বিকেল বেলা মানে যখন কোচিং ক্লাস, উইকএন্ড মানে আইনক্স, গরমের ছুটি মানে ‘সামার ক্যাম্প’। এক একটা পরিবার যেন ‘ডিজাইনার চাইল্ড’ তৈরির কারখানা। বাবা-মায়েরাও ‘এলিট’ তকমা পেতে মরিয়া। তখন সব দোষ কি নাবালকদের? এ বার সত্যিই আত্মবিশ্লেষণের সময় এসেছে।
১। আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরিজীবী?
২। যৌথ পরিবার বহু দিন ছেড়ে এসেছেন?
৩। ‘একটি’ সন্তানই আপনার পৃথিবী?
৪। সন্তানকে কি পড়াশুনার পাশাপাশি টেনিস, সাঁতার, নাচ, আঁকা সবই শেখাচ্ছেন?
৫। এই যে সারা দিন বাড়ি থাকেন না সেই গ্লানি থেকে বাচ্চাকে কেবলই প্যাম্পার করার অভ্যেস আছে?
৬। চাওয়া মাত্র চাহিদা পূরণ করেন?
৭। নাকি শাসনেই বেশি ভরসা আপনার?
৮। সন্তানকে শাসন করা নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বিরোধী মতামত পোষণ করা আকছারই ঘটে?
উপরের আটটি প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়—তা হলে সন্তান প্রতিপালন নিয়ে আপনার আত্মবিশ্লেষণের সময় এসেছে। ‘অত্যুৎসাহী’ অভিভাবকত্বের জন্যে হয়তো আপনার সন্তান ‘পেরেন্ট ইনডিউসড’ বা মা-বাবা আরোপিত সমস্যায় আক্রান্ত। নয় দারুণ ‘শাসন’ নয় অপরিমিত ‘সোহাগ’ বর্ষণ করছেন অথবা দুটোই ব্যালেন্স করবার চেষ্টা করেও কেউ হারিয়ে ফেলছেন। আর তার ফলে ওর জেদ বাড়ছে, আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটছে, হঠাৎ হঠাৎ ও রেগে যাচ্ছে বা চাহিদাও লাগামছাড়া হচ্ছে। সঙ্গে পড়াশুনোয় অমনোযোগিতা, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকী ওর অকারণে মিথ্যা বলা আপনার নজরে এসেছে। ওদের কিংবা ছোটখাটো চুরির খবরও শুনছেন। কিন্তু সব জেনেও ‘বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে’ গোছের অভয়বাণী দিয়ে নিজে ভুলিয়ে রাখছেন। ভাবতেই পারছেন না এই ‘কণ্ডাক্ট ডিসঅর্ডার’ বা ব্যবহার হঠাৎ তৈরি হওয়া অসংলগ্নতা ক্রমে বড় সমস্যার দিকে নিয়ে যেতেই পারে। তবু এত ব্যস্ত আপনি, এত ‘স্ট্রেসড’ যে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মগজ বা সময় কোনওটাই ব্যয় করতে আপনি রাজি নন। ওর সামান্য শারীরিক সমস্যাতেও যতটা বিচলিত হন মনের সমস্যায় ততটা নন!
ইদানীং সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলে যে সমস্ত খবর পড়তে হচ্ছে, তার থেকে স্পষ্ট যে বাবা-মার সমস্যায় আক্রান্ত ছেলেমেয়ের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বাচ্চাদের মধ্যে ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃঙ্খলতা। ভীষণ ব্যস্ত বাবা মায়ের যান্ত্রিক ও জটিল জীবনের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে সন্তানের ওপর। নইলে নবম শ্রেণির কোনও ছাত্রী নেহাতই ‘অ্যাডভেঞ্চারের টানে’ নিজের বাবার সংগ্রহ থেকে জলের বোতলে করে ‘মদ’ নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢোকার কথা কল্পনাও করতে পারে? মনোবিদ দেবযানী মিত্র বললেন, ‘‘কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার এখন শিশু-কিশোরদের মধ্যে এতটাই ছড়াচ্ছে যে প্রতিটি ছেলে মেয়েকে কাউন্সিলিং-এর আওতায় আনতে পারলে ভাল হয়। আর একক পরিবারের চাকুরিজীবী বাবা-মায়ের সিঙ্গল চাইল্ড হলে তো কথাই নেই!’’
একটা সময় ছিল যখন বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যরা ধূমপান করতেন দারুণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। পাছে গুরুজনেরা সেটা দেখে ফেলে আর হুলস্থুলু বাঁধায়! আজকের সংসারে সেই সম্ভ্রম কোথায়? একার পরিবার অঢেল স্বাধীনতা। ‘মদ’ খাওয়া নিয়েই ঢাকঢাক গুড়গুড় আজ প্রায় অতীত। মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, সংসারে বৃদ্ধ বাবা-মা আপনার পরিবারে আজ হয়তো নেই। কিন্তু একটি উঠতি বয়সের সন্তান তো আছে! ভুলবেন না, সে কিন্তু আপনাকে পর্যবেক্ষণ করছে এবং আপনাকেই দেখে শিখছে। মনোরোগ চিকিৎসক ডা. রীমা মুখোপাধ্যায় স্পষ্টতই বললেন, ‘‘বাবা-মায়েরা আজ বিভ্রান্ত।’’ সেই বিভ্রান্তিরই ফসল আবেশ দাশগুপ্ত ও তার বন্ধুবান্ধবেরা, বললে অত্যুক্তি হবে কি? মনোবিদ ডা. অমিত চক্রবর্তী বললেন, ‘‘সমাজ জীবন সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাদের পাখির চোখ সেই একটিই সন্তান। অফিস থেকে ফিরে তার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাবা-মা। এক দিক দিয়ে ভাল, বাচ্চা হয়তো তাতে বাবা-মায়ের সঙ্গ পাচ্ছে। কিন্তু এই ভালটা মন্দ হতে সময় নিচ্ছে না।’’
ওড়িশি নৃত্যশিল্পী সঞ্চিতা ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘গোটা দিনই প্রায় স্কুল। তার পর টেনিস, তারপরও যখন একটি মেয়েকে নাচ শিখতে পাঠানো হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এক একটা পরিবার আজ যেন ‘টেলর মেড চাইল্ড’ তৈরির কারখানা। বাচ্চাকে হর্স রাইডিং, গিটার বা পিয়ানো, গান-আঁকা অ্যাবাকাস সবই শিখতে হবে। তারপরেও যে লেখাপড়ায় ‘এ’ গ্রেড না পেলে মায়ের মুখ হাঁড়ি।’’ ডা. রীমা মুখোপাধ্যায় অবশ্য বললেন, ‘‘আসলে আগে একাধিক সন্তান থাকত। একজন নন-পারফর্মার হলেও, অন্য জন তা পুষিয়েই দিত, এখন একটি সন্তানের ওপরেই প্রত্যাশার পাহাড় জমছে। ফেসবুক টুইটার হোয়াটসঅ্যাপের আস্ফালন তো আছেই। এ সব থেকেই সমস্যার সূত্রপাত।’’
কী বলছেন সমাজতাত্ত্বিক শমিত কর? তাঁর মতে গোটা সমাজে পরিবর্তন ঘটেছে। বাঙালি পরিবারের চরিত্র বদলে যাচ্ছে। তার ওপর কোথাও একটা ‘এলিট’ তকমা পাবার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা। অন্য মনোবিদদের মতে, স্কুল ছুটির পরেও এখন কচিকাঁচাদের পড়াশুনা শেষ হয় না এবং খেলার মাঠের পরিবর্তে যাদের বসতে হয় কোচিং সেন্টারের ঘরে। আবার যাদের গরমের ছুটি মানে মামার বাড়ির ভারি মজা নয়, বরং অন্তঃসারশূন্য সামার ক্যাম্প। বা সপ্তাহান্তে মানে মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি যাবার যাদের রেওয়াজ নেই, আছে মল হপিংয়ের একঘেয়েমি।
এই নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোরালো সওয়াল, ‘‘বাচ্চাটাকে কি আমরা বাচ্চা থাকতে দিচ্ছি? আগে ছুটির দিন মানে ছিল পাড়া- ক্রিকেট, কাবাডির জন্য নির্ধারিত। সরস্বতী পুজোর আগে রাত দিন এক করে প্যান্ডেল তৈরি, ভোরে পাড়াময় ফুল ফল চুরি, বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ও পরে সপ্তাহ জুড়ে চলত ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া আর হইহই ঘুড়ি ওড়ানোর জমকালো আনন্দ—আর এখন? ওদের খেলতে যাবারই অবকাশ নেই। এ কী শৈশব। বাড়িময় দাপিয়ে আত্মীয় বন্ধু নিয়ে উত্তাল জন্মদিন উদযাপনকে তো আমরাই শপিং মলে কাঠখোট্টা ফুড কোটে সরিয়েছি। এখন ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই কোনও ক্লাবে বা রেস্টুরেন্টে চেনা-অজানা বন্ধুদের সঙ্গে বার্থডে কাটাচ্ছে। আমরা বাবা-মায়েরাই ওদের থেকে নির্মল আনন্দের উপাদান কেড়ে নিয়েছি। এখন মাত্র চোদ্দো বছরের তিন ছাত্রী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই ‘মদ’ দিয়ে জন্মদিনের আনন্দে মেতে উঠতে চাইছে। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা কি একেই ‘ঘোর কলি’ বলতেন?
ছোট মাথায় পড়াশুনা থেকে পিয়ানো, টেনিস থেকে ওয়েস্টার্ন ডান্স— এত কিছু ঢোকানোর ফলে মূল্যবোধটাই বাকি থেকে যাচ্ছে। সমাজতাত্ত্বিক শমিত কর বলছিলেন, ‘‘এখন তো বেশির ভাগ একটাই বাচ্চা। কোথাও গিয়ে তারা বুঝেই যাচ্ছে, আমি পরিবারের মধ্যমণি। তাই সময় থাকতেই যথোপযুক্ত শাসন ছাড়া সন্তান বখে যেতে বাধ্য।’’ দশম শ্রেণির ছাত্রী পায়েল বন্ধুদের কাছে জাহাজে কর্মরত বাবার সম্পর্কে মনগড়া নালিশ করে প্রায়ই। ওর শিক্ষক-শিক্ষিকারা যারা অভিভাবক মিটিং এর সূত্রে ওর বাবাকে ভাল করেই চেনেন, তারা স্কুলেরই মনোবিদের সাহায্যে নেন। তাকে পায়েল জানিয়েছে যে ওর বাবা চার মাসের জন্যে কলকাতায় ফিরলেই বাড়িতে অশান্তি হয়। বাবা ওর মাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। আর তাই মায়ের খুব বাবার ওপর রাগ। পায়েলের অনেক ছেলেবন্ধু। বাবা কলকাতায় ফিরলে, তাদের সঙ্গে মেলামেশাতেও ঘাটতি পড়ে। এই কারণে বাবাকে মোটেই পছন্দ করে না। মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, বয়ঃসন্ধির সময় তেরো থেকে এগিয়ে এসেছে নয়-দশ-এ। অতএব বাচ্চাদের বোধবুদ্ধিও পরিণত হচ্ছে অনেকটাই আগে। এম বি বি এস-এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রোহন শুধু মদ নয়, শহরের নিষিদ্ধ পাড়াতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আপাতত ওর সহৃদয় এক সিনিয়র দাদার সাহায্যে সে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন। ওর বক্তব্য, ডাক্তারি কোনও দিনই ওর পছন্দের বিষয় নয়। কিন্তু পরিবারের জোড়াজুড়িতে তাকে ভর্তি হতেই হয়েছিল।
যে সময়ে একটি ন’বছরের শিশু সাইবার গেম ‘পোকেমন গো’-তে মত্ত হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে পোকেমনকে ধরতে মুম্বই যাবার ছক কষে, সেই মতো হাওড়া স্টেশনেও পৌঁছে যেতে পারে সকলের অগোচরে, তখন সন্তান প্রতিপালন কঠিনতম চ্যালেঞ্জ, সন্দেহ নেই। আর এই দায়িত্ব মোকাবিলায় মনোরোগ চিকিৎসকদের দাওয়াই সন্তানকে প্রকৃত অর্থে ‘আত্মজ’ তৈরি করতে হলে, আপনাদের একাধারে ‘চিয়ারলিডার্স’, আর অন্য দিকে ‘ওয়াচ ডগ’ হওয়া রপ্ত করতে হবে।
------------------------------
• সন্তানের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হবার দরকার নেই। বরং সম্পর্কটা এমন রাখুন যে ও নিজেকে প্রকাশ করতে অসুবিধা বোধ না করে।
•ওর বিকেলবেলাগুলো ফাঁকা রাখুন। প্রয়োজনে জোর করে খেলতে পাঠান।
•ছেলে বা মেয়েটি বন্ধুদের সঙ্গে বেরোতে চাইলে আপনার উপস্থিতিতে ওদের বাড়িতে আসতে বলুন।
• আপনি অভিভাবক মানে শাসক। আর ও শাসিত এমন ভাবনা দূর করুন।
• বড় কঠিন সময়। নিজেদের আত্ম সংযম বাড়াতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy