Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

রত্নগর্ভা

তাঁদের কেউ জগদীশচন্দ্র বসুর মা, তো কেউ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কিংবা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। এমন মায়েদের জীবনও যে কী বিচিত্ররঙা! লিখছেন শুভাশিস চক্রবর্তীশিবরাম চক্রবর্তীর মা তাঁর নাম রেখেছিলেন পার্বতীচরণ।যখন তাঁদের কিছুতেই ছেলেপুলে হচ্ছিল না, শিবপ্রসাদ আর শিবরানি বিন্ধ্যাচলে গেলেন মানত করতে। সন্তান হল তার পর।বিন্ধ্যবাসিনীর দয়ায় পুত্র হল বলে শিবরানি নাম রাখলেন পার্বতীচরণ।

চিত্রণ: শেখর রায়

চিত্রণ: শেখর রায়

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

শিবরাম চক্রবর্তীর মা তাঁর নাম রেখেছিলেন পার্বতীচরণ।

যখন তাঁদের কিছুতেই ছেলেপুলে হচ্ছিল না, শিবপ্রসাদ আর শিবরানি বিন্ধ্যাচলে গেলেন মানত করতে। সন্তান হল তার পর।

বিন্ধ্যবাসিনীর দয়ায় পুত্র হল বলে শিবরানি নাম রাখলেন পার্বতীচরণ। কিন্তু স্বামী শিবভক্ত, পাল্টে রাখলেন শিবরাম। এই নাম মাহাত্ম্যেই তিনি শিবরামের মা–কে বিয়ে করেছিলেন সন্ন্যাস থেকে ফিরে।

মা ছিলেন শক্তির উপাসিকা। তিব্বত, কামাখ্যা নানা জায়গা থেকে লাল চেলিপরা হাতে ত্রিশূল নিয়ে ভৈরবীরা আসতেন — শিবরানির সঙ্গে নিভৃতে আলাপ হত তাঁদের। সেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ।

এক ভৈরবী বালক শিবরামকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার মা–কে সামান্য মনে কোরো না বাবা। জগন্মাতার অংশ তাঁর মধ্যে। উনি সাক্ষাৎ ভগবতী।’’

শিবরামকে এক রাতে নাকি প্রেতাত্মায় ভর করেছিল। ধুম জ্বর। মা বুঝতে পারলেন ছেলের প্রাণসংশয়। কালীঘাটের মায়ের কাছে ডান হাত বাঁধা রাখলেন। ডান হাতে আর খেতে পারেন না।

খেতে বসলেই কেউ–না কেউ জানতে চান তিনি বাঁ–হাতে খাচ্ছেন কেন! অমনি তাঁকে খাওয়া ফেলে উঠে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত যত দিন না কলকাতায় এসে পুজো দিয়ে ব্রত ভাঙলেন, কারও সামনে আর খেতে বসতেন না।

আবার, ছেলেকে বই পড়ার নেশা ধরিয়েছিলেন তাঁর মা–ই। বাড়িতে বাবার সংগ্রহে প্রচুর বই, পত্রিকাও আসত বেশ কয়েকটা।

দুই ছেলেকে সন্দেশ পত্রিকা থেকে ছড়া–গল্প পড়ে শোনাতেন।

সেই ছেলেবেলাতেই মা শিবরামের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন এক অমলিন সত্য: ‘‘বই পড়ে কিছু জানা যায় না, মন দিয়ে জানতে হয়। যে বিদ্যা জীবন হয়ে ওঠে না, জীবন্ত হয়ে ওঠে না, সে আবার কী বিদ্যা রে?’’

বই পড়ার অভ্যাস মায়ের থেকে পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

তাঁর মা প্রভাবতী দেবীর নিজেরই ছিল বই পড়ার দারুণ নেশা। আফিম খেতেন, তার ঝোঁকে সন্ধ্যার দিকে ঘুমিয়ে পড়তেন। দু’ঘন্টা পর উঠে সবাইকে খাইয়ে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসে যেতেন। রাত্রি দুটো— আলো জ্বলছে, মা পড়ছেন।

হাতের লেখা ছিল যেন মুক্তো। বানান নির্ভুল, ব্যাকরণেও ভুল করতেন না।

এ নিয়ে একবার অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। তারাশঙ্করের বাবা মারা যাওয়ার পর বিষয়–সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় দাখিল করা কাগজে মায়ের সই বা লেখা দেখে বিচারকের সন্দেহ হয়, এ কোনও মেয়ের লেখা হতেই পারে না!

শুধু পড়াশুনো নয়, পুত্র বিস্মিত হতেন মায়ের সাহস আর স্থৈর্য দেখে।

গাঁ-ঘরে বাড়ি। প্রায়ই ভূত বা প্রেতাত্মার গুজব ছড়াত। প্রভাবতীদেবীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সটান বেরিয়ে পড়তেন বাড়ি থেকে। সরেজমিনে দেখেটেখে অন্যের ভয় ভাঙাতেন।

ঘরে সাপ ঢুকলে নিমেষে বুঝে ফেলতেন। সাপের গন্ধ নাকি টের পেতেন তিনি।

একবার পায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে গোখরো সাপ। তাতে অচলা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে বিপদ এড়িয়েছিলেন তিনি।

মায়ের কথা তারাশঙ্কর লিখেছেন: “আমার মায়ের দেহবর্ণ ছিল উজ্জ্বল শুভ্র। আর তাতে ছিল একটি দীপ্তি। চোখ দুটি স্বচ্ছ, তারা দুটি নীলাভ। কথাবার্তা অত্যন্ত মিষ্ট, প্রকৃতি অনমণীয় দৃঢ়, অথচ শান্ত।… আমার মা যদি উপযুক্ত বেদীতে দাঁড়াবার সুযোগ পেতেন তবে তিনি দেশের বরণীয়াদের অন্যতমা হতেন — এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।”

বালক জীবনানন্দ দাশ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকত— কখন মা ঘরে আসবে। তবে সে ঘুমোবে।

ঘরের এক কোণে বাবা। বাতি জ্বালিয়ে তিনি অনেক রাত অবধি লিখতেন।

মা তখনও রান্নাঘরে। যৌথ পরিবারের বড় হেঁশেল। সংসারের শেষ মানুষটির খাওয়া সাঙ্গ হলে তবে তিনি ঘরে আসবেন।

ঘরে এসে এক দফা ছেলের সঙ্গে গল্প না করে ঘুমোতেন না। ছেলের সারা দিনের কাজের হিসেব নিতেন তখনই। তার পর ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন।

না ঘুম-আসা অবধি ছেলের কেবলই ভয় করত, এই বুঝি কোনও পড়শি তার মা–কে ডাকতে এল।

পাড়াপড়শির রোগভোগে মা থাকতেন সব সময় পাশে। এমনকী কোনও দুঃস্থ পরিবারকে হয়তো ভিটেছাড়া করা হয়েছে, হয়তো কোনও ‘নিচু জাতের’-কেউ মারা গিয়েছে, কার ঘরে কোনও পোয়াতি মায়ের প্রসব হবে— মা–র কাছে এক বার খবর এলেই হল, ঠিক চলে যেতেন। সারা রাত হয়তো বাড়িই ফিরতেন না আর।

বালক জীবনানন্দ, ডাকনাম যার মিলু, তখনও জানতেই পারেনি, তাঁর মা কুসুমকুমারীর কবি হিসেবে কত সুখ্যাতি। ‘ব্রহ্মবাদী’, ‘মুকুল’, ‘প্রবাসী’র মতো পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা বেরোয়। তবে এত বড় পরিবারের ঝক্কি ঠেলে তত সময় দিতে পারেন না লিখতে।

তবুও জীবনানন্দ নিজেই দেখেছেন: “সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন, এমন সময়ে ‘ব্রহ্মবাদী’র সম্পাদক আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুনি ‘ব্রহ্মবাদী’র জন্য তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। শুনে মা খাতা–কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুন্তি, আর এক হাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত… আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন।”

ছেলের জন্মদিনে তার বন্ধুদের, স্বামীর অফিসের লোকজনকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন কুসুমকুমারী। সেখানে গান হত। কবিতা পাঠও।

কখনও কখনও ছেলের বন্ধুদের নিয়ে বসাতেন সাহিত্যসভা— সেখানে ছোটদের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রর উপন্যাস, কি রামায়ণের নানান সব চরিত্র নিয়ে তক্কও করতেন। মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনত ছেলেপুলের দল।

এই কুসুমকুমারীই লিখেছিলেন— ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?/কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।’

তাই জীবনানন্দ যখন তারুণ্যের স্থূলতায় বড় বড় আদর্শ মহাপুরুষদের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন মা তাঁকে বলেছিলেন: “ও–রকম করে হয় না — আগে তাঁদের মহত্ত্বে বিশ্বাস করো — মনের নেতিধর্ম নষ্ট করে ফেলো; শুধু মহামানুষ কেন, যে–কোনও মানুষ কতখানি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পাত্র, অনুভব করতে শেখো।”

জগদীশচন্দ্র বসুর মা বামাসুন্দরী দেবী জাতিবিচার মানতেন না।

ছেলের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমান চাপরাশির পু্ত্র ছিল, আবার ছিল জেলের ছেলেও। মা প্রভাবতী তাদের পাশাপাশি বসিয়ে খেতে দিতেন।

জগদীশ এ নিয়েই লিখেছেন: “ছেলেবেলায় সখ্যতা হেতু ছোট জাতি বলিয়া যে এক স্বতন্ত্র শ্রেণীর প্রাণী আছে এবং হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে যে এক সমস্যা আছে (মায়ের জন্য) তাহা বুঝিতেই পারি নাই।”

জগদীশের যখন সতেরো বছর বয়স, কনিষ্ঠ পুত্রকে হারিয়েছিলেন বামাসুন্দরী। এর জের এসে পড়ল জগদীশের উপর!

ছেলেকে তিনি কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইতেন না। বিলেতে যাবেন জগদীশ। সেই শুনে নাওয়া–খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। স্বামী ভগবানচন্দ্র কত বোঝালেন। কাজই দিল না।

অবশেষে এক রাতে ছেলের শোবার ঘরে এসে বললেন: “আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। যা তুই বিলেতে। পড়াশুনো করে আয়। তবে বাবার টাকা–কড়ি তেমন নেই। আমার গয়নাগুলো বেচে দে।”

মায়ের অলঙ্কার বিক্রির টাকায় বিলেতে পড়তে গেলেন জগদীশচন্দ্র।

যশোর। কপোতাক্ষ নদ। তার গা–ঘেষে যে গাঁ, তার নাম রাঢ়ুলি।

এখানকার জমিদার হরিশচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তিনি স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবীকে লেখাপড়া শেখাবেন বলে জমিদার বাড়ির ভিতরেই প্রতিষ্ঠা করলেন এক বালিকা বিদ্যালয়। কলকাতায় গেলে ভুবনমোহিনীকে পড়াতেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

এই হরিশচন্দ্র আর ভুবনমোহিনীরই সন্তান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

ছোটবেলায় প্রফুল্লচন্দ্রের কাজ ছিল মাকে সুর করে রামায়ণ–মহাভারত পাঠ করে শোনানো। আর শুধু কি পড়া, অমৃতসমান মহাভারতের নানা কাহিনি, তার চরিত্র নিয়ে মায়ে-পোয়ে রীতিমতো আড্ডা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

হরিশচন্দ্র মারা গেলেন।

ভুবনমোহিনী বিধবার আচার–বিচার মেনে চলেন।

এক একাদশীর দিন। গাছ থেকে ডাব পাড়ার কোনও লোক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রফুল্লচন্দ্র নিজেই গাছ উঠে মায়ের জন্য ডাব পেড়ে আনলেন।

পরোপকারী উদার হাতে দান–ধ্যানকারী মায়ের ধারা পেয়েছিলেন তাঁর পুত্রও। অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার স্বভাব প্রফুল্লচন্দ্রকে ‘দানবীর’ করে তুলেছিল।

সে কালের মহিলা হয়েও ভুবনমোহিনী ছিলেন সমস্ত কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে। ছেলে বিলেত যাবে। ‘কালাপানি’ পেরোবে। সে আমলে অনেক মা-বাবাই শঙ্কায় পড়ে যেতেন। ভুবনমোহিনীর কিন্তু কোনও হেলদোল ছিল না।

মা যখন মারা যান প্রফুল্লচন্দ্র তখন ইওরোপে।

দাদার চিঠিতে মায়ের মৃত্যুসংবাদ এল তাঁর কাছে।

ডায়েরিতে লিখলেন: “ভোর সকালে দাদার চিঠিতে জানতে পারলাম মা আর নেই, কোনও মানসিক আঘাত যে এত তীব্র, এত ভয়ানক হতে পারে তা আমি জানতাম না। মাকে কেন্দ্র করেই তো আমার সব ভালবাসা। আজ সব শূন্য করে তিনি চলে গেলেন।”

বিলেতে বসে বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।

তড়িঘড়ি দেশে ফিরছেন। জাহাজে বসে শুনলেন, মা’ও আর নেই!

এই বিলেতে আসার আগে বারবার আপত্তি করেছিলেন মা। প্রসন্নময়ীর মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছিল, ছেলে বিলেতে গেলে তার সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনও দিন।

যে দিন ইওরোপ যাত্রা করবেন দ্বিজেন্দ্রলাল, তার আগের দিন সারা রাত ছেলের গলা জড়িয়ে কেঁদেছিলেন। মায়ের সেই অঝোর কান্না কোনও দিনই ভুলতে পারেননি তিনি।

আরও মর্মান্তিক, মায়ের আশঙ্কাই সত্যি হল ছেলের জীবনে!

ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ অদ্বৈতাচার্যের বংশের কন্যা ছিলেন প্রসন্নময়ী। পরে কৃষ্ণনগরের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের স্ত্রী।

মেধাবী ছেলেরা রাত জেগে পড়াশুনো করত। মা ঘুমোতে পারতেন না। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে-বসে রাত কাটাতেন। কখনও পাখার বাতাস করে দিতেন।

এমনই মানুষ ছিলেন প্রসন্নময়ী।

মা-অন্ত প্রাণ ডি.এল. রায় লিখেছিলেন: “জানি না জননী কেন এত ভালবাসি।/দুঃখের পীড়নে মোর হদয় ব্যথিত হলে/জানি না তোমারি কাছে কেন ধেয়ে আসি।”

মায়ের জন্য লর্ড কার্জনের আদেশ অমান্য করেছিলেন ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।

১৯০১ সাল। সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক অনুষ্ঠান। সারা পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন পড়ে গেছে।

ভারত থেকে যে বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত লোকেদের আমন্ত্রণ জানানো হবে সেই তালিকায় আছে স্যার আশুতোষের নামও।

কার্জন সগর্বে সেই সংবাদ আশুতোষের কাছে পাঠালেন।

কিন্তু জগত্তারিণী দেবী পুত্রকে কিছুতেই বিলেত যাওয়ার অনুমতি দিলেন না।

যেতে না পারার কারণ শুনে কার্জন বিস্মিত। ঈষৎ রুষ্টও। আশুতোষকে বললেন: “আপনার মাকে বলুন যে, ভারতে সম্রাটের প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেল কার্জন তাঁকে যেতে আদেশ করেছেন।”

আশুতোষ উত্তর দিলেন: “তা’হলে আমার মায়ের তরফ থেকে জানাই যে, তিনি কিছুতেই স্বীকার করেন না তিনি ছাড়া তাঁর পুত্রকে অন্য কারও আদেশ করার অধিকার আছে।”

ছেলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক পদে যোগ দিক তা’ও চাননি জগত্তারিণী। আশুতোষ মাকে অনেক বোঝানোর পর, তবে সম্মতি পেয়েছিলেন।

১৯২১–এ মায়ের স্মৃতিতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে এককালীন তিন হাজার টাকা দেন, যার সুদ থেকে চালু হয় ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’।

জীবনযুদ্ধে জেরবার হয়ে গিয়েছিলেন ভুবনমোহিনী দেবী। তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মা।

ভুবনমোহিনীর বাবা কেদারনাথ ভাগলপুরের ধনী, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। এই বাড়িতেই আশ্রিত ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। মেয়েকে কাছে রাখবেন ভেবে মতিলালের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন কেদারনাথ।

ঘরজামাই মতিলাল আয়েসি। শৌখিন। অর্থ উপার্জনের কোনও চেষ্টাই করেন না। তাঁর মন তাস–দাবায়, তামাকের নেশায় আর দিবানিদ্রায়। স্কুল মাস্টারির চাকরি পেলেন, বছর না ঘুরতেই তাতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলেন।

বাপের বাড়িতে লজ্জায় কুন্ঠিত হয়ে থাকতে হয় ভুবনমোহিনীকে।

তবু তিনি সংসারটাকে ভেসে যেতে দেননি।

মা–সম্পর্কে শরৎচন্দ্র লিখেছেন: “আমার মা ছিলেন খুবই উদারপ্রাণ। সংসারের সকল দুঃখ কষ্ট তিনি হাসিমুখেই সহ্য করতেন। ত্যাগ, কর্তব্যবোধ, নিষ্ঠা, স্নেহপ্রবণতা— এই সব গুণের সমন্বয়ে গঠিত ছিল তাঁর চরিত্র।”

সংসারে ভুবনমোহিনীর ভূমিকা কী ছিল তা বোঝা যায় ১৯১৯–এর ২৪ অগস্ট শরৎচন্দ্রেরই লেখা একটি চিঠিতে: “মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা প্রায় পাগলের মতো হয়ে যা কিছু ছিল সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে স্বর্গগত হন।”

দশ বছর বয়সে বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যাত্রাদলে যোগ দেবেন ভেবেছিলেন। অভাবের সংসারে যদি দু’পয়সা আয় হয়!

কথাবার্তা একদম পাকা। কিন্তু মা ‘না’ করে দিলেন। তাঁর ইচ্ছে, ছেলে পড়াশোনাই করুক।

ছেলেবেলা থেকেই ছেলের পড়ার বিষয়ে মা মৃণালিনী দেবীর ছিল কড়া নজর। স্বামী একমনে নতুন কথকতা লিখছেন, ছেলে যে সামনে বসে পড়া সরিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে, খেয়ালই নেই তাঁর। মৃণালিনী কিন্তু দূর থেকে খেয়াল রাখতেন সব। ধমক দিয়ে পড়ায় ফেরাতেন বিভূতিকে।

ছেলের পড়াশোনা নিয়ে তাঁর কতটা নজর ছিল, একটি ঘটনা বললে আরও স্পষ্ট হয়।

মাত্র ক’দিনের জন্য মুরাতিপুরের বাপের বাড়ি গেছেন মৃণালিনী। তখনও পড়া থেকে বিভূতি যাতে দূরে না থাকে, তার ব্যবস্থা করলেন। ছোট ভাই বসন্ত যায় সেখানকার বিপিন মাস্টারের স্কুলে। বিভূতিকেও তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন। মামা–ভাগ্নে মিলে পড়াশোনা চলল ওই ক’দিন।

বারাকপুর গ্রাম থেকে বনগাঁ স্কুলে পড়তে যেতে চায় ছেলে। টাকা নেই।

তোরঙ্গ থেকে মৃণালিনী বের করলেন ন্যাকড়ার ছোট্ট পুঁটুঁলি। তাতে একমাত্র সম্বল রুপোর গোট। সেটি বিক্রি করেও টাকায় কুলোয় না। তখন লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে সিঁদুর পরানো টাকাটাও তুলে দিলেন ছেলের হাতে।

যত দিন স্থায়ী চাকরি না পেয়ে আর্থিক ভাবে থিতু হয়েছেন বিভূতিভূষণ, তত দিন দারিদ্র্যের কালো ছায়া ছেয়ে ছিল তাঁদের সংসার। আর সেখানে ভয়ংকর লড়াই চালিয়ে যে মানুষটি ছিলেন একেবারে প্রথম সারিতে, তিনি বিভূতি-জননী মৃণালিণী দেবী।

তিন–তিনটি কন্যার কী হবে ভেবেও দেখলেন না ‘কুলি–কাহিনী’র লেখক।

স্ত্রী জ্ঞানদা মারা গেলে ব্রাহ্ম সমাজের একনিষ্ঠ কর্মী রামকুমার বিদ্যারত্ন সন্ন্যাস নিলেন, নিজেই নিজের শ্রাদ্ধ করে হয়ে গেলেন ‘রামানন্দ স্বামী’।

অনাথ তিন মেয়ের বড়টিকে পাঠানো হল হস্টেলে। মেজো মেয়ে সুরমার দায়িত্ব নিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। আর শিবনাথ শাস্ত্রী নিলেন ছোট মেয়ে রমাকে ।

উপেন্দ্রকিশোর পরে নিজের ছোট ভাই প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে সুরমার বিয়ে দেন।

তাঁদেরই কন্যা লীলা মজুমদার।

প্রমদারঞ্জনের চাকরি সূত্রে তাঁরা থাকতেন পাহাড়ে। লীলা ও তাঁর দিদি, ভাইদের বাল্যকালটা এখানেই কেটেছে আনন্দে, তাঁর নিজেরই কথায়: “পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে নিরাপদ স্থান ছিল আমার মায়ের বাড়িটি।… … কারণ ধারে কাছে কোথাও বিপদের সম্ভাবনা হবামাত্র আমার মা যে তাঁর গোলাপি নখ দেওয়া ফর্সা হাত দুটি দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না তাঁদের।”

পাহাড়ের দেশে সারা বছর বৃষ্টি হত। মাঝে মাঝে টিনের চাল দিয়ে জল পড়ত। সুরমা এনামেলের গামলা বসিয়ে জল ধরতেন। মায়ের বর্ণনা দিয়েছেন লীলা ওইভাবে: “ফুটফুটে ফরসা রং, রেশমের মত নরম
ঘন কালো চুল, ফুলের মত হাত দুখানি। গয়নাগাঁটির বিশেষ বালাই ছিল না তাঁর।”

অতি সাধারণ সাজগোজ। স্বামীর সঙ্গে লাটসাহেবের বা চিফ কমিশনারের বাড়িতে পার্টিতে গেলেও বড়জোর ছাই রঙের গরদের শাড়িটি পরে নিতেন।

একবার সারদারঞ্জন একটি চা–পার্টিতে খেয়াল করলেন তাঁর স্ত্রী মাঝে মাঝেই একটা–দুটো দামি চকোলেট তুলে নিচ্ছেন আর রুমালে জড়াচ্ছেন।

সুরমা যে কেন প্রাণ গেলেও ওগুলো খেতে পারছিলেন না, কাদের জন্য সেগুলি সরাচ্ছিলেন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামী।

তাই ফেরার পথে ছেলেমেয়েদের জন্য দামি দামি চকোলেট আর কেক কিনে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।

ছেলেমেয়ের কাছে স্বদেশি আন্দোলনের গল্প বলতেন সুরমা।

ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ জলে ভরে যেত। ক্ষুদিরামকে যে চিনতেনও তিনি! উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে ক্ষুদিরাম-পরিবারের সম্পর্ক ছিল নিবিড়।

সবে পাঁচ থেকে ছয়ে পড়েছে ক্ষুদিরাম।

কালীপুজোর রাতে মাতৃহারা হল সে। আগের দুটি পুত্রসন্তান অল্প বয়সেই মারা গেছিল বলে লক্ষ্মীপ্রিয়ার আশঙ্কা ছিল তৃতীয় পুত্রটিও বাঁচবে না। তাই নিতান্তই কুসংস্কারে চালিত হয়ে মায়ের কাছ থেকে তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে ভাইকে কিনে নিয়েছিল বড়দি অপরূপা। সেই থেকেই ছেলের নাম ক্ষুদিরাম। পদবি বসু।

কার্যক্ষেত্রে নাবালক ছেলে–মেয়েকে পথে ভাসিয়ে তিন মাসের ব্যবধানে মারা যান মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী এবং বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু।

বড়দি অপরূপার কাছেই ঠাঁই পেয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। দিদিই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর মা।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর দিদিমাকে ডাকতেন ‘মা’।

জন্মদাত্রী মা বিনয়কুমারী বুদ্ধদেবের জন্মের পরে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই প্রসবোত্তর ধনুষ্টংকার রোগে মারা যান।

এই মৃত্যুর জন্যই পুত্রের নাম রাখা হয় বুদ্ধদেব।

বু.ব–র দিদিমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে একটি ফটোগ্রাফ ছিল— ক্ষীণাঙ্গ এক যুবক, তার কাঁধে মাথা রেখেছে এক তরুণী— তরুণীটির মুখটি গোল মতো, পিঠ–ছাপানো একঢাল চুল, কিন্তু চোখ তার বোজা, যুবকটি তার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে।

মৃত পত্নীকে নিয়ে, ওই ভাবে মৃতদেহটিকে বসিয়ে, ছবিটি তুলেছিলেন তাঁর স্বামী ভূদেবচন্দ্র বসু, যিনি এর পরেই সংসারত্যাগী হন।

সারা জীবন মাকে নিয়ে, তাঁর একমাত্র ওই ছবিটি নিয়ে কোনও কৌতূহল বা চিন্তা করার অবকাশ পাননি বুদ্ধদেব।

জীবনের উপান্তে এসে,
ষাট–পেরোনো মানুষটির প্রান্তিক নির্জনতায় বসে ওই ছবির কথা মনে পড়ত তাঁর।

সেই সঙ্গে মনে হত: “কেমন ছিল সে দেখতে, কেমন পছন্দ–অপছন্দ ছিল তার? বই পড়তে ভালোবাসত? আমার মধ্যে তার কোনও একটি অংশ কি কাজ করে যাচ্ছে? মনে হয়, আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে–মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল, তার কিছু প্রাপ্য ছিল আমার কাছে।”

নিজের জীবন দিয়ে সন্তানদের এ ভাবেই আমৃত্যু ঋণী করে রেখে যান মায়েরা!

ঋণ: প্রভাতকুমার দাস, অনুপম সেনগুপ্ত, সপ্তর্ষি লোধ, সুজিত দে সিকদার, অশোকনগর শহিদ স্মৃতি পাঠাগার, মনীষীদের মা (শৈলেন কুমার দত্ত), বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র (প্রশান্ত প্রামাণিক), বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র (শ্যামল চক্রবর্তী), আশুতোষ–স্মৃতিকথা (দীনেশচন্দ্র সেন), স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (অচিন্ত্যকুমার মাইতি), অগ্নিকিশোর ক্ষুদিরাম (জলধর মল্লিক), পথের কবি (কিশলয় ঠাকুর), জীবনের পাঁচালীকার বিভূতিভূষণ (তারকনাথ ঘোষ), জীবনানন্দ দাশ (জীবনী) (প্রভাতকুমার দাস), জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রবন্ধাবলী (ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সম্পাদিত), ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা (শিবরাম চক্রবর্তী), রচনাবলী দশম খণ্ড (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), পাকদণ্ডী (লীলা মজুমদার), আর কোনোখানে (লীলা মজুমদার), আমার ছেলেবেলা (বুদ্ধদেব বসু)

অন্য বিষয়গুলি:

Mother
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy