Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Presents

ছাতার নীচে আয়ের হদিস

মিউচুয়াল ফান্ডের দুনিয়ায় এখন রীতিমতো ফ্যান ক্লাব তৈরি হয়ে গিয়েছে ইনকাম ফান্ডের। সৌজন্যে, কমতে থাকা সুদের জেরে চাঙ্গা হওয়া ঋণপত্রের বাজার।মিউচুয়াল ফান্ডের দুনিয়ায় এখন রীতিমতো ফ্যান ক্লাব তৈরি হয়ে গিয়েছে ইনকাম ফান্ডের। সৌজন্যে, কমতে থাকা সুদের জেরে চাঙ্গা হওয়া ঋণপত্রের বাজার।

নীলাঞ্জন দে
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০১:৫৪
Share: Save:

ঋণে সুদ কমলে পুঁজি জোগাড়ের খরচ কমে। কিন্তু এখন আমানতেও সুদ কমছে। ফলে খোঁজ পড়েছে ব্যাঙ্কের মেয়াদি জমা বা স্থায়ী আমানতের ম্যাড়মেড়ে বৃত্তের বাইরে টাকা বাড়ানোর বিকল্প জায়গার। যেখান থেকে আয় মোটামুটি ভাল হবে, কিন্তু তেমন একটা ঝুঁকি থাকবে না। শান্তিপ্রিয়, নির্ঝঞ্ঝাট সাধারণ মানুষের এই চাহিদা মেনে লগ্নির ঠিকানা হাতড়াতে গিয়েই উঠে এল ইনকাম ফান্ডের কথা। দেখা গেল, হালে লগ্নিকারীদের একটি বড় অংশ এই ফান্ডের পেছনে ছুটছেন। বিশেষত যাঁদের ঝুঁকি নেওয়ার মতো বাড়তি পুঁজি কম কিংবা যাঁরা অবসর নিয়েছেন বা নিতে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। কিন্তু কেন? চলুন, আজ এই উত্তরটাই খুঁজি।

কম ঝুঁকির আয়

বেশির ভাগ সাধারণ মানুষই লগ্নির ক্ষেত্রে ঝুঁকির পাল্লা ভারী হলে ভুরু কোঁচকান। যে কারণে রিটার্ন কিছুটা বেশি দিতে না দিতেই ইনকাম ফান্ডের কদর এতটা বেড়েছে। তবে হঠাৎই তার ভাগ্যের শিঁকে ছেড়ার কারণ বিশদে বুঝতে হলে আগে ফান্ডটির চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি জানা জরুরি। নয়তো কোন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে চাহিদা এই হারে বাড়ছে সেটা ধরা যাবে না।

ইনকাম ফান্ড হল এমন একটি ফান্ড, যার—

তহবিল খাটে মূলত উঁচু মানের (উঁচু রেটিং অর্থাৎ সুদ-সমেত আসলের টাকা মার যাওয়ার ঝুঁকি যেখানে অনেক কম) ঋণপত্রে।

নিয়মিত আয়ের বন্দোবস্ত থাকে। তহবিল যে-ভাবে বাড়ে, সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে কতটা সময় পর পর রিটার্ন মিলবে, তার ধরাবাঁধা হিসেব নেই। আবার নিয়মিত রিটার্ন যে মিলবেই, নিশ্চয়তা নেই তারও। সে ক্ষেত্রে হয়তো ফান্ড ভাঙানোর পর রিটার্নের পুরোটা হাতে আসতে পারে।

ওপেন এন্ড ফান্ড বলে যখন ইচ্ছে ফান্ডের ইউনিট কেনা বা বেচা যায়। ফলে চাইলে লগ্নিকারী ইউনিট বিক্রি করেও রোজগার করতে পারেন।

এমন ভাবে ফান্ডের তহবিল বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার ঋণপত্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে ঝুঁকি যতটা সম্ভব কম রাখা যায়।

তবে শেয়ারে (ইকুইটি) টাকা খাটালে যে-ভাবে তহবিল বাড়ার সম্ভাবনা থাকে, সেটা এখানে একেবারেই নেই।

লক্ষ্য, লগ্নিকারীদের খেটেখুটে রোজগার করা অর্থ সুরক্ষতি রাখা। এবং তার থেকে মোটামুটি নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

লাভের গুড় কতটা?

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ১৭ এপ্রিলের ন্যাভ অনুযায়ী গত এক বছরে দীর্ঘ মেয়াদি ইনকাম ফান্ড গড়ে ১৩.৩% রিটার্ন দিয়েছে। তেমন ঝুঁকি না-নিয়েও এই হারে পুঁজির বৃদ্ধি তাক লাগিয়েছে লগ্নিকারীদের। বিশেষত যাঁরা ঝুঁকি এড়িয়ে একটু বেশি আয়ের পক্ষপাতী, তাঁদের। কারণ, তাঁরা এটা বুঝে গিয়েছেন, এই দুর্মূল্যের বাজারে ব্যাঙ্কে জমিয়ে রোজগার খুব বাড়বে না। পরিসংখ্যানও দেখাচ্ছে, গত এক বছরে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে পাওয়া রিটার্ন চলে গিয়েছে ৯ শতাংশের নীচে। যে কারণে ভিড় বাড়ছে ইনকাম ফান্ডের বৃত্তে।

মুঠোয় সুযোগ

সকলেই জানেন ভারতে এখন সুদ কমছে। আগামী দিনে সুদ আরও কমতে পারে। আর সুদের এই কমে যাওয়া এবং তা আরও কমার সম্ভাবনাই চাঙ্গা করেছে দেশের ঋণপত্রের বাজারকে। কারণ, বাজারে সুদ কমা এবং কমার সম্ভাবনা, দু’টিই ঋণপত্রের দাম বাড়ানোর প্রধান শর্ত। ফলে এখন সুদিন দেখছে ইনকাম ফান্ডের মতো ঋণপত্র নির্ভর বিভিন্ন ফান্ড। সেগুলির ন্যাভ উঠছে। দ্রুত বাড়ছে তহবিল। আয় বাড়ছে লগ্নিকারীর। আপনি এই সুযোগের শরিক হবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। তবে লগ্নি-দুনিয়ায় যেহেতু সুযোগ সব সময়ে একই রকম থাকে না এবং সময় থাকতেই সব সুযোগ প্রাণপণে উসুল করে নেওয়াই দস্তুর, তাই কয়েকটা কথা মাথায় রাখতে বলব। যেমন—

সুদ কমছে। আগামী দিনে আরও কমতে পারে। এবং অন্তত আগামী বেশ কয়েকটি ত্রৈমাসিক ধরেই এই কম সুদের জমানা চলবে। এই সুযোগ হেলায় হারানো বোকামি।

এই মুহূর্তে কর্পোরেট সংস্থাগুলিও বাজারে প্রচুর ঋণপত্র ছাড়ছে। কারণ, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার আশায় তারা ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। ফলে আরও বেশি ঋণ নেওয়া তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। আর যেহেতু ঋণপত্র ছেড়ে টাকা জোগাড়ের নিয়ম-কানুন এখন অনেক বেশি সুবিধাজনক, তাই সংস্থাগুলিও সেই পথেই হাঁটতে চাইছে।

ব্যাঙ্ক, পেনশন ফান্ড বা বিমা সংস্থার মতো লগ্নিকারী সংস্থাগুলিও এই ঋণপত্র লেনদেনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট জোরালো ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এটা সাধারণ লগ্নিকারীদের ভরসা জোগাতে পারে। কারণ, ঋণপত্রের লেনদেন কম হলে সেটা সব সময়েই দুশ্চিন্তার বিষয়।

পুঁজি বাড়ানোর প্রথম শর্তই হল সুযোগ বুঝে কৌশলী হওয়া। যাঁরা ইতিমধ্যেই অন্য কোনও ফান্ডে লগ্নি করেছেন এবং সেটা তেমন রিটার্ন দিচ্ছে না, তাঁরা তা পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। এবং ইনকাম ফান্ডের ইউনিট কিনতে পারেন। আবার মিউচুয়াল ফান্ডে কোনও দিন কোনও লগ্নি করে না-থাকলেও এই চোটে তা শুরু করে দেওয়া যায়।

হাতে বাড়তি অর্থ থাকলে বেশির ভাগ অংশটা এই মুহূর্তে দ্রুত ইনকাম ফান্ডে লাগিয়ে দেওয়া যায়। চাইলে শুরু করতে পারেন এসআইপি-ও।

মাঝারি বা দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নি করলে এই ফান্ড থেকে সব থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

তবে ফান্ড ভাঙানোই হোক বা ইউনিটের একাংশ বিক্রি কিংবা ফান্ড বদল, সব লগ্নি ও লেনদেনের ক্ষেত্রেই করের বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।

মাথায় রাখুন

অবশ্য ইনকাম ফান্ডে টাকা ঢালবেন বলে ভেবে থাকলে প্রথম থেকেই কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখুন—

নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করা এই ফান্ডের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও কোনও ফান্ডই এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয় না। অর্থাৎ নিয়ম করে যে একটা টাকা আসবেই, তার স্থিরতা নেই।

অনেকে মান্থলি ইনকাম প্ল্যানের (এমআইপি) সঙ্গে ইনকাম ফান্ডকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। সেটা করবেন না কিন্তু। এমআইপি-তে তহবিলের ছোট অংশ শেয়ারে খাটে। এবং রিটার্ন তুলনায় বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।

বিপুল রিটার্নের প্রত্যাশা না-করাই ভাল। কারণ ঋণপত্রের বাজারের গতিপ্রকৃতি শেয়ার বাজারের মতো নয়। শেয়ার বাজারের তুলনায় এখানে ঝুঁকি ও রিটার্ন, দু’টিই কম থাকে।

সব সময়ে নিজের ফান্ডের পরিস্থিতি নজরে রাখুন। তহবিল বাড়াতে ফান্ডের টাকা কোথায় কী ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফান্ড ম্যানেজাররা, কোন অবস্থায়, কেন ন্যাভ বাড়ছে বা কমছে— সব লক্ষ করুন। না-হলে খারাপ ভাবে পরিচালিত ফান্ডের পেছনে টাকা গুনে হাত কামড়াতে হতে পারে।

ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে যে ঝুঁকি নেই, তা নয়। যেমন ধরুন, যে-সংস্থাটির ঋণপত্র কিনেছে ফান্ড, আচমকাই তা আর্থিক সঙ্কটে পড়ল। লোকসান হল বা কোনও মামলায় ফেঁসে গেল। হতেই পারে। আসলে ঋণপত্র কেনা মানে তো সংস্থাটি ঋণ নিচ্ছে। সুতরাং সঙ্কটে পড়লে ঋণের টাকা সুদ সমেত ফেরত দেওয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে ফান্ড বদলানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্তও নিতে হবে। বাজারে সুদ হঠাৎ বাড়লেও ইনকাম ফান্ডের সুদিন ফুরোতে পারে।

সুরক্ষা বজায় রেখে তহবিলের বৃদ্ধি ও আয়ের প্রবাহ— শর্ত দু’টি ঠিক মতো পূরণ হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন।

লেখক মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE