Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
রক্তকরবী ১

বার বার ফিরে আসে

রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘রক্তকরবী’। এ বার ফেরালেন গৌতম হালদার। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়‘‘ভয় হচ্ছে, পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করবার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দন্তস্ফুট করতে পারবে না।’’ বারোয়ারি সভায় অভিনয়ের আগে নিজেরই নাটক ‘রক্তকরবী’ নিয়ে এমনই কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! এক সময় শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাটককে বলতেন, আড়ষ্ট সংলাপে ভরা। যদু-মধু-হরি-শ্যামের মন এর মধ্যে প্রকাশ পায় না। পরে সে-মত তিনিই খণ্ডন করেন।

নাটকের মহলায়। ছবি: প্রণব বসু

নাটকের মহলায়। ছবি: প্রণব বসু

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

‘‘ভয় হচ্ছে, পালা সাঙ্গ হলে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন। তারা পালাটিকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করবার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দন্তস্ফুট করতে পারবে না।’’

বারোয়ারি সভায় অভিনয়ের আগে নিজেরই নাটক ‘রক্তকরবী’ নিয়ে এমনই কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ!

এক সময় শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাটককে বলতেন, আড়ষ্ট সংলাপে ভরা। যদু-মধু-হরি-শ্যামের মন এর মধ্যে প্রকাশ পায় না। পরে সে-মত তিনিই খণ্ডন করেন।

আজ পর্যন্ত অমসৃণ সময়ের চড়াই-উৎরাই ধরতে কত শত বার যে বাংলা থিয়েটার রবীন্দ্রনাথে ফিরে গেছে, কে জানে!

সদ্য তার আরও একটি সংযোজন। ‘সন্দর্ভ’ নাট্যদলের ‘রক্তকরবী’। প্রথম শো ২৮ ফেব্রুয়ারি, অ্যাকাডেমি। সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

পরিচালনায় জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চিত্রপরিচালক ও ‘কাছের মানুষ’, ‘নষ্টনীড়’-এর মতো নাটকের প্রাণপুরুষ গৌতম হালদার।

গৌতমের পরিচালনায় এই একই নাটক ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্য দল করেছিল বছর কয়েক আগে। পঁচাশিটি শো-ও হয় তার। কিন্তু সে-প্রযোজনার সঙ্গে এই মঞ্চায়ন ১৮০ ডিগ্রি না হোক, অনেকটাই ঘুরে।

•••

পর্দা ওঠার অল্প আগেই নাটকের সুর-তাল-লয়টি বেঁধে দিয়ে যায় উস্তাদ রাশিদ খানের আলাপ। গান নয়, সে যেন হাহাকার, নাকি কান্না, নয়তো থমথমে ভয়ার্ত সময়ের চাপা আর্তনাদ, কী বলব তাকে!

পর্দার আড়াল সরলেই কালাসনিকভের টানা আওয়াজ, চিৎকার, লাঠিয়ালের এলোপাথাড়ি দৌড়, লাঠির আগায় মৃত শরীরের ভেসে ওঠা, অ্যাম্বুল্যান্সের সাঁ সাঁ হুঁশিয়ারি— আতঙ্ক যেন পাহাড়ি জোঁকের মতো চেপে বসে।

হালকা নীল আলোয় মঞ্চ ধরা দেয়। ব্যাকস্টেজে আঁকিবুঁকি কাটা ঝলমলে স্বচ্ছ জাল উঁচু থেকে ঝুলছে। তার সামনে পর পর টানা কাঠের ফ্রেম পাশাপাশি জুড়ে দরজার মতো আকার নিয়েছে।

দরজার চওড়া ফ্রেমে গুচ্ছ গুচ্ছ চতুর্ভুজ, ত্রিভুজ সাঁটা। অনেকটা পিকাসোর ‘কিউবি়জম’-কে মনে করায়। পায়ের দিকে সার দেওয়া বক্ররেখা আঁকা। একসঙ্গে যেগুলো দেখলে কখনও মনে হয় আলজমি, কখনও আবার নদীও। ফ্রেমের মাথায় ছুঁচলো ছুঁচলো বর্শার ফলা।

এই দরজাগুলোর বাঁ ধারে শক্তপোক্ত আরও একটি দরজাবিশেষ। তার এক পাশে শেকল নেমেছে। ওপর দিকে ধ্বজা। বৃত্তাকার নকশা উঁচু উঁচু হয়ে বসে হিলহিলে সাপের মতো ভয় দেখাচ্ছে যেন!

পুরোটা জুড়ে মনে হয়, সর্বোচ্চ ক্ষমতার গা ঘেঁষটে দাঁড়ানো ন্যাড়া, এলোমেলো, জড়সড়, মৃত, কী মুমূর্ষু একটা ভূখণ্ড।

শব্দ-সেট-আলো মিলে যে সময়টা খাড়া হয়ে যায় মুহূর্তে, তার কোনও নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার নেই। ভৌগোলিক ম্যাপ তো নেই-ই। কিন্তু দেশ-কাল-সময়ের বেড়া ঠেলে সে যেন অতি চেনা। এ দেশ, নয়তো পাশের দেশ। কিংবা তারও পাশের দেশ। ভারত পেরিয়ে সিরিয়া-আফগানিস্তান-ইরাক…!

যে জন্যই হয়তো এক সময় ভাবা হয়েছিল এ-নাটক বুঝি বা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা। আরেক সময় মনে হয়েছে নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে।

অথচ ‘রক্তকরবী’ যত বার এসেছে তত বারই মিলে গেছে কোনও না কোনও ক্ষমতার মুখ, তার ভাষা। তার দমন, তার শাসন। তার অবিচার। অত্যাচার।

•••

জায়গাটার নাম যক্ষপুরী। পুরাণে এখানেই নাকি ছিল ধনদেবতা কুবেরের সিংহাসন।

কিন্তু এ নাটক একেবারেই পুরাণের নয়। এখানে মাটির নীচে যক্ষের ধন পোঁতা আছে। তারই সন্ধান পেয়ে পাতালে সুড়ঙ্গ-খোদাই চলেছে।

এ দেশের রাজা (দেবাশিস মৈত্র) থাকেন আড়ালে। তাঁর শাসন চলে সেখান থেকেই। প্রকৃতি, মানুষ সব কিছুকেই তিনি ক্ষমতার কল বানিয়ে ছেড়েছেন।

মানুষগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক। যন্ত্রণায় দুঃখে ক্ষোভে অস্থির। যে কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। তার মধ্যেই সন্দেহের বাতাবরণ গাঢ় হয়। চরবৃত্তি চলে। রাজার নামে শাসন চালায় তাঁর সর্দার (সৌম্য মজুমদার)।

এ দেশে প্রায় উড়ে আসে নন্দিনী (চৈতী ঘোষাল)। নন্দিনী মানবী। কিন্তু প্রজাতির ইতিহাসে, যুক্তির আলোয় তাকে ধরা যায় না। এমনকী আচারে-আচরণে-চেহারায় নন্দিনী কখনই যক্ষপুরীর মতোও নয়। বশ্যতা তার পোষায় না। ক্ষমতাকে সে চ্যালেঞ্জ জানায়। ভয় দেখানোর ব্যবসাকে সে ঘৃণা করে। রাজাকে সে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। ছলে কৌশলে রাজার ভয়ঙ্কর রূপটা প্রত্যক্ষ করেও তাঁকে ‘অতিমানব’ বলতে সে নারাজ।

রক্তকরবী নিয়ে নন্দিনী প্রতীক্ষা করে রঞ্জনের। তার বিশ্বাস, যক্ষপুরীর মৃতপ্রায় মানুষগুলোর মধ্যে একমাত্র রঞ্জনই পারে প্রাণসঞ্চার করতে। নন্দিনী বলে, ‘‘দুই হাতে দুই দাঁড় ধরে সে আমাকে তুফানের নদী পার করে দেয়। বুনো ঘোড়ার কেশর ধরে আমাকে বনের মধ্যে দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায় … জীবন সর্বস্ব পণ করে সে হারজিতের খেলা খেলে।’’

রঞ্জনকে কখনও মনে হয়ে নন্দিনীর প্রেমিক। কখনও আবার মানুষই নয়, যেন দেবদূত। নয়তো কোনও বিদ্রোহী নায়ক।

কী তাও নয়, কোনও দর্শন। অনাগত যুগ, কালের প্রতীক। নন্দিনী যার বাহক। পরাগমিলনে মৌমাছি যেমন।

নন্দিনীকে ঘিরেই নড়েচড়ে ওঠে যক্ষপুরী। আর তখনই সজাগ হয় প্রশাসন। এক দিকে ফৌজ নামে। অন্য দিকে ছদ্ম সুখের পসরা ছড়িয়ে, ভুল কথায় মোহ ধরিয়ে বেপথু করে দেওয়া হয় হা-ঘরে, হা-ভাতেদের।

যুগে যুগে যেমনটা হয়।

•••

নন্দিনীকে প্রাণপণে গড়ছেন চৈতী। সেই কোন শৈশবে বহুরূপী-র ‘ডাকঘর’ থেকে যাঁর রবীন্দ্র-নাটকে ঢোকা। তার পর থেকে ‘তৃপ্তি মিত্র’ হয়তো’বা তাঁর মননে, কিন্তু শরীরী ভাষায়, উচ্চারণের তীব্রতায়, নাটকীয় ক্ষিপ্রতায় তৃপ্তি মিত্রীয় ঘরানা থেকে বেরনো এই চৈতীর ‘নন্দিনী’ যেন অনেকটা উচ্চকিত। কঠোর। রূঢ়। স্বজনহারানো শ্মশানে প্রতিশোধের জন্য উগ্র। তবে শুধু চৈতীতে নন, রাবীন্দ্রিক নাটকের ক্ল্যাসিকাল ঘরানা থেকে কোথায় যেন সরে অন্য খানে তাঁবু ফেলেছেন নির্দেশক গৌতম হালদার। যার সঙ্গে তুখড় ভাবে মিলেছে তার মিউজিকের লাইন-আপ। যা এক কথায় মহাতারকাখচিত। উস্তাদ রাশিদ খান তো আছেনই, আছেন উস্তাদ আমজাদ আলি খান, আমান আলি খান, আয়ান আলি খান, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, কৌশিকী চক্রবর্তী।

একের পর এক বয়ে গেছে ধ্রুপদীর আলাপ ও আওচার। কিরওয়ানি, মাড়োয়া, পিলু, দরবারি…। সরোদের মিড়, আলাপের গমকে কখনও ঢুকে পড়েছে অর্কেস্ট্রেশন। তাকে আবার ভেঙে রবীন্দ্রগান।

মুগ্ধবিস্ময়ের রেশ মিলোতে না মিলোতেই চোখের কোণে বাষ্প জমে। এক এক সময় ভয়ের দমক শরীরে ঢুকে কাঁপন লাগায়।

অভিনয়ের ছন্দ, সুরের অঙ্গ ধরে কোরিওগ্রাফ আসে। যায়। যার প্রত্যেকটি চলাচলে সময়ের আসন, কালের নিয়ম পাতা থাকলেও দুইয়েরই সম্প্রসারণটি বারবার চোখে পড়ে। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়েই তো ‘রক্তকরবী’ আজও ফিরে ফিরে আসে।

আসতেই থাকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy