Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Subodh Chandra Mullick

রাজ-কাহিনি

দেশবাসীর ভালবাসায় তিনি রাজা। রাজদ্রোহের সৌধ তাঁর রাজপ্রাসাদ। দধীচির দহনদানে অমর রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক-এর ছোট্ট জীবন। নূতনের দিশারী এই বঙ্গসন্তানের সময়ে ভারতকে পথ দেখাত বাঙালি।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ ০৮:৪৪
Share: Save:

সেটা ১৯০৮ সাল। মজফফরপুরে ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীরা বোমা মারার পরেই ব্রিটিশের অত্যাচার তখন তুঙ্গে উঠেছে। সুবোধচন্দ্রের অভিন্নহৃদয় সহযোদ্ধা অরবিন্দকে মে মাসের গোড়াতেই পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে। অরবিন্দ-ভ্রাতা বারীন ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীরাও বন্দি। ১২ ওয়েলিংটন স্কোয়ারে রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিকের প্রাসাদোপম বাড়ি, ২/১ ক্রিক রোয়ে তাঁর প্রাণের ‘বন্দেমাতরম’ কাগজের অফিসে ঘন ঘন পুলিশি অভিযান চলছে। জোর গুজব, সশস্ত্র বিপ্লবীদের সহায়তার অপরাধে জাতীয়তাবাদী নেতা রাজা সুবোধচন্দ্রকে যে কোনও দিন সরকার দ্বীপান্তরে পাঠাবে। আর্থিক টানাটানির মধ্যেও ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার নতুন টাইপসেট কিনেছিলেন সুবোধ। তখনকার মতো তাঁর ভগিনীপতি হীরেন দত্তের কাশীর বাংলোয় চলে গেলেন তিনি। প্রত্যাশামতোই পুলিশ হানা দিল সেখানে।

মেজাজই রাজা

রাজার মেজাজ কাকে বলে, তা এ বার বোঝালেন সুবোধচন্দ্র। তখন কী-ই বা বয়স তাঁর! কলকাতায় স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে জাতীয় শিক্ষার প্রসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক লক্ষ টাকা দান করে আগেই গণ আবেগের চুড়োয় উঠেছিলেন। জনতাই তাঁকে ভালবেসে ‘রাজা সুবোধচন্দ্র’ বলে বরণ করে। অরবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে অর্থ, মেধা উজাড় করে ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার কাজেও নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু বিপদের সময়ে মোটে ২৯ বছর বয়সি যুবকের এমন স্থিতধী মর্যাদাসম্পন্ন সাহসে দেশ তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করল। ১৯০৮এর ২ জুন অমৃতবাজার পত্রিকা লেখে, ইউরোপীয় অফিসারদের নেতৃত্বে দূর থেকে পুলিশবাহিনীকে আসতে দেখেই সুবোধ বাড়ির সব চেয়ার তক্ষুনি বাগানে বাইরে সরিয়ে দিতে বলেন। নিজেও খোশমেজাজে বাইরেই বসে থাকলেন। বাবু সুবোধচন্দ্রের কাছে এসে শ্বেতাঙ্গ অফিসার ‘সার্চ ওয়ারেন্ট’ দেখালেও তিনি ফুরফুরে নির্ভার। ভিতরে তল্লাশি চলছে, সুবোধ নিশ্চিন্তে পরিচারকদের হাঁক দিয়ে ‘ছোটা হাজরি’র আদেশ করলেন। ব্রিটিশ পুলিশ দেখল, কোথাও কিচ্ছু হয়নি এমন ভাবে বাঙালিবাবু নিশ্চিন্তে তাঁর প্রাতরাশ সারছেন। অমৃতবাজারের প্রতিবেদকের মতে, ‘হতে পারে এ তাঁর নিরাসক্তি বা নিশ্চিন্ত বিবেক, কিন্তু ব্রিটিশ অফিসারদের সামনে চোখধাঁধানো মজবুত স্নায়ু ও সাহসের এক জব্বর প্রদর্শনীও বটে। নব যুগের বাঙালি দেশেবিদেশে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে।…গোটা দেশ এখন বাংলার তরুণদের দিকে তাকিয়ে!’

সুবোধচন্দ্রের জীবন ও সময় মানে বাঙালির এই গর্বের অধ্যায়, যখন দেশসেবার নেতৃত্বে নিজেকে উজাড় করে সে ভারতকে পথ দেখিয়েছিল।

ছবি ও ছোটলাট

সুবোধচন্দ্রের রাজকীয় শ্লাঘার আর একটি বহুচর্চিত ঘটনাও এই বেলা শোনা যাক! ১২ ওয়েলিংটন স্কোয়ার (আজকের ১২ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার)-এর বাড়িতে আমেরিকান শিল্পী স্টুয়ার্ট গিলবার্টের আঁকা জর্জ ওয়াশিংটনের একটি মহার্ঘ ছবি ছিল। সুবোধের কাকা হেমচন্দ্র মল্লিক তা ব্যবসায়ী রামদুলাল দে-র উত্তরসূরিদের হাত ঘুরে কিনেছিলেন। ছোটলাট স্যর অ্যান্ড্রু ফ্রেজার পুরনো ছবিটি দেখতে আসতে চাইলেন। শুনে বাড়ির মেয়েরা আতিথেয়তা নিয়ে তটস্থ। গৃহকর্তা সুবোধ পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘লাটসাহেব আসছেন ছবি দেখতে, তাতে অত আদিখ্যেতার কী! আমার বয়ে গেছে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে!’ খুড়তুতো ভাই নীরদচন্দ্র মল্লিককে ব্যাপারটা দেখতে বলে সুবোধ আর ত্রিসীমানায় ঘেঁষেননি।

মনে রাখতে হবে অ্যান্ড্রু ফ্রেজার বাংলার ছোটলাট ছিলেন ১৯০৩-০৮ পর্যন্ত। স্বদেশি, বয়কটের আঁচে সে এক উত্তাল সময়। ১৯০৬-এর অগস্ট থেকে সুবোধ বিপ্লবীচেতনায় ভরপুর ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা নিয়েও মাতোয়ারা। সুবোধের যা ধাত, দেশপ্রেমের আগুনে ফুটন্ত সেই সময়ে ব্রিটিশ ছোটলাটের সঙ্গে দেখা না-করায় আশ্চর্যের কিছুই নেই।

হৃদয় রাজ্যে অভিষেক

সুবোধচন্দ্রের রাজা হওয়ার সাক্ষী আবার ১৬ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট লাগোয়া পান্তির মাঠ। বিদ্যাসাগর কলেজের হস্টেল এখন সে মাঠ ঢেকে ফেলেছে। ১৯০৫-এর ৯ নভেম্বর সেই মাঠের সভাতেই যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল। বিপিনচন্দ্র পাল পরে বলেছিলেন, সে দিন সুবোধচন্দ্রের মহানুভবতার জন্যই দেশবাসী ব্রিটিশ সরকারের ঘৃণ্য ‘কার্লাইল সার্কুলার’-এর জবাব দিতে পেরেছিল। জনগণের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ১৬ অক্টোবর বাংলা ভাগ করার পরে ২১ তারিখ শিক্ষা প্রশাসনের কর্তা কার্লাইলের নির্দেশিকা বেরোয়। তাতে ছাত্রসমাজের যে কোনও মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধজনও সেই সার্কুলারের বিরুদ্ধে সরব হন। কলকাতায় পর পর সভা করে হিন্দু, মুসলিম ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে কালা কানুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিচ্ছে। রংপুর, মাদারিপুর, ঢাকায় স্বদেশি, বয়কটের আন্দোলনরত ছাত্রসমাজকে কোণঠাসা করতে তবু নৃশংস ব্রিটিশ সরকার। আন্দোলনরত ছাত্রদের বেত মেরে সাজা দিতে গররাজি হওয়ায় চাকরি গেল মাদারিপুরের স্কুলের হেডমাস্টার কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্তের। ৭ নভেম্বর রংপুরে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার শিকল মুক্ত স্বদেশি স্কুল পত্তনের ডাক দিয়েছিলেন ছাত্র, শিক্ষকেরা। এই পটভূমিতেই সময়ের দাবি বুঝতে সুবোধচন্দ্র ভুল করেননি।

পান্তির মাঠের সভায় সুবোধ ব্রিটিশের ইস্কুল, কলেজের নিষ্ফল শিক্ষার কারাগার ছেড়ে বেরোতে ডাক দিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পরে কেম্ব্রিজের ছাত্র সুবোধ বাংলা বক্তৃতায় সড়গড় নন। স্বদেশি শিক্ষার মহিমা বোঝাতে তিনি কবি বায়রনকে উদ্ধৃত করলেন। ‘…ইন নেটিভ সোর্ডস অ্যান্ড নেটিভ র‌্যাঙ্কস / দি ওনলি হোপ অব কারেজ ডোয়েলস’! ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণে কিছু বশংবদ কর্মচারী তৈরির শিক্ষা বর্জন করতে বলে সুবোধ দৃপ্ত ইংরেজিতে বোঝালেন, যে শিক্ষা সবার উন্নতিকল্পে নয় তা অসার। আর শিক্ষার হাল না-ধরলে জাতীয়তাবাদী আবেগটাই অবান্তর! অতঃপর দেশের শিক্ষিত বিদগ্ধজন এবং সাহসী ছাত্রদের আত্মত্যাগে আস্থা রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার তহবিলে এক লক্ষ টাকা দানের কথা ঘোষণা করলেন তিনি। মঞ্চে বিপিন পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আবুল হোসেন, প্রেমতোষ বসুরা তখন সুবোধের প্রশংসায় বাক্যিহারা। বরিশালের মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতাই সুবোধকে প্রথম ‘রাজা’ আখ্যা দিলেন। সভাশেষে আকাশ-বাতাস মন্দ্রিত রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিকের জয়ধ্বনিতে! হাজারো জনতা সুবোধের গাড়ির ঘোড়া খুলে নিজেরা টানতে থাকে। জনসমুদ্রের জোয়ারে ভেসেই সে-দিন ওয়েলিংটনের বাড়িতে ঢুকলেন সুবোধ।

রাজবাড়ির কথা

এক লক্ষ টাকা সে যুগে খুব কম ছিল না! বিপিন পাল বুঝেছিলেন, সুবোধের একার পুঁজিতেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সম্ভব। দরকারে আরও টাকা দিতে তৈরি ছিলেন সুবোধ। তিনি জনসভায় বলেন, “এই টাকাটা দেওয়া আমার জন্যও বিলাসিতা! কিন্তু এ হল মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়ার সময়!” সুবোধ মল্লিক তথা বসুমল্লিকদের এই বিত্তের সংস্থান কিন্তু জমিদারির খাজনা গুনে আসেনি। মাহিনগরের বসুদের এক শাখাভুক্ত কায়স্থ পরিবারটি পাঠান আমলে মল্লিক উপাধিধারী। সুবোধের প্রপিতামহ রাধানাথ বসুমল্লিক সাহেবি জাহাজ কোম্পানির মুৎসুদ্দি থেকে নিজের জাহাজের মালিক হয়ে ওঠেন। সেটা ১৮৩৮। ৪৫ বছরের জীবনের শেষ ক’বছরেই বিপুল বিত্তলাভ রাধানাথের। ইংরেজ বন্ধু স্যামুয়েল রিডকে সঙ্গে নিয়ে হুগলি ড্রাইডকের পত্তন করেই তাঁর সমৃদ্ধি। রিড তাঁর অংশটুকুও পরে বসুমল্লিকদের দিয়ে যান। ১৮৪৪-এ রাধানাথের অকালপ্রয়াণের পরে তাঁর বড় ছেলে জয়গোপাল বন্দরের কারবারের হাল ধরেন। সুবোধের বাবা প্রবোধচন্দ্র হলেন জয়গোপালের বড় ছেলে। বসুমল্লিকেরা পটলডাঙায় থাকলেও জয়গোপালের মৃত্যুর পরে সম্পত্তি ভাগ করে প্রবোধচন্দ্র মল্লিক (বসুমল্লিক লিখতেন না) এবং তাঁর দুই ভাই মন্মথ ও হেম অন্যত্র সরে গেলেন। ১২ ওয়েলিংটন স্কোয়ারের প্রাসাদটি প্রবোধচন্দ্রের তৈরি। ১৮৮১ থেকে সেখানেই থেকেছেন তাঁরা। সুবোধের তখন দু’বছর বয়স।

রাধানাথ, জয়গোপালদের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যেই মিশে ছিল পরের প্রজন্মের উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীন সত্তার পূর্বাভাস। সফল শিল্পপতি প্রবোধচন্দ্র, মন্মথ এবং হেম তিন ভাইই ভয়ডরহীন। ১৮৭৬-এ বড়লাট নর্থব্রুকের বিদায়বেলায় তাঁর স্মৃতিরক্ষা নিয়ে টাউন হলের সভায় তিনজনই বেসুরে বেজেছিলেন। মন্মথ তখন বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। তিনি সটান বলেন, নর্থব্রুককে ভারতবর্ষের মনে রাখবার কোনও কারণই নেই। ভোটাভুটিতে তিন ভাই ছাড়াও তাঁদের মামার বাড়ি ওয়েলিংটনের যোগেশ দত্তদের বাড়ির পাঁচজন একমত। মোট দশ জন সভার মতের বিরুদ্ধে অনড়। এই দশ জন সে-কালে অমর দশ বা ‘ইমমর্টাল টেন’ আখ্যা পান। সুবোধের বাবা ৪০ বছরও বাঁচেননি। বাবা-কাকাদের স্বাধীনচেতা মর্যাদাবোধ এবং দেশপ্রেমই সুবোধচন্দ্র তাঁর রক্তে বহন করেছেন।

সুবোধচন্দ্রের সেই প্রাসাদোপম বাড়ি আজ ভগ্নদশায়।

সুবোধচন্দ্রের সেই প্রাসাদোপম বাড়ি আজ ভগ্নদশায়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

জাতীয় শিক্ষা পরিষদ

সুবোধের এক লাখি দানে উজ্জীবিত হয়ে গৌরীপুরের জমিদার ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর মতো অনেক বিত্তবানই এগিয়ে এসেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তখন সুবোধকে জনসভায় ‘মহারাজ’ ডাকছেন। পান্তির মাঠে সুবোধের নিজের তৈরি ফিল্ড অ্যান্ড অ্যাকাডেমি ক্লাবের সভায় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সখারাম দেউস্কর, আশুতোষ চৌধুরী, আব্দুল রসুল, মৌলবি লিয়াকত হুসেন থেকে ভগিনী নিবেদিতাদের নিয়মিত যাওয়া-আসা। ছাত্রসমাজ ‘গোলদিঘির গোলামখানার’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মত্ত। সুবোধ বলে দিয়েছিলেন, তাঁর টাকায় সবার আগে পুব বাংলার স্কুলছুটদের শিক্ষা দিতে হবে। প্রস্তাবিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় আদর্শে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন থেকে অঙ্ক, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বন্দোবস্ত হল দেশের বিদ্বজ্জনের পরিকল্পনায়। ১১ মার্চ ১৯০৬-এ আত্মপ্রকাশ করল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। তার ৯২ জন সদস্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দের মতো বঙ্গসমাজের হিরে, জহরতের দীপ্তি। তবে সাহিত্য, বিজ্ঞান না-পড়িয়ে শুধু কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষায় জোর দিয়ে অন্য একটি কমিটি গড়েন তারকনাথ পালিত। দু’টি কমিটিরই সভাপতি কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতা রাসবিহারী ঘোষ। শিক্ষা পরিষদের বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল, কলেজের উদ্বোধন হল ১৪ অগস্ট ১৯০৬। এর কিছু দিন আগে তৈরি হয় তারকনাথের বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। ১৯১০-এ দু’টি প্রতিষ্ঠান মিশে গিয়েছিল। সুবোধচন্দ্র পরিষদের ট্রাস্টি হিসেবে জড়িয়ে থাকেন।

বরোদার রাজার চাকরি ছেড়ে অরবিন্দ ঘোষ ১৯০৬-এই পাকাপাকি কলকাতায় ফেরেন। বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের তিনি প্রথম অধ্যক্ষ।

অরবিন্দ ও বন্দেমাতরম

হেমকাকার মেয়ে লীলাবতীর বর আইসিএস চারুচন্দ্র দত্তের গুজরাতের বাড়িতেই প্রথমবার অরবিন্দকে দেখেন সুবোধচন্দ্র। চারুচন্দ্র তখন ঠাণের জেলা জজ। অরবিন্দ বরোদার রাজার চাকরি করতে করতেই মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামীদের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে জড়িয়ে। দেশের সব কাজেই সুবোধচন্দ্রের মধ্যে একনিষ্ঠ সহযোগীকে খুঁজে পেলেন তিনি।

স্বদেশি আন্দোলনে উত্তাল বাংলায় ঘাঁটি গাড়তে সুবোধের ওয়েলিংটনের বাড়িই হয় অরবিন্দের ঠিকানা। সেখানে থেকেই বন্দেমাতরম সম্পাদনার কাজ করছিলেন অরবিন্দ। সেই সঙ্গে সুবোধদের জাতীয় শিক্ষা পরিষদের বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষের ১০০ টাকার চাকরি। কংগ্রেসের নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে তোপ দেগে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিচিতি বাড়ছিল অরবিন্দের। সাধারণের চোখের আড়ালে নানা গুপ্তসমিতির সন্ত্রাসের নেপথ্যেও তখন তিনিই পুরোধা। এর মধ্যে বন্দেমাতরমের জন্য নিয়মিত টাকা ঢালা এবং কাগজ বার করার প্রাত্যহিক ধকল কাঁধে তুলে নিয়েছেন সুবোধচন্দ্র। স্ত্রী প্রকাশিনী মৃত্যুশয্যায়। ‘বন্দেমাতরমের’ প্রতি সুবোধের কর্তব্যে তখনও ঘাটতি ছিল না।

ক্ষুদিরামদের বোমা হামলার পরে বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইয়ের সাক্ষ্যে অরবিন্দ-সুবোধের যোগাযোগের ইতিকথা স্পষ্ট হয়ে আসে। সুশীল সেনকে বেত্রাঘাতের পরে সশস্ত্র সংগ্রামীদের গোপন বিচারসভায় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। সেখানেও অরবিন্দের সঙ্গে ছিলেন সুবোধ। সহযোগীদের অনেকের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হলেও মামলায় রেহাই পান অরবিন্দ। এক বছর জেল খেটে ১৯০৯-এর মাঝামাঝি তিনি মুক্ত হন। ১৯০৮-এর নভেম্বরে ‘বন্দেমাতরম’ বাজেয়াপ্ত করল ব্রিটিশ সরকার। ডিসেম্বরে কাশীতে গ্রেফতার হলেন সুবোধ। ১৪ মাস বাদে তিনি জেল থেকে বেরোলে ১২ নম্বর বাড়িতেই শেষ বার মুখোমুখি হন দুই বন্ধু। অরবিন্দ এবং সুবোধ।

১২ নম্বরের গল্প

ইউরোপীয় অন্দরসাজের চোখধাঁধানো বাড়ি। দিনশেষে তার ভিতর থেকেই ভেসে আসে বন্দেমাতরমের নিষিদ্ধ সুর। রাজপথ মথিত হয় সকন্যা সুবোধ, ‘বন্দেমাতরম’ কাগজের কর্মীদের কোরাসে। সূক্ষ্ম কারুকাজে সুবোধের দেওয়া বন্দেমাতরম পাড়ের বেনারসি শাড়িতে কোনও দিন বা এসে দাঁড়ান বোন লীলাবতী।

এ বাড়িতে উৎসব মানে জমজমাট থিয়েটার-সন্ধ্যা। সদ্য তরুণ কন্দর্পকান্তি সুবোধচন্দ্রের বিয়ের উদ্‌যাপন। একদা বরোদার গায়কোয়াড়ের জন্য ফুলকোর্স ফরাসি নৈশাহার দেখেছে এ বাড়ি। আবার হেমচন্দ্র, সুবোধের সঙ্গে দেখা করতে হাজির বাল গঙ্গাধর তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখেল বা আগা খাঁ, জাপানি মন্ত্রী ওকাহোমা।

শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর কাছে সুবোধচন্দ্রের লক্ষ টাকা দানের ইচ্ছের কথা শুনেই ভর সন্ধ্যায় হাজির বন্ধু চিত্তরঞ্জন। দু’জনে দু’ঘণ্টা আলোচনার পরে ঠিক হল সভা হবে পরের দিন পান্তির মাঠে। আবার ১৯০৭-এ বন্দেমাতরম-এর পাতায় রাজদ্রোহের মামলায় অরবিন্দ নিষ্কৃতি পেলে হঠাৎ হাজির রবীন্দ্রনাথ। কী ভাবে কী হল জানতে চান খুঁটিয়ে। রবীন্দ্র-চেতনায় ‘স্বদেশ-আত্মার বাণীমূর্তি’ অরবিন্দ স্মিত হাসেন। তাঁর সুহৃদেরা কবিকে আশ্বাস দেন, অরবিন্দের সামনে বড় কাজ। আপনার কবিতা ব্যর্থ হবে না!

১৯০৬-এর ডিসেম্বরে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের প্রাক্কালেই গোপনে সারা বাংলা বিপ্লবী সম্মেলনও বসেছিল ১২ নম্বরে। অনুশীলন সমিতির প্রমথনাথ মিত্র, পুলিনবিহারী দাসেরা সশস্ত্র হামলার মহড়ার জন্য জমি খুঁজছেন। ১৯০৭-এ সুরাত কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আগে বাড়িটায় দফায় দফায় বৈঠকে শামিল চিত্তরঞ্জন, অরবিন্দ, সুবোধ, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, হেমেন্দ্র ঘোষ-সহ জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসিরা। পরে সুবোধ-কন্যা সুচন্দ্রার বিয়েতে ভারী ব্যস্ত এক সুদর্শন কিশোরকেও দেখেছে এ বাড়ি। তিনি সুবোধের দিদি ইন্দুমতী ও হীরেন দত্তের ছেলে, পরবর্তীকালের কবি সুধীন দত্ত।

সহিংস আন্দোলনে ধাক্কার পরে এ বাড়ির একতলায় জেল-ফেরত অরবিন্দ-সুবোধও অনেক ক্ষণ একান্তে কথা বলেন। কী আলোচনা হয়েছিল তা অবশ্য কখনও জানা যায়নি। এর কিছু দিন বাদেই অরবিন্দ তাঁর অধ্যাত্ম-জীবনে পাড়ি দেবেন।

শেষ অঙ্ক

বাংলা থেকে দূরে বেরিলি, আলমোড়ায় নিঃসঙ্গ কারাবাসে ছিলেন সুবোধচন্দ্র। এই বীর বাঙালি যে-দিন ব্রিটিশের জেল থেকে বেরোলেন বাগবাজারে তাঁর স্কুলবাড়ি সাজিয়েছিলেন নিবেদিতা। বহু দিন বাদে প্রাণ ফিরে এল ওয়েলিংটনের ১২ নম্বরেও। এ বার এক নতুন সুবোধচন্দ্রের আত্মপ্রকাশ। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যিনি দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির কাজে ব্রতী। সুবোধচন্দ্রের বীমা সংস্থা ‘লাইট অব এশিয়া’ টিকে ছিল তাঁর মৃত্যুর বহু বছর বাদেও। তাতে সঞ্চয় রাখতে বিজ্ঞাপনে বাঙালিকে উৎসাহ

দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বসুও। সুবোধের প্রতিষ্ঠিত ‘রিড কোম্পানি’ও দেশি-বিদেশি ব্যাঙ্কের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। তবে সবাইকে বিশ্বাস করার রোগ ছিল সুবোধের। ফলে অনেক ঘনিষ্ঠজন এ ব্যাঙ্কের ঋণ না-মেটানোয় তাঁকে মামলায় ফাঁসতে হয়। বাধ্য

হয়ে বিপুল সম্পত্তি বিক্রি করেন সুবোধ। এমনকি ১২ ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িও খুড়তুতো ভাই নীরদকে মাত্র ৭৫ হাজারে বিক্রি

করে দেন।

চার কন্যা রেখে স্ত্রী প্রকাশিনীর মৃত্যুর পরে মজিলপুরের মিত্রবাড়ির মেয়ে কমলপ্রভাকে বিয়ে করেছিলেন সুবোধ। দম্পতির তিন ছেলে, দুই মেয়ে। ছোট মেয়ে সুজাতার জন্ম সুবোধের মৃত্যুর ১৫ দিন বাদে।

কলকাতার জীবনে ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমের জসিডি এবং দার্জিলিংয়েও সপরিবার থেকেছেন সুবোধ। অর্থকষ্ট থাকলেও দরিদ্রসেবা, অতিথি আপ্যায়নে ভাটা পড়েনি। পাহাড়ে ঘোড়দৌড়, শারীরচর্চায় মেতে থাকলেও হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়ায় পড়েন ৪১ বছরের সুবোধ। দার্জিলিংয়েই সব শেষ…১৯২০র ১৩ নভেম্বর। সুবোধের মা কুমুদিনী তখনও বেঁচে।

সব মরণ নয় সমান

‘প্রথম বাজিল তোমার পরাণ,—/ গড়িতে জাতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; / যাদবপুরে যাহার উড়িছে নিশান।/ ওগো বঙ্গ জননীর সুবোধ সন্তান / হৃদয়ের রাজা দেশগত প্রাণ।’

এ গান গাওয়া হয় সাবেক অ্যালবার্ট হলে, সুবোধের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে। শুনে অনেকেরই চোখে বাষ্প জমেছিল।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালির অখণ্ড ঐক্যর স্মারক হয়ে আজও যদি কিছু টিকে থাকে, তা সুবোধের স্বপ্নের জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। সুবোধের বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজই পর্বান্তরে যাদবপুরের কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি। স্বাধীনতার পরে তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার সুবোধের প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু পরাধীন দেশে শিক্ষায় উৎকর্ষ সাধনের ব্রত আমেরিকা, জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়েরও কুর্নিশ আদায় করে। জাতীয় কলেজের ছাত্রেরা সেখানে গবেষণার সুযোগ পান। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ আজও যাদবপুর চত্বরেই গবেষণা, প্রকাশনায় মগ্ন। রয়েছে যাদবপুর বিদ্যাপীঠও। দেশের জন্য রাজা সুবোধচন্দ্রের দহনদান ব্যর্থ হয়নি।

২/১ ক্রিক রোয়ে বন্দেমাতরমের বাড়ির একাংশ ভেঙে একটি বেসরকারি হাসপাতাল হয়েছে। বাকি অংশে সুবোধচন্দ্রের এক নাতি কুণাল বসুমল্লিক সস্ত্রীক থাকেন। ১২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি নীরদ মল্লিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে যান, যা আজ ভাঙাচোরা ভূতের বাড়ির চেহারায়। সরকার থেকে জনসাধারণ কারওরই কিচ্ছু পরোয়া নেই। অনাদরে মোড়া ইতিহাস বিস্মৃত জাতির সৌধটিই আজকের বাঙালির এক মোক্ষম পরিচয়।

তথ্যসূত্র: রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক অ্যান্ড হিজ টাইমস (অমলেন্দু দে), পটলডাঙা বসুমল্লিক বংশের ইতিহাস (দেবেন্দ্রচন্দ্র বসুমল্লিক), জাতীয় শিক্ষা পরিষদ।

অন্য বিষয়গুলি:

Jadavpur University
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy