জমিদার, আইসিএস জজ, বিসিএস মুনশেফ সায়েব, উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার— কারা ভারতীয় মধ্যবিত্তের মুখ রক্ষা করলেন মানবসেবায়, এর উত্তর দিতে গেলে মনে পড়ে যায় এই শ্রেষ্ঠ সম্মান যাঁরা পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের নাম মাস্টারমশায়। এই শিক্ষকেরাই জাতীয় জীবনের নানা পর্যায়ে মধ্যবিত্ত ভারতীয়ের নিরন্তর সেবা করেছেন। এঁদের কেউ ‘মাস্টারদা’ নামে শাসকের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছেন, কেউ মন্দিরের অখ্যাত পুরোহিতের বাক্যসুধার দিনলিপি লিখে তাঁকে বিশ্ববন্দিত করেছেন, সেই সঙ্গে বিদেশিনি দিদি নিবেদিতা ও বিদেশিনি এন্টালির দিদিমণি মাদার টেরেজাকে যদি ধরেন, তা হলে মানতেই হবে, এঁরাই আমাদের মুকুটমণি। উৎসাহীরা এই তালিকায় যোগ করে দেন আর একজন মাস্টারকে, যাঁকে স্বয়ং বিদ্যাসাগর পদত্যাগপত্র পাঠাতে বাধ্য করেছিলেন।
এই মধ্যবিত্ত মাস্টারমশায়ের অতুলনীয় জীবনকথা এ দেশের মানুষের অমূল্য সম্পদ। ‘কনটেম্পোরারি’ বা সমকালীন বলে একটা কথা আছে। আমি অন্য অনেকের মতো সগর্ব দাবি করতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুর সমসাময়িক। কারণ আমার কালে তাঁরা বেঁচে ছিলেন। সেই দাবি শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্বন্ধে একটুর জন্য হাতছাড়া হয়েছে, মাত্র এক বছরের জন্য। তাঁর কর্মময় ও কীর্তিময় জীবনের অবসান ১৯৩২ সালে এবং আমার জন্ম ১৯৩৩ সালে।
ভাবছি, এই মাস্টারমশায়ের নাম প্রথম কবে শুনলাম? আমাদের হাওড়ার বাড়ির খুব কাছে অরোরা বুক ডিপোতে খুব কম বয়সে গল্প করতে যেতাম এবং সেখানেই মাঝে মাঝে আসতেন এক ভদ্রলোক, একটা থলেতে এক মূল্যবান বইয়ের প্রচারের জন্য। বইটির নাম ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’। আমি ভেবেছিলাম, তিনি মূল প্রকাশকের সেলসম্যান, কিন্তু পরে শুনলাম, তিনি বইটির গুণগ্রাহী সেবক, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার, কোনও বই পছন্দ হলে মানুষ তা কেনে। কিন্তু সেই বই ঘরে ঘরে প্রচারের জন্য কেউ পথে বেরিয়ে পড়ে, তা আমার জানা ছিল না।
মনে পড়ে সেই বাল্যস্মৃতির কথা, অরোরা বুক ডিপোর মালিকের দুঃখ, রামকৃষ্ণকথামৃতের কপিগুলো বিক্রি করতে পারছি না, অথচ সেই ভক্ত ভদ্রলোক বলছেন ক্রমশই চাহিদা বাড়ছে। তার পর আমাদের চোখের সামনেই কথামৃতের চাহিদা বিপুল বাড়ল, গীতাকেও ছাড়িয়ে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগল, শেষযাত্রার আগে মৃতের শয্যায় গীতা দেওয়া হয় ডজন দরে, আর জ্যান্ত সংসারীদের বিশেষ প্রয়োজন দক্ষিণেশ্বরের পুজুরি বাউনের অমৃতকথা।
চাটুজ্যে বাউনের জুটে গিয়েছে
বদ্যি পাবলিসিটি অফিসার—
নাম তাঁর মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। কেউ তাঁকে দেখেনি, নিজের পয়সায় তিনি বই ছাপিয়েছেন। মা সরস্বতী ও মা লক্ষ্মী দু’জনেই একসঙ্গে দয়া করেছেন।
আমাদের বিবেকানন্দ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাঁদুদার সংগ্রহে দুটো বইয়ের সমস্ত খণ্ড ছিল— স্বামী সারদানন্দের লীলাপ্রসঙ্গ ও শ্রীম রচিত কথামৃত। দুটো বই থেকেই হাঁদুদা উদ্ধৃতি দিতেন। তবে বলতেন, ‘কথামৃতের জন্য কোনও মানে বইয়ের প্রয়োজন নেই। হাজার হোক, একজন হেডমাস্টারের লেখা তো, যে পড়বে সে-ই বিনা পরিশ্রমে পাশ করে যাবে।’
আমাদের স্কুলের বেয়ারা গজেনও চুপিচুপি কথামৃত পড়েছিল। তার মুখেই শুনেছি, স্বয়ং ঠাকুর স্বপ্নে এই বই ডিকটেট করেছিলেন এক হেডমাস্টারকে। এই হেডমাস্টার হাওড়া নয়, কলকাতায় থাকতেন। স্কুলের সিনিয়র শঙ্করীপ্রসাদ বসু আমার ভুল ভাঙালেন। বললেন, ‘আমি খোঁজ নিয়েছি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চেয়ে ইনি আঠেরো বছরের ছোট ছিলেন। স্বামীজিরা দশ ভাইবোন আর এঁরা আট ভাইবোন।’
অনেকের ধারণা, যাঁরা পড়াশোনায় তেমন দড় নন, তাঁরাই স্কুল মাস্টার হতেন, পরীক্ষায় কৃতীরা ব্যারিস্টারি কিংবা ডাক্তারির দিকে ঝুঁকতেন। কিন্তু এই মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এফ.এ পরীক্ষায় গণিতের একটি বিভাগে উপস্থিত না থেকেও পঞ্চম হন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সসম্মান বি.এ।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, মহেন্দ্রনাথের কথামৃত রচনায় আগ্রহের পটভূমি কী ? তিনি নিজেই বলেছেন, ছাত্রজীবনে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ তাঁকে মুগ্ধ করে, ‘আমি পাগলের মতো এই বই পড়তাম।’ ওকালতির ব্যাপারে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘ওকালতি করো আর না করো, আইন পড়ো।’ পরবর্তী কালে ডাক্তার ভক্তদের বলতেন, ‘গরিব-দুঃখীদের কেউ দেখবার নেই, কেউ তাদের খবর নেয় না।’
আঠেরো বছর বয়সে সেকালের রীতি অনুসারে মহেন্দ্রনাথের বিবাহ। অর্থাভাবে আইন পরীক্ষায় না বসে, বাবার অফিসে তিনি কিছু দিন চাকরি করেন এবং তার পরেই তাঁর মাস্টার জীবনের শুরু যশোহরের নড়াইল হাই স্কুলে। এ বার একের পর এক কর্মস্থান পরিবর্তন। জীবনীকারেরা তালিকা দিয়েছেন— কলকাতায় সিটি ও রিপন কলেজিয়েট স্কুল, মেট্রোপলিটন, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, এরিয়ান, মডেল প্রভৃতি স্কুলের তিনি হেডমাস্টার। এক সময়ে তিনি কলেজে ইংরেজি, ইতিহাস, অর্থনীতি পড়িয়েছেন।
অনেকের প্রশ্ন, যখন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শন, তখন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত কী করতেন? উত্তর— তখন তিনি শ্যামবাজার মেট্রোপলিটন শাখা বিদ্যালয়ের প্রধান। তাঁর ছাত্ররা শ্রীরামকৃষ্ণের বাঘা বাঘা শিষ্য— স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সুবোধানন্দ। শুরুতেই স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ‘মাস্টার’ নামে ডাকতেন।
রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ এক মানসিক দুর্যোগের সময়ে, তারিখটা ভক্তজনেরা আজও ভোলেন না— ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২, রবিবার দক্ষিণেশ্বরে। এই ঠাকুরই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। গান গাইতে বলায় উৎসাহ না দেখানোয় শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত মন্তব্য, ‘ও স্কুলে দাঁত বার করবে আর এখানে গান গাইতেই যত লজ্জা।’
নিজে মাস্টার হয়ে তিনিই তো পিতৃবিয়োগ ও অন্নকষ্টে কাতর নরেন্দ্রনাথকে মেট্রোপলিটন স্কুলে মাস্টারি জোগাড় করে দেন। গোপনে নরেন্দ্রনাথের জননীকে তিনি অর্থসাহায্য করতেন। তাঁর জীবনীকার স্বামীজির চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন— ‘মাস্টারমহাশয়, আমি এখন ভিক্ষা করিয়া খাইতেছি। আমাকে কিছু ভিক্ষা দিবেন?’
মহেন্দ্র জীবনীকারেরা বলেছেন, সেই সময়ে কৃতী শিক্ষকেরা একই সঙ্গে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাস্টারি করতেন। ১৮৭৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত নানা স্থানে শিক্ষকতা করে শেষ পর্বে তিনি নকড়ি ঘোষের কাছ থেকে ঝামাপুকুরের মর্টন ইনস্টিটিউট ক্রয় করেন। এই স্কুলই কিছু দিন পরে ৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর উপাধি তখন রেক্টর।
ঠাকুরের প্রথম দর্শনলাভের পরে অর্ধশতাব্দী বেঁচে থেকে, ১৯৩২ সালের ৪ জুন কলকাতায় তাঁর দেহাবশেষ। তার পূর্বরাত্রে ন’টার সময়ে পঞ্চমভাগ ‘কথামৃত’র প্রুফ দেখা শেষ হয়, এ কথা আজও ভক্তজনের মুখে মুখে।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের দেহাবসানের পর দুর্গাপদ মিত্র ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার পরপর চার সংখ্যায় লেখক মহেন্দ্রনাথের অনেক খবর লিপিবদ্ধ করেন। ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ১৮৮৬-র অগস্ট মাসে আর মহেন্দ্রনাথের সাহিত্যযাত্রার সময় ১৮৯৭ থেকে ১৯৩২— অর্থাৎ ৩৫ বছর। দুর্গাপদ মিত্র জানাচ্ছেন, যখন তিনি দক্ষিণেশ্বর সভায় যেতেন, ঠাকুর কখনও কখনও তাঁকে ‘হেডমাস্টার’, ‘সাড়ে তিনটে পাশ’, ‘ইংলিশম্যান’ ইত্যাদি নানা নামে তাঁর পরিচয় দিতেন। কখনও তাঁকে বলতেন, ‘মাস্টার’— ‘মহেন্দর মাস্টার’।
দুর্গাপদ মিত্রের মন্তব্য, ‘বাহ্য দৃষ্টিতে মহেন্দ্রনাথ গৃহী বটে, কিন্তু জীবনযাত্রা নির্বাহের ধরন-ধারণে তিনি প্রচ্ছন্ন সন্ন্যাসী ভিন্ন কিছুই নহেন।’
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬-র অগস্ট পর্যন্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সুযোগ ও সময় পেলে ঠাকুরের সঙ্গ করতে লাগলেন। এই সময়ে শ্যামবাজার স্কুলের এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হওয়ায় মালিক বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর অস্বস্তিকর বাক্য বিনিময় হয়।
বিদ্যাসাগর, মহেন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথের চাকুরি জীবনের বিপর্যয় নিয়ে আজও যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। আমরা জানি, বিদ্যাসাগর নিজেই এক সময়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। এক সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তেমন প্রয়োজন হলে স্বপাক ভিক্ষা-অন্ন ফুটিয়ে নিয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি করব।’
পরবর্তী পর্যায়ে মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত হলেন বিদ্যাসাগরের বিশ্বস্ত হেডমাস্টার। পিতৃহীন নরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন চাকরির সন্ধানে বারবার বিড়ম্বিত হচ্ছেন, তখন মহেন্দ্রনাথই তাঁকে বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন শাখার চাকরি জোগাড় করে দেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের জামাতা (ওই স্কুলের সেক্রেটারি) বাদ সাধলেন। তিনি ছেলেদের দিয়ে পিটিশন করালেন, নতুন হেডমাস্টার পড়াতে পারেন না। সেই সব কাগজপত্র বিদ্যাসাগরের কাছে যাওয়া মাত্র বিদ্যাসাগর ডেকে পাঠালেন মহেন্দ্রনাথকে। বললেন, ‘তুমি নরেন্দ্রকে বলো, আর না আসে।’ বুকে সাহস বেঁধে নরেন্দ্রনাথকে
তা বলতে হল। নরেন্দ্রর দিক
থেকে কিন্তু কোনও প্রতিবাদ নেই। সে শুধু বলল, ‘কেন ছেলেরা একথা বললে? আমি তো খুব খেটেখুটে পড়াতুম।’
পরবর্তী সময়ে মহেন্দ্রনাথও কোপানলে পড়লেন বিদ্যাসাগরের। স্কুলের আশানুরূপ ফল না হওয়ার পিছনে রয়েছে হেডমাস্টারের সর্বদা কাশীপুর যাতায়াত। ঠাকুরের উপরে অকারণে আক্ষেপ আসায়, পদত্যাগ করলেন বিরক্ত মহেন্দ্রনাথ। ছুটলেন ঠাকুরের কাছে। তিনি সব শুনে বললেন, ‘বেশ করেছো, বেশ করেছো, বেশ করেছো।’
কিন্তু সংসার চলবে কী করে? কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর অর্থাভাব চরমে উঠল। কী খেতে দেবেন ছেলেপুলেদের? সৌভাগ্যক্রমে একটা সুযোগ জুটে গেল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদ্য স্থাপিত রিপন কলেজে। এই প্রসঙ্গেই আমরা জানতে পারি, ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় শ্রীম মনে করতেন, ‘চাকরি অপেক্ষা ব্যবসা ভালো’। ঠাকুর নাকি তাঁর প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে (রাখাল মহারাজ) বলেছিলেন, ‘বরং শুনবো তুই গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিস, তবু পরের চাকরি করছিস যেন না শুনি।’
ঠাকুরের পছন্দ-অপছন্দ সম্বন্ধে বেশ কিছু মূল্যবান খবর দিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ—
ক) ঠকবি না
খ) ঠাকুরের প্রথম বিশেষ লক্ষ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
গ) অপব্যয় নয়, লক্ষ্মীছাড়ার চেয়ে কৃপণ হওয়া ভালো
ঘ) ঠাকুরের বিশেষ অপছন্দ, ছেঁড়া কাপড় কিংবা ময়লা কাপড় পরা
ঙ) এলোমেলো ভাব নয়, যেখানকার জিনিস সেখানে রাখা
চ) নিজের রান্না নিজে
করা, ‘নিজের দুটি চাল নিজে
ফুটিয়ে নেবে।’
ডায়েরির সংক্ষিপ্ত স্কেচ থেকে বহু সময়ের ব্যবধানে মাস্টার মহেন্দ্রনাথ কী ভাবে কথামৃত রচনা করতেন, তার বিবরণও রয়েছে। ‘শ্রীম-র মানসপটে চিত্রিত রয়েছে ঠাকুর রামকৃষ্ণের চিত্রাবলী। আত্ম-ডায়েরিতে রয়েছে সেই চিত্রাবলীর স্কেচ। সেই দিনলিপি খুলে শ্রীম সম্মুখে রাখেন এবং ধ্যানমগ্ন থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।’
সামান্য কয়েকটি স্কেচ থেকে তিনি কী করে বিস্ময়কর কথামৃত রচনা করলেন, তার উত্তরে স্বামী বীরেশ্বরানন্দকে শ্রীম বলেছিলেন, ‘লোকে দেখে ত্রিশ বছরের ঘটনা, কিন্তু আমি দেখছি আমার চোখের সামনে ঘটছে এইক্ষণে।’
গবেষক স্বামী প্রভানন্দ (বরুণ মহারাজ) জানিয়েছেন, কথামৃতের শতকরা আশি ভাগ রচনা শ্রীম শেষ করেছিলেন ১৮৯৭ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে। তখন তাঁর বয়স ৪৪ থেকে ৫৬।
১৮৯৮ থেকেই বাংলায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে, কিন্তু ‘কথামৃত’ শব্দটি প্রথমে ছিল না। তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায় নাম ছিল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত’। পরে নাম হল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপরমহংসের কথা’। ১৮৯৯ থেকে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতম্’।
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় শোনা যায়, খ্যাতনামা প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এই বই রিজেক্ট করেন। শোনা যায়, ‘বসুমতী’ আদিতে বুঝতে পারেনি, তাই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। ব্যাপারটা শাপে বর হল। মহেন্দ্রনাথ নিজেই প্রকাশকের ভূমিকায় নামলেন। ‘বসুমতী’র উপেনবাবু পরামর্শ দিলেন— কাগজ ভাল হবে, ছাপা সুন্দর হবে, গেটআপ আকর্ষণীয় হবে আর দাম বেশি হবে। দাম বেশি রাখার উপদেশটি মহেন্দ্রনাথ গ্রহণ করেননি এবং তাঁর পরিবার দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে বইটির বিস্ময়কর বিপণন করেছিল।
বলে রাখা ভাল, বাংলায় ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৫, তৃতীয় ভাগ ১৯০৮, চতুর্থ খণ্ড ১৯১০ এবং শেষ খণ্ড মাস্টারমশায়ের মৃত্যুর পরে (১৯৩২)।
ঠাকুরের মহাসমাধির দু’বছর পরে রথযাত্রার পরের দিন (১১ জুলাই ১৮৮৮) নীলাম্বরবাবুর ভাড়াবাড়িতে মহেন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডুলিপির একাংশ শুনিয়েছিলেন জননী সারদামণিকে।
আরও কিছু মজার খবর আছে। একটি ছোট পুস্তিকা প্রথম প্রকাশিত হয়— ‘সাধু মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের নিকট হইতে উপাদান সংগ্রহ করে সচ্চিদানন্দ গীতরত্ন দ্বারা প্রকাশিত’। এই দু’জনই যে ছদ্মনামে স্বয়ং মহেন্দ্রনাথ, তা এখন সন্দেহাতীত। এই পুস্তিকা পড়েই স্বামী বিবেকানন্দ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ লিখে পাঠান, ‘মাস্টারমশায়, আপনাকে লক্ষ লক্ষ ধন্যবাদ।’
অদ্ভুত ত্যাগের জীবন আমাদের মাস্টারমশায়ের। তিনটি স্কুলের তিনটি উপার্জন যেত তিন জায়গায়— একটি বরাহনগর মঠে সংসারত্যাগী গুরুভাইদের সেবায়, আর একটি সারদাদেবী ও সন্ন্যাসীদের সেবায় এবং তৃতীয় মাইনে থেকে চলত নিজের সংসার।
বইয়ের অসম্পূর্ণতা ধরলে আছে কিছু। ঠাকুরের শেষ কয়েক মাসের কোনও বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়নি প্রকাশিত পাঁচ খণ্ডে। ভক্তদের ধারণা, আরও কয়েক খণ্ড কথামৃত লেখার উপাদান শ্রীম-র কাছে ছিল— কেউ বলেন আরও দু’খণ্ড, কেউ বলেন আরও পাঁচ খণ্ড। চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকায় শ্রীম লিখেছিলেন, শ্রীশ্রীকথামৃত ছয়-সাত খণ্ডে সমাপ্ত হইলে শ্রীমুখ-কথিত চরিত্রামৃত অবলম্বন করিয়া একটি জীবনী লিখিবার উপকরণ পাওয়া যাইবে।
আরও হিসেব হয়েছে। ঠাকুরের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের ৭১টি সাক্ষাৎকার দক্ষিণেশ্বরে, ২৫৫ জন ভক্ত ও আগন্তুকের নাম উল্লেখ আছে মহেন্দ্রনাথের সুবিশাল রচনায়।
পরবর্তী কালে ডা. জলধিকুমার সরকার যে ‘মহানির্দেশিকা’ সংকলন করেন, তার প্রাথমিক তথ্য লিপিবদ্ধ করতেই ২৮,০০০ কার্ড প্রয়োজন হয়েছিল।
ঠাকুরের বাণী বিশ্বপ্রচারের জন্য লিখতে বসেননি মহেন্দ্রনাথ, তিনি নিজেই একবার কৌতূহলী গিরিশচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন, ‘আমি নিজের জন্য লিখছি,
অন্যের জন্য নয়, আমার দেহ
যাবার সময় পাবে।’
আরও হাজার কাহিনি এই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতকে কেন্দ্র করে। একটি হল, কলকাতার ট্রামে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়া। যেমন বহু বছর আগে হারিয়েছিল চৈতন্যচরিতামৃত এবং বিলেতে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। আমাদের সৌভাগ্য, তিনটি পাণ্ডুলিপিই
খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল
যথাসময়ে।
অপরের মঙ্গল নিয়ে সদাবিব্রত মহেন্দ্রনাথ যে নিজের পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাননি, তার দীর্ঘ হৃদয়স্পর্শী বিবরণ রয়েছে তাঁর শিষ্য নিত্যানন্দের ১৬ খণ্ডের ‘শ্রীমদর্শন’-এ। প্রথম ছেলে নির্মলের অকালমৃত্যুর সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের আশ্রয় মহেন্দ্রনাথের কাজে লেগেছিল। ‘তৃতীয় পুত্র চারু বয়ে গিয়েছিল।’ আদরের কন্যা হাঁদুর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি, তাঁর অকালমৃত্যু ২২-২৩ বছরে। চিরকুমার কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে পিতার সম্পর্ক এক আশ্চর্য বেদনাদায়ক কাহিনি। সে রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় ও জুয়াখেলায় আকৃষ্ট। এই পুত্রকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করলেন দ্বিধাহীন মহেন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে সেই পুত্র ‘আশ্রয়হীন ও অন্নবস্ত্রহীন হইয়া খুবই দুর্দশায় পতিত হইলেন।’ এই বিতাড়িত পুত্র পরে বাবাকে একটি চিঠি লেখেন— ‘বাবা, আমি অনাহারে মৃতপ্রায়। আমায় কিছু অর্থ দিন।’
টাকা কিছু দেবেন, কিন্তু পুত্রকে ঘোড়দৌড়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। পুত্র সেই চিঠি পড়লেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ গ্রহণ করলেন না। অনাহারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও নিজের বাবাকে প্রবঞ্চিত তিনি করতে চাইলেন না। এই পিতা-পুত্র কাহিনি চণ্ডীগড় থেকে প্রকাশিত ১৬-খণ্ড শ্রীমদর্শন-এর অনন্য কাহিনি, মানুষ মহেন্দ্রনাথ এখানে নতুন ভাবে উদ্ভাসিত। স্নেহে অন্ধ হয়েও আমাদের শ্রীম নিজের নিয়মকানুন বিন্দুমাত্র শিথিল করেননি। এই বিপথগামী পুত্রকে আমরা আবার দেখি ১৯৩২ সালে কলকাতায়। পিতার দাহকার্যের সময়ে।
কথামৃতের খবরাখবর দিয়েই এই সামান্য রচনা শেষ করা প্রয়োজন। উদ্বোধন প্রেসে ছাপা হলেও বিজ্ঞাপনে লেখা হত, ‘গুরুপ্রসাদ চৌধুরীর গলিতে শ্রীপ্রভাসচন্দ্র গুপ্তের নিকট প্রাপ্তব্য’। সমকালের নানা নিন্দা সমালোচনা মাস্টারমশায় মহেন্দ্রনাথকে সহ্য করতে হয়েছে। সেও মস্ত এক কাহিনি।
ভক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিচিত্র জীবনকথা আজ দেশে দেশে প্রচারিত। কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’, সে সম্বন্ধে কোথাও দ্বিমত নেই। এ দেশের প্রকাশনার ইতিহাসে এমন বই আর দ্বিতীয় নেই, তা সবাই এখন নতমস্তকে মেনে নেন। শেষে মহেন্দ্রনাথের নিজস্ব মন্তব্যটিই শেষ কথা। তিনি ১৯১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে একজন পাঠককে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের কাজ ঠাকুরই করেছেন। তিনি মেধারূপে, ইচ্ছাশক্তিরূপে আমার ভিতরে আবির্ভূত হয়ে লিখিয়েছেন। তিনিই কর্তা ও কারয়িতা। আমরা বুঝি আর না বুঝি।’
তথ্যসূত্র :
অমৃতকথাকার শ্রীম — শংকর,
শ্রীম সমীপে— স্বামী চেতনানন্দ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy