Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Swami Vivekananda

স্বামীজির শেষ ছবি কোথায়?

স্বামীজির শেষ দিন নিয়ে এখনও রয়েছে অনেক জল্পনাকল্পনা। সে দিন সম্পর্কিত সব তথ্য কি এখনও আমরা জানি? লিখছেন শংকর নরেন্দ্রনাথের ছাত্রজীবনের কোনও ছবি আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং তাঁর প্রথম ছবি বলে যেটি পরিচিত, সেটিও নাকি তোলা হয়েছিল কাশীপুর উদ্যানবাটীতেই। কে এই ছবি তুলেছিল ?

ধর্মমহাসভায় স্বামীজি

ধর্মমহাসভায় স্বামীজি

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২০ ০২:২০
Share: Save:

আমেরিকা ও ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ৪ জুলাই ও ১৫ অগস্ট, এই দু’টি দিন যেমন কোটি কোটি মানুষের কাছে সমাদৃত, তেমনই অনেক ভক্তজনের কাছে দুঃখের দিনও। কারণ, স্বামী বিবেকানন্দ ও ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ওই দু’দিনে অমৃতলোকের যাত্রী হয়েছিলেন।

১৮৮৬ সালের ১৫ অগস্ট রাতে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ক্যানসারে জর্জরিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কেমন ভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তী কালের সন্ন্যাসীরা গভীর নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন দেশে এবং বিদেশে।

সেই রাতে শ্রীরামকৃষ্ণের সেবকবৃন্দ বিশ্বাস করতে পারেননি যে, তাঁদের হৃদয়েশ্বর মৃত। তাই তাঁরা সারা রাত ধরে তাঁর বুকে মালিশ করে গিয়েছিলেন, যাতে তিনি সমাধি থেকে ফিরে আসতে পারেন। তার পর সুদূর কাশীপুর থেকে বিখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের কাছে মধ্য কলকাতায় খবর পাঠানো হয়েছে এবং এই কিংবদন্তি পুরুষ মহানগরীর সব দূরত্বকে অগ্রাহ্য করে ১৬ অগস্টের সকালবেলায় কাশীপুরে হাজির হয়ে ভক্তজনের হৃদয়ে আঘাত করে জানিয়েছেন ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে, আর কিছুই করার নেই।

ডাক্তার সরকার শুধু হৃদয়বান ও প্রতিভাবান চিকিৎসক নন, এ দেশের বিজ্ঞানচর্চায় তিনি অগ্রদূত এবং সেই সঙ্গে ইতিহাসের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। আমরা তাঁর ডায়েরি থেকে জানতে পারছি, সে দিন সকালে ঠিক কী হয়েছিল এবং কী ভাবে তাঁর দেওয়া দশ টাকায় তখনকার বিখ্যাত বেঙ্গল ফোটোগ্রাফারকে ডেকে দু’খানা ছবি তোলা হয়েছিল, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেজায়। এই ছবি দু’টিতে অমৃতপথযাত্রী শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়াও আদি ভক্তজনদের কে নেই ? তবে সকলের বিশেষ আকর্ষণ ধুতি পরা নরেন্দ্রনাথ দত্ত।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (বাঁ দিকে)। সারদা দেবী।

নরেন্দ্রনাথের ছাত্রজীবনের কোনও ছবি আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং তাঁর প্রথম ছবি বলে যেটি পরিচিত, সেটিও নাকি তোলা হয়েছিল কাশীপুর উদ্যানবাটীতেই। কে এই ছবি তুলেছিল ? কার ইচ্ছেয় এই ছবি উঠেছিল এবং ঠিক কবে এই ছবি তোলা হয়েছিল, তা নিয়ে আজও তেমন কোনও গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সন্ন্যাস ও সাধনার দুর্গম পথের যাত্রীর এটিই প্রথম আলোকচিত্র এবং তার পরেই চিরনিদ্রায় শায়িত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে গ্রুপ ফোটো। সে দিন তোলা ওই দুই ছবিতে কে কে রয়েছেন, কী ভাবে রয়েছেন এবং কেন রয়েছেন, তা নিয়ে আজও বিভিন্ন দেশে নানা কৌতূহল। যা কিছু অস্বস্তি, ঠাকুরের রোগক্লিষ্ট দেহাবশেষ ঘিরে। যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন টেকনিক্যাল পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে তাঁকে আর দেখা না যায়। আমাদের ঠাকুর ফোটোগ্রাফিতে কৌতূহলী ছিলেন, বিভিন্ন সময়ে তিনি সাগ্রহ স্টুডিয়োয় গিয়েছেন, ছবি তুলেছেন এবং কয়েকটি ছবি পছন্দ না হওয়ায় মুখ ফুটে বলেছেন। সেই সব ছবি সমকালের ভক্তরা গঙ্গার জলে নেগেটিভ-সহ বিসর্জনও দিয়েছিলেন। একদিন যে তাঁরই ছবি বিশ্বজনের সাদর সংগ্রহে স্থান পাবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিও শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল। যদিও বিশ্ববিজয়িনী সহধর্মিণীর সঙ্গে তাঁর কোনও ছবি নেই এবং সারদামণির যে সামান্য ক’টি ছবি আমরা দেখছি, সেগুলো সবই বৈধব্য অবস্থার এবং তা বিদেশিনীদের প্রবল আগ্রহে বিদেশি ফোটোগ্রাফারদের তোলা। আর কয়েকটি তোলা ভক্তপ্রাণ অ্যামেচার ফোটোগ্রাফারদের উৎসাহে।

সৌভাগ্যক্রমে ঠাকুরের মর্মর মূর্তি তৈরি হয়েছে তাঁর দেহাবসানের অনেক পরে। তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মতামত ও সমর্থন নিয়ে। তবে তার চেয়ে শতগুণ বেশি মূর্তি নগরে নগরে শোভিত হয়েছে তাঁর প্রিয় শিষ্যের, যিনি বেশ কয়েক বার সন্ন্যাস-নাম পরিবর্তন করে সাগর পাড়ি দেওয়ার শেষ মুহূর্তে ‘বিবেকানন্দ’ নাম গ্রহণ করেছিলেন।

বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তিগুলি নিয়ে ভক্তজনের দুঃখ অনেক। অনেক সৃষ্টিই যে নিতান্ত হতাশাজনক তা বলতে দ্বিধা নেই। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলতেন, মাথায় একটা পাগড়ি ঝুলিয়ে দিলেই বিবেকানন্দ হয় না। কিন্তু সে নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই, বহু যুগ ধরে ভগবান বুদ্ধও একই ভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। তিনি ঠিক কেমন দেখতে ছিলেন, কোন শরীরের মায়ামোহে তিনি বিশ্বজনের হৃদয় হরণ করেছিলেন, তা আজ আরও বোঝার উপায় নেই। কালজয়ী শঙ্করাচার্য সে দিক থেকে ভাগ্যবান। স্বামীজির মতো তিনিও অকালে দেহত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু এ দেশের পথেঘাটে তিনি বিস্ময়কর ভাবে অনুপস্থিত এবং সে জন্যই বোধহয় বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে তিনি বিশিষ্ট জনের হৃদয়ে সদা উপস্থিত আজও।

স্বামী ব্রহ্মানন্দের ডায়েরিতে লেখা— মহাপ্রস্থানের কয়েক সপ্তাহ আগেই স্বামীজি বেরিয়েছিলেন তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের শেষ ছুটিতে, তাঁর মৃণালিনী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। বড় জাগুলিয়ার অবস্থিতি নদিয়া জেলায়, সেখানে যাওয়াও সহজ নয়। প্রথমে ট্রেনে কাঁচরাপাড়া (৩৪ মাইল), তার পর গরুর গাড়িতে বড় জাগুলিয়া (৭ মাইল)। এই যাত্রার উল্লেখ খুঁজে পাচ্ছি স্বামীজির লেখা চিঠিতে। বেলুড়ে ফিরে এসেই মহাপ্রয়াণের কুড়ি দিন আগে মিস্টার ক্রিশ্চিনকে লম্বা এক চিঠি লিখেছিলেন মায়াবতীতে। সেই চিঠিতে স্বামীজি বলছেন, আমার ভাগ্নে নেদু নিখুঁত উচ্চারণে ইংরেজি বলতে শিখল, কোনও বিদেশি ভাষাই ঠিকমতো আয়ত্ত করা যায় না, শৈশব থেকে না শিখলে। শেষ প্যারাগ্রাফে বড় জাগুলিয়ার উল্লেখ, “আমি এখন আগের তুলনায় অনেক শক্তিমান। সাত মাইল গরুর গাড়িতে নড়বড়ে রাস্তায় যাত্রা এবং সেইসঙ্গে ট্রেনে ৩৪ মাইল যাত্রার পরেও আমার পা ফুলল না—ড্রপসি ফিরে এল না। আমার নির্ঘাত বিশ্বাস, ওই রোগ আর ফিরছে না। যাই হোক, এই মুহূর্তে সবই আমার শ্রেষ্ঠ স্থান।”

ফেরা যাক ৪ জুলাইয়ের দুঃখদিনে। জুলাইয়ের এই চতুর্থ দিনে দেহাবসানের কয়েক বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কাশ্মীরে বসে আমেরিকান ভক্তদের সামনে পাঠ করেছিলেন ৪ জুলাইয়ের উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি কবিতা। তখন কে জানত, এই ৪ জুলাইয়েই তাঁর দেহাবসান ঘটবে! যেমন কেউই জানত না, ঠাকুরের তিরোধান দিবসই একদিন হয়ে উঠবে এ দেশের স্বাধীনতা দিবস।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহাসমাধি

মৃত্যুপথযাত্রী সিংহের এক প্রাণস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর বিখ্যাত ‘যুগনায়ক’ বইয়ে। স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় তিনি প্রায়ই শুয়ে থাকতেন, অসুখ কমলে মাঝে মাঝে নীচে নেমে আসতেন এবং কৌপীন পরিহিত অবস্থায় বেলুড় মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করতেন। কখনও রান্নাঘরে ঢুকে দু’-একটি পদ প্রস্তুত করতেন। সেই সময়ে তিনি কখনও খালি গায়ে, কখনও গেরুয়া পরে, চটি পায়ে। হাতে কখনও লাঠি, কখনও হুঁকো। শেষ দিকে মানুষের সংস্রব এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। শেষের দিকে প্রিয় শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী একবার তাঁকে নদীর ও পারে আহিরীটোলার ঘাটে দেখেছিলেন। স্বামীজির বাঁ হাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা রয়েছে। শিষ্যকে ডেকে তিনি বললেন, চারটি চানাচুর ভাজা খান, বেশ নুন-ঝাল আছে।

বিদায়দিনের বিস্তৃত বিবরণ অনেকেই পড়েছেন। স্কুলে আমরা শুনতাম, বেলুড়ে ধরা গঙ্গার ইলিশের খবর। ঝাল ঝোল ভাজা অম্বল ইত্যাদি যথেষ্ট খেয়ে পরমানন্দে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে। আগেকার সময়ে এমন একটা গুজব ছিল, বেশি খেয়েই অঘটন। কিন্তু এর কোনও নির্ভরযোগ্য সমর্থন নেই।

আমরা জানি, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ সে দিন বেলুড়ে ছিলেন না। ইমার্জেন্সির খবর পেয়ে রাত সাড়ে দশটায় তাঁরা কলকাতা থেকে মঠে ফিরে এসেছিলেন এবং প্রায় একই সময়ে এসেছিলেন ডা. মহেন্দ্রনাথ মজুমদার এবং বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল।

এর আগেই শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য, যার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন প্রমথনাথ বসু তাঁর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইয়ে—

“রাত্রি ৯টার পরে পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া শয়ন করিয়াছিলেন এবং ক্ষুদ্র বালক যেরূপ কাঁদিয়া ওঠে সেইরূপ একটা অস্ফুট ধ্বনি করিলেন। তাহার এক মিনিট কি দুই মিনিট পরে পূর্ববৎ আর একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলিলেন। তার পর সব যেন স্থির হইয়া গেল— ক্লান্ত শিশু যেন মার ক্রোড়ে ঘুমাইতে লাগিলেন। দেখিয়া বোধ হইতেছে, যেন তিনি মহাধ্যানে মগ্ন। তখন ৯টা বাজিয়া মিনিট দশেক মাত্র হইয়াছে।”

সব সময়ের সঙ্গী “ব্রহ্মচারীটি অল্পবয়স্ক—কিছু বুঝিতে না পারিয়া বয়স্ক সন্ন্যাসীকে (বোধহয় স্বামী নিশ্চয়ানন্দ) ডাকিলেন। নাড়ির গতি অনুভূত না হওয়ায় তিনি আরেকজনকে ডাকিলেন (বোধহয় স্বামী প্রেমানন্দ)। দুইজনেই দেখিলেন নাড়ি নাই। ... প্রেমানন্দ কহিলেন, বোধহয় সমাধি হইয়াছে। ... উচ্চৈঃস্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নামকীর্তন হইল, কিন্তু কিছুতেই সমাধিভঙ্গ হইল না। হায় হায়, এ যে মহাসমাধি! স্বামী অদ্বৈতানন্দ এ বার বোধানন্দ স্বামীকে ভাল করিয়া নাড়ি পরীক্ষা করিতে বলিলেন। তিনি কিছুক্ষণ নাড়ি ধরিয়া দাঁড়াইয়া, চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।”

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনার কথা উঠল। আর একজন ছুটলেন কলকাতায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দকে ডেকে আনতে। রাত সাড়ে দশটায় তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন। কৃত্রিম উপায়ে চৈতন্য সন্ধানের নানা প্রচেষ্টা হল। তার পর রাত বারোটায় ডাক্তার বললেন, প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে। “পরের দিন ডাক্তার বিপিন ঘোষ দেহ পরীক্ষা করে বললেন, সন্ন্যাস রোগে মৃত্যু হয়েছে।”

এর আগে মহেন্দ্রবাবু বলে গিয়েছেন হৃদরোগই মৃত্যুর কারণ। কেউ কেউ বললেন, মাথার শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে। “মঠের সন্ন্যাসীদিগের দৃঢ় বিশ্বাস, শ্রীরামকৃষ্ণদেব যাহা বলিতেন তাহাই ঘটিয়াছে, অর্থাৎ স্বামীজি যোগবন্ধনপূর্বক সমাধিতে দেহত্যাগ করিয়াছেন।” ৪ জুলাই ১৯০২ স্বামীজির বয়স ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। “তিনি প্রায় বলিতেন, আমি চল্লিশ পেরুচ্ছি না।”

বলরাম বসুর বাড়িতে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ (বাঁ দিক থেকে), স্বামী সদানন্দ (নীচে)

পরের দিন মানসকন্যা নিবেদিতা এলেন সকাল সাতটায়। স্বামীজির মা খবর পেলেন সকালবেলা, ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ চলে এলেন দ্রুত, সঙ্গে তাঁর ভগ্নীপতি। তার পর কাঁদতে কাঁদতে ঢুকলেন জননী ভুবনেশ্বরী, সঙ্গে নাতি ব্রজমোহন ঘোষ। গিরিশচন্দ্র এলেন চিতায় আগুন দেওয়ার সময়ে। মঠপ্রাঙ্গণে দাহকার্য শেষ হল সন্ধ্যা ছ’টায়। শেষকৃত্যে একটু দেরি হল এই জন্য যে, বালি মিউনিসিপ্যালিটি শ্মশানের বদলে মঠপ্রাঙ্গণে দাহের অনুমতি দিতে প্রথমে বোধহয় আপত্তি জানিয়েছিল। স্বামী সারদানন্দের সঙ্গে তাঁদের যে পত্রবিনিময় হয়েছিল তা এখন কোথায়, তা কেউ জানেন না।

স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সারদানন্দ ও নিবেদিতা বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে বেশ ক’টি চিঠি লিখেছিলেন বিদেশে থাকা স্বামী তুরীয়ানন্দ ও স্বামী অভেদানন্দকে এবং অবশ্যই জোসেফিন ম্যাকলাউডকে। অনেক দিন পরে একজন প্রত্যক্ষদর্শী ‘বিশ্ববাণী’ পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। তাঁর (চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়) লেখা থেকে কিছু মূল্যবান উদ্ধৃতি দিতে পেরেছি আমার ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইয়ে।

সকাল ন’টার একটু আগে চন্দ্রশেখরবাবু বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কাছে শুনলেন মঠের স্বামীজি আর নেই, দেহ রেখেছেন।

সে দিন শনিবার, অফিসে না গিয়ে ভাই দুলালশশীকে নিয়ে “বেলা দশটায় বেলুড়মঠে পৌঁছিলাম।” সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। “দেখিলাম স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রমুখ কয়েকজন সন্ন্যাসী একখানি সুন্দর খাটে পুষ্পশয্যা রচনায় রত। স্বামীজির ঘরে গিয়ে দেখা গেল, একখানি সুন্দর গালিচার উপরে শায়িত তাঁর বিভূতি-বিভূষিত দেহ। স্বামীজির বামদিকে ভগ্নী নিবেদিতা অশ্রুপূর্ণ নয়নে হাত-পাখার দ্বারা স্বামীজির মাথায় অনবরত বাতাস করিতেছেন। ... স্বামীজির দক্ষিণ করের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া লইলাম। জপ শেষ হইলে ভগ্নী নিবেদিতা চুপিচুপি বলিলেন, ‘Can you sing my friend?’ তখন বন্ধু নিবারণচন্দ্র সুমধুর স্বরে কয়েকটি গান গাইলেন।”

বেলা একটার সময়ে স্বামী সারদানন্দ তরুণদের বললেন, “আমরা ভেঙে পড়েছি। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি ?” নীচে নামার পরে শেষ ফোটো নেওয়ার কথা উঠেছিল, কিন্তু রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) বারণ করলেন। এর পর স্বামীজির চরণতল আলতায় রঞ্জিত করে তাঁর পায়ের ছাপ নেওয়া হল। ভগ্নী নিবেদিতাও একটি রুমালে স্বামীজির চরণের ছাপ তুলে নিলেন।

বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথ ছিল চোরকাঁটায় ভরা, তারই মধ্যে পালঙ্কখানি চন্দনকাঠের চিতার উপরে স্থাপন করা হল। এই সময়ে স্বামীজির কাকিমা ও জ্ঞাতিভাই হাবু দত্ত উপস্থিত হয়ে ক্রন্দন ও বিলাপ করতে লাগলেন।

এক সময়ে “চিতাবহ্নি ক্রমে ক্রমে লেলিহ্যমান ঊর্ধ্বমুখী জিহ্বা বিস্তার সহ ধূ-ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল।” এই সময়ে অন্য অনেকের সঙ্গে উপস্থিত মহাকবি গিরিশচন্দ্র, বসুমতীর উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্রীম, জলধর সেন প্রমুখ। ঠাকুরের দাহকার্যেও এই উপেন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন এবং বৃষ্টিভেজা শ্মশানেই সাপের কামড়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

শোকোচ্ছ্বাস চাপতে না পেরে নিবেদিতা জ্বলন্ত চিতার চারপাশে পরিক্রমণ করতে লাগলেন। পাছে তাঁর গাউনে আগুন ধরে যায়, এই ভয়ে কানাই মহারাজ স্বামী ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে তাঁর হাত ধরে গঙ্গার ধারে নিয়ে বসালেন। সন্ধ্যার সময়ে জানা গেল, গত রাত থেকে সন্ন্যাসীরা অভুক্ত রয়েছেন। একজন ভক্ত বেরিয়ে গেলেন শোকার্তদের মুখে দেওয়ার জন্য কিছু মিষ্টি কিনতে।

স্বামী অভেদানন্দকে লেখা স্বামী সারদানন্দের চিঠির তারিখ ৭ অগস্ট ১৯০২। এর অনেক আগেই তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল। “স্বামীজির মৃত্যু বড়ই অদ্ভুত! প্রায় দুই মাস পূর্বে তিনি কাশীধামে যান, সেখান হইতে শরীর খুব খারাপ লইয়া আসেন। মঠে ফিরিয়া আসিয়া কবিরাজী চিকিৎসা করান...একমাস ঔষধ ব্যবহারে হাত-পা ফোলা সারিয়া গেল, পেটেও জল রহিল না।”

এর পরেই এক সপ্তাহের জন্য বড় জাগুলিয়া যাওয়ার বর্ণনা। ৬ জুন তিনি শিষ্যা মৃণালিনী বসুর বাড়ি যান এবং মঠে ফেরেন ১২ জুন। “রাত্রি ৪টার সময় সকলকে লইয়া জপ-ধ্যান করিতেন এবং সর্বদাই বলিতেন, ‘আমার কার্য হইয়া গিয়াছে, এখন তোরা সব দ্যাখ শোন, আমায় ছুটি দে’।” এর পরেই ৪ জুলাইয়ের বর্ণনা : “সেদিন ঠাকুরের শয়নঘরে একলা বসিয়া ধ্যান করিলেন... নীচে নামিয়া সকলের সহিত ইলিশ মাছের ঝোল ভাজা ইত্যাদি দিয়া ভাত খাইলেন। খাবার পরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম করিয়া সকলকে ডাকিয়া ব্যাকরণ ও যোগ শিক্ষা দেন... পরে ৪টা-৫টা পর্যন্ত বাবুরামের সঙ্গে মঠের বাইরে দু’মাইল বেড়াইয়া আসিলেন। ...ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি নাই।’

এর পরে শনিবারের কথা : “পরদিন অপরাহ্নে বেলা ৪টার সময় শরীর অগ্নিসাৎ করা হইল...গঙ্গার পশ্চিম পারে মঠের ভিতরেই তাঁহার অগ্নিসাৎ করা হয়। ইহার ঠিক অপর পারেই গুরুমহারাজের শরীর অগ্নিসাৎ করা হইয়াছিল।”

স্বামী প্রেমানন্দের চিঠিটি আরও হৃদয়গ্রাহী, “তার শরীর বেশ সেরে উঠেছিল। বিশেষ কোনও অসুখই ছিল না। ঠিক ইচ্ছা করে শরীর ছেড়ে দিলেন।...কার্যগতিকে শরৎ, রাখাল দু’চার দিন কলিকাতায় ছিল। পুরাতন লোকের মধ্যে গোপাল দাদা ও আমি সেদিন মঠে ছিলাম।... গঙ্গার একটা ইলিশ মাছ এ বৎসরে এই প্রথম কেনা হলো, তারপর তার দাম নিয়ে আমার সঙ্গে কত রহস্য হতে লাগল। একজন বাঙালি ছেলে ছিল, তাকে বললেন— ‘তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর।’...আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন। আহারের পর নানা কথা কয়ে কিছু বিশ্রাম করিলেন।”

স্বামী গম্ভীরানন্দ গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার জন্য শেষ পর্বে বিবেকানন্দ থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন—“এমনও হইতে পারে যে, আমি হয়তো বুঝিব—এই দেহের বাহিরে চলিয়া যাওয়া, এই দেহকে জীর্ণ পোশাকের মতো ফেলিয়া দেওয়াই আমার পক্ষে হিতকর। কিন্তু আমি কোনদিন কর্ম হইতে ক্ষান্ত হইব না।” এর পরেই রয়েছে স্বামীজীর ‘৪ জুলাই’ কবিতার বঙ্গানুবাদ :

‘চল প্রভু চল তব বাধাহীন পথে ততদিন—

যতদিন ঐ তব মাধ্যান্দিন প্রখর প্রভায়

প্লাবিত না হয় বিশ্ব, যতদিন নরনারী—

তুলি ঊর্ধ্বশির—নাহি দেখে ছুটেছে শৃঙ্খলভার—

না জানে শিহরানন্দে তাহাদের জীবন নূতন।’

ভগ্নী নিবেদিতাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মধ্যে তফাত কী ? নিবেদিতার স্মরণীয় উত্তর, “অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে, তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ। আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে, তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।”

সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে স্বামীজির শেষ সাক্ষাৎ দেহাবসানের দু’দিন আগে। এ বিষয়ে জোসেফিন ম্যাকলাউড লিখে গিয়েছেন — তাঁর স্কুলে একটি বিশেষ বিজ্ঞান পড়ানো উচিত হবে কি না, সেই ব্যাপারে স্বামীজির মতামত নিতে মঠে গিয়েছিলেন। স্বামীজি উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমি যা করতে চাইছ হয়তো সেটাই ঠিক। তবে কি জান, জাগতিক কোনও কিছুতেই আর মন দিতে পারছি না। আমি এখন মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি।”

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda Ramakrishna Paramahamsa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy