‘পিস হেভেন’
গত বার সৌমিত্র কাকুর বাড়িতে আড্ডার ফাঁকে বলেছিলাম, ‘‘তোমার ঘাড়ে চেপে বেশ করে খাচ্ছি।’’
উনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘মানে?’’
আমি তখন বলি, আমার ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কথাটা।
ওঁর উজ্জ্বল জীবনচরিতে ব্যাপারটা ফিকে হলেও আমার কাছে ল্যান্ডমার্ক।
গত বার ‘আনন্দপ্লাস’-এর ‘বায়োস্কোপে বাজিমাত’-এর ক্যুইজে যখন প্রশ্ন করা হল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক মাত্র জাতীয় পুরস্কার কোন ছবিতে, তখন এই ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িত মনে করে মনে মনে বাহবা না দিয়ে পারিনি।
তার পর থেকে আমার প্রায় প্রতি ছবিতে ওঁর সঙ্গে কাজ করাটা, ওঁর সান্নিধ্য পাওয়াটা ছুতো হয়ে উঠেছে যেন!
কাকুকে বললে ওঁর স্বভাবোচারিত বিনীত হাসিতে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আরে না না।’’
এই প্রসঙ্গে গত সপ্তায় দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান ফিল্ম উৎসবে ইরানের বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক বাহমান গভাদির সঙ্গে কথপোকথনটা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ধরনের বড় মাপের মানুষের কাছ ‘ইনরোড’ পাওয়াটাই দুষ্কর।
মনে হয়েছিল, গতানুগতিক ভদ্রতায় আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার কী ছবি? আমি বলব, উনি শুনবেন (শুনবেন না)। তারপর মিষ্টি হেসে ‘গুডলাক’ বলবেন, এটাই স্বাভাবিক।
এই নিয়মমাফিকতা ফাঁকি দিয়ে ওঁর সঙ্গে শিল্পী হিসেবে আড্ডা দেওয়া ও নতুন কিছু শেখার লোভ সামলাতে পারিনি, তাই মোক্ষম চাল চাললাম।
ছবির নাম বলেই বললাম, আমার ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আছেন।
উনি যেন কেমন হকচকিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, ‘‘হু?’’
আমি ভাবলাম, কী রে বাবা, কী জিজ্ঞেস করছেন!... বললাম, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’…।
এর পর আমাকে ওইখানেই থামিয়ে উনি আউড়ে গেলেন, অপুর সংসার, অভিযান (উচ্চারণটা অন্য রকম অবশ্য), ডিসট্যান্ট থান্ডার (অশনি সংকেত)… একের পর এক সৌমিত্রকাকুর ফিল্মোগ্রাফি। তার পর ওঁর আমার সঙ্গে গল্প করার আগ্রহ যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘হাউ ওল্ড ইজ হি নাও? আই’ম সো হ্যাপি হি ইজ স্টিল ওয়ার্কিং।’’
আমি পাল্টা ওঁকে বললাম, শুধু কাজ করছেন তাই নয়, এ বছরের সেরা হিট দুটো বাংলা ছবির নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘বেলাশেষে’, ‘অহল্যা’।
ব্যস, আমি পেয়ে গেলাম ‘ইনরোড’।
ওই যে বললাম না, কাকুর ঘাড়ে চেপে দিব্যি করে খাচ্ছি। আর উনিও প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন আমায় গত দশ বছর ধরে।
কুড়িতম আন্তর্জাতিক বুসান উৎসবে ছিল আমার নতুন ছবি ‘পিস হেভেন’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার।
সেই ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্রেও সৌমিত্রকাকু। আর আছেন পরান বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরুণ মুখোপাধ্যায়।
বুসান এশিয়ার সব থেকে বিখ্যাত ও পৃথিবীর সেরা ফিল্মোৎসবের মধ্যে অন্যতম। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজনা ছিল চরমে।
এই রকম উৎসবের সব থেকে বড় পাওয়াটা বোধহয় বিশ্বের সেরা চিত্রপরিচালকদের সঙ্গে কিছু দিনের সাহচর্য। তাঁদের সঙ্গে নানা রকম আলোচনার মাধ্যমে নতুন কিছু শেখা।
কেমন যেন মনে হয়, একটা আলাদা পারস্পেকটিভ দিয়ে যায়। নিজেকে এই বৃহৎ ফিল্ম-বিশ্বের দরবারে কীরকম ক্ষুদ্র শিশু মনে হয়… কত কিছু যেন শেখার এবং করার আছে।
যেমন অসাধারণ লাগল বার্লিন এবং ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়া কোরিয়ার চিত্রপরিচালক কিম-কি-দুকের সঙ্গে কথপোকথন। এত বিনয়ী ভদ্রলোককে দেখে বা কথা বলে বোঝা যায় না তাঁর বিশ্ব-সিনেমার জগতে স্থান। ‘থ্রি আয়রন’ বা ‘পিয়েটা’র মতো অসামান্য ছবির ইনিই স্রষ্টা।
তা ছাড়া এ বছর বুসান চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করেছিল এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ দশটা সিনেমা বিশেষ প্রদর্শন। প্রায় একশ জন চলচ্চিত্র-সমালোচকের তৈরি এই তালিকা। তাতে অবশ্যই ‘অপু ট্রিলজি’ ছিল।
এক নম্বরে ছিল ইয়াসুহিরো ওজু-র ‘টোকিও স্টোরি’। তার পর কুরোশোয়ার ‘রশোমন’। তিন নম্বরে ওয়ং কার ওয়াই-এর ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। তার পর সত্যজিৎ রায়ের অপুর ট্রিলজি।
পিস হেভেন-এর শ্যুটিং-এর অভিজ্ঞতাটা বড়ই মধুর। প্রধানত, এই তিন দিকপালের সঙ্গে কাজ করা।
মনে পড়ে ওঁদের জমাটিয়া আড্ডাগুলো! যখন এরকম আড্ডা বসেছে, প্রতি বারই আমি শট নেওয়া আটকে রেখেছিলাম। যতক্ষণ না ওদের আড্ডা থামে। কী করব, নিজেও যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে যেতাম। সে কত রকমের আজব গল্প চলত যে তিন জনের!
আর খুব মনে পড়ে বোলপুরে মুড়ি আর চা খেতে খেতে শ্যুটিং-এর পর তিন জনের গান।
পরানকাকুর টপ্পাগুলো তো ভোলার নয়। সৌমিত্রকাকুর গানও সেই প্রথম শোনা। তাঁর অগাধ প্রতিভার আরেক রূপ দেখলাম যেন।
যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল ওঁদের রসবোধ। পিস হেভেন ছবির বিষয় খুব গম্ভীর হলেও সেটাকে একটা ‘অ্যাবসার্ডিস্ট হিউমার’-এর মোড়কে বলার চেষ্টা করেছি।
ছবিটায় ওঁদের তিন জনের কেমিস্ট্রি যেন তাঁদের ওই রসায়নের প্রতিফলন। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের আগে এই সব টুকিটাকি স্মৃতিগুলোই মনে পড়ছিল।
দু’বছর আগে পুজোর সময় যখন আসানসোলে আমার পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে যাই, তখন দেখি রোজ দুপুরবেলা আমার সুন্দরকাকু ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘‘কী ভাবো রোজ?’’
বাঙাল ভাষায় উত্তরটা এল, ‘‘এই যে পচাত্তরটা বসর কাটাইয়া দিলাম, তার ইজুকালটুটা (=)কী হইল?’’
এই ডায়লগটা দিয়েই পিস হেভেন ছবিটা শেষ হয়।
আসানসোল থেকে বুসান। অদ্ভুত যাত্রা এই পিস হেভেন-এর। পরের স্টপ মুম্বই চলচ্চিত্র উৎসবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy