এক প্রেমিকের মৃত্যু হয় ওঁর সঙ্গেই। কিন্তু অন্যরা? কেমন আছেন তাঁরা?
শৈশবের অ্যালথ্রপ। হাইড পার্কের স্মারক-ঝরনা। রাজপরিবার। ব্রিটেনের মানুষজন। কোথায় কী ভাবে বেঁচে ওঁর স্মৃতি? নাকি তাঁর জনপ্রিয়তার সিংহভাগ এখন কেট মিডলটনের দখলে?
গত উনিশ বছরে প্রকাশিত তাঁকে নিয়ে গুচ্ছ বই। একটি সিনেমাও। তার মাঝেই রাজকুমারীর মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ!
তিনি প্রিন্সেস ডায়ানা।
এখন অ্যালথ্রপ
অ্যালথ্রপ। প্রিন্সেস ডায়ানার শৈশবের বাড়ি। সামনের মাঠে ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। পর্যটকদের।
লন্ডন থেকে সত্তর মাইল দূরে ঠিক উনিশ বছর আগে এই বাড়িতেই রাজকুমারীর মরদেহ নিয়ে এসেছিলেন ওঁর ভাই আর্ল স্পেনসার। আর্ল-পরিবার এখন এ বাড়িতেই থাকেন। ওঁর বাচ্চারা। স্ত্রী। সবাই।
একটু দূরেই সেই হ্রদটা। যার মধ্যিখানে ছোট্ট দ্বীপে ডায়ানা চিরনিদ্রায় শুয়ে।
গোটা এলাকাটা শান্ত। নিশ্চুপ। জনা দশেক পর্যটক। সবাই-ই পঞ্চাশের ওপরে। সমাধির আশেপাশে কিছু মালা, ফুল।
এ বাড়ির পেন্টিং-এর সংগ্রহ দেখার মতো। সিঁড়িতে ঝোলানো ডায়ানার বিশাল পোর্টেট। তার পাশে পরিবারের অন্যান্য সব বিখ্যাত মানুষ।
‘‘আশেপাশে কোথাও যেতে চাইলে এই জায়গাটাই আমার সবচেয়ে পছন্দের,’’ বলছিলেন লিন্ডা ব্ল্যাক। জর্জিয়া থেকে লিন্ডা এসেছেন বন্ধু মেরি ফিটজপ্যাকট্রিক একেনকে নিয়ে। মেরি থাকেন দক্ষিণ ক্যারোলিনায়। লিন্ডা বললেন, ‘‘দিনটা আজও আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে। টানা দু’দিন শুধু কেঁদে গিয়েছিলাম।’’
ডায়ানার বাড়ি দেখতে এসে হঠাৎ করেই আর্ল স্পেনসারকে পেয়ে গিয়েছিলেন লিন্ডা। উদ্বেলিত হয়ে ওঁর সঙ্গে ছবিও তুলেছেন।
হ্রদের ধারে বেঞ্চের ওপর বসেছিলেন অ্যান্ডি স্মিথ। বয়স আটষট্টি। নটিংহাম থেকে এসেছেন স্ত্রী মার্গারেটকে নিয়ে। স্মিথ পরিস্কার বললেন, রাজ-পরিবার নিয়ে উনি বিশেষ কিছু জানেন না। মার্গারেট অবশ্য ডায়ানার খুব ভক্ত। এটাই ওঁদের প্রথমবার এখানে আসা। যদিও থাকেন মাত্র পনেরো মাইল দূরে। বললেন, ‘‘আমাদের ভবিষ্যতের রাজার চিরকালই মা হিসেবেই থেকে যাবেন উনি। রাজ-উপাধি ওঁর কাছ থেকে যতই কেড়ে নেওয়া হোক।’’
মিডল্যান্ডের বাসিন্দা বাহান্ন বছরের কিম তাঁর স্বামী তিপ্পান্ন বছরের অ্যান্ডিকে নিয়ে এসেছেন তাঁর জন্মদিন পালনের জন্য। কিম বলছিলেন, ‘‘প্রিন্সেস ডায়ানা রাজ-পরিবার আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সেতুর কাজ করতেন। প্রিন্স উইলিয়াম অনেকটা ওঁর মায়ের মতো।’’
কফিনের ফুলে সেই শব্দটা
হাইড পার্কের ডায়ানা
হাইড পার্ক। ডায়ানা মেমোরিয়াল ফাউন্টেন। ২০০৪ সালে এটি উদ্বোধন করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। অ্যালথ্রপের সেই নিঝুম, নিরালা ভাবটা এখানে নেই। ঠান্ডা জলে ঝাপটাঝাপটি করে খেলে বেড়াচ্ছে বছর চারেকের মেয়ে সুরি। সুরির দেশ পর্তুগাল।
রোদ ঝলমলে অগস্টের সকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। এমনই দুর্দান্ত একটা আবহাওয়া যে, কেউই বোধ হয় আর ঘরে বসে নেই। দলে দলে হাইড পার্কে এসেছে সবাই। কেউ জগিং করছে। কেউ খেলে বেড়াচ্ছে। পিকনিক হচ্ছে কোথাও।
জল ছেড়ে উঠে পিকনিক এলাকাটায় দাঁড়িয়ে স্যান্ড্উইচ-এ কুটুস করে একটা কামড় বসিয়ে সুরি বলল, ‘‘এটা কি স্যতিই প্রিন্সেস-এর ঝরনা?’’
সুরির মা সোফিয়া। ওর সঙ্গেই ছিলেন। বললেন, ‘‘সত্যি করেই উনি ছিলেন ‘প্রিন্সেস অব দ্য পিপল’। রাজপরিবারের অন্য কেউ ওঁর মতো পর্তুগিজদের এত ভাল বাসেননি।’’
সোফিয়ার পাশেই দাঁড়িয়ে সাতোকো। জাপানি। দু’বছরের ছেলে কোশিকে নিয়ে এসেছেন তিনি।—‘‘এখানে প্যাডলিং করতে আমাদের দারুণ লাগে। ঠান্ডা জল। বেশি গভীরও না,’’ বলছিলেন সাতোকো, ‘‘জাপানে গেলে দেখবেন, লোকজন ইংরেজ রাজপরিবারকে কী ভালবাসে! ডায়ানা সেখানে অসম্ভব উষ্ণ এক স্মৃতি।’’
হত্যার অভিযোগ
মৃত্যুর কুড়ি বছর চলে এল বলে! অথচ ডায়ানার জীবনকাহিনি মানেই আজও বিশাল বাণিজ্য আর কাঁড়ি কাঁড়ি মুনাফা।
এই ক’বছরে ডায়ানাকে নিয়ে ব্রিটেনে যা বইপত্তর বেরিয়েছে, তার লেখক-লেখিকার তালিকাটি বেশ অদ্ভুত! কে নেই! রাজপরিবারের জীবনীকার, সাংবাদিক, প্রাক্তন সব কর্মী, এমনকী পরিচারকরাও।
‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর প্রাক্তন সম্পাদক টিনা ব্রাউন-এর লেখা বই ‘দ্য ডায়ানা ক্রনিকলস’ বেরিয়েছে ২০০৭-এ। ২০১৪-য় ডন মর্গান-এর বইটির নাম ‘দে মার্ডার্ড প্রিন্সেস ডায়ানা : দ্য শকিং ট্রুথ’। এই বইটিতে মর্গানের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ— ব্রিটিশ সিকিওরিটি সার্ভিস-ই ডায়ানাকে মেরে ফেলেছে।
এঁরা ছাড়াও ডায়ানাকে নিয়ে আর যে সব বইপত্তর বেরিয়েছে সেগুলি হল— রাজকুমারীর এক নিরাপত্তা-কর্মী ইন্সপেক্টর কেন হোয়ার্ফ-এর ‘ডায়না : ক্লোজলি গার্ডেড সিক্রেট’, ওঁর দেহরক্ষী ট্রেভর রিজ-জোন্সের ‘দ্য বডিগার্ড স্টোরি’, ওঁর পরিচারক পল বারেল-এর ‘আ রয়্যাল ডিউটি’। কিন্তু এগুলির কোনওটির মধ্যেই নতুন যে কিছু আছে, তা নয়।
বরং একটি বইয়ের কথা বলা যাক। এই তালিকার একমাত্র দুনিয়া-কাঁপানো বই। অ্যান্ড্রু মর্টন-এর ‘ডায়ানা : হার ট্রু স্টোরি-ইন হার ওন ওয়ার্ডস’। বলতে গেলে, গোটা বইটি ডায়ানার বলে যাওয়া কথা দিয়ে সাজানো। যেখানে প্রথম বারের মতো রাজপ্রাসাদে ডায়নার একা হয়ে পড়া থেকে তাঁর ‘বুলিমিয়া’ (পেট পুরে খেয়ে বমি করে দেওয়া) নিয়ে নানা রকম কাহিনিতে ঠাসা।
এই প্রসঙ্গেই বিবিসি প্যানোরামা ইন্টারভিউর কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তাঁর দিকে ঘন কাজল-আঁকা চোখে চেয়ে যুবরানি ডায়না। হঠাৎ যুবরানি বলে দিলেন, ‘‘আমাদের বিয়েতে দু’জন নয়, আসলে তিনজন ছিল।’’
এক কথায় যুবরাজ চার্লসকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে পরকীয়ার অভিযোগ! ওঁদের যে দিন ডিভোর্স হয়, কুচকুচে কালো পোশাক পরেছিলেন ডায়ানা। আর তার সব কাজকম্ম শেষে সেখান থেকে তিনি চলে যান হাইড পার্কের সার্পেনটাইন গ্যালারিতে। একটা প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে। এই ঘটনার পর ডায়ানার প্রেমিকদের খবর যেন আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
হাইড পার্ক
প্রেম নিয়ে প্রকাশ্যে নিশ্চুপ গিলবি
জেমস গিলবি। এক জন প্রপার্টি-কনসাল্ট্যান্ট। তাঁর প্রেমেও পড়েন রাজকুমারী। ওঁর প্রেমিকদের চোখধাঁধানো তালিকায় গিলবি ততটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সারিতে জায়গা না পেলেও, প্রেম তো!
যদিও আজ পর্যন্ত গিলবি এ নিয়ে মিডিয়াকে কোনও সাক্ষাৎকার দেননি। কোনও ‘পাবলিসিটি’ তিনি চাননি।
গিলবি বিয়ে করেছেন ২০১৪-য়। লাভিনিয়া হাডসলে-চ্যাপলিনকে।
ডায়ানা-গিলবি প্রেম নিয়ে এক সময় কিন্তু ধুন্ধুমার বেঁধে যায় ব্রিটেনে।
কান্নাভেজা গলায় সেই ফোনালাপে শোনা যায় ডায়না অভিযোগ করছেন, চার্লস ‘‘আমার জীবনটাকে সত্যি সত্যি করে অত্যাচারে ভরিয়ে দিয়েছিল।’’
১৯৮৯-এর ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’-এ ডায়ানার সেই ফোনের আলাপ শুনে ফেলে ব্রিটেনের ‘গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেড কোয়ার্টার্স’। অভিযাগ, এরাই নাকি ডায়ানাকে হেয় করার জন্য ব্যাপারটি ফাঁস করে দেয় ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সির কাছে।
পুরো ঘটনাটি বা কেলেঙ্কারি, যাই-ই বলুন, আজও ‘স্কুইজি টেপস্’ (squidgy tapes) নামে পরিচিত।
প্রেমিক হিউইট নাকি দেউলিয়া
মেজর জেমস হিউইট। ছিলেন পদাতিক বাহিনীর আধিকারিক। তিনিও টানা পাঁচ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ডায়ানার সঙ্গে।
সদ্য ভদ্রলোকের ছবি ছেপেছে একটি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড। হিউইট এখন মাঝবয়েসের প্রৌঢ়। চুলে পাক ধরেছে। মাথার সামনের দিকটায় টাক। বয়স আটান্ন। শোনা যায়, তিনি নাকি প্রায় দেউলিয়া। থাকেন মায়ের সঙ্গে। এক্সেটর-এ।
ওঁর সঙ্গে ডায়ানার দেখা ১৯৮৬-তে। ওই সময় ডায়ানাকে ঘোড়ায় চড়া শেখানোর জন্য নিয়ে আসা হয় ওই মেজরকে। তাতেই প্রেমের শুরু। ’৯২ সাল অবধি সম্পর্কটি চলতেও থাকে। কিন্তু শোনা যায়, প্রেমের পাশাপাশি এই সম্পর্ক থেকে মেজর এক ধরনের ফায়দা তোলার চেষ্টায় ছিলেন। হিউইট ওঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘিরে নানা ধরনের খবর দিতে থাকেন পাপারাৎজিদের। শেষের দিকে ডায়ানার পাঠানো চিঠিপত্র, কার্ড পর্যন্ত বেচে দেওয়ারও চেষ্টা করেন তিনি। এমনকী পাঁচ বছর বয়েসে প্রিন্স উইলিয়ামের হাতের লেখা দুটো নোটস, সেটাও ছিল তাঁর বিক্রি করে দেওয়ার তালিকায়।
ডায়ানার এরকমই একটা চিঠি, ১৯৮৮-র মার্চে লেখা—‘‘প্রিয়তম জেমস, কিছুক্ষণ আগে তুমি চলে গেলে। আর এখন আমার এখানে সব কেমন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা শ্যাম্পেনের বোতলও আছে! তোমার সঙ্গে দেখা করাটা যে কী ভাল ছিল!’’
অ্যালথ্রপের সমাধি তীরে
কেমন আছেন প্রেমিক হাসনাত
হাসনাত খান। এক পাকিস্তানি ডাক্তার। ডায়ানা তাঁরও প্রেমে পড়েন। হাসনাতকে ডায়ানা ডাকতেন ‘মিস্টার ওয়ান্ডারফুল’।
সম্পর্কটা এতটাই গভীরে গ়ড়িয়ে যায় যে, নিজের গাড়ির ‘ডিকি’-তে লুকিয়ে এক বার ডায়না তাঁর ডাক্তার-প্রেমিককে কেনসিংটন প্রাসাদে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানে গিয়ে খানের বাবা-মা’র সঙ্গেও দেখাও করেন ডায়ানা। ঠিক করেন ওঁকেই তিনি বিয়ে করবেন। এ নিয়ে ডায়ানা ওঁর বন্ধু জেমিমা খানের কাছে পরামর্শও চান। জেমিমা তখন প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানের স্ত্রী। ওঁদের সম্পর্কটা টিকেছিল দু’বছর মাত্র। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭। এর পর হাসনাত খানই সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তখনই ডায়ানা আবার করে প্রেমে পড়েন ডোডি ফায়েদের। পৃথিবী বিখ্যাত ‘আপ মার্কেট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ হ্যারডস-এর মালিক মহম্মদ আল ফায়েদের ছেলে।
এই ঘটনাটি নিয়ে পরে কেট স্নেল একটি বই লেখেন। নাম, ‘ডায়ানা, হার লাস্ট লাভ’। তাতে স্নেল বলেছেন, হাসনাতের মনে ঈর্ষা জাগাতেই নাকি প্রথম দিকে ডোডির দিকে ঝোঁকেন ডায়ানা। এই বইয়ের কাহিনি নিয়ে ২০১৩-য় একটি সিনেমাও হয়ে গেছে— ‘ডায়ানা’। যাতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন নাওমি ওয়াটস আর নভি অ্যান্ড্রুজ।
হাসনাত অবশ্য ঘটনাটিকে পুরো অনুমান আর গালগল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে তিনি এসেক্স-এর বেসিলডন ইউনিভার্সিটি-তে কাজ করছেন। আজও বলে যান, ডায়ানার মৃত্যুকে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। ইথিয়োপিয়ায় একটি চ্যারিটি হাসপাতাল তৈরি করেছেন হাসনাত। সেটিও নাকি প্রিন্সেস ডায়ানারই অনুপ্রেরণাতে।
ট্যাবলয়েডে হাসনাত-ডায়ানার অসংখ্য ছবি বেরিয়েছে একটা সময়। হাসনাত তখন সুদর্শন যুবক। এখন স্থূল প্রৌঢ়। বয়স সাতান্ন। ২০০৬ সালে বিয়েও করেন। ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’। বছর দেড়েক পর বিয়ে ভেঙে যায়। ওঁর একমাত্র কাজ এখন সেবামূলক কাজকম্ম আর হাসপাতাল।
বিয়ে করেছেন ডোডির বাবা
ডোডির সঙ্গে ডায়ানার সম্পর্কটি গোড়া থেকেই রাজকুমারীকে খড়বড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। সে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পাপারাৎজিদের তাড়া। সেই ৩০ অগস্টের ভয়ঙ্কর রাত। সবার চোখ এড়িয়ে রিৎজ্ হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে গিয়েও ওঁদের শেষ হয়ে যাওয়া!
ছেলে ডোডি নেই। কিন্তু বাবা আছেন। আল ফায়েদ। এখন ছিয়াশি কী সাতাশি। কিন্তু এই বয়েসেও নিয়মিত জাহাজে পাড়ি দেন। প্যারিসের রিৎজ হোটেলের মালিকও এখন তিনি। স্কটল্যান্ডে তাঁর সম্পত্তিও বহাল আছে। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছেন। ১৯৮৫-তে। পাত্রী ফিনিশ-সমাজতন্ত্রী হেইনি ওয়েদেন। তাঁর এই পক্ষের চার সন্তান। তবে ‘হ্যারডস’-এর হাতবদল হয়ে গেছে ২০১০-এ। আল ফায়েদ ওটি বেচে দিয়েছেন কাতারি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি-কে।
একটি ফুটবল ক্লাবও ছিল আল-এর। ফুলহাম ফুটবল ক্লাব। ২০১৩-য় সেটিও বেচেছেন। ক্লাবটির নতুন মালিক এখন শায়েদ খান।
মুখ খুলেছেন প্রিন্স হ্যারি
আজ, এই মুহূর্তে ডায়ানা-পরম্পরার কী পড়ে রয়েছে এই টেমস নদীর পারে?
আর্ল কথা রাখেননি। ডায়ানার ভাই আর্ল স্পেনসার। ডায়ানার অন্ত্যেষ্টির দিন, নাটকীয় ভাবে যিনি ঘোষণা করেছিলেন, মা-হারা দুই রাজপুত্রর দায়িত্ব এ বার থেকে ওঁর এবং ওঁর পরিবারের।
সে দায়িত্ব ওঁরা নেননি। ডায়ানা-পুত্ররা বড় হয়েছেন রাজপ্রাসাদেই। ওদের বাবার কাছে থেকে।
ওদের দাদু দুই ভাইয়ের স্কুলবেলায় যেমন-যা দরকার, পাশে থেকেছেন।
যুবরাজ চার্লস বিয়ে করেছেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা কেমিলা পার্কার বোলস্কে। বোল্স ‘ডাচেস অব কর্নওয়াল’ হয়ে রাজপরিবারে পা রেখেছেন ২০০৫-এর এপ্রিলে।
প্রিন্স উইলিয়ামের ওপর একটি জীবনীমূলক বই লিখেছেন পেনি জুনর নামে এক সাহিত্যিক। বইটির নাম ‘বর্ন টু বি কিঙ্গ’। সেখানে লেখিকা দেখিয়েছেন, ডায়ানার মৃত্যুর পর এই দুনিয়ায় কত কিছুর মুখোমুখি হতে হতে বড় হয়েছেন রাজপুত্র উইলিয়াম।
স্যান্ডি হেনি বলে একজনের কথা বলেছেন জুনর। যিনি ছিলেন প্রিন্স অব ওয়েল্স-এর প্রেস-সেক্রেটারি। এই স্যান্ডি, ডায়ানার মৃত্যুর পর এক অদ্ভুত দায়িত্ব সামলেছিলেন। মা-হারা দুই কিশোরকে তিনি শিখিয়েছিলেন মায়ের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার সময় কী ভাবে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হবে।
জুনর লিখছেন, ‘‘ওর বয়সটা তখন পনেরো বছর। এই বয়সকালটা বেশ গোলমেলে। ঠিক কিশোরও নয়, আবার পুরোদস্তুর পরিণত মানুষও তাকে বলা যায় না। স্যান্ডিকে সে কোনও দিন নিজের মনের কথা বলেনি। স্যান্ডি কোনও দিন জলও দেখেনি রাজপুত্রের চোখে। কষ্টকে সে যেন সব সময় বুকে চেপে রেখে বেড়াত। অতটুকু জীবনেই এমন অনেক কিছু সে চেপে রাখতে পেরেছে। উইলিয়ামের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আবেগকে লুকিয়ে ফেলার। অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ ওঁর নিজের ওপর।’’
উইলিয়ামের ভাই প্রিন্স হ্যারি অবশ্য সদ্য ওর মাকে নিয়ে মুখ খুলেছে। তিন বছর হল, সে বলতে শুরু করেছে ওঁর মায়ের মুত্যু কী ভাবে ওকে কষ্টের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ষোলোটা বছর ব্যাপারটা পুরোপুরি চেপে রাখার পর এই প্রথম বার আক্ষেপ শোনা গেছে ওর মুখে।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে একটি সভায় হ্যারি বলেছে, ‘‘কষ্ট পাচ্ছেন, বলতে পারলে ঠিক আছে। যতক্ষণ আপনি কষ্টটা নিয়ে কথা বলছেন, সেটা কিন্তু আপনার দুর্বলতা নয়। দুর্বলতা হল সেটাই, যখন সমস্যা আছে, কিন্তু আপনি তাকে স্বীকার করছেন না, তার সমাধানও করছেন না।’’
ডায়ানা বনাম কেট এবং পাপারাৎজি
প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে কেট মিডলটন-এর বিয়ে নিয়ে রাজপরিবারে বিরাট উচ্ছ্বাস দেখা গেল।
কারণটা আর কিছুই নয়, ঘটনাটি যেহেতু পরিবারের পরের প্রজন্মকে ফোকাসে এনে দিল, তাই এত উল্লাস।
কেট-এর আঙুলে ডায়ানারই ‘বাগদান-আংটি’টি পরিয়ে দেওয়া হল। এই ছোট্ট ঘটনাটি যেন বলে দিল, ডায়ানা না থেকেও ওদের সঙ্গে সব সময় আছেন। থাকবেনও।
প্রিন্স জর্জ আর প্রিন্সেস শার্লট জন্মানোর পর সংবাদমাধ্যমকে দেখা গেল বড় করে খবর করতে।
আর এ বছরই গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে একেবারে প্রচ্ছদে একটি ছবি খুব শোরগোল ফেলে দিল। তাতে দেখা গেল, ড্রেসিং গাউন পরা ছোট্ট প্রিন্স জর্জ উইন্ডসর ক্যাসেল-এ প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে।
কেট মিডলটন, ‘ডাচেস অব কেমব্রিজ’ এখন নতুন স্টাইল আইকন। সংবাদ মাধ্যম এখন লাগাতার ওর পোশাকআশাক খেয়াল করে চলেছে, একটা সময় যে রকমটা করা হত ডায়ানার বেলায়, অতটা না হলেও করছে। ডায়ানাকে ঘিরে আগ্রহর সঙ্গে কেট-এর কোনও তুলনাই হয় না। কেট-এর খ্যাতি যদিও এখনই আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছেছে, কিন্তু ডায়নার জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে যাওয়া এখনও ওঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ডায়ানার মৃত্যুর পর সংবাদমাধ্যমের সেই ‘পাপারাৎজি’ ব্যাপারটি প্রায় নেই। কোনও যে কড়া আইন এসেছে, তা নয়। কিন্তু সব সংবাদ-মাধ্যমের সম্পাদকরা একজোট হয়ে ঠিক করেছেন, ওই পাপারাৎজি-দৌরাত্ম্যের ইতি হোক।
যে জন্য ব্রিটিশ সংবাদপত্র এখন উইলিয়াম, কেট বা তাঁদের বাচ্চাদেরও কোনও অন্তরঙ্গ ছবি ছাপে না। বলা যেতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে যেন যুবরানি ডায়ানা সংবাদমাধ্যমের নিরন্তর ধাওয়া করা থেকে বোধ হয় পুত্রদের রক্ষা করে গেলেন।
সমাধি কাণ্ডে শোরগোল
বোনের ছেলেদের দেখভালের প্রতিশ্রুতি রাখেননি, সে জন্য সমালোচিত আর্ল। তেমন একই ভাবে চূড়ান্ত সমালোচনার শিকার ডায়ানার সমাধি নিয়ে তার এক প্রকার বাণিজ্য করার কথা ঘোষণা করার পর। সমাধি দেখতে যাওয়া পর্যটক পিছু উনি সাড়ে আঠারো পাউন্ড টিকিট ‘এন্ট্রি ফি’ হিসেবে হেঁকেছিলেন।
ডায়ানা নামটি আজ অনাবাসীদের কাছে কী ভাবে কাজ করে, তার একটা নমুনা দেওয়া যাক। কিছু দিন আগে আমেরিকার এক পর্যটক সমাধিটির ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেন। তাতে দেখা যায়, গোটা চত্বরটি বড় বড় ঘাসে ভরে গেছে। স্মারক-পাথরটা শ্যাওলায় ভর্তি। তুমুল হইচই তাতে। টেক্সাসের সেই ভদ্রলোক মিস্টার ম্যাকগ্রাড লিখছেন, ‘আমার মতে এটা কখনই কোনও রাজকুমারীর আস্তানা হতে পারে না।’’
জায়গাটির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, হ্রদটা শ্যাওলায় ভরে গেছে। বাড়ন্ত গাছ, ঝোপেঝাড়ে ছেয়ে আছে দ্বীপটা। দেখে মনে হচ্ছে, যে দিন ডায়ানাকে সমাধিস্থ করা হয়, সে দিনই বোধ হয় শেষ বারের মতো এখানকার গাছপালা ছাঁটা হয়েছিল।’’
‘দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস’ ব্যাপারটা দেখেটেখে খবর করে দেয়। ছবি ছাপে সেই ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়া বুনো এলাকার।
সঙ্গে অ্যালথ্রপ-এ ডায়ানার মন্দিরের ছবিও। যেখানে দেওয়াল থেকে রং খসে খসে পড়ছিল। হট্টগোল তুঙ্গে ওঠে এর পরে।
ছেলেদের কাছে মা
তাঁকে ঘিরে একসময় যাই-ই জল ঘোলা হোক, পরের বছর ডায়ানার ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে তিনি যথেষ্ট কথাবার্তার মধ্যে। আর্লের মতে, তুমুল উৎসাহ তৈরি হবে ২০১৭-র ওই ঘটনাটি ঘিরে। তাই তাঁদের বাড়ি, তালুক সব মেরামতি, সাফসুতরো করার কাজ চলছে।
ডায়ানার অন্ত্যেষ্টিতে রাজপরিবারকে সমালোচনা করার পর থেকে আর্লকে চার্লস-পরিবার ‘নিষিদ্ধ’ করে দেয়। কিন্তু ডায়ানাকে ঘিরে হতে চলা রাজ-অনুষ্ঠানে ওঁকেও নাকি ডাকা হবে। প্রিন্স উইলিয়ামকে আপাতভাবে এ জন্য বেশ আগ্রহীই দেখাচ্ছে, ওঁর ছেলেপুলেরা এত দিনে তাঁর মামাকে তো দেখতে পাবে!
ডায়ানার মধ্যে যে একটা দানধ্যান, সাহায্য করার ব্যাপার ছিল সেই পরম্পরাটা ধরে রাখতে ওঁর দুই ছেলেই এগিয়ে এসেছে।
উইলিয়ামকে একটা গে-ম্যাগাজিন তাদের কভারপেজের জন্য ছবি করেছে। এডস রোগীদের সাহায্যকল্পের একটি অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখা গেছে, হ্যারি এইচআইভি পরীক্ষার জন্য রক্ত দিচ্ছে।
হ্যারি বলেছে, ‘‘আমাদের পরিবার মায়ের জন্য অনেক কিছু করবে, শুধু এটা নিশ্চিত করতে যে, মাকে কোনও দিন আমরা ভুলে যেতে চাই না। ভুলতে পারবও না। আর আমি যা কিছু করি, আমার আশা তার মধ্যে দিয়েই আমার মায়ের প্রতিভা প্রকাশ পায়।’’
ডায়ানার সবচেয়ে বড় পরম্পরা আজ বোধহয় এটাই যে, ওঁর দুই পুত্রই স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে যে সব সেবামূলক কাজ করছে, এক দিন তাদের মা সেটাই শুরু করেছিলেন!
ফিরে যাই ১৯৯৭-এর অগস্ট-এ। সারা পৃথিবীতে যাঁরাই ও দিনের একটি দৃশ্য দেখেছেন, ভুলতে পারেননি আজও।
অনেকের সঙ্গে কালো পোশাক পরা দুই কিশোর হাঁটছে তাঁদের মায়ের কফিনের পিছন পিছন। মুখ গম্ভীর। কিন্তু চোখে জল নেই এক ফোঁটাও।
একটু দূরেই এল্টন জন গেয়ে চলেছেন গান— ‘ক্যানডেল ইন দ্য উইন্ড’!
কফিনটা ফুলে ফুলে ঢাকা! তারই মাঝে আশ্চর্যজনক ভাবে জেগে আছে একটিই শব্দ। তীক্ষ্ণ শেল হয়ে যে শব্দ বিঁধেছিল সবার বুকে— ‘মাম্মি’!
তখন সে ডাকে সাড়া দেননি শীতল নিথর হয়ে যাওয়া তাঁদের মা। আজ, তাঁর দুই কিশোর-পুত্র যখন যৌবনে, তারাভরা আকাশ থেকে সেই সাড়াই বোধহয় ফিরে আসছে আশীর্বাদ হয়ে!
বিশ্বাস করতে দোষ কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy