাপ্ত তহবিলের একটি বড় অংশ লগ্নি করতে পারেন করমুক্ত বন্ডে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy