জীবনে কত কিছুই ঘটে। যা প্রত্যাশিত নয়। স্বপ্ন ভাঙছে, ভালবাসারও মৃত্যু ঘটছে। এরকমই বাস্তব-অবাস্তব মিলিয়ে ‘সঙ্ঘারাম’-এর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হল ‘চৌমাথা’ নাটকটি। ঋত্বিক ঘটকের ‘কমরেড’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘লুলু’ এবং ‘মশা’ ও প্রমিতা সেনগুপ্তের ‘ওলি ও আলি’ গল্প নিয়ে নির্মিত নাটকটি। গল্পগুলো নতুন নয়, তবে নতুনত্ব আছে ভাবনায়, প্রয়োগে এবং দৃশ্যায়নে। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এটিই প্রথম নাটক। পর পর চলতে থাকে গল্পগুলো, মাঝে একটা করে হুলি-গান। নাটকের শুরুতে চরিত্রদের আগমন, হেঁটে চলে বেড়ানো, হঠাৎ ফ্রিজ হয়ে যাওয়া এবং নাটকের শেষ দৃশ্যে ‘চৌমাথা’র সমস্ত চরিত্রদের মিলেমিশে যাওয়ার দৃশ্যায়ন দেখতে ছবির টাইটেল কার্ডের মতো লাগে। এভাবেই নাটকের চলন হয়ে যায় কখনও সিনেমার মতো, কখনও কবিতা, কখনও বা ঘোর বাস্তব।
কলেজে পড়া আলি ও ওলি অষ্টমীর সন্ধেয় ঠাকুর দেখতে বেরোয়। পথে দেখা হয় কলেজ স্টুডেন্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট সঞ্জয় এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের। ঘটনাক্রমে এই বাহুবলী দাদার লালসার শিকার হওয়া ওলি কোনও ক্রমে পালিয়ে ওদের হাত থেকে রেহাই পায়। কিন্তু পালাতে পারে না আলি। ওদের হাতে মার খেয়ে আধমরা হয়ে, দু’দিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয়। গল্পটা চেনা লাগলেও টান টান দৃশ্যায়নে চমক লাগে। একটি দৃশ্যে পুজোর সন্ধেয় অলি-গলিতে বাচ্চাদের ক্যাপ ফাটানো, তরুণ প্রেমিকদের বেপরোয়া উন্মত্ত প্রেমের দৃশ্যায়ন, দড়ি সরলে ধাক্কা সামলে ছুটে গিয়ে প্রতিমা দর্শন, সেলফি তোলা, মুহূর্তেই দর্শনার্থীদের দুর্গা লক্ষ্মী সরস্বতী ... মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে পরা, পরক্ষণেই রক গানের তালে নেচে ওঠা – এ সব ভিজুয়াল মন ভরিয়ে দেয়। তবে নাটকের দৈর্ঘ্যটা কম হলে ভাল হত।
‘লুলু’ চরিত্রটি অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের। তার চমৎকার মঞ্চায়নে চরিত্রটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশভাগ, কী জরুরি অবস্থা বা গাঁধী হত্যা, বিশেষ বিশেষ সময়ে লুলুর সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে এক সাংবাদিকের। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই তাকে বিচলিত দেখায় না। তবে লুলুরও কিছু বলার থাকে। ভাবলেশহীন, ক্ষীপ্র দৃষ্টি, খামখেয়ালিপনা কিংবা যৌনতার প্রকাশ দৃশ্যে শান্তনুর (লুলু) অভিনয় প্রশংসনীয়। প্রশংসা পাবেন তথাগত চৌধুরী (সাংবাদিক)ও। সাংবাদিককে লুলু তার ম্যানসনে নিয়ে যাওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয় লিফটে ওঠার সময় আলোর প্রয়োগ, কামনা কিম্বা সঙ্গম দৃশ্যের মোহময়ী আবেশ রচনায় পরিচালকের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়।
ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘কমরেড’ গল্পটিও সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে নাটকে। ঝাব্বু বন্ধ কারখানার জঙ্গি ইউনিয়নের নেতা। শোষিত মজদুর শ্রেণির প্রতিনিধি। কিন্তু এক সময় তার স্বৈরতন্ত্রী মালিক শ্রেণির সঙ্গে সমঝোতা মেনে নিতে পারে না লালবাহাদুর। যিনিও ঝাব্বুর নেতৃত্বে লড়াই চালিয়ে যাওয়া এক মজদুর। আদর্শ থেকে সরে আসা এই কমরেড নেতাকে সকলের চোখে হিরো বানিয়ে রাখতেই শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলে লালবাহাদুর। ঝাব্বু চরিত্রে প্রতীক দত্তের অভিনয় উল্লেখের দাবি রাখে।
‘মশা’ গল্পটি বিশেষভাবে মনে ধরে তার মঞ্চসজ্জায়, এবং চরিত্রদের কৌতুক রূপদানে। যেমন- ল্যাঙ্গোট পরা এক দঙ্গল মানুষরূপী মশার দল। তাড়া খেয়ে তাদের ছুটে পালানো কিংবা নফরের স্ত্রীর জীবন্ত ফটো-ফ্রেম হয়ে মাঝে মাঝে মঞ্চে আগমন। নফরের হাতে থাকা লগির ঘায়ে লোকটার হুট করে মরে যাওয়া, এসব দৃশ্যায়নে দর্শকের হাসি বাঁধ মানে না। নফর সত্তরোর্ধ এক মানুষ। স্ত্রী গত হয়েছেন। ছেলের বউ এবং ছেলের অবহেলায় বেঁচে আছেন। ইদানীং তিনি আঁচ পান তাকে ফাঁকি দিয়েই বউমা এবং ছেলে বাড়তি দু-চার পদ রেঁধে খায়। জীবনে নফর একটাই ভুল করেছিলেন। ছোকরা বয়সের মাথা গরমে একটা লোককে মেরে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন রোজ রাতে লোকটি নফরের কাছে আসে পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিতে। এভাবেই নিঃসঙ্গ নফরের জীবনে সঙ্গী জুটে যায় এবং এই লোকটির সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নফরের চরিত্রে পরিচালক অনির্বাণের অভিনয় নাটকে বাড়তি পাওনা। মোটা-সোটা, আহ্লাদি বউ-এর চরিত্রে মধুরিমা গোস্বামী অনবদ্য। তাঁর ড্যাব-ড্যাবে চোখে চেয়ে থাকা, ক্রমাগত এটা সেটা খেয়ে চলা, বরের প্রতি ভালবাসার ধরন, চাল-চলন কিংবা শ্বশুরকে মুখ ঝামটার দৃশ্য সুন্দর মানিয়ে যায়।
নাটকে হুলি গানের ব্যবহার বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। (অংশগ্রহণে – শুভদীপ, ইন্দ্রদীপ, প্রীতম, সমাদৃতা, সোমঋত, নীলাংশুক।) সেদিক থেকে চৌমাথাকে মিউজিক্যাল প্রযোজনা বললে ভুল হবে না। ওলি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সংযুক্তা চৌধুরী, আলি-সৌরভ পাল, সঞ্জয়-সৌমক ভট্টাচার্য, অক্ষয়-অনিতীর্থ মুস্তাফি। অ্যাসিসট্যান্ট-সুরজ বিশ্বাস, জিনি-শ্রুতি দাস। ফালতু লোক-রবিন মণ্ডল, চারু-সুস্মিতা ভট্টাচার্য, গণেশ-অরিত্র প্রতিম বিশ্বাস, নরহরি-সৌমেন দত্ত, নরহরির বোন-দোয়েল রায় নন্দী প্রমুখ।সকলের অভিনয়ই চরিত্রপযোগী।
নেপথ্যে- শিল্প নির্দেশনায়-শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্চনির্মাণে-মদন হালদার, আলোক ভাবনায়-সাধন পাড়ুই ও তথাগত চৌধুরী, আবহ সঙ্গীতে-অরিন্দম মুখোপাধ্যায় ও অভিমন্যু দেব, গানের সুরে- শুভদীপ, অনির্বাণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy