Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Radhanath Sikdar

প্রথম স্বদেশি বিজ্ঞানী

হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট গণিতবেত্তা। আরও নানা প্রতিভার অধিকারী। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় ‘ডিরোজিও-বৃক্ষের উৎকৃষ্ট ফল’। অথচ জরিপবিদ পরিচয়টুকু ছাড়া ভবিষ্যৎকাল আর মনে রাখল না রাধানাথ শিকদারকে। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট গণিতবেত্তা। আরও নানা প্রতিভার অধিকারী। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় ‘ডিরোজিও-বৃক্ষের উৎকৃষ্ট ফল’।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩৭
Share: Save:

হিমালয়ের কোলে মুসৌরী, দেহরাদূন কিংবা এই বঙ্গের ফরাসডাঙা— সর্বত্রই তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য গল্প প্রচলিত। কথিত আছে, ১৮৫০-এর পর থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী এমন কোনও শিক্ষিত বাঙালি ছিলেন না, যাঁর কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু কাহিনি জানা যেত না। এটা অতিশয়োক্তি হলেও, সে কালে শিক্ষিত বঙ্গজন মাত্রেই গণিতশাস্ত্রে তাঁর প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি এবং শারীরিক বলের প্রশংসা করে থাকতেন। ব্যক্তিত্বটি সম্ভ্রমের যোগ্যও বটে। ইংরেজ বা ফরাসি হোন অথবা বাঙালি, কোনও ভাবে আলাপ হলেই তাঁকে হয় ভয়-ভক্তি করতেন, নয়তো মনে মনে পুজো করতেন। ১৮৭০ সালের ২৩ মে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় লেখা হয়— “গণিতাধ্যাপক ডাক্তার টাইটলার তাঁহাকে প্রতিভাসম্পন্ন মনে করিতেন এবং তিনি ও রাজনারায়ণ বসাক হিন্দু জাতির মধ্যে সর্বপ্রথমে তাঁহার নিকট নিউটনের প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যপাঠে প্রভূত আনন্দ লাভ করিতেন এবং মাসিক পত্রিকার জন্য প্লুটার্ক ও জেনোফেন লিখিত গ্রন্থ হইতে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি কড়া ধরনের লোক ছিলেন এবং সদ্য সদ্য কর্মনির্বাহ করিতেন এবং কার্যকারণকালে ক্ষিপ্রকারিতার ন্যূনতা তাঁহাতে কখন পরিলক্ষিত হয় নাই। রাধানাথ অসাধারণ লোক ছিলেন ও তাঁহার অনেক সদ্‌গুণ ছিল।” (বঙ্গানুবাদটি আর্যদর্শন পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত) আক্ষরিক অর্থেই এক বহুমুখী প্রতিভা— একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জরিপবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। তিনি ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষায় নতুন ভোর নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন, কিন্তু আজ কেবল এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা মাপকের পরিচিতিতেই হারিয়ে গিয়েছেন। রাধানাথ শিকদার মানুষটি তার চেয়ে বড়, অনেক অনেক বড়।

হিন্দু কলেজ ইতিবৃত্ত

রাধানাথের জন্ম কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো এলাকার শিকদার পাড়ায়, ১৮১৩ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর বাবা তিতুরাম শিকদার ও তাঁর পরিবার ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব, কলকাতার আদি নিবাসী। জ্যেষ্ঠপুত্র রাধানাথকে পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের কাছে পড়ানোর পরে ফিরিঙ্গি কমল বসুর স্কুলে ভর্তি করে দেন তিতুরাম। স্কুলটি ছিল ৪৮ নম্বর চিৎপুর রোড। এর পর ১৮২৪ সালে রাধানাথ হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে সাত বছর দশ মাস পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। আর এই সময়েই তাঁর প্রতিভা, ব্যুৎপত্তি, চিন্তাশক্তির বিস্ময়কর স্ফুরণ দেখা যায়। কলেজের সব শিক্ষকেরই স্নেহভাজন ছিলেন। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন প্রবাদপ্রতিম প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িও। তাঁর মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে যে ক’জন ছাত্র ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এ যুক্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিলেন রাধানাথ। সঙ্গে পেয়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দের, যাঁদের কারও কারও সঙ্গে রাধানাথের আজীবন বন্ধুত্ব বজায় ছিল।

স্কুলজীবন সম্পর্কে দিনলিপি লিখতেন রাধানাথ। সেই রচনায় যেমন তাঁর হিন্দু কলেজের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়, তেমনই ধরা পড়ে সাবেক প্রতিষ্ঠানটির ছবিও। তিনি লিখছেন, ১৮২৪ সালে তিনি কলেজের নবম (অর্থাৎ সবচেয়ে নিচু) শ্রেণিতে ভর্তি হন। উঁচু শ্রেণির ছেলেরা নিচু ক্লাসের উপরে অযথা ক্ষমতা ফলাত। তার কারণ, তখন শিক্ষকসংখ্যা খুব কম ছিল, সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররাও নিচু শ্রেণিতে পড়াত। তারা শিক্ষকের জায়গা পেয়ে ‘বালকস্বভাবসুলভ অভিলাষ, অনভিজ্ঞতা, অথবা ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া’ বয়সে ছোটদের নির্দয় ভাবে মারধর করত। এর জন্য প্রায় কেউ শাস্তিও পেত না। রাধানাথের ভাষায়, “এই জন্যই উচ্চশ্রেণিস্থ বালকদিগের ভয়ে অথবা তাহাদিগকে বাধ্যকরণ মানসে, নিম্নশ্রেণিস্থ বালকেরা তাহাদের বশীভূত থাকিত। তাহাদের প্রাধান্য ও ক্ষমতা যাহাতে বিস্তারিত হয় সেইজন্য তাহারা সর্ব্বদাই গাম্ভীর্য্য ও প্রাধান্যসূচক ভাবভক্তি ব্যক্ত করিত।”

তখন হিন্দু কলেজে দশটি শ্রেণি ছিল। ১৮২৬ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে উন্নীত হন রাধানাথ, ডিরোজ়িওর ছাত্র হওয়ার সুযোগ পান। এর আগে তিনি মলিস সাহেবের কাছে ব্যাকরণ পড়েছিলেন, এ বার শিখলেন ইংরেজি রচনা, ব্যাকরণ, পদ্য প্রভৃতি। তবে কলেজজীবনে তাঁর কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিলেন গণিত শিক্ষক ডক্টর টাইটলার, সংস্কৃত ভাষাতেও যাঁর অগাধ দখল ছিল। রাধানাথ সে সময়ে হিন্দু কলেজের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, তাঁর অগাধ প্রতিভা দেখে টাইটলার তাঁকে নিউটনের বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়িয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যামিতির এমন একটি সম্পাদ্য সমাধান করে ফেলেছিলেন, যা গ্লিনিংস ইন সায়েন্স (জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ১৮৩১) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমাধান সম্পূর্ণ ভাবে ছিল রাধানাথের নিজস্ব আবিষ্কার। ১৮৩২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি যখন হিন্দু কলেজ ছাড়লেন, সে সময় তাঁকে দেওয়া সার্টিফিকেটে লেখা ছিল— ‘ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এবং অন্যান্য বিষয়সমূহের মূল সূত্রে তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন।’ নীচে ডেভিড হেয়ার, হোরেস হেম্যান উইলসন, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, রসময় দত্তের মতো বিশিষ্টদের সই ছিল। উল্লেখ করতে হয়, বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে রাধানাথের অন্যান্য গুণের স্ফুরণও এই হিন্দু কলেজেই ঘটেছিল। প্রত্যেক বছর কলেজের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভায় অংশগ্রহণ করে সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে নিতেন তিনি। ১৮২৮ সালের সভায় ‘ফার্স্ট সিন অব ভেনিস প্রিজ়ার্ভড’ থেকে ‘জ্যাফিয়ের’ অংশটি আবৃত্তি করে শোনালেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাধানাথ। দ্য কোয়ার্টারলি ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজ়িন-এর প্রতিবেদনে তাঁর প্রশংসা ছাপা হল। ১৮৩১-এর সভায় প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাধানাথ পাঠ করলেন স্বরচিত প্রবন্ধ। তার বিষয় ‘The cultivation of the sciences is not more favourable to individual happiness, nor more useful and honourable to a nation, than that of polite literature.’ দ্য এশিয়াটিক জার্নাল অ্যান্ড মান্থলি মিসেলেনি-র ১৮৩১ অগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিতও হল সেই প্রবন্ধ।

এ ভাবেই প্রত্যেক বছর তৎকালীন বঙ্গসমাজের বিশিষ্ট মানুষেরা এই কিশোরের প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকল।

জরিপবিদ ‘কম্পিউটার’

রাধানাথের পরিবারের ছিল বিপুল অর্থকষ্ট। কলেজে পড়াকালীন, ১৮ বছর বয়সেই সার্ভে অফিসে চাকরিতে ঢুকলেন রাধানাথ। কলেজ পাশ করলেন পরের বছর। তিনি যোগ দিলেন ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে, পদের নাম ‘কম্পিউটার’, বেতন মাসে ৩০ টাকা। গৌরবের কথা, এই পদে সেই প্রথম কোনও ভারতীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। রাধানাথের বিস্ময়কর প্রতিভা, পড়াশোনার গভীরতা, গবেষণার ব্যাপ্তি, উদ্ভাবনী শক্তির কারণে টাইটলারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। টাইটলারই তাঁর নাম প্রস্তাব করেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্টের কাছে, যাঁর সান্নিধ্য ভবিষ্যতে রাধানাথের কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

এভারেস্ট ছিলেন ‘সার্ভেয়র জেনারেল অব ইন্ডিয়া’র সুপারিনটেনডেন্ট। রাধানাথের কাজকর্মে তিনি একেবারে মুগ্ধ। বস্তুত, রাধানাথের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, তাঁকে নিজের ডান হাত বলতেন। ১৮৩৭ সালে এক বার হিন্দু কলেজের বেশ কিছু প্রথম সারির কৃতী ছাত্র ডেপুটি কালেক্টরের পদে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন। প্রার্থী ছিলেন রাধানাথও। সে কথা জানতে পেরেই প্রমাদ গনেন এভারেস্ট। তিনি বুঝেছিলেন, রাধানাথ চলে গেলে ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের অসুবিধে তো হবেই, তবে এক ভারতীয় প্রতিভারও অপমৃত্যু ঘটবে। তিনি সরকারকে এমন ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন, যাতে এই সব ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনও দেশীয় কর্মচারী বিভাগ পাল্টাতে না পারেন। এই সূত্রে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারি করেন। রাধানাথ রয়ে যান সার্ভেতেই। কোনও কোনও গবেষকের মত, এ সময় তাঁকে চাকরিতে রেখে দিতে বেতনও বাড়ানো হয়েছিল। তবে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, ফলাফল যে তাঁর ও তাঁর দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল, এ নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহ নেই।

অবশ্য এর পরেও সার্কুলার অগ্রাহ্য করে রাধানাথ ভিন্ন চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেটা ১৮৫০ সাল, কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট পদ খালি হয়েছিল। রাধানাথ সম্ভবত কিছুটা বেশি বেতনের আশাতেই সেই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তত দিনে এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করেছেন, সার্ভেয়র জেনারেলের পদে এসেছেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনিও বলতেন, রাধানাথের মতো প্রতিভাধর, পরিশ্রমী গণিতবিদ ও জরিপবিদ পাওয়া দুষ্কর, তিনি বিভাগের সম্পদ। সরকারের কাছে তাঁর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করলেন ওয়া। সঙ্গে এভারেস্টের মতোই লিখলেন একটি প্রশস্তি চিঠি। সে যাত্রাতেও চাকরি পাল্টানো হল না রাধানাথের। এবং তাঁর সম্বন্ধে ওয়া-র এই অসীম শ্রদ্ধা বজায় ছিল চির দিন। ১৮৫০ সালের ২০ অক্টোবর ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ‘হাউস অব কমন্স’-এ একটি দীর্ঘ রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছিল ওয়া-কে। সহকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে রাধানাথের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

আসলে, ভারতে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে জরিপের কাজ করার জন্য নিজস্ব যে সব অভিক্ষেপ পদ্ধতির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন এভারেস্ট, সেগুলিরই কিছু কিছু পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ। তাই তিনি ছিলেন অপরিহার্য। পরে ১৯৫১ সালে এই সংক্রান্ত যুগান্তকারী কাজ ‘A set of Tables for facilitating the computation of Trigonometrical Survey and the projection of Maps for India’ প্রকাশিত হয়। রাধানাথের তৈরি এই টেবল সার্ভের কাজে খুবই ব্যবহৃত হত। এভারেস্ট উদ্ভাবিত ‘রে ট্রেস মেথড’-ও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ।

পাহাড়ের মাপজোক

১৮৪৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেন এভারেস্ট, স্থলাভিষিক্ত হন ওয়া। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শৃঙ্গকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ৩১টি শৃঙ্গের স্থানীয় নামকরণও করে ফেলে সার্ভে বিভাগ। বাকিগুলি তখন সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হত। তেমনই ছিল ১৫ নম্বর শৃঙ্গ।

সালটা ১৮৫২। পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। রাধানাথ তখন ৬০০ টাকা বেতনে প্রধান কম্পিউটার পদে অধিষ্ঠিত। শোনা যায়, হঠাৎ একদিন ছুটতে ছুটতে এসে ওয়া সাহেবকে তিনি বলেন, “স্যর, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আবিষ্কার করে ফেলেছি।” সরকারি ভাবে সেই ঘোষণা হতে আরও বছর চারেক সময় লেগেছিল। বারবার হিসেবের পর ১৮৫৬ সালে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৫ নম্বর শৃঙ্গটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ। নাম দেওয়া হয় ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। বর্তমানে নেপালে অবস্থিত এই শৃঙ্গটির অবশ্য তখনই স্থানীয় একটি তিব্বতি নাম ছিল, ‘চোমোলুংমা’, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর মা’।

১০০ মাইলের মতো দূর থেকে এই শৃঙ্গের উচ্চতার বেশ কয়েকটি পরিমাপ নিয়ে যখন গড় করা হয়, তখন হিসেব আসে ঠিক ২৯,০০০ ফুট। কিন্তু এমন ‘রাউন্ড ফিগার’ সার্ভেয়ারদের ধন্দ জাগায়। তাঁরা এ-ও ভাবেন যে, নিটোল সংখ্যা দেখে জনসাধারণের মনে শৃঙ্গের উচ্চতা সম্পর্কে অবিশ্বাস দানা বাধতে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত ২ ফুট যোগ করে শৃঙ্গের উচ্চতা দাঁড়ায় ২৯,০০২ ফুট; ১৯৫৪ পর্যন্ত যা ছিল সরকারি হিসেব। পরে অবশ্য এভারেস্টের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯,০২৮ ফুট।

কিন্তু বহু দিন যাবৎ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। ১৮৮৪ সালে আর্যদর্শন পত্রিকায় যখন রাধানাথের দিনপঞ্জি ও অন্যান্য তথ্য সাজাচ্ছেন তাঁর জীবনীকার যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন উচ্চতম শিখরটির নাম ও উচ্চতা জ্ঞাত হলেও গণনাকারীর নাম ফাইলবন্দি, অর্থাৎ জনসমক্ষে অপ্রকাশিত। জীবনীকার লিখছেন, “যৌবনের প্রারম্ভে গৃহত্যাগী হইয়া সত্যের অনুসন্ধানে কর্নেল এভারেস্টের সহিত হিমালয় শিখরে শিখরে পর্যটন করিয়াছিলেন।” আর পাদটীকায় জানাচ্ছেন, “উক্ত মহাত্মার নামেই হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘এভারেস্ট শৃঙ্গ’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইনিই রাধানাথের পরম বন্ধু ও শিক্ষক ছিলেন।” রাধানাথের পরবর্তী জীবনীকার শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯০৩ সালে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ বইয়ে ‘নব্যবঙ্গ’-এর নায়ক তথা রামতনুর সুহৃদবর্গের অন্যতম রাধানাথ প্রসঙ্গে অনেক কথা লিখলেও সেখানে শৃঙ্গের কোনও উল্লেখ মেলে না। রাধানাথ প্রধান কম্পিউটারের পদে পৌঁছেছিলেন; সার্ভে সংক্রান্ত গণিতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, কর্নেল থুলিয়ার সার্ভে বিষয়ে যে বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন, তার প্রধান গণনাগুলি রাধানাথই লিখে দিয়েছিলেন— এইখানেই রাধানাথের প্রতিভা-বর্ণন সমাপ্ত হয়। ১৯১৯ সালে প্রবাসী পত্রিকায় সত্যভূষণ সেন লিখছেন, উচ্চতম শিখরের নাম কত দূর সঙ্গত হয়েছে তা বিবেচ্য, কেননা এভারেস্টের সঙ্গে এই শৃঙ্গ আবিষ্কারের সরাসরি কোনও যোগাযোগই নেই। এ প্রবন্ধ উল্লেখ করেছিল, “যে ভাগ্যবান পুরুষ প্রকৃতপক্ষে ইহাকে দেখিয়া, উহার উচ্চতা পরিমাপ করিয়া সর্বপ্রথম ইহাকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার নামানুসারে ইহার নামকরণ করিলেই যথার্থ ও সর্ববাদিসম্মত হইত।” যদিও গণনাকারীর নামটি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি প্রাবন্ধিক। কেবল এক বার প্রসঙ্গ উসকে দিয়ে লিখেছিলেন, “জানি না ঘটনাক্রমে একজন এদেশীয় লোকের পক্ষে সে সৌভাগ্য ঘটিয়াছিল কিনা এবং সে জন্যই সে বেচারার নাম একেবারে বিস্মৃতির সাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল কিনা।” শেষ অবধি ১৯২৮ সালে প্রবাসী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল সেই ‘ভাগ্যবান পুরুষ’-এর নাম। এবং ১৯৩২ সালে যোগেশচন্দ্র বাগল বিস্তারিত আলোচনা করে রাধানাথকে বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গের গণনাকারী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

অন্য আলোয়

একটা দীর্ঘ সময় এভারেস্টের উচ্চতা মাপকের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। আবার সেই তথ্য জনসমক্ষে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর অবশিষ্ট পরিচয়গুলো চাপাই পড়ে গেল। জরিপবিদ রাধানাথ নিশ্চয়ই নমস্য, অগ্রগণ্য। কিন্তু তিনি যে ভারতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চারও পথিকৃৎ, তা ভুলে যাই কী করে?

জরিপের কাজ করতে গিয়েই এসেছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান, তাতে আগ্রহী হয়েছিলেন রাধানাথ। ১৮৫১ সালে ভারতে প্রথম জরিপ-সম্পর্কিত বই আ ম্যানুয়াল অব সার্ভেইং ফর ইন্ডিয়া প্রকাশিত হয়। এর ‘Part-V’-টি লিখেছিলেন রাধানাথ, যার শিরোনাম ‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশনস টু সার্ভেইং’। সেখানেই জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে বিস্তৃত করেন লেখক। ‘অব দ্য ফিক্সড স্টারস’ নামে একটি অত্যন্ত জরুরি নিবন্ধ লেখেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে রাধানাথ আর একটি কৃতিত্বের ছাপ রেখেছিলেন ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভেতে। ‘সার্কামপোলার স্টারস’, অর্থাৎ যে তারাগুলো কখনও অস্ত যায় না, সার্ভেতে সেগুলিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ফর্মুলা নিরূপণ করেছিলেন এভারেস্ট। সেই দু’টিকে নিখুঁত ভাবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করেন রাধানাথ এবং সার্ভেতেও যে তা কাজে লাগানো যেতে পারে, তা-ও জানিয়ে দেন। ইন্ডিয়া মেটেরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, কলকাতার প্রাক্তন ডিরেক্টর অজানা চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৩ সালে কলকাতার আকাশে নক্ষত্রদের সংক্রমণ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে জাহাজ চলাচল যাতে সুষ্ঠু ভাবে হতে পারে, সে জন্য সময়-সিগন্যালের ব্যবস্থাও করেছিলেন রাধানাথ। তিনিই জানান, ভারতে আবহাওয়া বিজ্ঞানেরও প্রধান পথপ্রদর্শক ছিলেন রাধানাথই। ১৯৫২ সালে এ বিষয়ে তাঁর সবচেয়ে জরুরি কাজটি প্রকাশিত হয়েছিল।

আগেই বলছিলাম, রাধানাথ কেবল গণিত বা বিজ্ঞানে সুপণ্ডিত নন, তিনি বহু গুণের আধার। তার মধ্যেই একটি হল তাঁর সাহিত্যিক সত্তা, যা বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক গবেষকরই মত, নিয়মিত সাহেবদের সঙ্গে মিশতে মিশতে রাধানাথের চালচলন ও কথাবার্তা ধীরে ধীরে পুরোদস্তুর বিলিতি হয়ে যাচ্ছিল। তাতে অসুবিধে ছিল না, কিন্তু এক সময় তিনি বাংলা ভাষা চর্চা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলেন। এ সময়ই তাঁর হাত ধরেন প্যারীচাঁদ। দু’জনে মিলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। আসলে, রাধানাথও মাটির টানেই বাংলা ভাষা চর্চায় ফিরতে চাইছিলেন। যুগ্ম ভাবে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন তাঁরা, নাম মাসিক পত্রিকা। ১৮৫৪ সালের ১৬ অগস্ট প্রকাশিত এই পত্রিকা সম্পর্কে জেমস লং-এর গবেষণা থেকে জানা যায়, এর গদ্য মূলত মৌখিক বাংলা ঘেঁষা, মহিলাসমাজ ও সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবেই সম্পাদিত। পরে সরকার অসমের জন্য এই পত্রিকার ৫০০ কপির গ্রাহক হয়। পত্রিকাটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাখ্যানের মাধ্যমে নারীশিক্ষার পক্ষে এবং হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আলোচনা করত। রাধানাথ এখানে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য চর্চা করতেন। এই পত্রিকার জন্যই তিনি প্লুটার্ক, জ়েনোফোনের রচনা অনুসরণ করে প্রবন্ধ ও গল্প লিখতেন। আবার, এখানেই ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল প্যারীচাঁদ মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’।

পত্রিকাটি মাত্র চার বছর চললেও রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছিল। বিভিন্ন ক্যাটালগে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির ১৯তম রিপোর্ট বলছে, স্কুল-কলেজের জন্য পুস্তক মুদ্রণ এবং ক্রয়ের তালিকায় আছে মাসিক পত্রিকা। সে বারে এই পত্রিকা কেনা হয়েছিল ৩৬০০ কপি। বলতেই হয়, রাধানাথও এই পত্রিকার পিছনে বিপুল সময় ব্যয় করতেন।

নানা কাজে জড়িয়ে ছিলেন, সেই সঙ্গে ছিলেন স্পষ্টবক্তা। তাই শত্রুরও অভাব ছিল না। ১৮৭০ সালের ১৭ মে তাঁর মৃত্যুর পর গবেষণা-জগৎ থেকে তাঁর নাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার, তাঁর কাজকে খাটো করে দেখানোর উদ্যোগও কম ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঙালি বিদ্বৎসমাজের প্রত্যেকটি মানুষ মুক্তকণ্ঠে তাঁর কৃতিত্ব স্বীকার করেছেন।

রাধানাথের ডায়েরি থেকে জানা যায়, “কলেজে এক মনে পড়িতে পাইতাম না, একবার পড়ার কথা মনে পড়িত, পরক্ষণেই বাটীতে ফিরিয়া যাইয়া কি খাইব, মা বুঝি এখনও কিছুই খান নাই, এই সকল ভাবনা মনে উদিত হইয়া পড়ার ব্যাঘাত ঘটিত।” জীবনী থেকেও জানা যায়, লেখাপড়া করার সময়ও অন্নবস্ত্র জোগাড়ের জন্য তাঁকে ও তাঁর ভাই শ্রীনাথকে খুবই কষ্ট পেতে হত। সে জন্যই মাত্র আঠারো বছর বয়সে চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছিল রাধানাথকে। তা সত্ত্বেও, তাঁর হৃদয়ে কখনও কোনও কার্পণ্য বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না। যখনই কেউ তাঁর সাহায্য চেয়েছেন, তিনি যথাসাধ্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বহু পণ্ডিত মানুষ গবেষণার কাজে সহায়তা পেতে রাধানাথের দ্বারস্থ হতেন, সব সময়ই নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করতেন তিনি। আসলে, এ সব কাজই তিনি জনস্বার্থ বলে মনে করতেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় জনস্বাস্থ্য-ভাবনায় তাঁর অংশগ্রহণের কথা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে বাংলার গ্রাম-শহর ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তখন সরকার এই সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে। রোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে তারা একটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেই সূত্রে কিছু বিশিষ্ট মানুষের কাছে চারটি প্রশ্ন পাঠানো হয়। প্রশ্ন পেয়েছিলেন রাধানাথও। তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, তা সত্ত্বেও গভীর মনোযোগ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে সব উত্তর জমা দিয়েছিলেন, তা সে যুগের নিরিখে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনকি, জবাব দিতে গিয়ে নতুন কিছু জরুরি প্রশ্নও উসকে দিয়েছিলেন রাধানাথ। ১৮৬২ সালের মার্চ মাসে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পুরোপুরি নিজেকে উন্নয়নমূলক সামাজিক কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন।

কেবল ন্যায়পরায়ণ নন, প্রবল তেজস্বীও ছিলেন রাধানাথ। সে সময় বেআইনি ভাবেই গরিব মানুষকে দিয়ে বেগার খাটাত কোম্পানির লোকেরা। তা প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৮৪৩ সালের ১৫ মে দেহরাদূনের ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে রাধানাথ ও তাঁর দুই সহকর্মীর পাহাড়ি ভৃত্যেরা মালপত্র নিয়ে তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাধানাথ তখন নিজের ভৃত্যদের বেগার খাটতে বারণ করে ম্যাজিস্ট্রেটের মালপত্র নিজের বাড়িতে রেখে দেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কানে খবর পৌঁছতে তিনি তো রেগে আগুন! প্রথমে চাপরাশিকে পাঠান, পরে স্বয়ং এসে উপস্থিত। কিন্তু রাধানাথ নাছোড়বান্দা— রসিদ ছাড়া মালপত্র ফেরত দেবেন না। ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর অভিযোগে রাধানাথকে অভিযুক্ত করা হল। মোকদ্দমা চলল বহু দিন, শেষ পর্যন্ত তাঁর দুশো টাকা জরিমানা হল। কিন্তু এই ঘটনা ভারতীয়দের নাড়িয়ে দিল, তৈরি হল আন্দোলন। আর তার ফলেই এই অন্যায় প্রতিকারের পথ সুগম হল।

যতই প্রতিভাশালী হোন, এ হেন ব্যক্তি যে অধিকাংশ ক্ষমতাসীন সমাজপতিরই চক্ষুশূল হবেন, এ-ই তো স্বাভাবিক!

ঋণ স্বীকার: রাধানাথ শিকদারের আত্মকথা ও মূল্যায়ন: দীপক দাঁ (সম্পা.), রাধানাথ শিকদার/ তথ্যের আলোয়: শঙ্করকুমার নাথ

অন্য বিষয়গুলি:

Radhanath Sikdar Mathematician Mount Everest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE