Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অভিমানে কলকাতা ছেড়েছিলেন শচীনকর্তা

অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসা। চলে যান এক বুক যন্ত্রণা চেপেএ তো ‘নাকি’ সুরের গলা। উচ্চারণে বাঙাল টান। এ চলবে না। এই যুক্তি দেখিয়ে শচীনদেবকে প্রায় তাড়িয়েই দিল নামকরা এক রেকর্ডিং কোম্পানি। কর্তার কলকাতা-জীবনের সে বড় সুখের সময় নয়। বাবা মারা গিয়েছেন। মানসিক ভাবে অসহায়। বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন, তাতে স্বচ্ছন্দেই চলে যেত। এখন সেখানেও টানাটানি। ত্রিপুরা প্যালেস ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছে পালিত স্ট্রিটের এক কামরার ভাড়ায়। খুব একা লাগত তখন।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

এ তো ‘নাকি’ সুরের গলা। উচ্চারণে বাঙাল টান। এ চলবে না।
এই যুক্তি দেখিয়ে শচীনদেবকে প্রায় তাড়িয়েই দিল নামকরা এক রেকর্ডিং কোম্পানি।
কর্তার কলকাতা-জীবনের সে বড় সুখের সময় নয়। বাবা মারা গিয়েছেন। মানসিক ভাবে অসহায়। বাবা প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন, তাতে স্বচ্ছন্দেই চলে যেত। এখন সেখানেও টানাটানি।
ত্রিপুরা প্যালেস ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছে পালিত স্ট্রিটের এক কামরার ভাড়ায়। খুব একা লাগত তখন।
কী করবেন, ফিরে যাবেন কুমিল্লায়? ব়ড় ভাইদের জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাঁরা বললেন, ‘‘ফিরে যাও নিজের জায়গায়। নিশ্চিন্তে ঘর করো।’’
মন সায় দিল না। পেট চালাতে টিউশনি শুরু করলেন।
ত্রিপুরার ঠাকুর নরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মন তখন কলকাতায়। দু’জনে দু’জনকে নাম ধরে ডাকতেন। চণ্ডীচরণ সাহা তখন নতুন রেকর্ডিং কোম্পানি খুলেছেন। হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস। জার্মানি থেকে নতুন মেশিন এনেছেন।
চণ্ডীবাবুর সঙ্গে নরেনঠাকুরের অল্পবিস্তর আলাপ ছিল। চণ্ডীচরণ রাজি হলেন শচীনের রেকর্ড করতে।
প্রথম রেকর্ড বেরল শচীনদেবের। এক দিকে লোকগান ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’। গীতিকার হেমেন্দ্রকুমার রায়। অন্য পিঠে রাগপ্রধান, ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’। গীতিকার শৈলেন রায়। সুর কর্তারই।

তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে

প্রথম রেকর্ড। আনন্দ আর ধরে না। ছুটলেন কুমিল্লা। তার পর আগরতলা। রাজ্যপাট তখন মহারাজা বীরবিক্রমের।

রাজার বাড়িতে আরও কর্তাদের ভিড়। শচীনকর্তার হাতে নতুন রেকর্ড ধরা। হঠাৎ ছোঁ মেরে সেখানা বাগিয়ে নিয়ে দে-দৌড় দুষ্টুবুদ্ধির জ্যোতিষচন্দ্রের!

পিছন থেকে কর্তা চেঁচিয়েই চললেন, ‘‘আরে এইডা একটা মাত্র কপি। ভাইঙ্গা গেলে আর পাইমু না-আ-আ-আ!’’

কে কার কথা শোনে!

•••

কলকাতায় প্রথম-প্রথম খুব হাঁপিয়ে উঠতেন। ‘‘এ শহরে মাটিও বিক্রি হয়। আকাশে অমাবস্য কই!’’— অবাক লাগত খুব। খোলা মাঠ, নদীজল, পুকুরঘাট, গাছগাছালিতে ভরা কুমিল্লা ছেড়ে কংক্রিটে মোড়া শহর— মনটা কিছুতেই নোঙর হতে চাইত না।

সকাল থেকে যেমন-তেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটে যেত। সন্ধে হলেই সময়টা যেন হাঁ করে গিলে খেত।

ওয়াইএমসিএ-তে নাম লেখালেন। এক দক্ষিণী নামী খেলোয়াড়কে দিনে আট আনা নগদ দিয়ে তবে তাঁর সঙ্গে খেলতে পেতেন। তাই সই। সময় তো কাটে!

তার মধ্যেই এক জনের গান তাঁকে বুঁদ করে ফেলল। কৃষ্ণচন্দ্র দে। শুরু করলেন তাঁর কাছে তালিম। কিন্তু খেলতে গিয়ে ঘাম বসে গলার ক্ষতি হচ্ছে। কৃষ্ণচন্দ্রর এক কথায় সাধের টেনিস ছেড়ে দিলেন।

পড়ুন, রসিক কর্তা

কৃষ্ণচন্দ্র তখন তাঁকে মাত করে রেখেছেন। তাঁকে নিয়ে আসরে যাচ্ছেন এখানে ওখানে। আগরতলাতেও। আগরতলার আসরে তখন চাঁদের হাট বসত— উস্তাদ আলাউদ্দিন থেকে বাদল খান!

এর মধ্যে আকাশবাণী-তে ডাক। পনেরো মিনিট গাইবার সুযোগ পেলেন কর্তা। নিজেরই দু’খানা গান। দশ টাকা পেলেন। জীবনের প্রথম উপার্জন!

•••

হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সঙ্গে নাটকের দলের খুব যোগ ছিল। সম্ভবত তিনিই কর্তাকে থিয়েটারে নিয়ে গেলেন।

শুরু হল থিয়েটারের গান লেখা। কর্তার গানের ভক্ত হয়ে পড়লেন শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়রা।

অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেলেন ছবি বিশ্বাস আর জহর গঙ্গোপাধ্যায়।

জহর গঙ্গোপাধ্যায় কর্তার মতোই খেলা-পাগল। কিন্তু মোহনবাগানি। মোহনবাগান হেরে গেলে কাঠবাঙাল কর্তার সঙ্গে তাঁর কথাই বন্ধ হয়ে যেত! তার পর অবশ্য আবার হরিহর আত্মা।

চিত্র পরিচালক মধু বসুর চৌরঙ্গী প্লেসের বাড়িতে তখন প্রায়ই গানের আড্ডা বসে। হাজির হন হিমাংশু দত্ত, শচীনকর্তা, তিমিরবরণের দাদা মিহির ভট্টাচার্য। মধু বসুর স্ত্রী বিখ্যাত নর্তকী সাধনা বসুকে (আলিবাবা-য় যিনি মর্জিনা হন) কর্তা গান শেখাতেন। সব মিলিয়ে মধু বসুর সঙ্গে কর্তার মিলমিশ ভালই।

•••

মধুবাবু এক দিন বললেন, ‘‘একটা ছবি করছি। ভিখারির একটা ছোট্ট রোল আছে। শুধু বসে বসে গান গাইতে হবে? করবে?’’

শুনে কর্তা আঁতকে উঠলেন, ‘‘বলেন কি মিস্টার বোস? আমি ফিল্মে নামব? জানেন আমার পরিবার! গান গাই তাতেই কত কথা, সিনেমায় গেলে একঘরে করে দেবে।’’

মধুবাবু বললেন, ‘‘দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে এমন মেকআপ করে দেব, কেউ চিনবে না।’’

সব ভুলে যাই তাও ভুলি না

সেই প্রথম শচীনদেবের ছবিতে অভিনয়।

কবি নজরুল ইসলাম বেশ ক’বছর কুমিল্লায় কাটিয়েছেন। কর্তার সঙ্গে তাঁর খুব সখ্য। কবিকে বললেন, ‘‘কাজীদা ঝুমুরের ধরনে একটু ‘টিকলিশ’ সুরে গান দ্যান আমায়।’’ পাঁচ মিনিটের মধ্যে লিখে ফেললেন নজরুল। কর্তা গাইলেন তাঁর গান ‘চোখ গেল চোখ গেল...’।

•••

তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। এলাহাবাদে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স। শচীনকর্তা ডাক পেলেন। সেই প্রথম তাঁর কলকাতার বাইরে যাওয়া। নিজের মতো করে ঠুংরি গাইলেন। শ্রোতার আসনে উস্তাদ আব্দুল করিম খান। গান শেষে কর্তার মাথায় হাত রাখলেন তিনি।

বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে আরও অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল। কর্তা গাইবেন। তার ঠিক আগে ম়ঞ্চে উঠবেন উস্তাদ ফৈয়াজ খান!

উস্তাদ শেষ করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘ঝন ঝন ঝন পায়েল’ দিয়ে। তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়লেন দর্শক।

মঞ্চে এলেন এসডি।

তিনি ধরলেন, ‘যদি দখিনা পবন’। এক ঘণ্টা ধরে। ধীরে ধীরে পদ্ম যেমন পাপড়ি মেলে, ঠিক তেমন করে গাইলেন।

গান শেষ।

উস্তাদজি ছুটে এলেন মঞ্চে। বুকে জাপটে ধরলেন তরুণ শচীনদেবকে!

বিয়ের আসর

রেডিয়ো-তে নিয়মিত গান করছেন। টিউশানি চলছে। আসরেও ডাক আসছে। ধীরে ধীরে অবস্থা ফিরছে। এক কামরার বাড়ি ছেড়ে উঠে গেলেন ১এ, বসন্ত রায় রোডের দু’কামরার বাড়িতে।

এক ঘরে থাকা। অন্য ঘরে গানের ইস্কুল। ‘সুরমন্দির’।

বিয়ে করলেন ছাত্রী মীরা দেববর্মনকে। কিন্তু এ বিয়ে মানতে পারলেন না রাজবাড়ির অনেকেই। এমনকী কর্তার ‘গুরু’ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ও।

কিন্তু মীরা-শচীনের সংসার, গান-জীবন তাতে টাল খায়নি। বরং শচীন কর্তার গানভুবনে গীতিকার, সুরকার মীরার আগমন যেন গানের বান ডেকে দিল!

•••

সব হচ্ছিল। কিন্তু সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালকের ডাক তেমন করে আসছিল না।

অথচ কে না চেনেন তাঁকে? সবাই। নীতিন বসু, দেবকী বসু। প্রমথেশ বড়ুয়া একসঙ্গে টেনিস খেলেন। সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল, নিউ থিয়েটার্সের মালিক বি এন সরকার সবাই কর্তার গানে মুগ্ধ। তবু তেমন ডাক নেই বাংলা সিনেমা থেকে!

অভিমান জমছিল ভেতরে ভেতরে।

ডাক এল মুম্বই থেকে। রঞ্জিত স্টুডিয়োর মালিক স্বয়ং চন্ডুলাল শাহ খবর পাঠালেন। ‘না’ করে দিলেন কর্তা। তখনও আশায় যে!

আরও দু’বছর কাটল। তাতেও কোথায় কী!

আবার ডাক এল আরবসাগর পারের। এ বার চন্ডুলালের সঙ্গে শশধর মুখোপাধ্যায়েরও।

এ বার আর ফেরালেন না তিিন।

ভাঙা মন নিয়ে ফিল্মস্তানে পাড়ি দিলেন অভিমানী শচীনদেব বর্মন।

ঋণ: অভিজিৎ দাশগুপ্ত, খগেশ দেববর্মন, ভাটি গাঙ বাইয়া (শ্যামল চক্রবর্তী)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy