সে দিনের মহলায়। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
পেশোয়া-র নানা ফড়নবিশ কি আদলে খানিকটা সত্যজিৎ রায়ের হীরকরাজার মতো?
স্বভাবে, আলাপে, শাসনের ছলচাতুরীতে নানা আর তাঁর ব্রাহ্মণকুল কি মিলে যান হীরক-চূড়ামণি আর তাঁর পারিষদবর্গের সঙ্গে?
চেতনা নাট্যদলের নতুন নাটক ‘ঘাসিরাম কোতোয়াল’-এর মহলা দেখতে দেখতে হঠাৎই ভাবনাটা ঘাই মেরে গেল।
প্রথম শো ২২ ফেব্রুয়ারি, অ্যাকাডেমি, সন্ধে সাড়ে ছ’টা।
•••
’৭২ সালে মহারাষ্ট্র যখন শিবসেনার উত্থান দেখছে, মরাঠি নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকর তখনই এই নাটকটি লেখেন।
ওই বছরেরই ডিসেম্বরে তার প্রথম অভিনয় পুণের ‘ভারত নাট্য মন্দির’-এ। প্রায় গোড়ার থেকেই বিতর্কের ঝড়।— চিতপাবন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় আর নানা ফড়নবিশকে নাকি ছত্রে ছত্রে হেয় করেছেন নাট্যকার।
বলিউডে যশ চোপড়া বা রাজকপূরের ডাক ফিরিয়ে দেওয়া নাট্যকার বিজয় অবশ্য কোনও কালে এ কথা মানেননি। নানা বা পেশোয়া বড়জোর তাঁর কাছে একটা চিহ্ন মাত্র। ক্ষমতার চিহ্ন।
তবু ঘটনা এই যে, কিছু কালের জন্য থিয়েটারটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ’৮০-তে ইউরোপ, ’৮৬-তে আমেরিকা, কানাডায় তুমুল প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি ‘ঘাসিরাম কোতোয়াল’ নিয়ে এ দেশের দর্শকও বারবার উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। হাউসফুল দিয়েছেন।
শহর কলকাতা যে এ যাবৎ কত বার কত দলের ‘ঘাসিরাম…’ দেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। যার মধ্যে জব্বর পটেলের পরিচালনায়, মোহন আগাসের অভিনয়ে আর ভাস্কর চন্দ্রভারকরের সঙ্গীতে প্রযোজনাটি নিয়ে আজও নস্টালজিয়ার অন্ত নেই। কিন্তু কোনও বারেই ওই ‘হীরকরাজা’ চিন্তাটা আসেনি।
এ বারে এল। প্রথম বার এল অবন্তী চক্রবর্তী-নীল মুখোপাধ্যায়ের অসম্ভব জোরালো বাংলা রূপান্তরটিতে চোখ বুলিয়ে। দ্বিতীয় বার মহলাটি দেখে।
সেই একই রকম ছন্দোবদ্ধ সংলাপ। অন্ত্যমিল। মিলের শেষ শব্দটি ধাওয়া করে হুবহু একই শব্দে পরের উচ্চারণ!—
‘আমি বদ্যি। করি চিকিৎসা। মানুষকে সুস্থ রাখা আমার নেশা।’
কিংবা, ‘আমি তর্কবিদ। তর্ক করে জগতের নাড়িয়ে দেব ভিত।’
এমন বারবার। অসংখ্যবার।
এমনকী নানার (শঙ্কর চক্রবর্তী) স্টাইলাইজেশনে কোথায় যেন উৎপল দত্তীয় অভিনয়ের ধাঁচা। আপাত নিপাট সরলামনা়, নিষ্পাপ অথচ ক্রূঢ় শীতল চাউনি মেলে একের পর এক নৃশংস সব অপরাধ ঘটিয়ে চলার সেই অতি পরিচিত ভঙ্গিটি।
বহু কাল পিএলটি-র ঘরে বাস করে উৎপল দত্তর দীক্ষা পাওয়া শঙ্কর প্রাণপণে সেই মেজাজটা গড়তে চাইছেন হয়তো’বা কিছুটা স্বেচ্ছায়।
এও তো আরেক ধরনের নস্টালজিয়া!
•••
মিউজিক্যাল। এবং একই সঙ্গে ঘোরতর রাজনৈতিক। ‘চেতনা’-র পরম্পরাতে এমন থিয়েটার বারবার এসেছে। ‘মারীচ সংবাদ’, ‘ভালোমানুষের পালা’, ‘মা’, ‘কবীর’, ‘দুখীমুখীযোদ্ধা’।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি অবধি ওদের এই জার্নিটা চোখে পড়ার মতো। ‘ঘাসিরাম কোতোয়াল’-এ এসে আবার সেই পরম্পরাকেই ফেরালেন ওঁরা।
রঙে, জাঁকে শিমুল-পলাশের রাঢ় বাংলাকেও বোধহয় এ থিয়েটার বলে দেবে— তফাত যাও!
প্রায় দু’ঘণ্টার এ-নাটকে প্যালেটের যত রং সব যেন উপচে উঠল খোলা মঞ্চের আনাচে কানাচে!
•••
কনৌজের ব্রাহ্মণ ঘাসিরাম সবলদাস (অধিকারী কৌশিক)। বউ, মেয়ে নিয়ে সে গৌরবের শহর পুণেতে আসে ভাগ্যের খোঁজে। ভেবেছিল এ দেশে সম্মান পাবে, বদলে পেল চোরের তকমা। আচমকা তাকে চুরির দায়ে ফাঁসিয়ে দেয় ক্ষমতাবাজ লুঠেরা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ।
ক্রমে ঘাসিরাম বুঝে যায়, ‘এটা একটা ভাগাড়। লাল কাপড় না নাড়লেও তেড়ে আসবে ষাঁড়।… এখানে চোর না হলেও সবাই চোর, আর যে চুরি করে সে হয় না চোর।’
একরাশ ঘেন্না, আপাদমস্তক রাগ আর মুঠো মুঠো গ্লানি গায়ে মেখে সে ঠিক করে, যে-শহর তাকে পশু বানিয়েছে, শয়তান হতে বাধ্য করেছে, তাকে সে শুয়োরের আস্তানা বানিয়ে ছাড়বে।
তার পর আবার ঘাসিরাম হবে।
দিনে রাতে বদলে বদলে যেতে থাকে ঘাসিরামের চাওয়াপাওয়া। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চারপাশকে লন্ডভন্ড করে দিতে দিতে সে তার কোতোয়ালি হওয়ার আকণ্ঠ ইচ্ছেটা সওদা করে কামার্ত নানার কাছে নিজের মেয়েকে ‘সওদা’ করে!
মাঝে মাঝে ঘাসিরাম থামে। অনুতপ্ত হয়। পরক্ষণেই হিংসায় ফেটে পড়ে। আক্রোশে ঝাঁপ দেয় আগুনে। লাভায়। ফেরার যে পথ নেই! নিজের অজান্তেই সে তখন ক্ষমতার পুতুল।
পুতুল ঘাসিরাম ভুলেও যায়, এলোমেলো লুঠের খেলার সে দোসর নয়, শানানো অস্ত্র মাত্র। ভাঙলে সে-অস্ত্রই ভাঙবে, রক্ত ঝরলে তাতেই দাগ লাগবে। যে শানিয়েছে, যে ঝরাতে দিয়েছে সে থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
•••
নাটকটি যবনিকার দিকে এগোতে থাকে ক্ষমতার ট্র্যাপিজ খেলায় সওয়ার হয়ে। রাষ্ট্রনায়কের লিপ্সা, বিশ্বাসঘাতকতা, আদ্যন্ত লোভী অবয়বের রূপটা নগ্ন করতে করতে।
ক্লাইম্যাক্সের বহু আগেই এ নাটক আর পেশোয়ায় আটকে থাকে না। হয়ে যায় পৃথিবীর ইতিহাসে আসা বহু বহু সংখ্যক নানা ফড়নবিশ আর তাঁদের তৈরি ঘাসিরাম কোতোয়ালের কাহিনি।
কাহিনিটি গড়িয়েছে, কখনও জুড়েছে সূত্রকারের ভাষ্যে (নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় ও সুমন্ত্র দাস)। গড়পড়তা ধারাভাষ্যকার নয়, মিউজিক্যালিটির সঙ্গে তাঁদের শরীরী ভঙ্গি, সংলাপের ধরন যেন একই ‘টিউন’-এ বাঁধা।
•••
অনবদ্য মিউজিক দেবজ্যোতি মিশ্রের। একের পর এক সুর এসেছে। আর গনগনে আঁচে দাউ দাউ জ্বলেছে এই ‘ঘাসিরাম…’। কখনও সুফি কাওয়ালি, কখনও স্তবগান, কখনও টপ্পা, তো কখনও নিখাদ পুরিয়া। নিরবচ্ছিন্ন। নিরন্তর।
পাল্লা দিয়ে কোরিওগ্রাফ করেছেন সুদর্শন চক্রবর্তী। ‘নির্বাক’, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ বা ‘চারুলতা ২০১১’-র মতো ছবি কিংবা মিনার্ভা রেপার্টরির ‘দেবী সর্পমস্তা’ বা কৌশিক সেনের ‘ম্যাকবেথ’-এ কাজ করা সুদর্শন আদতে ভরতনাট্যম-কথাকলির ছাত্র। ইদানীং ‘কনটেম্পোরারি ডান্সিং’ নামের একটি নিজস্ব ঘরানা বেঁধেছেন।
দেশজ, লোকজ নৃত্যকে যথাসম্ভব বজায় রেখে এ নাটকে তিনি যে তরঙ্গায়িত রংদার শরীরী ভঙ্গি দিয়ে কোরিওগ্রাফ গড়েছেন, তাকে বলা যায় ‘নন ভার্বাল বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’।
বাহারি ওড়নার নড়চড়ায়, শরীরী চালনায় নানান জ্যামিতিক আকার গড়ে সে-নাচ যেন পূর্ণিমার আকাশের মতো তারা-ফটফটে। বসন্ত উৎসবের মতো হৃদমাঝারিয়া।
‘ঘাসিরাম…’-এর আরেকটি জোরালো কৌণিক বিন্দু তার সেট (দেবেশ চট্টোপাধ্যায়)। অতি সরল তার গড়ন। পিছন দিকে অল্প উচ্চতায় আড়াআড়ি একটা পাটাতন। যে-পাটাতন দু’পাশে আনুভূমিক হয়ে মিশেছে মঞ্চে।
তারও পিছনে বড় স্ক্রিনে বিমূর্ত ছবির কোলাজ। কিংবা কোলাজ নয়, সবটা মিলিয়ে ছবিটা একটাই। যার দিকে তাকালে এক-এক বার এক-এক রকম রূপ ফোটে। কখনও ত্রিনয়ন, কখনও কুঠার, কখনও ত্রিশূল, কখনও’বা বিকৃত ক্ষতবিক্ষত নগ্ন নারীশরীর, নয়তো একটা ঢাউস মরা প্রজাপতি।
গোটা ক্যানভাসে নীলচে আলোর মায়াও যে কী ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর পাপ হয়ে ফুটতে পারে— না দেখলে বিশ্বাস হত না!
এটিই নীল-এর প্রথম বারের মতো ‘ফুল লেংথ’ থিয়েটারের নির্দেশনা।
অভিনেতা হিসেবে নীল যে ভাবে ‘ব্রেন’, ‘নাটকটার নাম কী’র মতো থিয়েটারে ভাইব্র্যান্ট অভিনয় করেন, তাঁর পরিচালনায় এ-নাটকেও সেই একই স্পন্দন। আচমকা বজ্রপাত কী চোরা ঢেউ যেমন ঠিকরে উঠে অতর্কিতে এলোমেলো করে দেয়, ঠিক তেমনই তাঁর এই মঞ্চায়ন।
ঘাসিরামদের জন্ম, তার উত্থানের রাষ্ট্রীয় আখ্যান তো এমনই— লন্ডভন্ড, ধূলিসাৎ করে দেওয়া ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিধ্বংসী!
তাই না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy