Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ভক্তিমার্গ তাঁর মাধ্যম মাত্র। পাখির চোখ— সমন্বয়, প্রতিবাদ, যুগরচনা। নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন সমসময়ের আয়না, মিশে গিয়েছেন বাঙালির অখণ্ড জাতিসত্তার রক্তে। তিনি রামপ্রসাদ সেন।
Ramprasad Sen

Ramprasad Sen: দর্পণে সময়শশী

রাগাশ্রয় নিলেও রামপ্রসাদ নদী, মাঠঘাটের সুরেই ঝুঁকেছেন বেশি। কারণ, তাঁর লক্ষ্য সাধারণ মানুষ। পরে যেমন লালনের।

রামপ্রসাদ সেন।

রামপ্রসাদ সেন। অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২২ ০৮:৩৭
Share: Save:

চারণ বলছেন— ‘কথা রবে, কথা রবে’। চারণের ধর্মে দেখনদারি নেই। তবে, উপচার আছে কালীভজনার, মায়া আছে বৈষ্ণবরসের, সহজিয়া সাম্যসূত্র আছে বাউল-সুফি-ইসলামের। চারণের মন্ত্র তাঁর কথা। যা না-মানলে ব্রহ্মময়ীরও কলঙ্ক ‘রটিবে’ বলে তাঁর প্রত্যয়।

শ্রীরামপ্রসাদ সেন। ভক্তিধর্ম, কাব্যধর্ম, সঙ্গীতধর্ম, লোকধর্ম, ভাষাধর্ম এবং ইতিহাসধর্ম— লোকায়ত বাঙালিয়ানার মাদক অমনিবাস। রামপ্রসাদকে প্রথম যিনি নব্য ভাবনায় শিক্ষিত বাঙালির কাছে তুলে ধরেছিলেন, ‘সংবাদপ্রভাকর’ পত্রিকার সেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের তাঁর সময়নিরিখে মনে হয়েছিল, রামপ্রসাদই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি। অনুমান আর লোকশ্রুতি-নির্ভর ছিল ঈশ্বর গুপ্তের সেই কাজ। কিন্তু অবিসংবাদী প্রয়াসই। ঢের পরে আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে আসন পাতছেন রামপ্রসাদের। ‘সত্য’ প্রবন্ধে লিখছেন— ‘যাহারা সহজেই সত্য বলিতে পারে তাহাদের সে কী অসাধারণ ক্ষমতা! যাহারা হিসাব করিয়া পরম পারিপাট্যের সহিত সত্য রচনা করিতে থাকে, সত্য তাহাদের মুখে বাধিয়া যায়, তাহারা ভরসা করিয়া পরিপূর্ণ সত্য বলিতে পারে না। রামপ্রসাদ ঈশ্বরের পরিবারভুক্ত হইয়া যেরূপ আত্মীয় অন্তরঙ্গের ন্যায় ঈশ্বরের সহিত মান অভিমান করিয়াছেন, আর কেহ কি দুঃসাহসিকতায় ভর করিয়া সেরূপ পারে! অন্য কেহ হইলে এমন এক জায়গায় এমন একটা শব্দ প্রয়োগ, এমন একটা ভাবের গলদ করিত যে, তৎক্ষণাৎ সে ধরা পড়িত’। এ-বয়ানে রামপ্রসাদের সহজিয়া আখরের সঙ্গেই রয়েছে ভক্তিমার্গের কথা।

‘ভক্তি’ শব্দটি এলেই বাল্যে ফিরে যেতে মন চায়। গঙ্গাতীরে রাধাকৃষ্ণ জিউয়ের মফস্‌সল-সাম্রাজ্য খড়দহে আমাদের দেবদেবীর অভাব ছিল না। ব্রত উদ্‌যাপনেই মা-ঠাকুমার দিন কাটত। শুক্রবারটিও কেড়ে নিয়েছিলেন ছোলাগুড়নন্দিত সন্তোষী মা। পাশাপাশি, রক্ত-আমাশা হলে শ্মশানঘাটের জীর্ণ বেড়াঘরের নমাজি সুবৃদ্ধ আলি উল্লাহের ফুঁ-যোজিত ‘জলপড়া’ খাওয়াতেও নিয়ে যেতেন পরম-নিরক্ষর চরম-হিন্দু ঠাকুমা। দোরগোড়ায় ভিক্ষুকের বেশে সত্যপির এলে ঠাকুমারই মিলিটারি শাসনে আমাদের লাইন লেগে যেত মাথায় তাঁর শীর্ণ চামরের আলিম্পন, দারিদ্র-দুর্গন্ধি ফুৎকার নিতে। এত কথার একটিই কারণ— ভক্তি বা বিশ্বাস বলে কোনও সঞ্চয় বাঙালির যদি অর্জিত হয়ে উঠে থাকে, তবে তা আবহমান সকল ভক্তিমার্গের নিরবচ্ছিন্ন মুক্তধারাই। অখণ্ড বাঙালিয়ানা।

রামপ্রসাদ সেই ঐতিহাসিক বাঙালিয়ানারই অন্যতম আদিপ্রজন্ম। যে প্রতিবাদী আলোপথে রামমোহনের জন্ম হবে, তার সূচনাদীপটি ধরা রামপ্রসাদের হাতে। নিছক বাৎসল্যরস নয়, বৈপ্লবিক সত্যমার্গই। ভক্তিকে মাধ্যমমাত্র করেছেন এই কবি। কারণ, সেকালে শিল্প-সাহিত্য ভক্তিবাদ বা দেবদেবী ছাড়া হালে পানি পেত না।

কালের মন্দিরা

আঠারোশো শতাব্দীর বাংলা। ধর্মীয়-সামাজিক, আর্থসামাজিক এবং দেশীয় প্রেক্ষাপট— সব দিক থেকেই জট-জটিল। সমাজ তখনও ‘বিধর্মী’ শব্দটিকে মুখে তোলেনি। শাসকের মসনদে ধর্মপাঞ্জার বদল ঘটলেও, ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারের ধর্মকলঙ্ক লাগলেও আমবাঙালির বেড়াঘরে, কৃষিজমিতে তা পৌঁছয়নি। বৌদ্ধ প্রভাবকাল গিয়েছে ঢের আগেই। বৌদ্ধ পালবংশের শেষ পর্বেই স্থানিক হিন্দু-ধর্মের আচমন। লেখা হচ্ছে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম‌্‌’। শৈব সেনবংশের আগেই। আঠারো শতকে রামপ্রসাদের বাংলায় বৌদ্ধ প্রভাব জিনে থাকলেও ত্বকে লেগে নেই। তার ঢের-বহু আগে থেকেই অ-বৌদ্ধ, অ-মুসলিম সমাজ বিভক্ত শাক্ত-বৈষ্ণবে। সে-বিরোধের তেজস্ক্রিয়তা হালের বিচ্ছেদকামীর কাছেও অকল্পনীয়।

ইসলামের মতো বাংলার সংস্কৃতিক্ষেত্রে শাক্ত এবং বৈষ্ণব ধারাও প্রভাব ফেলেছে। এগিয়ে বৈষ্ণব ধারা। কারণ, বৈষ্ণব রসসাহিত্য অবিস্মরণীয় কবিদের পেয়েছে, যা শাক্ত রসকৃষ্টি পায়নি। ব্যতিক্রম রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত। সমাজসংস্কৃতি যখন নতুন করে সংস্কৃত পুরাণ-ভাগবতে ডুব দিচ্ছে, তখন মঙ্গলকাব্যের কবি পুরাণকে নিচ্ছেন আর বৈষ্ণব কবির অবগাহন ভাগবতে। তবে, মূল ধারার বৈষ্ণব সাহিত্য ভাগবতকে উপলক্ষ-মাধ্যম করছে মাত্র। শ্রীচৈতন্যের বহু আগে ‘শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্’-এর কবি জয়দেবকে পেয়েছি আমরা। যিনি ভাবগতের কৃষ্ণকে নিলেন, সঙ্গে লোককথা থেকে আমদানি করলেন রাধিকাকে, যে রাধার চিহ্নমাত্র নেই ভাগবতে। একই পথের অনুসারী বিদ্যাপতি, পদাবলির চণ্ডীদাস। কিন্তু চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণবসাহিত্যের বাঁক ভিন্‌ পথে। সেই পথেই দেখা রামপ্রসাদের সময়ের সঙ্গে। চৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণবসাহিত্য রসবিচারে ক্ষীণ। কারণ, সেখানে রাধাকৃষ্ণের আসনে চৈতন্যকে বসাচ্ছেন কবিরা। চৈতন্যের মতো যুগবিপ্লবীকে জনশ্রুতি আর অলৌকিকতায় আঁকতে গিয়ে সাহিত্য হয়ে উঠল মোহস্তুতি, মাহাত্ম্যকথা। বৈষ্ণবধারার আচারসর্বস্ব রূপান্তরও বড় কারণ সেই পতন এবং মূর্ছার।

মঙ্গলকাব্যের কবিরাও একই ছাঁচে বারবার একই সন্দেশ বানাতে গিয়ে বিষয়টিকে হালের বাংলা সিরিয়ালের মতো করে তুললেন। দেবদেবীই সাম্রাজ্য সামলাচ্ছেন। বাহনেরাও বসে নেই। মানুষ ল্যাজেগোবরে। কিন্তু সমাজভাবনার ইতিহাসে দেবদেবী আর দৈব এক বস্তু নয়। দেবদেবী-নির্ভর মঙ্গলকাব্যের সাম্পান এ-ভাবেই এগোচ্ছিল। পুরাণে দেবদেবীও কম পড়ে নাই। বৈষ্ণব-শাক্ত দুই ধারার সংমিশ্রণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঘটল না বিদ্বেষের কারণে। আঠারোশো শতকে বাঁক এল। এল ভারতচন্দ্রের হাত ধরে। অন্তরে বৈষ্ণব রায়গুণাকর তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে দেবদেবীকে ঐশী স্তর থেকে মাটিতে নামালেন। শেক্সপিয়রের ভাঁড়ের মতো গুণী ব্যক্তিত্বে নয়, অন্নদার স্বামীকে তিনি ভাঁড় বানালেন সমসময়ের সামাজিক ভাঁড়েদের আদলে। দৈব শিরোধার্য হল, দেবতা নয়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আরাধ্যা দেবীকে দিয়ে যা সব করালেন সভাকবি, তা সমসময়েরই অনুলেখ।

একই সময়ের কবি রামপ্রসাদ। তবে, যুগচেতনায় তিনি ভারতচন্দ্রের চেয়ে ঢের এগিয়ে। উত্তর ভারতের মুসলমান কবিদের কাব্যভাবনার অনুসরণে দু’জনেই লিখছেন বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেমকাহিনি ‘বিদ্যাসুন্দর’। ধর্মনিরপেক্ষ কাব্যে ধর্মগন্ধ জুড়ছেন দু’জনেই। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ মণিমাণিক্যখচিত। রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ হয়তো পিছিয়েই। কিন্তু ফল্গুধারায় আন্দাজ মিলছে, রামপ্রসাদের উনুনে আন-পদের রান্না চলছে। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ যেমন ধুয়া-গানে বৈষ্ণবরসে ভিজে যাচ্ছে, তেমনই রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ স্পর্শ করছে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, বৈষ্ণব কবিরা উঁকি মেরে যাচ্ছেন রামপ্রসাদের ‘শ্রীশ্রীকালী কীর্ত্তনং’ কাব্যে গৌরীর গোষ্ঠলীলায়, ভগবতীর রাসলীলায়।
মিলনটি বৈষ্ণব-শাক্তের নয় শুধু। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষ অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার মিলনসুরই বেজে উঠছে আঠারোশো শতকে। এবং তার তুলনাহীন প্রকাশ রামপ্রসাদের পদে, যাকে আমরা রামপ্রসাদী গান বলে চিনি। সেখানে শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, সহজিয়াই নয় শুধু, সম্মিলন ইসলাম, সুফি, বাউল, মায় খ্রিস্টীয় আঙ্গিকেরও।

ইতিকথা

রামপ্রসাদের জন্ম-মৃত্যু কবে, ইতিহাস জানে না। জানে জনশ্রুতি। প্রসাদের বাবার নামও দীর্ঘদিন কবিরই বড় ছেলে রামদুলাল হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কলকাতায় ঈশ্বর গুপ্ত রামপ্রসাদ নিয়ে প্রথম যা লিখেছেন, মূলত তাকেই প্রামাণ্য ধরে রামপ্রসাদ বিষয়ে বাকি লেখালিখি। পরে ঢাকায় দয়ালচন্দ্র ঘোষ লেখেন ‘প্রসাদ-প্রসঙ্গে’। দু’জনের কাজই লোকশ্রুতি এবং ইতিহাস অনুমানে তৈরি। তা থেকেই সাধক কবির জন্ম-মৃত্যু বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা-প্রতিমা। ইতিহাসের বাকি পরিসরে রামপ্রসাদ প্রায় উল্লেখহীনই। অথচ তিনি বহু যুগের ওপারের কবি নন। উইলিয়ম উইলসন হান্টারের ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে অব বেঙ্গল’ (১৮৭৫) ও ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ (১৮৭৭) গ্রন্থ সে সময়ের নির্ভরযোগ্য দলিল। কিন্তু বিস্ময়! রামপ্রসাদের মতো কবির রচনা, যা সমসময়েই মাঝিমাল্লার মুখে-মুখে, বণিকের সাম্পানসূত্রে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর তেমন উল্লেখই নেই হান্টারে। শুধু ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে অব বেঙ্গল’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে রামপ্রসাদের উল্লেখ মেলে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ হিসাবে— ‘আ স্যানস্ক্রিট স্কলার’। প্রসাদের এই ‘প্রাপ্তি’র দায় কিছুটা তাঁর নির্জন যাপন আর ভণিতা-বিভ্রমেরও।

১৮৩১ সালে ‘সংবাদপ্রভাকর’ প্রকাশ করেন ঈশ্বর গুপ্ত। সেখানেই ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত রামপ্রসাদের ‘কালীকীর্ত্তন’ এবং ১৮৫৩ সালে ‘রামপ্রসাদ-জীবনী’। আগে-পরে রামপ্রসাদ নিয়ে আরও লেখা এবং প্রসাদী রচনা। ঈশ্বর কাঁচড়াপাড়ার। রামপ্রসাদ কুমারহট্টের, এখন যার নাম হালিশহর। কাছাকাছি ভূমিখণ্ড। রামপ্রসাদের জন্ম-মৃত্যু সালের যে ইঙ্গিত ঈশ্বর দিয়েছেন, সে হিসেবে প্রসাদের মৃত্যুর ৩০ বছর পরেই তাঁর জন্ম। তবু বিস্ময়কর ভাবে ঈশ্বরের নির্ভরতা লোকশ্রুতিই। প্রসাদের গ্রামে গিয়ে ঈশ্বর খোঁজও নেননি। এর কারণ, কবি ঈশ্বর বুঁদ কবি রামপ্রসাদের কাব্য-ঐশ্বর্যেই। তিনি যে ইতিহাসবিদের কাজও করছেন, তা সম্ভবত বিস্মিত।

তবে, মহৎ কাজ বিফলে যায় না। আলো ক্রমে প্রভাময় হতে লাগল। ‘সংবাদপ্রভাকর’-এ এক পাঠকের চিঠি যেমন। রামপ্রসাদ নিয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ বিষয়ে চিঠি। পত্রলেখক প্রসাদেরই গ্রামের এক প্রবীণ। তিনি দিলেন নতুন কিছু তথ্য। অনামী পত্রলেখক লিখলেন— ‘ওই মহাপুরুষ কেবল কতিপয় প্রাচীন তত্ত্বজ্ঞ ও মর্ম্মগ্রাহি মনুষ্যের নিকট পরিচিত ছিলেন’, ‘শ্রুত আছি যে কবিবরের মিষ্টস্বর ছিল না তথাচ তিনি যখন গান করিতেন শ্রোতৃবর্গের শ্রবণে সেই স্বর মধুর বোধ হইত’, ‘তিনি এক ঈশ্বরবাদী ছিলেন... রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময়ে ছিলেন এবং তাঁহার অধিকারে বাস করিতেন, সুতরাং ভীত হইয়া প্রচলিত ধর্ম্মানুযায়ি প্রকাশ্য উপাসনাদি করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন’। এই সব তথ্যের সবই যে পরীক্ষিত, তা নয়। এর মধ্যে পত্রলেখকের ভাবনা ও জনশ্রুতির প্রতিফলনও রয়েছে। যেমন, অন্য জনশ্রুতি মানলে, প্রসাদ অতি-সুকণ্ঠই। কিন্তু এই প্রথম রামপ্রসাদের নিজের গ্রামের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। উঠল সিরাজদৌল্লার প্রসঙ্গও, যা নবাব-মাহাত্ম্যে আগে থেকেই জনশ্রুতি। প্রবীণ লিখলেন— ‘কবিরঞ্জন নবাবের মনোরঞ্জনার্থে একটি খেয়াল ও একটি গজল গাইলেন’। যদিও সমান্তরাল জনশ্রুতি— হিন্দি খেয়াল বা উর্দু গজল নয়, বাংলার নবাব বাংলা শ্যামাগানই শুনতে চেয়েছিলেন রচয়িতা প্রসাদের কাছে, যা তিনি প্রথম শুনেছিলেন গঙ্গাপথে নৌকায় যাওয়ার সময়।

ঈশ্বর-আন্দাজ সূত্রেই ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’য় দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য রামপ্রসাদের জন্মসাল হিসেবে উল্লেখ করলেন ১৭২০ খ্রিস্টাব্দ বা ১১২৭ বঙ্গাব্দ এবং মৃত্যুসাল ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দ বা ১১৮৮ বঙ্গাব্দ। এখন যদিও ভাবা হয়, রামপ্রসাদের জন্ম ১৭১৮ থেকে ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, মৃত্যু ১৭৭৫ থেকে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক সময়ে। এই সময়কালকে মান্যতা দিলে বড় চমক অপেক্ষা করে।

কী কী ঘটছে এই সময়কালে? ১৭০০ সাল। অশান্ত দেশ। ঔরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁকে বাংলার দেওয়ান বানালেন। ১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ বাংলার সদর। মুর্শিদকুলির নীতিতে দিল্লি-দরবার রাজস্বে উপচে পড়লেও ভিখিরি হল শস্যশ্যামল বাংলা। জন্মাল নতুন জমিদার শ্রেণি, অভিজাতকুল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সে সময়ে তার নিন্দা করলেও পরে নেবে মুর্শিদকুলির পথই, ‘বাবু’ বানাবে অভিজাতকুলকে। মুর্শিদকুলির পরে তখতে সুজাউদ্দিন। ছন্দ একই। ১৭৪০ সালে সফররাজ খুন। সিংহাসনে আলিবর্দি। পরের বছর বাংলায় পঙ্গপালের আক্রমণ। তখন বাংলার রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ যেত মহারাষ্ট্রে। রাজস্ব পাঠাতে পারছেন না আলিবর্দি। দিল্লি মরাঠাদের ইন্ধন দিল বাংলা লুটের। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল— টানা বর্গি হানা। এর পর ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ এবং ১৭৬৯ সালে মন্বন্তর, যা বঙ্গাব্দ অনুযায়ী ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে চেনা। যে দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল।
পঙ্গপালে কৃষিবিপর্যয়, নানা স্তরের শাসকের শোষণে নাগরিকের নাভিশ্বাস, বর্গি আক্রমণ, বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরের পোড়া গন্ধ এবং খরা-মন্বন্তরের ধ্বংসলীলা— এটাই সাধক রামপ্রসাদের সাধনাসময়।

নিম খাওয়ালে চিনি বলে

রামপ্রসাদের পদ জানাচ্ছে, ‘নুন মেলে না আমার শাকে’। দ্বৈতশাসনে হাঁড়ির হাল। রামপ্রসাদের আগে কেউই সেই হালকে বঞ্চনার সুরে বাঁধেননি, ঝলসে নেননি প্রতিবাদের আঁচে। বৈষ্ণব ব্যস্ত কল্পলোকে, রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগে- ভাবসম্মিলনে। মঙ্গলকাব্য ব্যস্ত দৈব কৃপালাভে। এই প্রথম এক কবি ব্যস্ত হলেন সাধারণ মানুষের যন্ত্রণাকে চারণের দ্রুততায় ছড়িয়ে দিতে। মন্বন্তরের কান্না মূর্ত হল প্রসাদের ‘অন্ন দে গো, অন্ন দে গো, অন্ন দে গো, অন্নদা’ পদে। ‘আশার আসা ভবে আসা, আসামাত্র হল/চিত্রের পদ্মেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে রল’ পদের ‘চিত্রের পদ্মে’র অমিত রূপকের পাশেই ‘নিম খাওয়ালে চিনি বলে’র কৌতুকী হাহাকার। একই রকম কান্নাভেজা রূপক কাব্যভাষ— ‘সাগরে যার বিছানা মা, শিশিরে তার কী করিবে’। রামপ্রসাদ সমকালের আয়নাই।

বর্গি হানা বা ভাস্কর পণ্ডিতদের দৌরাত্ম্যের উল্লেখ ভারচতন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ বা গঙ্গারামের ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এর মতো রামপ্রসাদে সরাসরি মেলে না। সম্ভবত জীবনের প্রথম পর্বে সাধনমার্গ প্রাধান্য পাওয়ায় প্রসাদী স্পন্দ তখনও খানিক অনুপস্থিত। যে কারণে রামপ্রসাদ বনাম দ্বিজ রামপ্রসাদ প্রতর্কে ওই পর্বের রচনাকে দ্বিজ রামপ্রসাদের ভণিতায় রামপ্রসাদেরই রচনা বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু জীর্ণ বাংলার কথা নেই রামপ্রসাদে, তা নয়। টালমাটাল অবস্থার কথা রয়েছে পদে পদে। পরের দিকের রামপ্রসাদ সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ। যা বলার বলে দিয়ে রচনাকে ‘মা’ সম্বোধনের মায়ায় গেঁথে নিচ্ছেন। যেন আপন ছাঁচে বাংলার ‘মেটাফিজ়িক্যাল’ কাব্য। নরনারীর প্রেমের পাশাপাশি বিদ্রোহও প্রকাশ পেয়েছিল পাশ্চাত্যের ওই রূপকধর্মী কাব্যধারায়। রামপ্রসাদেও রূপক-বল্কলের আড়ালে গাঁথা রইল সমসময়।

নানা কিসিমের বণিকের আকর্ষ শুষে খাচ্ছে বাংলার প্রাণরস। দেশি-বিদেশি সেই বণিককুলের প্রতি বার্তা রামপ্রসাদের— ‘অনিতা ধরনের আশে ভ্রমিতেছে দেশে দেশে/ও তোর ঘরে চিন্তামণি নিধি, দেখিস না রে বসে বসে’। আবার দেশীয় জমিদারদের অবস্থাও কটাক্ষে আঁকা প্রসাদে— ‘প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তার নামেতে নিলাম জারি/ঐ যে পান বেচে খায়, কৃষ্ণ পান্তি, তারে দিলি জমিদারি’। পেয়াদা লেগেছিল প্রসাদের পিছনেও। কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রকেও। এবং কৃষ্ণ পান্তি ছিলেন ইংরেজ কোম্পানির ধামাধরা নুন ব্যবসায়ী, পরে ভুঁইফোড় জমিদার।

রামপ্রসাদ বাণিজ্যে লক্ষ্মীই দেখছেন, কিন্তু পথটি লক্ষ্মীমন্ত না-হলে কষাঘাত করছেন বণিকগিরিকে। এই কবিই তাঁর আরাধ্যাকে প্রশ্ন করেন— ‘কাজ কি মা, সামান্য ধনে?’ কারণ তিনি জানেন— ‘এ সংসার ধোঁকার টাটি/ও ভাই আনন্দ বাজারে লুটি’। সামাজিক অসাম্য কবিকে ভাবিয়েছে— ‘কারেও দিলে ধন জন মা, হস্তী রথী জয়ী/আর কারও ভাগ্যে মজুরখাটা, শাকে অন্ন মিলে কই/কেউ থাকে অট্টালিকায়, আমার ইচ্ছা তেম্নি রই’। জীবনসূত্রেই লিখছেন— ‘কাজ হারালেম কালের বশে/গেল দিন মিছে রঙ্গরসে’। কাজ তিনি করতেই গিয়েছিলেন। কোথায়, তা নিয়ে বিস্তর গোল। কেউ বলেন, কলকাতায়। কারও মত, হুগলি। কথিত, মুহুরি দফতরের খাতায় গান লিখতেন কবি। সে খাতায় লেখা ‘দে মা আমায় তবিলদারি/আমি নেমকহারাম নই, শঙ্করী’ তাঁর রচিত প্রথম পদ বলেও রয়েছে জনশ্রুতি।

এ-সবের হয়তো ইতিহাসভিত্তি নেই। কিন্তু মিথ্যে নয় যে, রামপ্রসাদ কাজের সন্ধানী ছিলেন সংসার পালনে। কিছু দিন মাসিক ভাতা পেয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ও সার্বণ রায়চৌধুরীরা জমি দিয়েছিলেন। সে দানপত্রও পাওয়া যায়। কিন্তু শোষণ আর অজন্মার কালে জমি ভূমিখণ্ড মাত্র। চাষবাসের অর্জন যায় জোতদার-জমিদারের সিন্দুকে। কবির মন লাগেনি পারিবারিক বৈদ্যগিরিতে। চাকরির ভাবনাতেই ফারসি, আরবি শেখেন সংস্কৃতজ্ঞ রামপ্রসাদ। তবে, অনিশ্চয়তার যুগ তাঁকে নিশ্চিন্ততা দেয়নি। বরং অভাবই ছিল নিত্যসঙ্গী। গোঁড়া কৃষ্ণচন্দ্রের সান্নিধ্য তাঁকে টানেনি। রাজানুকূল্যে ভাবজগতের অনর্থও ঘটাননি। চেষ্টা করেছেন গ্রামজীবনেই সংসারভার বইতে। ভেবেছেন কৃষিকাজের কথা— ‘এ বার আমি করব কৃষি’। কিন্তু অনিশ্চয়তাই শস্য হয়ে উঠেছে। কবি আত্মব্যর্থ কৃষিকাজকে মিলিয়েছেন জীবনদর্শনে— ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না/এমন মানবজমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলত সোনা’। বাঙালিমনে চিরজাগরূক এ-গানের রূপকার্থ। বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ। একই সঙ্গে সাক্ষী সমকালীন অন্ধকারের।

ব্রহ্মময়ীর খাসতালুকে

সে এক সব পেয়েছির দেশ। কৃষিনির্ভর স্বপ্নরাষ্ট্র। যেখানে শিব জমির পাট্টাদাতা এবং সৎ কৃষক। মধ্যেমাঝে ‘শিব হয়েছেন কর্ম্মচারী’ও। যেন রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবায়ন’ কাব্যের অনুরণন। সেই স্বপ্নব্যবস্থায় মনকে নিমন্ত্রণ করছেন প্রসাদ— ‘আয় মন বেড়াতে যাবি/কালী কল্পতরুতলে গিয়া চারি ফল কুড়ায়ে খাবি’। প্রসাদকল্পিত ব্রহ্মময়ীর খাসতালুকে আদালতের ‘সমন’ বা যমের ‘শমন’ ভয় দেখাতে পারে না। শ্রেণিহীন সেই ব্যবস্থায় শোষণ নেই। আছে জ্ঞানরসামৃত পান।

পান প্রসঙ্গেই আসে সুরা। আসে রামপ্রসাদের ‘মাতলামি’ বিষয়ে লোকশ্রুতি, যার অন্যতম হোতা ছিলেন প্রসাদকে দু’চক্ষে দেখতে না-পারা আজু গোসাঁই নামের এক বৈষ্ণব কবি। ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’রই উৎকট প্রতিবয়ান বেঁধেছিলেন আজু— ‘বোলেছে রামপ্রসাদ কবি/আয় মন বেড়াতে যাবি/...ও তুই মদের ঝোঁকে কোত্তে পারিস মাঝগাঙেতে ভরাডুবি’। একের পর এক প্রসাদী গানের প্যারোডির ব্যর্থ বয়ানই প্রমাণ করে, রামপ্রসাদের নিভৃত ভক্তিরসে ভয় পেয়েছিল ব্রাহ্মণ্যসমাজ, বৈষ্ণববলয়। আজু আজ বিস্মৃত। কিন্তু বেঁচে আছে প্রসাদের ‘ওরে সুরা পান করি নে আমি/সুধা খাই জয় কালী বলে/মন-মাতালে মাতাল করে/মদ-মাতালে মাতাল বলে’।

প্রসাদী পদে বারবার এসেছে জ্ঞান-মাধুকরীর কথা। সে মাধুকরী সংসারবিমুখ সাধকের নয়। বরং শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত গৃহী ভক্তের। স্ত্রী-সন্তান নিয়েই আমৃত্যু সংসার রামপ্রসাদের। তাঁর তান্ত্রিকতা নিয়ে জনশ্রুতি থাকলেও পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার ছাড়া তন্ত্রসাধনার ছাপ তাঁর লেখায় নেই। এবং সে পরিভাষাও ব্যবহৃত রূপক-কটাক্ষে। রামপ্রসাদ কঠোর বিরোধী বলিপ্রথার— ‘তুমি খুসি কত্তে চাও কি মাকে, কেটে একটা ছাগলছানা/...কল্লে লোকদেখানো কালীপূজা, মা তো তোমার ঘুস খাবে না’। কারণ, ‘ত্রিভুবন যে মায়ের মূর্তি’। কারণ, তাঁর ‘ব্রহ্মময়ী সকল ঘটে’। এ-কথা সর্বজীব বিষয়ে যেমন প্রযোজ্য, তেমনই ভাবলীন সর্বধর্ম-সর্বশাখা প্রসঙ্গেও— ‘যমুনা আর জাহ্নবীকে/একই ভাবে মনে ভাব না/প্রসাদ বলে, গন্ডগোলে/এ যে কপট উপাসনা/তুমি শ্যাম-শ্যামাকে প্রভেদ করো/চক্ষু থাকতে হলে কানা’। শাক্ত আর বৈষ্ণবের মিলনসুরের সঙ্গে আপন অদ্বৈতবাদে কবি মেলাচ্ছেন বহু পরে শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত ‘যত মত তত পথ’ ভাবনাকে— ‘জেনেছি জেনেছি তারা, তুমি জানো ভোজের বাজি/যে তোমায় যে ভাবে ডাকে, তাতেই তুমি হও মা রাজি/মগে বলে ফরাতারা, গড বলে ফিরিঙ্গী যারা, মা/খোদা বলে ডাকে তোমায় মোগল পাঠান সৈয়দ কাজী/...শ্রীরামপ্রসাদ বলে, কালী জেনো এ সব জনে/এক ব্রহ্ম দ্বিধা ভেবে মন আমার হয়েছে পাজী’। ‘জাতি-ধর্ম সর্পখেলা’য় রাজি নন প্রসাদ।

করপুটে প্রসাদ

কত গান বেঁধেছেন রামপ্রসাদ, জানা যায় না। ‘লাখ উকিল করেছি খাড়া’ তাঁরই একটি পঙ্‌ক্তি, যা থেকে ভাবা হয়, লক্ষ পদের রচয়িতা তিনি। অমূলক ধারণা। উকিল খাড়া করার ইঙ্গিতটিকে ‘প্রচুর’ অর্থেই ব্যবহার করেছেন কবি। তবে, সংখ্যায় খুব কম হওয়াও অস্বাভাবিক। কারণ, প্রসাদ পরে পদাবলিতেই মন দেন। সকরুণ সাফল্য আমাদের, পুঁথিকে সচন্দন-সিঁদুরে পুজো করে বহু রত্নকে নষ্ট করতে সমর্থ হয়েছি আমরা! তাই মাত্র কয়েকশো পদই মেলে রামপ্রসাদের।
তাঁর পদ যুগের কথ্য ভাষায় বাঁধা। রূপকের আশ্রয় নিলেও প্রসাদ অরাজি তৎসম কাব্যভূষণে। সদ্যনির্মিত কৃত্রিম সাধুভাষার ধার ধারেননি। তাঁর পদে দেদার স্থান ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি শব্দের। ব্যবহার আইন, আদালত, জমিজমার দুনিয়ার শব্দের। যেমন— খাসতালুক, সওয়াল, মোকদ্দমা, তছরুপ, দস্তাবেজ, মিছিল, জমাবন্দি, ঘুষ, কর্জ, আমদানি, পাট্টা, কবুলতি প্রভৃতি। স্থান পেয়েছে কিছু তন্ত্র-আখর, তৎসম শব্দও। বাকি যাপন-উৎসারিত শব্দমালা। পরবর্তী বাংলা ভাষা যে পথে এগোবে, তারই যেন রূপরেখা আঁকছেন হালিশহরের রামপ্রসাদ।

রামপ্রসাদী

রামপ্রসাদ ‘রামপ্রসাদী’ হয়েই বহমান বাংলার গানজীবনে। তাঁর সার্থক প্রভাব কমলাকান্ত ভট্টাচার্যে। পরে লালনের গানে ছায়া রামপ্রসাদের। যেমন, ‘রাসুল রাসুল বলে ডাকি’ বা ‘এক ফুলে চার রং ধরেছে’। প্রসাদ-প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথের গানে ‘রাগ রামপ্রসাদী’র উল্লেখ মেলে। যেমন, ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’, ‘প্রিয়ে তোমার ঢেঁকি হলে’, ‘আমিই শুধু রইনু বাকি’ প্রভৃতি। প্রভাব রয়েছে দ্বিজেন্দ্রলালে— ‘কে তোমারে জানতে পারে’। ‘মিছে তুই ভাবিস মন’ বাঁধার সময় অতুলপ্রসাদে রামপ্রসাদই ভর করেন। রজনীকান্তের ‘আমায় পাগল করবি কবে’ প্রসাদেরই অনুরণন। নজরুলের ‘থির হয়ে তুই বোস দেখি, মা’ ভনিতা-বিহীন রামপ্রসাদীই।

এই সুরচলন রামপ্রসাদের হলেও এটিই একমাত্র প্রসাদী সুর-আঙ্গিক নয়। যদিও ‘রামপ্রসাদী’ বলতে এটাই আধুনিক সময়ে চিহ্নিত। কিন্তু রামপ্রসাদ একজন দক্ষ সঙ্গীতকারও। তাঁর কাব্যে, পদে মার্গগানের নানা রাগ-রাগিণী, তালের উল্লেখ মেলে। তার মধ্যে কিছু রাগিণীর ব্যবহার অবলুপ্ত। চেনা রাগরূপ অনুসরণে পরে অনেকেই প্রসাদী পদের গায়নরূপ ভেবেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁদের তুঙ্গ প্রতিভার কারণেই প্রসাদী রাগরূপের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রসাদী গানকাঠামোয়। রবীন্দ্রনাথ রামপ্রসাদকে উত্তরীয় করেছেন। নজরুল রামপ্রসাদে স্নান করে নিজ-নির্বাচিত রাগপথে এগিয়েছেন।

রাগাশ্রয় নিলেও রামপ্রসাদ নদী, মাঠঘাটের সুরেই ঝুঁকেছেন বেশি। কারণ, তাঁর লক্ষ্য সাধারণ মানুষ। পরে যেমন লালনের। তাই প্রসাদে বাউল-ভাটিয়ালি-কীর্তনের আঙ্গিক। তবে, প্রসাদের কীর্তন বৈষ্ণবের সঙ্কীর্তন নয়, তা নির্জন এককের সহজ গান।

এই জায়গাতেই শ্রীরামপ্রসাদ সেন বাংলার চিরস্মরণীয় সুফি-বাউলের নাম। যাঁর হাতে সহজিয়া একতারাই মানানসই। ঝংকৃত রুদ্রবীণা নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Ramprasad Sen History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy