Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

চল্লিশ তো কী, মা হতেই পারেন

কী ভাবে তা সম্ভব? বলছেন ডা. গৌতম খাস্তগীরবয়স বেড়েছে, সন্তান আসেনি? হতাশা আর একাকীত্ব বাড়ছে? সমাজের ভয়ে সন্তানের কথা ভাবতে পারছেন না? চল্লিশ পেরিয়েও আরও এক বার ভেবে দেখতে পারেন মা হওয়ার কথা। এখন প্রায়ই হচ্ছে। এমনকী পঞ্চাশের পরেও মা হচ্ছেন অনেকে। বিদেশে ষাটের পরেও! এই কিছু দিন আগে গুরগাঁওতে এক মহিলা পঁয়ষট্টি বছরে মা হলেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ ফার্স্ট লেডি ৪৫ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দিয়ে শিরোনামে এসেছিলেন। ৪১ বছরে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ।

সাক্ষাৎকার: রুমি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

বয়স বেড়েছে, সন্তান আসেনি? হতাশা আর একাকীত্ব বাড়ছে? সমাজের ভয়ে সন্তানের কথা ভাবতে পারছেন না?

চল্লিশ পেরিয়েও আরও এক বার ভেবে দেখতে পারেন মা হওয়ার কথা। এখন প্রায়ই হচ্ছে। এমনকী পঞ্চাশের পরেও মা হচ্ছেন অনেকে। বিদেশে ষাটের পরেও! এই কিছু দিন আগে গুরগাঁওতে এক মহিলা পঁয়ষট্টি বছরে মা হলেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ ফার্স্ট লেডি ৪৫ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দিয়ে শিরোনামে এসেছিলেন। ৪১ বছরে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন অভিনেত্রী নন্দিতা দাশ। চল্লিশ পেরিয়ে মা হয়েছেন, হলিউড অভিনেত্রীদের তালিকা বানালে, তা নেহাত ছোট হবে না। তবে ভাববেন না, যে ওঁরা সবাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে তবে এই বয়সে সন্তানের মুখ দেখেছেন। বয়স বেশি হলেও মেনোপজের আগে ওঁদের অনেকেই মা হয়েছেন স্বাভাবিক ভাবেই। ব্রিটেনের এক অভিনেত্রী চল্লিশ পেরিয়ে মা হওয়ার পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘অনেকেই মনে করেন সেলিব্রেটিরা অঢেল খরচাপাতি করে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা করে বেশি বয়সে মা হচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। আমাদের জননাঙ্গ জানে না কে বিখ্যাত আর কে নয়! আমাদের শরীরের সঙ্গে সাধারণ মহিলাদের শরীরের কোনও পার্থক্য নেই।’ অতএব প্রেগন্যান্সি আসতে পারে স্বাভাবিক ভাবেই।

তবে ঝুঁকি থাকছেই

চাইলেন আর মা হয়ে গেলেন, ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। প্রথমত অনেক ক্ষেত্রেই প্রেগন্যান্সি আসতে চায় না। আসলে ৩০-এর পর থেকে মেয়েদের শরীরে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান কমতে থাকে। ৩৫-এর পর প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা দ্রুত কমে যেতে থাকে। প্রেগন্যান্সি এলেও হরমোনের গোলমালের জন্য মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। আবার ডিম্বাণুর গুণমান ভাল না হলে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হতে পারে। বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে মায়ের স্বাস্থ্যও। সে ক্ষেত্রেও প্রেগন্যান্সিও জটিল হয়ে পড়ে। সময়ের আগে জন্মালে বাচ্চার ওজন কম হতে পারে। তাই তিরিশের আগেই মা হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আর ৩৫ হল মাতৃত্বের ডেডলাইন।

অথচ ডেডলাইন পেরোচ্ছে

মধ্য চল্লিশে সন্তান! শুনে মনে হতেই পারে হুজুগ। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই বেঁচে থাকার তাগিদ। মধ্য চল্লিশের রঞ্জিতা সামন্তের কথাই ধরা যাক। লিভারের অসুখে ২০ বছরের মেয়ে মারা গিয়েছিল। বেঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠেছিল ওঁর। ঘটনাচক্রে এক দম্পতির সঙ্গে আলাপ হয়। যাঁদের আঠারো বছরের ছেলে আত্মহত্যা করেছিল। দত্তকের কথা না ভেবে তাঁরা আবার সন্তানের চেষ্টা করেন। পঞ্চাশের কোঠায় দাঁড়িয়ে নতুন করে সন্তানের জন্ম দেন। রঞ্জিতাও নতুন আশায় বুক বাঁধেন। বছরখানেকের চেষ্টায় মা হন। বেশি বয়সে একমাত্র সন্তান মারা গেলে অনেক মহিলাই আবার সন্তান চাইছেন। স্বভাবতই তাঁরা আসছেন চল্লিশ পেরিয়েই। কখনও পঞ্চাশেও।

অন্য দিকে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চল্লিশ পেরিয়ে মা হওয়ার প্রবণতাও অনেক বেড়েছে। সেই মহিলার হয়তো আগের পক্ষের সন্তান রয়েছে। কিন্তু নতুন জীবনেও নিজের সন্তান চাইছেন। কম বয়সে ক্যানসারের মতো জটিল অসুখ থেকে সেরে উঠেও অনেকে নতুন জীবন শুরু করতে চাইছেন। আর এখন বিয়ের বয়স এমনিতেই ৩৫ পেরোচ্ছে। চল্লিশ পেরিয়েও অনেকেই তাই সন্তান চাইছেন।

বয়স একা দায়ী নয়

চল্লিশ পেরোলে প্রেগন্যান্সিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ডিম্বাণু। বয়সের জন্য এর সংখ্যা ও গুণমান কমে যায়। তাই বয়সকেই যত নষ্টের গোড়া ধরা হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভিলেন বয়স নয়, ডিএইচইএ নামের হরমোন। এটি ডিম্বাণুকে ভাল রাখে। অথচ বয়সের জন্য হরমোনটি কমতে থাকে মেয়েদের শরীরে। পাল্লা দিয়ে কমে ডিম্বাণুর গুণমানও। ব্যাপারটা অনেকটা কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখার মতো। বাতানুকূল যন্ত্র ভাল থাকলে আলু ভাল থাকবে। কিন্তু যন্ত্র পুরনো হলে কার্যকারিতা কমবে। আলুও খারাপ হবে। এ ক্ষেত্রেও তাই। বেশি বয়েসে মা হওয়ার পরিকল্পনা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ডিএইচইএ ওষুধ নিতে পারেন মেয়েরা। এই হরমোনটিই বাদবাকি ডিম্বাণুগুলোকে ভাল রাখবে। এর সে রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। ত্বক তৈলাক্ত, মুখে ব্রণ বা অবাঞ্ছিত লোমের কিছু সমস্যা হতে পারে। তার বেশি নয়। আর এর গুণেই চল্লিশ পেরিয়েও এখন নিজের ডিম্বাণু দিয়েই মা হতে পারেন।

আতঙ্কিত হবেন না

চল্লিশ পেরিয়ে মা, ভাবলেই একটা ভয় কাজ করে। তবে আতঙ্কিত হবেন না। কারণ আধুনিক চিকিৎসা। বেশি বয়সে মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে একটা চিন্তা থেকে যায় ঠিকই। তবে বাস্তবে এমনটা খুব কম ক্ষেত্রেই হয়। নিয়ন্ত্রিত খাওয়া দাওয়া, এক্সারসাইজ, হেল্থ চেকআপ-এর জন্য পঞ্চাশেও অনেকেই সুস্থ থাকেন। ফলে সমস্যা হয় না। তবে সমস্যা এলেও তার মোকাবিলায় চিকিৎসাও রয়েছে। তাই ভাল ফল আসছে। তা ছাড়া বেশি বয়সে মাতৃত্বের ক্ষেত্রে সব দিক ভাল করে খতিয়ে দেখে তবেই এগোনো হয়। ব্যাপারটা এমন নয়, যে আপনি এসে চাইলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার উঠেপড়ে লেগে পড়লেন। হবু মায়ের হার্ট, লাং, কিডনির কার্যকারিতা-সহ অন্য শারীরিক অবস্থা খতিয়ে দেখে তবেই এগোনো হয়।

সহজে প্রেগন্যান্সি না এলে

সাহায্য নিতে পারেন কৃত্রিম উপায়ের। এতে ডোনারের ডিম্বাণু নেওয়া হয়। তার সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ গর্ভে রোপণ করা হয়। এতে বাবার শুক্রাণু নেওয়া হচ্ছে। আর মা-ই বাচ্চাকে গর্ভে ধারণ করছেন। মা’র রক্ত-মাংসে সন্তান বড় হচ্ছে। সুতরাং দু’জনের ভূমিকাই থাকছে। তা ছাড়া সুবিধে হল কমবয়সি মহিলাদের থেকে ডিম্বাণু নেওয়ায় গুণমান ভাল হয়। গর্ভপাত ও বিকলাঙ্গ সন্তানের সম্ভাবনা কমে। বেশি বয়সে মা হলে যে সব সমস্যা হতে পারে, তার অনেকগুলিই সরিয়ে রাখা যায়। তা ছাড়া এগ ডোনেশন খুব সহজ। এতে কিডনি বা লিভার প্রতিস্থাপনের মতো কোনও ম্যাচিং-এর দরকার হয় না।

এখন ট্রেন্ড

৪২ বছর বয়সি এক মহিলাকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর ২১ বছরের মেয়ে। মেয়েটি বিদেশে পড়েন। স্বামী ব্যবসায় ব্যস্ত। নিঃসঙ্গতা গ্রাস করেছিল মহিলাকে। তাই মেয়েই চাইছেন একাকীত্ব কাটাতে মায়ের আর একটি সন্তান হোক।

কিন্তু...

প্রশ্ন থাকছেই। আশা পূরণের জন্য যে কেউ-ই মা হতে চাইতেই পারেন। কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যৎ?

মধ্য চল্লিশে যে সন্তান জন্মাচ্ছে, সে যখন স্কুলে যাবে, তাঁর মা পঞ্চাশের কোঠায়। অন্যদের মায়ের থেকে বেশি বয়স্ক। তাই বন্ধুদের কাছে হাসির খোরাক হতে পারে বাচ্চাটি। বাচ্চার মনে চাপ পড়তে পারে। তা ছাড়া সন্তান বড় হওয়ার অনেক আগেই বাবা-মা বার্ধক্যে পৌঁছে যাবেন। এমনকী তাঁদের মৃত্যুও হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এমন যে হয় না, তা নয়। অনেকে ঝোঁকের বশে বেশি বয়সে মা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। পরে তাঁদের অনেকে দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাত জাগা, সন্তানকে যত্ন করা সব মিলিয়ে জেরবার। আবার উল্টোটাও হয়। বেশি বয়সের মা অনেক বেশি ম্যাচিওরড। অনেক ক্ষেত্রে ওঁরা আর্থিক ভাবে বেশি সক্ষম। তা ছাড়া দেখবেন কম বয়সে যাঁরা মা হচ্ছেন, তাঁদের সন্তানকে বাড়িতে দিদিমা-ঠাকুমারাই বেশি দেখেন। কারণ তাঁরা অনেক বেশি অভিজ্ঞ। এ জন্য ক্লিনিকগুলোতে কাউন্সেলিং করা হয়। বাবা-মায়ের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হয় তাঁদের অর্থনৈতিক, মানসিক অবস্থা। উতরোলে তবেই পরবর্তী পদক্ষেপ। নতুবা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যাপারটা বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ জোর করে প্রকৃতির ঊর্ধ্বে ওঠা ঠিক নয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy